তিনি নিঃশব্দে শার্ট গায়ে দিলেন। চুল আঁচড়ালেন। জুতা পরলেন। জুতার ফিতায় কাদা লেগেছিল, ঘষে ঘষে সাফ করলেন। লিলি সারাক্ষণই বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। তিনি বেরুবার জন্যে উঠে দাঁড়াতেই বলল, বাবা, আনবে তো?
মেয়েটার গালে প্রচণ্ড একটি চড় কষিয়ে দেবার ইচ্ছা প্রাণপণে দমন করে তিনি শান্ত গলায় বললেন, টাকা নেই, সামনের মাসে আনব।
লিলি নিঃশব্দে উঠে গেল। তিনি ভেবে পেলেন না সবাই বৈরি হয়ে উঠলে কী করে বেঁচে থাকা যায়। তিনি তো কিছু বলেন নি। শুধু শান্ত গলায় বলেছেন, হাতে টাকা নেই। এটা তাকে বলতে হলো কেন? যে মেয়ে বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে তার অভাব বুঝতে পারে না সে কেমন মেয়ে?
তার মন খারাপ হয়ে গেল। ইদানীং অল্পতেই তার মন খারাপ হয়ে যায়, সামান্য সব কারণে হতাশ বোধ করেন। বেঁচে থাকা অনাবশ্যক বলে মনে হয়।
‘হতাশা গুণনাশিনী। হতাশা মানুষের সমস্ত গুণ নষ্ট করে দেয়। তবুও তো ভালোবাসার মতো মহত্তম সগুণটি আমার এখনো নষ্ট হয় নি। তোমাদের সবাইকে আমি ভালোবাসি। তোমাদের জন্যে সারাক্ষণ আমার বুক টনটন করে, আর লিলি তুমি তোমার বাবার দিকে ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে থাক। মাসের ছাব্বিশ তারিখে তোমার একটি শখের জিনিস আমি কিনে আনতে পারি না। কিন্তু তুমি তো আমারই মেয়ে। তুমি তোমার মায়ের মতো অবুঝ হবে কেন?’
আজহার খাঁর কান্না পেতে লাগল। যদিও সন্ধ্যা হয়ে আসছে, তাঁকে এক্ষুনি বাইরে বেরুতে হবে। তবু তিনি চৌকিতে বসে বাইরের আকাশ দেখতে লাগলেন।
বাবা, এই নাও টাকা।
লিলি তিনটি দশ টাকার নোট টেবিলে বিছিয়ে দিল। তিনি অবাক হয়ে বললেন, টাকা কোথায় পেয়েছিস?
আমার টাকা। আমি জমিয়েছি। আনবে তো বাবা।
আনব।
নাম মনে আছে তোমার?
আছে।
লজ্জা ও হতাশার মিশ্র অনুভূতি নিয়ে তিনি বেরিয়ে এলেন। বাইরে ঝিরঝির করে হালকা বৃষ্টি হচ্ছিল। সন্ধ্যা এখনো মিলায় নি। এর মধ্যেই চারদিকের তরল অন্ধকার গাঢ় হয়ে এসেছে। পরিচিত পথঘাটও অপরিচিত লাগছে।
দশ বছর ধরে আমি এই শহরে পড়ে আছি। দশ বছর খুব দীর্ঘ সময়। এই দীর্ঘ সময়ে আমি রোজ একই রাস্তায় হাঁটছি। একই ধরনের লোকজনের সঙ্গে কথা বলছি। এই দীর্ঘ সময়ে কোথাও যাই নি। তোমাদের কথা ভেবেই প্রতিটি পয়সা আমাকে সাবধানে খরচ করতে হয়েছে। অফিসে টিফিন আওয়ারে সবাই যখন চায়ের সঙ্গে দুটি করে বিস্কিট খায় আমি সেখানে এক কাপ চা নিয়ে বসি। সেও তোমাদের কথা ভেবেই। তোমরা তার প্রতিদানে কী দিয়েছ আমাকে? আমাকে লজ্জা দেবার জন্যে লিলি, তুমি তোমার দীর্ঘদিনের জমানো টাকা বের করে আন। তোমর মা তার ভাইদের কাছে টাকা চেয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে চিঠি লেখে।
তাঁর মনে হলো তিনি কুকুরের জীবনযাপন করছেন। সাধ-আহ্লাদহীন বিরক্তিকর জীবন। তিনি একটি নিঃশ্বাস ফেললেন।
বৃষ্টির ছাটে আধভেজা হয়ে আজহার খাঁ বাজারে ঢুকলেন। খারাপ আবহাওয়ার জন্যে বাজার তেমন জমে নি। সন্ধ্যাবেলা যেমন জমজমাট থাকে চারদিক সেরকম নয়। কেমন ফাঁকা ফাঁকা। তিনি বড়সড় দেখে একটি স্টেশনারি দোকানে ঢুকে পড়লেন।
ইভিনিং ইন প্যারিস সেন্টটা আছে আপনাদের?
না, অন্য সেন্ট আছে। দেখবেন?
উঁহু, এইটাই চাই।
তখন ঝমঝম করে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টি অগ্রাহ্য করে তিনি রাস্তায় নেমে পড়লেন। তিন-চারটি দোকান ঘুরতেই কাদায় পানিতে মাখামাখি। তার গাল বেয়ে পানির স্রোত বইতে লাগল। তাঁর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল, সেন্টের শিশিটি তাঁর এই মুহূর্তেই প্রয়োজন। বৃষ্টি কখন ধরবে তার জন্যে অপেক্ষা করতে পারছেন না—এমনি তাড়া। পঞ্চম দোকানে সেটি পাওয়া গেল। দোকানি শিশিটি কাগজে মুড়ে বলল, ইশ, একেবারে যে ভিজে গেছেন? রিকশা করে চলে যান।
কত দাম?
ছাব্বিশ টাকা পঞ্চাশ পয়সা।
দরদাম করবার ধৈর্য নেই আর। টাকার জন্যে পকেটে হাত দিয়ে আজহার খাঁ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। সেখানে দুটি এক টাকার নোট আর একটি আধুলী ছাড়া কিছুই নেই।
দোকানি নীরবে শিশিটি আগের জায়গায় রেখে দিল। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল এরকম ঘটনা যেন প্রতিদিন ঘটে। কাস্টমার জিনিস কিনে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখে পয়সা নেই। এ যেন খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার।
অজিহার খাঁ ভাবলেশহীন মুখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বৃষ্টির ভেতর নেমে গেলেন। হু-হুঁ করে হাওয়া বইছে। ঝড় উঠবে কিনা কে জানে। চশমার কাছে বৃষ্টির ফোঁটা জমে চারদিক ঝাপসা দেখাচ্ছে। আজহার খাঁ নীরবে হেঁটে চলেছেন। দু’একটি রিকশা তার ঘাড়ের ওপর পড়তে পড়তে সামলে উঠছে। দ্রুতগামী। ট্যাক্সির উজ্জ্বল আলো মাঝে মাঝে তার চোখ ঝলকে দিচ্ছে। তিনি আচ্ছনের মতো হাঁটছেন। এই বৃষ্টি, এই শীতল হাওয়া, পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত ডুবে যাওয়া ময়লা পানির স্রোত, কিছুই যেন নজরে আসছে না তার।
‘আহা, আমার মেয়ে শখ করে একটা জিনিস চেয়েছে। আশা করে বসে আছে হয়তো। এমন লক্ষ্মী মেয়ে আমার বাবার সংসারে কত কষ্ট পাচ্ছে। তার। নিজের সংসার হোক, সেখানে কোনো দুঃখ-কষ্ট থাকবে না, আমি কসম খেয়ে বলতে পারি।’
এই জাতীয় অসংলগ্ন ভাবনা ভাবতে ভাবতে তিনি নয়াপাড়া ছাড়িয়ে হাইস্কুল ছাড়িয়ে সেইজখালী পর্যন্ত চলে গেলেন। কোথায় যাচ্ছেন, কী জন্য যাচ্ছেন, এসব তাঁর মনে রইল না। একসময় ইটে ধাক্কা খেয়ে পানিতে পড়ে গেলেন। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে বুঝলেন তাঁর পা টলছে; মাথায় অসম্ভব যন্ত্রণা। পাগলের মতো ঘুরছি কী জন্যে? এই ভেবে ফিরে চললেন উল্টো পথে! বাজারের সীমানা ছাড়িয়ে পোস্ট অফিসের কাছে আসতেই সশব্দে বাজ পড়ল কোথাও। রাত কত হয়েছে কে জানে। বাতি-টাতি বিশেষ দেখা যাচ্ছে না। লোকজন শুয়ে পড়েছে। আজহার খাঁর হঠাৎ মনে হলো রফিকের বাসায় গিয়ে বিশটা টাকা নিয়ে এলে হয়। কিন্তু দোকান খোলা থাকবে কতক্ষণ! তিনি ডানদিকের গলিতে ভেজা স্যান্ডেল টানতে টানতে দ্রুত হাঁটতে লাগলেন।