আমি হতাশ গলায় বললাম, আমার চাকরি কি স্যার হচ্ছে না?
চেয়ারম্যান সাহেব বললেন, মোকাররম স্যার চিঠি দিয়েছেন। আপনাকে চাকরি না দিয়ে উপায় আছে? আমি সুপারিশ করছি যেন আপনাকে অনেক বেশি বেতন দেওয়া হয়। যাতে বেতনের লোভে হলেও আপনি এখানে থেকে যান।
সেই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন লেকচারারের বেসিক পে ছিল ৪৫০ টাকা। অনার্স এবং এমএসসিতে ফার্স্ট ক্লাস থাকলে দু’টা ৫০ টাকার ইনক্রিমেন্ট পেয়ে হতো ৫৫০ টাকা। আমাকে চারটা ইনক্রিমেন্ট দেয়া হলো। বেতন হলো ৬৫০ টাকা। সেই সময়ের জন্যে অনেক টাকা।
আমার শিক্ষকতা জীবন শুরু হলো। এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটি, বিশাল ব্যাপার। কিন্তু সেখানের কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্ট হলো দিঘিতে শিশির বিন্দু। সেখানে কেমিস্ট্রি পড়ানো হয় সাবসিডিয়ারি বিষয় হিসাবে। ল্যাবরেটরির অবস্থা তথৈবচ। কেমিস্ট্রির শিক্ষকরা ক্লাসে যান নিতান্তই অনাগ্রহে। ক্লাস শেষ হওয়া মাত্র শিক্ষকরা (কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের কথা বলছি। যে যার বাড়িতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন কিংবা তাস খেলেন। ছোট্ট একটা উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা পরিষ্কার করি। সকাল দশটায় রসায়ন বিভাগের একজন শিক্ষকের মেটালার্জি (ধাতুবিদ্যা বিষয়ে ক্লাস। ক্লাস শুরু হবার পাঁচ মিনিট আগে ওই শিক্ষক আমাকে বললেন, হুমায়ুন সাহেব, আমার ক্লাসটা নিয়ে আসুন তো। আমার আজ ক্লাস নিতে ইচ্ছা করছে না।
আমি বললাম, ভাই, মেটালার্জি আমার বিষয় না। আমি ভৌত রসায়নের। ওই ক্লাস আমি কীভাবে নেব? আমার তো কোনোরকম প্রিপারেশন নেই।
প্রিপারেশন লাগবে না। ক্লাসে ঢুকে যান। কিছুক্ষণ বকবক করে চলে আসবেন।
আপনি পড়াচ্ছেন কী?
স্টিল। স্টিল কীভাবে তৈরি হয়, এইসব হাবিজাবি।
আমি ক্লাসে ঢুকলাম। মন খারাপ করেই ঢুকলাম। হচ্ছেটা কী?
এখন বলি কীভাবে থাকতাম। কয়েকজন শিক্ষক মিলে ইউনিভার্সিটির কাছেই একটা পাকাবাড়ি ভাড়া করেছিলেন। আমি তাদের সঙ্গে যুক্ত হলাম। আমাকে আলাদা একটা রুম দেওয়া হলো। সকালবেলা একটা কাজের মেয়ে আসে। মেয়েটা অল্পবয়স্ক। বেশির ভাগ শিক্ষকই মেয়েটার সঙ্গে রসিকতা করা দায়িত্ব মনে করেন। এই মেয়ে ঘর ঝাট দেয়। বাজার করে আনে। রান্না করে। দুপুরে সবাইকে খাইয়ে থালাবাসন পরিষ্কার করে চলে যায়। খাবার যা বাচে রাতে তাই খাওয়া হয়। নতুন করে রান্না হয় না। খাবারের আয়োজন থাকে সর্বনিম্ন পর্যায়ের। শিক্ষকরা প্রাণপণ চেষ্টা করেন টাকা বাঁচানোর।
বিনোদনের ব্যবস্থার কথা বলি। দুই প্যাকেট তাস আছে। তাস দিয়ে ব্রিজ খেলা হয়। মাঝে মাঝে লুডু খেলা হয়। সব খেলাই সিরিয়াসলি খেলা হয় না। লুডু খেলায় গুটি খাওয়া নিয়ে কয়েকবার হাতাহাতি পর্যন্ত হয়েছে।
আমি কিছুতেই তাদের সঙ্গে মিশ খাওয়াতে পারি না। শিক্ষকদের মধ্যে একজনকে আমার পুরোপুরি মানসিক রোগী বলে মনে হলো। তিনি রোজ রাতে ঘুমুতে যাবার আগে আমার কাছে এসে বিনীত গলায় বলেন, আমাকে একটা লাথি দেবেন? কষে আমার পাছায় একটা লাথি।
প্রথম রাতে এই কথা শুনে আমি চমকে উঠে বললাম, লাথি দেব কেন?
ভদ্রলোক আগের চেয়েও বিনয়ী গলায় বললেন, আপনি পবিত্র একজন মানুষ। আপনি লাথি দিলে আমার কিছু পাপ কাটা যাবে। আমি ভয়ঙ্কর পাপী একজন মানুষ। কী কী পাপ করেছি শুনবেন?
না।
না বলার পরেও তিনি পাপের কথা বলতে থাকেন। আমার বমি আসার মতো হয়। কাজের মেয়েটির রান্না গলা দিয়ে নামতে চায় না।
গ্লানিময় পরিবেশ থেকে বাঁচার জন্য মাঝে মাঝে আমি ময়মনসিংহ শহরে যাই। শহরের ছোটবাজার নামক জায়গায় আমার মেজোখালা থাকেন। তিনি আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন। কিন্তু তাঁর বাড়িটিও বিচিত্র। তার ছোট ছেলেমেয়েগুলি কোনো কারণ ছাড়াই সারাদিন তারস্বরে কাঁদে। এই কান্না বিরামহীন। খালা এসে মাঝে মাঝে কান্না থামাবার জন্য এদের পিঠে ধুম ধুম কিল দেন। এতে তাদের ব্যাটারি রিচার্জ হয়। তারা নবোদ্যমে কান্না শুরু করে।
বায়োলজিক্যাল ইভোলিউশনের নিয়ম অনুযায়ী বাচ্চাদের কান্না এমন হয়, যা বড়দের মধ্যে চূড়ান্ত বিরক্তি তৈরি করবে। যাতে বড়রা ছুটে এসে কান্নার কারণ অনুসন্ধান করে। বাচ্চাদের কান্না যদি বিরক্তি উৎপাদন না করে, তাহলে কেউ কান্নার কারণ অনুসন্ধানে এগিয়ে আসবে না। শিশু থাকবে একা। ইভোলিউশন বাধাগ্রস্ত হবে।
খালার বাসায় যতক্ষণ থাকি, ততক্ষণ ইভোলিউশনের যন্ত্রণা মর্মে মর্মে অনুভব করি। বেশির ভাগ সময় আমি চলে যাই দোতলার একটা ঘরে। দরজা জানালা বন্ধ করে রাখি, যাতে আওয়াজটা কম আসে।
ছুটির দিনের এক দুপুরের কথা। দোতলার ঘরে দরজা বন্ধ করে শুয়েছি। একটা জানালা শুধু খোলা। বৃষ্টি দেখার জন্য সেই জানালাটা খোলা রেখেছি। ভালো বৃষ্টি হচ্ছে। জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট আসছে, ঠান্ডা হাওয়া আসছে। আরামে চোখে ঘুম এসে যাচ্ছে। খালার বাচ্চাগুলোর কান্নাটাও আবহসঙ্গীতের। মতো লাগছে। ঘুম ঘুম অবস্থায় (কিংবা ঘুমের মধ্যে একটা ঘটনা ঘটল। আমি স্পষ্ট দেখলাম জানালার শিক গলে অদ্ভুত এক প্রাণী ঢুকল। পাঁচ ফুটের মতো লম্বা। লোমশ শরীর। মুখমণ্ডল মানুষের মতো। প্রাণীটা ইশারায় কাদের যেন ডাকল। তারা ঘরে ঢুকল। এরা সাইজে খুবই ছোট। মনে হয় বড়টার সন্তান। বড়টা এসে আমার বুকে বসল। দুহাত দিয়ে গলা চেপে ধরল। মেরে ফেলার চেষ্টা। আমি হাত-পা কিছুই নাড়াতে পারছি না। চিৎকার করার চেষ্টা করছি। পারছি না। নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে শুরু করেছি।