তার বাড়ির দশ গজের ভেতর কোনো সিগারেট খাওয়া যাবে না। আমি সিগারেট খাই শুনে সে আমার বিছানার ওপর একটা স্মোক ডিটেকটর লাগিয়ে দিল।
অদ্ভুত কোনো কারণে আমার প্রতি বুড়ির আচার-আচরণ হঠাৎ বদলে গেল। তার আদর এবং যত্নে আমি অতিষ্ঠ হয়ে গেলাম। এক পর্যায়ে সে বলল, তুমি আমাকে মা ডাক। এ দেশে আমিই তোমার মা। একদিন বলল, তোমার ঘরের স্মোক ডিটেকটরের কানেকশন আমি অফ করে দিলাম। ঠান্ডার মধ্যে সিগারেট খাবার জন্য বাইরে না গিয়ে এখন ঘরেই খাবে। তবে খবরদার অন্য বোর্ডাররা যেন জানতে না পারে। প্রতি রবিবার আরেক যন্ত্রণা। বুড়ি আমাকে চার্চে নিয়ে যাবে। আমি বললাম, আমি মুসলিম। আমি কেন চার্চে যাব?
বুড়ি বলল, গডের চার্চে সব ধর্মের লোক যেতে পারে।
আমি বললাম, আমি যাব না।
বুড়ি মন খারাপ করে চলে যায়। পরের রবিবারে আবার আসে।
পৃথিবীতে অনেক ধরনের অত্যাচার আছে। ভালোবাসার অত্যাচার হচ্ছে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অত্যাচার। কারণ এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে কখনোই কিছু বলা যায় না। সহ্য করে নিতে হয়।
ফার্গো শহরে প্রথম বরফ পড়ল। পুরো এলাকা ঢেকে গেল বরফে। বুড়ি আমার রুমে উপস্থিত। আমার জন্য বরফে হাঁটার জুতা নিয়ে এসেছে। ঘটনার এখানেই ইতি নয়। বুড়ি ঘোষণা করল, সে আমাকে হাত ধরে ধরে ইউনিভার্সিটিতে নিয়ে যাবে। কারণ বরফে হাঁটার বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা নেই। পিছলে পড়ে পা ভাঙতে পারি।
অনেক চেষ্টা করেও আজ আমি ওই মমতাময়ীর নাম মনে করতে পারছি না। নিজের ওপর প্রচণ্ড রাগ লাগছে।
সব নিরানন্দের মধ্যেই নাকি কিছু আনন্দ লুকানো থাকে। বুড়ির অন্ধকার কোঠায় হঠাৎ একদিন আনন্দের সন্ধান পেলাম। একা একা বই পড়ার আনন্দ। ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখি সায়েন্সের বই ছাড়াও গল্প-উপন্যাসের বিশাল কালেকশন। এর আগে লুই হামসুনের একটা মাত্র বই পড়েছি Vagabond। তার অন্য বইগুলো পড়ার খুব শখ ছিল। বাংলাদেশে পাই নি। লাইব্রেরিয়ানকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি কম্পিউটারের বোতাম চেপে বললেন, আমাদের কাছে ভার তিনটি বই আছে। তুমি চাইলে বাকিগুলোও আনিয়ে দেব।
আমি বললাম, কীভাবে?
লাইব্রেরিয়ান বললেন, আমাদের Inter library loan system আছে। যে বই আমাদের নেই, সেই বই আমরা পনেরো দিনের জন্য আমেরিকার যে-কোনো লাইব্রেরি থেকে লোন করে আনতে পারি।
আমি সরল বাংলায় বললাম, খাইছে আমারে।
লাইব্রেরিয়ান চোখ কপালে তুলে বলল, তার মানে?
আমি বললাম, এটা আমাদের বাংলা ভাষার একটা শব্দ। এর মানে হলো—I have been eaten.
কিছুই বুঝতে পারছি না। কে তোমাকে খেয়েছে?
তোমার অপূর্ব System.
লাইব্রেরিয়ানের বয়স চল্লিশ। হিজড়ার মতো দেখতে একজন মহিলা। শুষ্কং কাষ্ঠং। তাকে মানুষ মনে হয় না। মনে হয় ব্যাকরণের বই।
চিড়িয়াখানায় যে লোক জিরাফের দেখাশোনা করে তার গলা খানিকটা লম্বা হয়ে যায়। যে মহিলা লাইব্রেরিতে কাজ করবেন, তিনি বইয়ের মতো হয়ে যাবেন সেটাই স্বাভাবিক।
একটা পর্যায়ে ভদ্রমহিলা আমার বই পড়ার ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হলেন। লাইব্রেরিতে গেলেই তিনি আমাকে ঘরে বানানো কালো কেক খেতে দেন (অতি অখাদ্য), কফি খেতে দেন (কেকের চেয়েও অখাদ্য)।
থ্যাংকস গিভিংয়ে তিনি আমাকে তার বাড়িতে টার্কি খাবার দাওয়াত করলেন। আমেরিকান নিয়ম অনুযায়ী এক বোতল রেড ওয়াইন কিনে (জীবনে প্রথম নিজের পয়সায় মদ কেনা) উপস্থিত হলাম। ভদ্রমহিলা আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন এইভাবে—এর নাম হুমায়ুন। বাংলাদেশ থেকে এসেছে। নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটির ইতিহাসে এর মতো পড়ুয়া ছেলে নেই। সে সব বই পড়ে ফেলেছে।
ভদ্রমহিলার স্বামী, মা-বাবা সবাই খুব মাথা দোলাতে লাগল যেন এমন আনন্দের খবর তারা এর আগে শোনে নি। ভদ্রমহিলা আমাকে Robert Frost এর কবিতার বইয়ের একটি রাজকীয় সংস্করণ উপহার দিলেন। বইয়ের ওপর লেখা
To a person who loves book
and books love him.
খাবারের টেবিলে টার্কি নামের বিশাল পক্ষী রোস্ট করা অবস্থায় আছে। তার পেটভর্তিও নানান খাবার। টার্কির মাংসের রঙ একেক জায়গায় একেক রকম। কোনোটা কালো, কোনোটা লাল, কোনোটা সাদা। আমাকে প্রত্যেক জায়গা থেকে খানিকটা করে কেটে দেওয়া হলো। আমি খাবার মুখে দিয়ে শিউরে উঠলাম। বিকট বোটকা গন্ধ। এই দ্রব্য খাওয়া মানে সাক্ষাৎ মৃত্যু। বমি করতে করতেই মারা যাব। এই বিপদ থেকে কী করে উদ্ধার পাওয়া যায়?
আমি মুখ কাচুমাচু করে বললাম, টার্কির মাংস যে খেতে অসাধারণ হয়েছে তা গন্ধ থেকেই টের পেয়েছি, কিন্তু আমি নিরামিশাষি, আমি মাছ-মাংস-ডিম কিছুই খাই না। আমার জন্য ব্যস্ত হতে হবে না। এক প্লেট সালাদ আর আপেল পাই আমার জন্য যথেষ্ট।
.
আমেরিকায় পড়াশোনা করা অবস্থাতেই খবর পাই আমাকে বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। বাজারে আর তখন মাত্র চারটা বই। বয়স ত্রিশ-একত্রিশ। আমি পেয়ে গেছি বাংলা একাডেমী পুরস্কার।
লাইব্রেরিয়ানকে খবরটা দিতে গেলাম। তিনি খুবই অবাক হয়ে বললেন, তুমি যে একজন লেখক এই খবরটা তো আমাকে কোনোদিন বলে নি। আমি বললাম, পড়াশোনার চাপে আমি নিজেই ভুলে গিয়েছিলাম। ভদ্রমহিলা হঠাৎ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, Standing ovation for a fiction writer.