ঘন অন্ধকার রাস্তা, বিজলির আলোয় একআধবার সব ফর্সা হয়ে ওঠে। পরক্ষণে নিকষ কালো।
রফিকের বাসায় কড়া নাড়তে গিয়ে বুঝলেন তাঁর শরীর সুস্থ নয়। প্রবল জ্বর এসেছে। পিপাসায় গলা বুক শুকিয়ে কাঠ। রফিক আঁতকে উঠে বলল, কী হয়েছে আজহার ভাই?
না, কিছু হয় নি। এক গ্লাস পানি খাওয়াও!
বাসার সবাই ভালো আছে তো? ভাবির জ্বর কেমন?
সব ভালোই আছে, এক গ্লাস পানি আন আগে।
আজহার খাঁ উদ্ভ্রান্ত শূন্যদৃষ্টিতে তাকাতে লাগলেন। রফিক তার হাত ধরল, এহ্, তোমার ভীষণ জ্বর। কী হয়েছে বলো?
টাকা আছে তোমার কাছে?
কত টাকা?
গোটা বিশেক।
দিচ্ছি। তুমি একটা শুকনো কাপড় পরো। আমি রিকশা আনিয়ে দিই। আগে একটু পানি দাও।
.
ঘর বন্ধ করে দোকানিরা শুয়ে পড়েছিল। আজহার খা হতভম্ব হয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। রিকশাওয়ালা বিরক্ত হয়ে বলল, ধাক্কা দেন না স্যার, ভিতরে লোক আছে।
তিনি প্রাণপণে দরজায় ঘা দিলেন। ভেতর থেকে শব্দ এল—কে? তিনি ভাঙা গলায় বললেন, আমি। একটু খুলেন ভাই।
কী ব্যাপার?
টাকা নিয়ে এসেছি। সেন্টের শিশিটা দিন।
খুট করে দরজা খুলে গেল। সন্দেহজনক দৃষ্টিতে দোকানদার তাকিয়ে রইল তার দিকে। তিনি পকেট হাতড়ে টাকা বের করলেন।
দোকানদার বলল, আপনার কী হয়েছে?
কিছু হয় নি।
এত রাতে আসলেন কেন? সকালে আসলেই পারতেন।
রাত কত হয়েছে?
সাড়ে বারো।
.
দ্রুতগতিতে রিকশা চলছে। তিনি শক্ত হাতে হুড চেপে ধরে আছেন। তার সমস্ত শরীর অবসন্ন হয়ে আসছে। তার মনে হলো তিনি যে-কোনো সময় ছিটকে পড়ে যাবেন।
বাড়ির কাছাকাছি সমস্ত অঞ্চলটা অন্ধকারে ডুবে আছে। একটি লাইটপোস্টেও আলো নেই। অল্প ঝড়-বাদলা হলেই এ দিককার সব বাতি নিভে যায়। রিকশা আজহার খাঁর বাড়ি থেকে একটু দূরে টগরদের বাড়ির সামনে থামল। তিনি দেখলেন, হারিকেন জ্বালিয়ে লিলি আর তার মা বারান্দায় বসে আছে। রিকশার বাতি দেখে দু’জনই উঠে দাঁড়িয়েছে। অন্ধকারের জন্যে বুঝতে পারছে না কে এল।
আজহার খাঁ ডাকলেন, লিলি! লিলি?
জমে থাকা পানিতে ছপছপ শব্দ তুলে মা ও মেয়ে দুজনেই দ্রুত আসছিল। তিনি ব্যস্ত হয়ে রিকশা থেকে নামতে গিয়ে উল্টে পড়লেন। যে জায়গাটায় তিনি হুমড়ি খেয়ে পড়লেন, সেখানটায় অদ্ভুত মিষ্টি সুবাস। তিনি ধরা গলায় বললেন, লিলি, তোর শিশিটা ভেঙে গেছে রে।
লিলি ফোঁপাতে ফেঁপাতে বলল, আমার শিশি লাগবে না। তোমার কী হয়েছে বাবা?
গভীর জ্বরে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে আছেন আজহার খাঁ। রঞ্জু অকাতরে ঘুমুচ্ছে। লিলি আর লিলির মা ভয়কাতর চোখে জেগে বসে আছেন। বাইরে বৃষ্টিস্নাত গভীর রাত। ঘরের ভেতরে হারিকেনের রহস্যময় আলো। জানালা গলে ভিজে হিমেল হাওয়া আসছে।
সেই হাওয়া সেন্টের ভাঙা শিশি থেকে কিছু অপরূপ সৌরভ উড়িয়ে আনল।
০৯.
‘টাকশাল থেকে সদ্য বের হওয়া ঝকঝকে কাঁচা রুপার টাকা’। এই উপমা বাংলা সাহিত্যে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করার পর আমার নিজেকে ঝকঝকে রুপার টাকা মনে হতে লাগল। চেষ্টা করলাম চেহারায় আলগা গাম্ভীর্য নিয়ে আসতে চলনে-বলনে শিক্ষকসুলভ স্থিরতা। হালকা কথাবার্তা বন্ধ। চপলতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শোভা পায় না। একটা প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস, দুটো সাবসিডিয়ারি কেমিস্ট্রি ক্লাস এবং M.Sc. Preliminary-তে কোয়ান্টাম মেকানিক্স। এই হলো আমার দায়িত্ব।
আমি অর্থনৈতিক সমস্যা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রাম দেওয়া। একটা প্যাড় ছাপিয়ে ফেললাম। প্যাডের এক কোনায় লেখা হুমায়ূন আহমেদ, লেকচারার, রসায়ন বিভাগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। যাকে চিঠি লিখব সে যেন। আমার অবস্থানটা বুঝতে পারে। আমাকে এলেবেলে কেউ ভেবে না বসে।
শিক্ষক পরিচয় ছাড়াও আমার লেখক পরিচয়ও আছে। কাজেই লেখকের একটা উদাসী ভাবও চেহারায় আনার চেষ্টা করি। অন্যমনস্ক ভঙ্গি, খেয়ালি দৃষ্টি ইত্যাদি।
যখন ক্লাস থাকে না তখন চলে যাই দৈনিক বাংলা পত্রিকার অফিসে। দৈনিক বাংলার সহ-সম্পাদক সালেহ চৌধুরীর সঙ্গে গল্প করি। তিনি প্রায়ই নিয়ে যান কবি শামসুর রাহমান সাহেবের কামরায়। কবি তখন দৈনিক বাংলার সম্পাদক। তাকে ঘিরে সব সময় ভিড়। দর্শনার্থীদের সঙ্গে কবি নানান ধরনের কথা বলেন। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি এবং প্রায়ই ভাবি আমি এদের দলেরই মানুষ। আমাদের অবস্থান জাতির আত্মার কাছাকাছি। আমাদের জন্মই হয়েছে জাতিকে পথ দেখানোর জন্যে। বড় ভালো লাগে। নিজের ভেতরে পবিত্র ভাব হয়।
দৈনিক বাংলা অফিসেই বিচিত্রার ঘরবাড়ি। বিচিত্রার সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী কোনার দিকের একটা ঘরে বসেন। তিনি তখন কাগজ ছেঁড়া নামক বিচিত্র রোগে ভুগছেন। সবসময় কাগজ ছিঁড়ছেন। ছেঁড়া কাগজের শব্দ না শুনে এক সেকেন্ডও থাকতে পারেন না। গাদা গাদা নিউজপ্রিন্ট তাঁর কাছে রাখা হয় ছেঁড়ার জন্যে।
মাঝে মাঝে শাহাদত ভাইয়ের ঘরে গিয়ে বসি। শাহাদত ভাই কাগজ ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলেন, ভালো?
জি ভালো।
চা খান। এই চা দাও।
চা দেওয়া হয়। আমি চা খাই। শাহাদত ভাই অন্যদিকে তাকিয়ে কাগজ ছিঁড়তে থাকেন।
বিচিত্রা অফিসে অনেকেই তখন কাজ করে। তাদের সবার নাক বেশ উঁচু। নাক উঁচু পত্রিকার কারণে। একটি ক্ষমতাধর পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত সবাই ক্ষমতার আঁচ অনুভব করেন। সেটাই স্বাভাবিক। তারা খুব একটা কথা বলেন না। লেখকশ্রেণীকে পাত্তা দেন না। লেখকরা তাদের তোয়াজ করে চলবে এটাই আশা করেন। আমি তোয়াজটা কীভাবে করব বুঝতে না পেরে কিছুটা কনফিউজড বোধ করি।