লেখালেখির দোহাই, আমি হক ভাইকে প্যাঁচে ফেলতে চাই নি। হক ভাই। যে প্যাঁচ তৈরি করেছেন, তার ভেতর থেকে বের হতে চেয়েছি। এই মুহূর্তে আমার হাতে হক ভাইয়ের কিছু উপন্যাস আছে। সবগুলিই ফর্মা হিসেবে এসেছে। কিংবা প্রকাশকরা ফর্মা হিসেবে সাজিয়ে নিয়েছেন।
নন্দিত নরকে উপন্যাসে ফিরে যাই। হঠাৎ করেই বড় বড় মানুষরা (কবি শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান,..) নন্দিত নরকে নিয়ে লেখা শুরু করলেন। তাঁদের অনেকের লেখাই যথেষ্ট হাস্যকর। যেমন শামসুর রাহমান মৈনাক হিসাবে দৈনিক বাংলায় লিখলেন, শুনেছি বইটা ভালো হয়েছে। পড়ে দেখতে হবে।
আমি এতেই খুশি। এই অবস্থায় বন্ধু আনিস সাবেত উত্তেজিত ভঙ্গিতে আমাকে এসে বললেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তোমাকে নিয়ে দেশ পত্রিকায় লিখেছেন।
বলেন কী?
পত্রিকা সঙ্গে আছে, পড়ে দেখ।
উনি আমার বই কোথায় পেলেন?
সেটা তো জানি না। কেউ নিশ্চয়ই তাঁকে দিয়েছে।
পত্রিকা ধরে রাখতে পারছি না, হাত কাঁপছে।
সনাতন পাঠক ছদ্মনামে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কি সত্যিই নন্দিত নরকে বইটি নিয়ে লিখেছেন? কোথাও ভুল হচ্ছে না তো?
এই ঘটনার অনেক অনেক বছর পর নুহাশ পল্লীর সুইমিংপুলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে দল বেঁধে আমরা নেমেছি। খুব আনন্দ হচ্ছে। হঠাৎ সুনীল বললেন, হুমায়ুন, আপনার প্রথম বইটি নিয়ে অনেক অনেক বছর আগে দেশ পত্রিকায় আমি একটা লেখা লিখেছিলাম। লেখাটি কি আপনার চোখে পড়েছিল?
আমি বললাম, কী লিখেছিলেন সেটা কি আপনার মনে আছে?
সুনীল বললেন, অবশ্যই। ঔপন্যাসিকের স্মৃতিশক্তি ভালো থাকতে হয়।
০৭.
অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান। তাঁর কাছে কলেজে পড়ুয়া তরুণ এক কবি এসেছে। সেই তরুণ কবি সিরাজ স্যারের সামনে বসতে বসতে বলল, সিরাজ ভাই, আপনার অমুক লেখাটা পড়েছি। ভালো হয়েছে, তবে…
সিরাজ স্যার তার উত্তরে বললেন,..
কী বললেন, সেটা আর উল্লেখ করলাম না। কারণ তা সিরাজ স্যারের চরিত্রের সঙ্গে যায় না। আমার ধারণী গল্পটা বানানো। সমাজের গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের নিয়ে অনেক বানানো গল্প চালু আছে।
পাঠক কি লক্ষ করছেন যে, আমি কৌতূহল জাগ্রত করে দূরে সরে গেছি। সিরাজ স্যার কী বললেন তা জানার আগ্রহ তৈরি করেছি, আগ্রহ মেটানোর ব্যবস্থা করি নি।
আমি একজন Fiction writer. ফিকশন লেখার একটা ছোট্ট টেকনিক ব্যবহার করলাম। প্রথম পৃষ্ঠা থেকে শেষ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পাঠকের আগ্রহ যেন থাকে। সে যেন কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করে। পাঠকের কিছু কৌতূহল মেটানো হবে। কিছু মেটানো হবে না। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়—‘অন্তরে অতৃপ্তি রবে…’ Fiction writing-এ তৃপ্তির চেয়ে অতৃপ্তি গুরুত্বপূর্ণ।
সর্বনাশ! আমি দেখি উপদেশমূলক রচনা শুরু করেছি। ফিকশন রাইটিংয়ের নিয়মকানুন শেখানো আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না।
ঔপন্যাসিক হবার আগ্রহ নিয়ে অনেকেই আসে আমার কাছে। গভীর আগ্রহে জানতে চায় লেখালেখির নিয়মকানুন। আমি তাদের তেমন কিছুই বলতে পারি না। ক্রিয়েটিভিটি শেখানোর কলাকৌশল এখনো মানুষের আয়ত্তে আসে নি। আমার ধারণা ক্রিয়েটিভিটি শেখানো যায় না। যদি শেখানো যেত তাহলে রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা ভাষার সবচেয়ে বড় লেখকের নাম হতো রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্রনাথের ছেলে। বাবার কাছ থেকে লেখালেখির সব কৌশল শিখে নেওয়ার সুযোগ তারই সবচেয়ে বেশি ছিল।
সিরাজুল ইসলাম স্যারকে নিয়ে শুরুতে যে গল্প ফেঁদেছি তার ভেতরে আছে বিশ্বাসযোগ্যতা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান ছিলেন এবং হাঁটুর বয়েসি অনেক তরুণ লেখককে আমি নিজে সিরাজ ভাই সিরাজ ভাই করতে শুনেছি।
আসল কথা, ফিকশন রাইটারের ফিকশন বিশ্বাসযোগ্য হতে হবে। সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য একটা ঘটনার এমন বর্ণনা হতে হবে, যেন মনে হয়—এটাই তো হবে।
অবিশ্বাস্য ঘটনার বিশ্বাস্য রূপের প্রথম পরিচয় পেলাম আমি যখন ঢাকা কলেজের ছাত্র তখন। ঘটনাটা বলি। কলেজ ছুটি হয়েছে। আমি কলেজ থেকে যাচ্ছি নানাবাড়িতে—মোহনগঞ্জে (নেত্রকোনা)। গৌরীপুর জংশনে ট্রেন বদল করতে হয়। পাঁচ থেকে ছ’ঘণ্টার যাত্রাবিরতি। সময় কাটানোর জন্য কিছু বই কিনে নিয়ে গেছি। মস্কোর প্রগতি প্রকাশনীর বই। বইগুলো দামে খুব সস্তা। সুন্দর কাগজ, ঝকঝকে ছাপা। একটি গল্প পড়তে শুরু করেছি—গল্পের নাম ‘হৈটি টৈটি’ অদ্ভুত নাম দেখে এই গল্পটি প্রথম পড়ার জন্য বাছলাম। লেখকের নাম খুব সম্ভব আলেকজান্ডার বেলায়েভ (খুব সম্ভব বলছি, কারণ চল্লিশ বছর আগের স্মৃতি। ঝাপসা হয়ে আসছে।) গল্পে একটা মানুষের মাথায় হাতির ব্রেইন ট্রান্সপ্লান্ট করে দেয়া হয়। মানুষটি সম্পূর্ণ বদলে যায়, কারণ তার জগৎ হয়ে যায় হাতির জগৎ। তার স্মৃতি হাতির স্মৃতি।
সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য গল্প। অথচ কী উপস্থাপনা! লেখক যা লিখছেন মনে হচ্ছে সবই সত্যি। কোথাও সামান্য অতিকথন পর্যন্ত নেই। এ ধরনের গল্প তো আগে পড়ি নি। উত্তেজনায় আমার হাত-পা কাঁপা শুরু হলো। গল্প শেষ হবার পর আবার প্রথম থেকে পড়া শুরু করলাম। সায়েন্স ফিকশন নামক নতুন একধরনের রচনা পড়ার সেটাই শুরু। কী অপূর্ব শুরু! গৌরীপুর জংশনের কোলাহল। ট্রেনের আসা যাওয়া। ট্রেন চলে যাবার পর পর হঠাৎ কিছুক্ষণের নীরবতা। তার মধ্যে আমার বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর প্রথম পাঠ।