বিচিত্রার শাহাদত ভাইয়ের অফিসে একদিন বসে আছি, তিনি যথারীতি কাগজ ছিঁড়ে যাচ্ছেন। হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, পশ্চিমবঙ্গে পূজাসংখ্যা বের হয়। আমাদের দেশে ঈদসংখ্যা বলে কিছু নেই। ঈদ মানেই কোলাকুলি এবং সেমাই। ঠিক করেছি এবার ঈদসংখ্যা বের করব। আপনি একটা উপন্যাস দেবেন।
আমি বললাম, অবশ্যই।
আনন্দে ঝলমল করছি। বিচিত্রা আমার কাছে উপন্যাস চাচ্ছে, আমি তাহলে লেখক হয়েই গেছি। এই প্রথম উপন্যাস লিখছি একজনের ফরমায়েশে। কী লেখা যায়? গ্রামের পটভূমিতে কিছু লিখি নি। গ্রামে গল্পটা শুরু করলে কেমন হয়? গ্রামের স্মৃতি তেমন নেই। ঠিক করলাম দশদিনের ছুটি নিয়ে গ্রামে যাব। দাদার বাড়ি, কিংবা নানার বাড়ি। উপন্যাসটা সেখানেই লিখে শেষ করব।
ইউনিভার্সিটিতে ছুটির দরখাস্ত করতে হয় রেজিস্ট্রারের কাছে। সেই দরখাস্ত রেকমন্ড করবেন বিভাগীয় চেয়ারম্যান।
দরখাস্ত করলাম। অফিসে জমা দিলাম। খন্দকার স্যার বিরক্ত গলায় বললেন, মাত্র সেদিন জয়েন করেছ। এখনি ছুটি? কী জন্য ছুটি চাও?
কী উত্তর দেব বুঝতে পারছি না, লেখালেখির জন্য ছুটি চাচ্ছি শুনলে স্যার সম্ভবত আরো রাগবেন।
আমি মুখ শুকনো করে দাঁড়িয়ে আছি। স্যার বললেন, লিখেছ অতি জরুরি। কারণে ছুটি দরকার। অতি জরুরি কারণটা কী?
স্যার, ছুটি লাগবে না।
গুড। যাও ঠিকমতো ক্লাস নাও।
আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চলে এলাম। গ্রামের পটভূতিতে উপন্যাস লিখতে হবে এটা মাথা থেকে দূর করে দিলাম। ঠিক করলাম শহরকেন্দ্রিক উপন্যাসই লিখব। মধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প। বাবা-মা ও দুই বোন। গল্পটা মাথার ভেতর তৈরি হতে থাকল। যতক্ষণ ক্লাসে থাকি ততক্ষণ মাথায় গল্প থাকে না। ক্লাস। থেকে বের হলেই মাথায় গল্প ঘুরঘুর করতে থাকে।
কোয়ান্টাম মেকানিক্স পড়িয়ে তখন খুবই আরাম পেতাম। বিজ্ঞান মানেই যে’শুষ্কং কাষ্ঠং তিষ্টতি অগ্রে’ না।
বিজ্ঞানে অপূর্ব রহস্য আছে। রহস্য জানা এবং না-জানার আনন্দ আছে তা ছাত্রদের বলতে পেরে ভালো লাগত। প্রাণপণ চেষ্টা করতাম অতি জটিল বিষয়। সহজে ব্যাখ্যা করার।
একদিন ক্লাসে বললাম, মনে করো God লুডু খেলছেন। তিনি যখন দান দেবেন তখন ছক্কার গুটিতে কত উঠবে তাকি আগে থেকে বলতে পারবেন?
সবাই একসঙ্গে বলল, অবশ্যই পারবেন।
আমি বললাম, তোমাদের চিন্তার সঙ্গে আইনস্টাইনের চিন্তার মিল আছে। আইনস্টাইনও ভাবতেন, পারবেন। আসলে কিন্তু তা-নী। মানুষের ক্ষেত্রে যে অনিশ্চয়তা, গডের ক্ষেত্রেও তা। একটি বস্তুর গতি এবং অবস্থান যেমন মানুষ একই সঙ্গে বলতে পারবে না, অনিশ্চয়তা থাকবে, গডের ক্ষেত্রেও তা।
আমার অতি সরল ব্যাখ্যা ছাত্রছাত্রীদের খুব যে কাজে এল তা না। পরীক্ষার খাতায় তারা উদ্ভট উদ্ভট উত্তর লিখতে লাগল। একটা প্রশ্ন ছিল, ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্স এবং কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মূল প্রভেদটা কী?
এক ছাত্র উত্তর লিখল—ক্ল্যাসিক্যাল মেকানিক্সে ঈশ্বর পাশা খেলেন। কোয়ান্টাম মেকানিক্সে তিনি পাশা খেলেন না।
আমি তখনি ঠিক করলাম, ছাত্রদের জন্য কোয়ান্টাম মেকানিক্সের একটা টেক্সট বই লিখব। যেখানে অতি Abstract এই বিষয়টি বোধগম্য ভাষায় লেখা হবে। ছাত্ররা সেই বই ভয় নিয়ে পড়বে না, আনন্দ নিয়ে পড়বে। পিএইচডি করে ফেরার পর সেই বই লিখেছিলাম। নাম কোয়ান্টাম রসায়ন।
বিচিত্রার উপন্যাসে ফিরে যাই।
লেখা শুরু করার পরে দেখি গল্প শুরু হয়েছে গ্রাম্য পটভূমিতে। কিছুতেই পাত্রপাত্রীদের ঢাকা শহরে আনা যাচ্ছে না। সেদিন প্রথম মনে হলো লেখালেখির পুরোটা লেখকের হাতে থাকে না। তার পেছনে অন্যকেউ থাকে। মূল সুতা যার হাতে।
বিচিত্রার প্রথম ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত আমার উপন্যাসটির নাম অচিনপুর।
বিস্ময়কর মনে হলেও সত্যি আমাকে লেখকখ্যাতি এনে দিল এই উপন্যাসটি। কারণ বিচিত্রার কারণে বহু পাঠক এই লেখাটা পড়ল।
উপন্যাসের জন্য আমি তিনশ’ টাকা পেলাম। সেই দিনই খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানির খান সাহেবও আমার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিলেন নন্দিত নরকে এবং শঙ্খনীল কারাগার উপন্যাসের রয়েলটি বাবদ, যেখানে চারশ’ টাকা আছে। টাকা নিয়ে ফিরছি, স্টুডেন্ট ওয়েজের মালিক ডেকে দোকানে বসালেন। তারা আমার একটা উপন্যাস ছাপতে চান। এই উপলক্ষে দুশ টাকা অ্যাডভান্স দিলেন। জীবনে প্রথম কোনো উপন্যাসের জন্য অ্যাডভান্স টাকা পাওয়া।
বেতনের ডবল টাকা নিয়ে বাসায় ফিরেছি। কেমন যেন অস্থির লাগছে। মনে হচ্ছে এই টাকার ওপর আমার কোনো অধিকার নেই। এই টাকা অন্য কারোর।
অচিনপুর উপন্যাসের কিছুটা পড়লে কেমন হয়?
অচিনপুর
মরবার পর কী হয়?
আট-ন’ বছর বয়সে এর উত্তর জানবার ইচ্ছে হলো। কোনো গূঢ় তত্ত্ব নিয়ে চিন্তার বয়স সেটি ছিল না, কিন্তু সত্যি সত্যি সেই সময়ে আমি মৃত্যুরহস্য নিয়ে ভাবিত হয়ে পড়েছিলাম।
সন্ধ্যাবেলা নবু মামাকে নিয়ে গা ধুতে গিয়েছি পুকুরে। চারদিকে ঝাপসা করে অন্ধকার নামছে। এমন সময় হঠাৎ করেই আমার জানবার ইচ্ছে হলো, মরার পর কী হয়? আমি ফিসফিস করে ডাকলাম, নবু মামা, নবু মামা।
নবু মামা সাঁতরে মাঝপুকুরে চলে গিয়েছিলেন। তিনি আমার কথা শুনতে পেলেন না। আমি আবার ডাকলাম, নবু মামা, রাত হয়ে যাচ্ছে।