পড়ার জন্য সায়েন্স ফিকশনের বই খুঁজি। পাই না। এই ধরনের রচনার লেখকের সংখ্যা হাতেগোনা। এসিমভ, লেরি নিভেন, আর্থার সি ক্লার্কের নাম তখনো শুনি নি। একদিন হাতে এল উভচর মানব নামের আরেকটি রচনা। কী অদ্ভুত উপন্যাস!
সায়েন্স ফিকশন ঢুকে গেল আমার রক্তে তার ফলাফল হলো আমার তৃতীয় প্রকাশিত উপন্যাসটি একটি সায়েন্স ফিকশন। নাম তোমাদের জন্যে ভালোবাসা। অঙ্কের গ্রান্ডমাস্টার ফিহাকে নিয়ে কাহিনী। ভূঁইয়া ইকবাল সম্পাদিত বিজ্ঞান সাময়িকী সাপ্তাহিক পত্রিকায় আমার এই উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে আবার ছাপাও হয়েছে। বই আকারে প্রকাশের সময় একটি নির্ঘন্ট যুক্ত করে দিয়েছি। আমার ভয় ছিল পাঠকরা নতুন নতুন শব্দ এবং ধারণা ঠিক বুঝতে পারবে না। যেমন—
নিওরোন : মস্তিষ্কের যেসব কোষে স্মৃতি সজ্জিত থাকে।
দ্বৈত অবস্থানবাদ : একই সময়ে একই স্থানে দুটি বস্তুর উপস্থিতির সম্ভাবনা সম্পর্কীয় সূত্র। (কাল্পনিক)
NGC 1303 : দূরবর্তী কোয়াজার। (কাল্পনিক)
সিলঝিন : ১১৯তম ধাতু সিলঝিনিয়াম ও এক্টিনিয়ামের সংমিশ্রণে তৈরি বিশেষ ঘাতসহ সঙ্কর ধাতু। (কাল্পনিক)
বই প্রকাশের সময় কভার নিয়ে একটা সমস্যা হলো। এ ধরনের বইয়ের কভার কী হবে কেউ বুঝতে পারছে না। শেষে দৈনিক বাংলার শিল্পী কালাম মাহমুদ (এখন প্রয়াত) একটা কভার করেন—কিছু চক্র, কিছু চতুর্ভুজ দিয়ে এক ধরনের খিচুড়ি। যার সঙ্গে বইয়ের কাহিনীর কোনো সম্পর্ক নেই।
তোমাদের জন্যে ভালোবাসা নিয়ে বিতং করে অনেক কিছু লিখলাম। কারণ নানান আলোচনায় দেখছি লেখা হচ্ছে তোমাদের জন্যে ভালোবাসা বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম সায়েন্স ফিকশন। বাংলা ভাষার কথা বলতে পারছি না, তবে বাংলাদেশে এটিই প্রথম প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। এই বা কম কী?
আমার ছোটভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল এরপর সায়েন্স ফিকশন লেখায় হাত দেয় এবং চমৎকার কিছু লেখা লেখে। তার বেশির ভাগ সায়েন্স ফিকশন হলো হার্ডকোর জেনারের অর্থাৎ বিজ্ঞানের সূত্র যেখানে নিখুঁতভাবে মানা হয়। বাংলাদেশের অনেক পাঠকের মতো আমিও আমার ছোটভাইয়ের হার্ডকোর সায়েন্স ফিকশনের ভক্ত।
যেসব পাঠক আমার লেখা সায়েন্স ফিকশনের সঙ্গে পরিচিত না, তাদের জন্য একটি গল্প দিয়ে দিচ্ছি। গল্পটি পূর্বপ্রকাশিত।
অঁহক
ইন্টার গ্যালাকটিক স্পেসশিপগুলির পরিচালনা নীতিমালায় তিনটি না-সূচক সাবধান বাণী আছে। স্পেসশিপের ক্যাপ্টেনকে এই তিন ‘না’ মেনে চলতে হবে।
১. স্পেসশিপ কখনো নিউট্রন স্টারের কলয়ের ভেতর দিয়ে যাবে না।
২. ব্ল্যাকহোলের বলয়ের ভেতর দিয়ে যাবে না।
৩. অঁহক গোষ্ঠীর সীমানার কাছাকাছি যাবে না। ভুলক্রমে যদি চলে যায়, অতি দ্রুত বের হয়ে আসবে।
সমস্যা হলো নিউট্রন স্টার এবং ব্ল্যাকহোলের অস্তিত্ব আগেভাগে টের পাওয়া যায়। সময়মতো ব্যবস্থা নেয়া যায়। কিন্তু অঁহকদের ব্যাপার সম্পূর্ণ ভিন্ন। আগেভাগে তাদের উপস্থিতি জানার কোনো উপায় নেই।
অথচ অঁহকরা মহাশূন্যের বুদ্ধিমান প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে দয়ালু। বিপদগ্রস্ত মহাশূন্যযানের সাহায্যের জন্যে অতি ব্যস্ত। তাদের কর্মক্ষমতাও অসাধারণ। যে-কোনো যন্ত্রাংশ তারা অতি দ্রুত ঠিক করতে পারে। এই অনন্ত মহাবিশ্বের যে-কোনো শ্রেণীর প্রাণীর যে-কোনো ক্ষতিগ্রস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঠিক করে ফেলতে পারে। তারপরেও এদের কাছে যাওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। এদেরকে ব্ল্যাকহোল কিংবা নিউট্রন স্টারের মতোই বিপদজনক ভাবা হয়।
অঁহকদের সম্পর্কে পরিপূর্ণ কোনো তথ্য কোথাও নেই। গ্যালাকটোপিডিয়াতে লেখা আছে—
অঁহক
অতি উন্নত বুদ্ধিমত্তার প্রাণী। ছোট ছোট দলে এরা অনন্ত মহাশূন্যে ভেসে বেড়ায়। অসংখ্য বাহু বিশিষ্ট প্রাণী। এদের খাদ্যগ্রহণ পদ্ধতি অজ্ঞাত। ধারণা করা হয় এরা খাদ্য গ্রহণ করে না। মহাজাগতিক বিকিরণ থেকে এরা প্রয়োজনীয় শক্তি সংগ্রহ করে। অন্যসব বুদ্ধিমান প্রাণীর সংস্পর্শ এড়িয়ে চলতে চায়। তবে বিপদগ্রস্ত প্রাণীদের সাহায্যে অতিদ্রুত ছুটে আসে। ভগ্ন যন্ত্রাংশ ঠিক করা এবং আহত প্রাণীদের চিকিৎসায় এদের ক্ষমতা সীমাহীন।
অন্য বুদ্ধিমান প্রাণীদের কাছাকাছি এলে এরা নিজেদের অদৃশ্য রাখতে পছন্দ করে। এই ক্ষমতা তাদের আছে। তারা টেলিপ্যাথিক মাধ্যমেও বুদ্ধিমান প্রাণীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম। আহত বুদ্ধিমান প্রাণীদের চিকিৎসা দান কালে। তারা এই ক্ষমতা ব্যবহার করে আহতের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নেয়। তবে নিজেদের সম্পর্কে কিছুই বলে না।
তাদের যান্ত্রিক কোনো কিছু নেই। কারণ, তাদের যন্ত্রের কোনো প্রয়োজন নেই। মহাকাশের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে তারা ছোটাছুটি করতে পারে।
ধারণা করা হচ্ছে অঁহকরা অতি শান্তিপ্রিয়। সিরাস নক্ষত্রের গ্রহ ‘ভি থ্রি’র অতি উন্নত প্রাণী মায়রাদের একটি দল একবার অঁহকদের লক্ষ করে আণবিক ব্লাস্টার, লেজার-নিও ব্লাস্টার এবং পজিট্রন ব্লাস্টার নিক্ষেপ করে। সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণার মতো অবস্থা তৈরি হয়। এর উত্তরে অঁহকরা তাদের যাত্রাপথ থেকে সরে যায় এবং তাদের কাছে একটি বার্তা পাঠায়। বার্তায় বলা হয়—ধ্বংসে আনন্দ নেই। আনন্দ সৃষ্টিতে।
অঁহকদের মোট সংখ্যা, তাদের জীবনকাল কিংবা বাসস্থান সম্পর্কে কিছুই জানা যায় নি। খুব সম্ভব তাদের নির্দিষ্ট কোনো বাসস্থান নেই। তাদের শরীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়া এবং জৈব রসায়ন বিষয়ক কোনো কিছুই জানা যায় নি। স্পেকট্রোগ্রাফিতে প্রাপ্ত সামান্য তথ্যে অনুমান করা হয় তারা মেঘসদৃশ্য প্রাণী। তাদের বলয় থেকে পর্যায়ক্রমিকভাবে গামা রশ্মি এবং এক্স রশির বিকিরণ হয়। এই বিকিরণ অনিয়মিত বলেই তাদের উপস্থিতি আগে থেকে বোঝা যায় না। গ্যালাকটোপিডিয়াতে অঁহকদের সম্পর্কে খারাপ কিছু নেই। মহাবিশ্বের অন্যসব বুদ্ধিমান প্রাণীর সঙ্গেই তাদের যুক্ত করা হয়েছে। তবে তাদের স্থান হয়েছে রেড বুকে। রেড বুকে নাম ওঠার অর্থ এদের কাছে যাওয়া অতি বিপদজনক।