পরে শুনলাম এটা একটা অসুখ। অসুখের নাম বোবায় ধরা। ময়মনসিংহের মেজোখালার বাসায় যে অসুখের শুরু সেই অসুখ আমি এখনো লালন করছি। এখনো আমি একা ঘুমাই না। একা ঘুমালেই বড় বোবাটা বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে উপস্থিত হয়। যখন কেউ আমার সঙ্গে থাকে, তখনো উপস্থিত হয়। তবে তখন আমার গোঙানির শব্দে পাশের জনের ঘুম ভাঙে। সে আমাকে ডেকে তোলে। যে দায়িত্ব এখন বর্তেছে শাওনের কাঁধে।
বোবার হাতে আক্রান্ত হবার পর মেজোখালার বাসায় যাওয়া আমি একেবারেই কমিয়ে দিলাম। খালার বাড়িতে যাওয়ার ভৌতিক কারণ ছাড়াও একটা লৌকিক কারণও ছিল। লৌকিক কারণটা ব্যাখ্যা করি।
খালার ধারণা হলো, বিয়ের পাত্র হিসাবে আমি অতি উত্তম। তিনি তার শ্বশুরবাড়ির দিকের মেয়েদের সঙ্গে আমার বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাতে লাগলেন। তার বাসায় মফস্বলের আধুনিকতায় আধুনিক তরুণীরা আসা-যাওয়া করতে লাগল। মফস্বলের আধুনিকতা হচ্ছে সারা শরীর দুলিয়ে কথা বলা, অকারণে হাসা এবং অকারণে লম্বা গলায় বলা ‘সরি’। তখনো ‘oh Shit’ বলা চালু হয় নি।
খালা এদের বলতেন, আমি রান্নাবান্না নিয়ে ব্যস্ত। আমার ভাইগ্না একা বসে আছে। যাও তার সঙ্গে গল্প কর।
তাদের গল্পের নমুনা দেই। একজন গল্প করতে এল। অকারণে হেসে ভেঙে পড়তে পড়তে বলল, আপনি নাকি রাইটার?
হুঁ।
আমি কিন্তু বাংলাদেশের কোনো রাইটারের বই পড়ি না। সরি।
সরি হবার কিছু নেই।
আরেকটা কথা আপনাকে বলি—-টিচার আমার দুই চোখের বিষ। আপনি রাগ করলেন নাকি? সরি।
সুপাত্র হিসেবে ইউনিভার্সিটিতে আমার সমস্যা শুরু হলো। কোনো এক ফ্যাকাল্টি ডিন এসে বললেন, আমার মেয়ে দিলরুবা (নকল নাম দিলাম। আপনার ছাত্রী। সে আপনার খুব প্রশংসা করে। আপনি আজ সন্ধ্যায় আমার বাসায় আসবেন। আমাদের সঙ্গে খাবেন। মেস করে থাকেন। কী খান তার নাই ঠিক। আমার স্ত্রী নাটোরের মেয়ে। রান্নার হাত অসাধারণ। বাসা চিনবেন? না-কি দিলরুবাকে পাঠিয়ে দেব আপনাকে নিয়ে যেতে।
বাসা চিনব।
সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে চলে আসবেন। কিছুক্ষণ গল্পগুজব করব। দিলরুবা ভালো গান জানে। গান শুনবেন। গানবাজনার প্রতি কি আগ্রহ আছে? শুধু। লেখাপড়া নিয়ে থাকলে হয় না, জীবনে সুকুমার কলারও প্রয়োজন আছে।
সুকুমার কলার সন্ধানে গেলাম। দিলরুবা হারমোনিয়াম নিয়ে তৈরি। তার গানের টিচার এসেছেন। তিনি তবলা বাজাবেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে শুরু হলো—‘খোল খোল দ্বার রাখিও না আর…’। তারপর নজরুল ‘মোর প্রিয়া হবে এসো রানী’।
দিলরুবার বাবা বললেন, হুমায়ূন সাহেব, এইবার আপনার পছন্দের গান হবে। বলুন আপনার কোন গান পছন্দ?
দিলরুবা বলল, আমার কোনো গানই স্যারের পছন্দ হচ্ছে না। আমি লক্ষ করেছি, আমি গান গাওয়ার সময় স্যার অন্যদিকে তাকিয়ে থাকেন। আমি আর গানই করব না। বলতে বলতে দিলরুবার গলা ভারি হয়ে গেল। সে বসার ঘর থেকে ছুটে ভেতরের দিকে চলে গেল। দিলরুবার মা বললেন, আমার মেয়ে বড়ই অভিমানী। এখন বাথরুমে দরজা বন্ধ করে কাদবে। বাবা, তোমার কি খিদে লেগেছে? টেবিলে খাবার লাগাতে বলি।
বলুন।
খাওয়াদাওয়া শেষ হলো। দিলরুবা আমাকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে বলল, স্যার, একটা আইটেম আমি রান্না করেছি। বলুন তো কোনটা?
আমি বললাম, এটা বলা তো খুব কঠিন।
দিলরুবা বলল, মোটেই কঠিন না। সবচেয়ে পচা হয়েছে যে আইটেমটা সেটা আমি বেঁধেছি।
আমি বললাম, তাহলে তো মনে হয় সবই তোমার রান্না।
দিলরুবা চোখে আঁচল চাপা দিয়ে আবারো ঘরের দিকে ছুটে গেল। মনে হয় বাথরুমে ঢুকে কাঁদবে।
তিন মাস পার করার পর চাকরিতে ইস্তফা দিলাম। চেয়ারম্যান স্যার থমথমে গলায় বললেন, কেন চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন? এখানে সমস্যা কী হচ্ছে?
আমি বললাম, কোনো সমস্যা হচ্ছে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারারের পোস্ট খালি হয়েছে। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করব।
চেয়ারম্যান স্যার হতাশ গলায় বললেন, আমি বলেছিলাম না, এটা হচ্ছে আপনার মতো ছেলেদের ট্রানজিট পয়েন্ট।
জি আপনি বলেছিলেন।
সেকেন্ড থট দিন। আমি চেষ্টা করব যেন অতি দ্রুত আমাদের ইউনিভার্সিটির স্কলারশিপ নিয়ে পিএইচডি করতে যেতে পারেন।
স্যার। আমাকে ছেড়ে দিন। ময়মনসিংহ আমার শহর। কিন্তু আমাকে শহর টানছে না।
আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন করলাম। ময়মনসিংহ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার কোনো অর্জন নেই। সবই বিসর্জন। ছোট্ট একটা অর্জন আছে—এক বর্ষার রাতে ‘সৌরভ’ নামে একটা ছোটগল্প লিখেছিলাম। গল্পটা বিচিত্রায় প্রকাশিত হয়েছিল। সৌরভ আমার লেখা প্রথম ছোটগল্প, যা হারিয়ে যায় নি। ছফা ভাইয়ের পত্রিকায় ছাপা হওয়া গল্পটার এখন কোনো অস্তিত্ব নেই।
কৌতূহলী পাঠকদের জন্য গল্পটা দিয়ে দিলাম। গল্পের পটভূমি ময়মনসিংহ শহর, এটা কি বোঝা যায়?
.
সৌরভ
আজহার খাঁ ঘর থেকে বেরুবেন, শার্ট গায়ে দিয়েছেন, তখনি লিলি বলল, বাবা আজ কিন্তু মনে করে আনবে।
তিনি তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকালেন মেয়ের দিকে। মেয়ে বড় হয়েছে, ইচ্ছে করলেও ধমক দিতে পারেন না। সেই জন্যেই রাগী চোখে তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ।
লিলি বলল, রোজ রোজ মনে করিয়ে দেই। আজ আনবে কিন্তু।
সামনের মাসে আনব।
না, আজই আনবে।
রাগে মুখ তেতো হয়ে গেল আজহার খার। প্রতিটি ছেলেমেয়ে এমন উদ্ধত হয়েছে। বাবার প্রতি কিছুমাত্র মমতা নেই। আর নেই বলেই মাসের ছাব্বিশ তারিখে দেয়ালে হেলান দিয়ে দৃঢ় গলায় বলতে পারে, না, আজই আনতে হবে।