বাসায় কোনো টেলিভিশন নেই। নোভা-শীলা টেলিভিশন দেখার জন্যে পাশের ফ্ল্যাটে যায়! টেলিভিশনে বাংলাদেশ প্রোগ্রাম দেখতে তাদের না-কি খুব ভালো লাগে। তখন এত চ্যানেল হয় নি। বিটিভি সবেধন নীলমণি।
এক রাতের কথা। মেয়েরা খুব আগ্রহ করে টিভি দেখতে গিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে তারা ফিরে এসে জানালো, ঐ ফ্ল্যাটে মেহমান এসেছে। কাজেই তাদেরকে আজ টিভি দেখতে দেয়া হবে না। বাচ্চারা খুবই মন খারাপ করল। তাদের চেয়েও মন খারাপ করল বাচ্চাদের মা। কেন বাংলাদেশে এসেছি? কী পাচ্ছি বাংলাদেশে? একটা টিভি কেনার সামর্থ্য নেই। ইত্যাদি ইত্যাদি।
রাতে ভাত খাবার সময় বড় মেয়ে বলল, বাবা, তুমি আমাদের একটা টিভি কিনে দেবে?
আমি বললাম, দেব।
রঙিন টিভি?
আমি বললাম, অবশ্যই রঙিন টিভি।
কবে কিনে দেবে?
এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারলাম না। তবে একটা রঙিন টিভি যেভাবেই হোক কিনতে হবে এটা মাথায় ঢুকে গেল।
বিটিভির নওয়াজীশ আলি খান সাহেবের সঙ্গে তখন আমার সামান্য পরিচয় হয়েছে। আমার একটি নাটক তিনি বিটিভিতে প্রচার করেছেন। নাম খুব সম্ভব ‘প্রথম প্রহর’। তিনি আমাকে একটি ধারাবাহিক নাটক লিখতে বলছেন। আমি ধারাবাহিক নাটক লিখতে রাজি হলাম। ঠিক করলাম, একটি রঙিন টিভি কিনতে যত টাকা লাগে তত টাকার ধারাবাহিক নাটক লেখা হবে। যে নাটকটি লিখলাম তার নাম ‘এইসব দিনরাত্রি’। নাটকটির পরিচালক ছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান।
আমার রঙিন টিভি কেনার টাকা হওয়া মাত্র নাটকের একটি চরিত্র টুনির মৃত্যু দিয়ে নাটক শেষ করে দিলাম।
এই নাটকটির প্রতি আমি নানাভাবে ঋণী। নাটকটির কারণে আমি আমার বাচ্চাদের একটা শখ মিটালাম—রঙিন টিভি কিনলাম।
একটিমাত্র ধারাবাহিক নাটকের কারণে দর্শকদের কাছে হুমায়ূন আহমেদ নামটি পরিচিতি পেল। তারা এই নাট্যকারের লেখা গল্প-উপন্যাস হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করা শুরু করল।
এই নাটক প্রসঙ্গে একটা মজার গল্প বলি। মুস্তাফিজুর রহমান সাহেব একদিন টেলিফোনে আমাকে ডেকে পাঠালেন। একটা মজার জিনিস না-কি দেখাবেন। আমি মজার জিনিস দেখতে গেলাম।
মুস্তাফিজ সাহেব বললেন, একতলায় আমাদের একটা বিলবোর্ড আছে। বিলবোর্ডটা দেখে আসুন। আনন্দ পাবেন।
আনন্দ পাবার জন্যে বিলবোর্ড দেখতে গেলাম এবং আনন্দ পেলাম। বিলবোর্ডে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত Statesman পত্রিকার একটি খবর সেঁটে দেয়া আছে। সেখানে লেখা আজ রাতে এইসব দিনরাত্রির শেষ পর্ব প্রচার হবে। এরপর আমরা কী দেখব?
বিটিভিতে নাটক লিখে খুব আনন্দ পেয়েছি। একের পর এক ধারাবাহিক নাটক—অয়োময়, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই। ঈদের হাসির নাটক। এক ঘণ্টার নাটক। আমি খুব সূক্ষ্মভাবে নাটকের ভাষা বদলানোর একটা চেষ্টা চালালাম। আগে কোলকাতার ভাষা (নদীয়া-শান্তিপুরের ভাষা বলাই ঠিক হবে) ছিল বিটিভি নাটকের ভাষা। যাই নি, খাই নি, জুতো, নৌকো। আমি চেষ্টা করলাম ঢাকার ভাষা বলে আলাদা কিছু দাঁড়া করাতে।
আমার ধারণা পরীক্ষা-নিরীক্ষা পুরোপুরি ব্যর্থ হয় নি। আজকের নাটকের ভাষা নদীয়া-শান্তিপুর মুক্ত।
বিটিভির একটি কর্মকাণ্ডে আহত হয়েছিলাম। বলপয়েন্ট লেখা মানেই আনন্দ অভিজ্ঞতার বয়ান না। মনোকষ্টের বয়ানও তো বটে! বিটিভি তার পঁচিশ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে রজতজয়ন্তির বিশাল অনুষ্ঠান করছে। পনেরোদিন ধরে অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে বিটিভির নানান দিকের সাফল্য তুলে ধরা হচ্ছে। সেই বিপুল উৎসবে একটি নাম অনুচ্চারিত হুমায়ূন আহমেদ। অথচ তখন আমার সব কটি ধারাবাহিক নাটক প্রচারিত। টিভি নাটকে আমি কী করেছি কতটুকু করেছি তা ‘বিটিভি’র কর্তাব্যক্তিরা জানেন।
আমি এক কর্তাব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলাম। বললাম, আমি তো আপনাদের ‘ভাসুর’ না। আমার নাম মুখে নিতে সমস্যা কী ছিল?
তিনি বললেন, আপনি খুব ভালোভাবেই অনুষ্ঠানে ছিলেন। পরে আপনাকে বাদ দেয়া হয়েছে।
আমি বললাম, কেন?
কর্তাব্যক্তি মধুর ভঙ্গিতে হাসলেন। কিছু বললেন না।
বাদ পড়ার অভিজ্ঞতা আমার জীবনে প্রচুর আছে। সাহিত্যের অধ্যাপকদের অনেক গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে, যার বিষয়বস্তু মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালীন সাহিত্য। সেখানে সবাই আছে, আমি নেই। হতেই পারে সাহিত্যের অধ্যাপকরা আমাকে লেখক মনে করেন না। এমন একজন মনে করেন যে লেখালেখি করে অর্থ উপার্জন করেন। তাদের কাছে লেখালেখি করে অর্থ উপার্জন মানে সাহিত্যের মহান বোধের অবমাননা। এই নিয়ে আমি ঝামেলাতেও পড়েছি। উদাহরণ দেই—
এইসব দিনরাত্রি ধারাবাহিক নাটকটি প্রচার হবার পর এক সাংবাদিক জানতে চাইলেন, এই ধারাবাহিক নাটকটি লেখার পেছনে আপনার মূল প্রেরণ কী ছিল?
আমি বললাম, অর্থ উপার্জন। আমার একটি রঙিন টিভি কেনার প্রয়োজন ছিল বলেই ধারাবাহিক নাটকটি লিখেছি।
সাক্ষাৎকার প্রচার হবার পরপরই এই নাটকে যারা অভিনয় করেছেন তারা আহত হলেন। বিশেষভাবে রাগলেন প্রয়াত অভিনেতা আবুল খায়ের। তিনি বললেন, আমরা এত আবেগ নিয়ে এই নাটকে অভিনয় করেছি, আর হুমায়ুন আহমেদ বলে দিলেন তিনি সামান্য একটা রঙিন টিভির জন্যে নাটক লিখেছেন।
অভিনেতাদের তপ্ত বক্তব্য পত্রিকায় ছাপা হাতে লাগল। বাধ্য হয়ে একদিন আমি আবুল খায়ের সাহেবকে ডেকে পাঠালাম। আমি বললাম, ভাই, আপনি যে অভিনয় করেছেন তার জন্যে কি বিটিভির কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন?