অবাক হয়ে দেখি বিদেশিনীর চোখ ছলছল করছে। এক জীবনে পরম করুণাময় কতভাবেই না আমাকে আনন্দ দিয়েছেন।
আমি যে লেখক না
আমি যে লেখক না–এই বিষয়টি আমেরিকায় যাবার পর স্পষ্ট হয়ে গেল। টানা পাঁচ বছর আমেরিকায় ছিলাম। Ph.D করেছি, পোস্ট ডক করেছি। এই পাঁচ বছরে এক লাইনও লিখি নি। গল্প-উপন্যাসের তো প্রশ্নই ওঠে না।
একজন সত্যিকার লেখক না লিখে থাকতে পারবেন না। তাকে কিছু না কিছু লিখতেই হবে। একজন তবলাবাদক তবলী না পেলে টেবিলে বা চেয়ারে বোল তোলেন। একজন গায়ককে গুনগুন করতেই হয়। সেখানে আমি কীভাবে না লিখে পারছি? আমার সমস্যাটা কী?
প্রচণ্ড পড়াশোনার চাপ। লেখার সময় নেই —এইসব ভুয়া কথা। একজন লেখক প্রচণ্ড কাজের চাপের ভেতর থেকেও লেখার সময় বের করে নেবেন। তাহলে আমি কেন পারছি না? সমস্যাটা কি পরিবেশ? বাংলাদেশের আলো-বাতাস গায়ে লাগছে না বলেই বাংলা ভাষার লেখকের বলপয়েন্ট দিয়ে কালি বের হচ্ছে না? বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ শুনছি না, ব্যাঙের ডাক শুনছি না—এটাই কি সমস্যা?
মা’কে চিঠি লিখলাম তিনি যেন ক্যাসেটে ব্যাঙের ডাক এবং বৃষ্টির শব্দ রেকর্ড করে পাঠান। আমার সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা আহসান হাবীব ক্যাসেট রেকর্ডার নিয়ে বৃষ্টির দিনে বনবাদাড়ে ঘুরতে লাগল। যথাসময়ে বর্ষা এবং ব্যাঙের ডাকের ক্যাসেট চলে এল।
আমি তখন ইউনিভার্সিটি হাউজিং-এ চমৎকার বাড়ি পেয়েছি। ডুপলেক্স বাড়ি। একতলায় রান্নাঘর, বসার ঘর এবং স্টাডি রুম। দোতলায় দু’টা শোবার ঘর। গুলতেকিন তার কন্যাকে (নোভা) নিয়ে চলে এসেছে। মেয়ের বয়সও দেখতে দেখতে তিন বছর হয়ে গেছে। নিখুঁত বাংলা এবং নিখুঁত ইংরেজিতে। হড়বড় করে কথা বলে। উইকএন্ডে আশেপাশের সব বাঙালি চলে আসে। খিচুড়ি মাংস রান্না হয় এবং ক্যাসেটে বৃষ্টির শব্দ ও ব্যাঙের ডাক বাজে। বাঙালি ছেলেগুলির চোখ ছলছল করতে থাকে।
বাদলা দিনে মনে পড়ে
ছেলেবেলার গান
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
নদেয় এল বান।
আমার জীবনচর্যা সম্পর্কে বলি। সামারে দুই মাস কাজের চাপ থাকে না। সবাই ভ্যাকেশনে যায়। আমার ভ্যাকেশনে যাবার ডলার নেই। আমি ইউনিভার্সিটি থেকে কিছু জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ শুরু করে দিলাম। চাষি হুমায়ূন। আমার সঙ্গী মেয়ে নোভা। পিতা-কন্যা দু’জনের হাতেই খুরপা। আমরা মাটি কোপাই! বীজ বুনি। গাছে পানি দেই। এই সময়টায় মেয়ের সঙ্গে নানা গল্প করি। সবই বাংলাদেশের গল্প। বাংলাদেশের বিশাল নদী, বাঁশবাগানে জোছনা, রয়েল বেঙ্গল টাইগার এবং হরিণে ভর্তি সুন্দরবন, বিশাল সমুদ্র, সিলেটের ডিঙ্গিপোতা হাওর যেখানে সমুদ্রের মতো বড় বড় ঢেউ ওঠে।
নোভা চোখ বড় বড় করে শোনে। একদিন সে বলল, আমাদের দেশটা “a piece of paradise”, তাই না বাবা?
আমি বললাম, অবশ্যই তাই। তবে একটু ভুল করেছ। আমি নিশ্চিত Paradiseও এত সুন্দর না।
আমি অতি ভাগ্যবান, আমি আমার জীবন Paradise-এ কাটিয়ে দিতে পারছি। আমার মেয়েটা ভাগ্যবতী না। তার জীবন কাটছে আমেরিকায়। সে এবং তার স্বামী না-কি ঐ দেশের নাগরিকত্বও পেয়েছে। মেয়েটির কি কখনো তার বাবার সঙ্গে কথোপকথন মনে পড়ে? জানি না। আমার সঙ্গে দীর্ঘদিন তার কোনো যোগাযোগ নেই।
.
শুরুতে যে তথ্য দিয়েছি, লেখালেখি কিছুই করি নি, সেখানে সামান্য ভুল আছে। চিঠি লিখতাম। মাকে, ভাইবোনদের। আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছ? এর বাইরে চিঠিতে তেমন কিছু লেখার থাকে না। দেশের সবাই চায় অনেকক্ষণ ধরে চিঠি পড়তে। কাজেই আমি বানিয়ে বানিয়ে অনেক কিছু লিখতাম যা মোটেই সত্যি না। যেমন একবার টর্নেডোর বর্ণনা দিলাম। একবার লিখলাম ব্লিজার্ডে কীভাবে আটকা পড়েছিলাম। Frost bite হয়ে গেছে।
এইসব কি সাহিত্যের আওতায় পড়বে? Vladimir Nabokov (বিখ্যাত রাশিয়ান লেখক এবং সমালোচক-এর মতে এইসবও সাহিত্যের মধ্যে পড়বে। তিনি বলছেন, Neanderthal যুগে একটি বালক গুহা থেকে চিৎকার করতে করতে বের হলো—নেকড়ে বাঘ! নেকড়ে বাঘ! দেখা গেল তার পেছনে পেছনে ছুটে আসছে নেকড়ে বাঘ। তখন কিন্তু সাহিত্যের জন্ম হলো না। সাহিত্যের জন্ম হলো তখনি যখন একটা বালক চিৎকার করতে করতে আসছে—নেকড়ে বাঘ! নেকড়ে বাঘ! অথচ তার আশেপাশে কোনো নেকড়ে বাঘ নেই।
আমেরিকায় শুরুতে বেশ অর্থকষ্টে ছিলাম। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। একটা উদাহরণ দিয়ে পরিষ্কার করি। বড় মেয়ের প্রথম জন্মদিন। তারিখটা বেকায়দা ধরনের, ২৮ আগস্ট মাসের শেষদিকে। বেতনের চেক পেতে আরো তিনদিন লাগবে। হাতের সব ডলার শেষ। মেয়ের মা’র মেয়ের প্রথম জন্মদিন নিয়ে নানান পরিকল্পনা। আমি উপহার কিনে নিয়ে এলাম দুই কেজি ময়দা। মেয়ে ময়দা ছানতে পছন্দ করে। আমি প্যাকেট খুলে মেয়ের চারপাশে ময়দা বিছিয়ে দিলাম। সে মহানন্দে দুই হাতে ময়দা ছানাছানি করতে লাগল। সে আনন্দে যতই হাসে, তার মা দুঃখে ততই কাঁদে। মেয়ের প্রথম জন্মদিনে দুই কেজি ময়দা!
তার কষ্ট দেখে আমি বলেছিলাম, দোয়া করছি যেন তোমার সব ছেলেমেয়ে থাকে দুধেভাতে। যেন তারা কখনো অর্থকষ্টে না পড়ে। পরম করুণাময় আমার প্রার্থনা শুনেছেন।
গুলতেকিন আমার অর্থকষ্ট লাঘবের জন্যে কাজে নেমে পড়ল। বেবি সিটিং করে। পত্রিকার অ্যাড দেখে কাপড় এনে রিফু করে দেয়। এইসব বিষয় অন্য বইগুলিতে বিস্তারিত লিখেছি বলে এখানে আর লিখলাম না।