আমি বললাম, কোন জায়গাটা বড় করব বুঝতে পারছি না!
খান সাহেব বললেন, একটা কোর্ট সিন নিয়ে আসেন। উকিল মন্টুকে জেরা করছে এই রকম। এই, হুমায়ূন সাহেবকে কাগজ আর কলম দে।
আমি খান সাহেবের সামনেই ফর্মা মিলানোর জন্যে উপন্যাস বড় করতে শুরু করলাম। উত্তেজনায় শরীর কাঁপছে তাহলে সত্যি সত্যি আমার বই বের হচ্ছে?
বই বের হলো। দাম তিন টাকা। বইয়ের কভার আমার ছোটভাই জাফর ইকবাল এবং ভাস্কর শামীম শিকদার দুজনে মিলে করল। কয়েকজন মানুষ বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। কভার করার নিয়মকানুন (ব্লক পদ্ধতি) দুজনের কেউ জানে না। অতি অখাদ্য এক কভার হলো। মানুষগুলির একটা মুখেরও ব্লক ডিজাইন ঠিক হয় নি বলে নষ্ট হয়ে গেল।
খান ব্রাদার্স থেকে তখন সুন্দর সুন্দর কবিতার বই বের হচ্ছে। নির্মলেন্দু গুণের প্রেমাংশুর রক্ত চাই। কবি আবুল হাসানের রাজা যায় রাজা আসে। এইসব বইয়ের কভার করেছেন কভার ডিজাইনের গ্র্যান্ড মাস্টার কাইয়ুম চৌধুরী।
নন্দিত নরকে বের হবার ছয় মাস পর খান সাহেব ডেকে পাঠালেন। হতাশ গলায় বললেন, বই তো কিছুই বিক্রি হচ্ছে না। পুশ সেল করেন। বন্ধুবান্ধবের কাছে বেচেন।
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, বইয়ের কভারটা কি চেঞ্জ করা যায়? কাইয়ুম চৌধুরীকে দিয়ে…।
আমাকে অবাক করে খান সাহেব ড্রয়ার থেকে দুশ’ টাকা বের করে আমার হাতে দিলেন এবং বললেন, টাকাটা কাইয়ুম সাহেবকে দিয়ে বইয়ের কভার নতুন করে করতে বলেন। উনি কভারের জন্য দুশ’ টাকা নেন।
শুরু হলো আমার অন্তহীন ঘোরাঘুরি। কাইয়ুম চৌধুরীর কাছে যাই, তিনি একটা তারিখে আসতে বলেন। সেই তারিখে যাই, তিনি আরেকটা তারিখ দেন। ধৈর্যে আমি রবার্ট ব্রুসকে হার মানালাম। হাঁটাহাঁটি করতে করতে আমার স্বাস্থ্য ভালো হয়ে গেল। কভারের দেখা নেই।
একদিন খান সাহেব বললেন, আমি যাব আপনার সঙ্গে। আমি অন্য এক সূত্রে তাকে চিনি। সেটা উল্লেখ করে যদি কিছু হয়। আপনি পুলাপান মানুষ বলে উনি আপনাকে পাত্তা দিচ্ছেন না। আমি একজন বয়স্ক মানুষ।
গেলাম খান সাহেবকে নিয়ে। ঘণ্টাখানিক বসে রইলাম। কাইয়ুম চৌধুরীর বসার ঘরে না। বসার ঘরের বাইরে ছোট্ট একটা ঘরে। কাইয়ুম চৌধুরী খবর পাঠালেন, তিনি একটা ডিজাইন নিয়ে বিশেষ ব্যস্ত। ডিজাইনটা শেষ হলেই আসবেন। আরো দশ-পনেরো মিনিট লাগবে।
দশ-পনেরো মিনিট পর কাইয়ুম চৌধুরী বের হলেন না। ভয়ালদর্শন এক কুকুর বের হয়ে খান সাহেবের পা কামড়ে ধরল। আমি খান সাহেবকে কুকুরের হাতে ফেলে রেখে দৌড়ে পালিয়ে গেলাম। য পলায়তি স জীবতি।
সেই দিনই খান সাহেবকে তার বাসায় দেখতে গেলাম। তিনি বিছানায় পড়ে আছেন। নাভিতে ইনজেকশন শুরু হয়েছে। সান্ত্বনাসূচক কিছু কথা বলা দরকার। কোনো কথাই মাথায় আসছে না। খান সাহেব বললেন, কাইয়ুম চৌধুরীর হাত থেকে কভারের আশা ছেড়ে দিন। সামান্য কভারের জন্যে কুকুরের হাতে মৃত্যুর। মানে হয় না।
আমি বললাম, জি আচ্ছা।
খান সাহেব বললেন, আমি আপনার জন্যে দোয়া করলাম, আপনার বই কভার ছাড়া বের হলেও মানুষ যেন কিনে পড়ে।
কাইয়ুম চৌধুরী শেষ পর্যন্ত কভার করে দিয়েছিলেন। অপূর্ব কভার। কভার দেখে খান সাহেব কুকুরের কামড়ের দুঃখ ভুলে গেলেন।
কভার ডিজাইন হাতে পাওয়ার দৃশ্যটা বলি। কাইয়ুম চৌধুরী ডিজাইন হাতে বের হয়ে এলেন। আমাকে বুঝিয়ে দিলেন কীভাবে ছাপতে হবে। আমি বিদায় নিয়ে চলে আসছি, কাইয়ুম চৌধুরী বললেন, একটু দাঁড়ান। আমি দাঁড়ালাম।
কাইয়ুম চৌধুরী বললেন, কভারটা করার আগে আপনার উপন্যাসটা আমি পড়েছি। আপনার হবে।
আমি ধন্যবাদসূচক কিছু বলতে যাব তার আগেই তিনি বললেন, সামান্য ভুল বলেছি। আপনার হবে না বলে বলা উচিত আপনার হয়েছে।
এই বাক্যটি আমার লেখালেখি জীবনের প্রথম শোনা প্রশংসাসূচক বাক্য। উনিশ-কুড়ি বছরের একজন তরুণকে এই বাক্যটি কী আনন্দই না সেদিন দিয়েছিল।
আনন্দের কথা যখন এসেছে, তখন নিরানন্দের কিছু কথা আসুক। Ph.D করে ফিরেছি। পুরোদমে লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছি। অনেকগুলি বই বের হয়ে গেছে। পত্রপত্রিকায় ইন্টারভ্যু দিতে খুবই আগ্রহী। কেউ ইন্টারভ্যু নিতে আসে না। হঠাৎ বিচিত্রা পত্রিকা থেকে ডাক পেলাম। তারা আমাকে এবং সৈয়দ শামসুল হককে নিয়ে একটা কভার স্টোরি করতে চাচ্ছে। দেশের প্রধান ঔপন্যাসিক সৈয়দ শামসুল হকের সঙ্গে তরুণ ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের কথোপকথন। আমি অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে রাজি হলাম।
বিচিত্রর শাহাদত ভাইয়ের উপস্থিতিতে কথোপকথন শুরু হলো। মডারেটর হচ্ছেন ঔপন্যাসিক মঈনুল আহসান সাবের। সৈয়দ শামসুল হক আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, হুমায়ুন, বলুন তো আপনার লেখাগুলি সবসময় ফর্মা হিসেবে বের হয় কেন? এরচেয়ে বড়ও হয় না, কমও হয় না। এর কারণটা কী?
আমি তাকিয়ে দেখি শাহাদত ভাই মাথা নাড়ছেন। তার মাথা নাড়া থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, তরুণ ঔপন্যাসিক কঠিন পাচে পড়েছে।
আমি হক ভাইকে বললাম, হক ভাই, আপনি তো সনেট লেখেন। সনেটগুলো ১৪ লাইনে শেষ হতে হয়। আপনি যদি আপনার ভাবনা নির্দিষ্ট ১৪ লাইনে শেষ করতে পারেন আমি কেন আমার ভাবনা ফর্মা হিসেবে শেষ করতে পারব না?
হক ভাই খানিকটা হকচকিয়ে গেলেন। এই উত্তর তিনি আমার কাছ থেকে আশা করেন নি। শাহাদত ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি আগের চেয়েও দ্রুত মাথা নাড়ছেন। তাঁর এই মাথা নাড়ার অর্থ হক ভাই প্যাঁচে পড়েছেন।