- বইয়ের নামঃ বলপয়েন্ট
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই, জীবনী
আমার পুত্র নুহাশ
আমার পুত্র নুহাশকে কে যেন জিজ্ঞেস করল, তুমি বড় হয়ে কি বাবার মতো লেখক হতে চাও? নুহাশ বলল, না।
কেন না?
নুহাশ গম্ভীর গলায় বলল, লেখক হলে খুব বেশি হাঁটাহাঁটি করতে হয়। সে সবসময় আমাকে দেখেছে লিখতে শুরু করেছি, কিছুক্ষণের মধ্যেই লেখা বন্ধ করে বারান্দায় হাঁটছি। আবার লিখছি আবার হাঁটছি। সে ধরেই নিয়েছে হাঁটাহাঁটি লেখালেখিরই একটা অংশ। বাংলা একাডেমীর লেখক প্রকল্পের একজন আমাকে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, আপনার লেখালেখির প্রধান অনুপ্রেরণা কী? আমি গম্ভীর গলায় বললাম, হন্টন।
একবার সাঁতারে চ্যাম্পিয়ন একজনকে জিজ্ঞেস করা হলো, আপনি এত ভালো সাঁতার কোথায় শিখেছেন? চ্যাম্পিয়ন বললেন, টিউবওয়েলে শিখেছি।
টিউবওয়েলে সাঁতার শিখলেন কীভাবে?
আমাকে কল চেপে বালতির পর বালতি পানি তুলতে হতো। সেটা করতে গিয়ে হাতের মাসল শক্ত হলো। সেখান থেকে সাঁতার।
আমার বেলাতেও কি তাই? হাঁটতে হাঁটতে পা শক্ত। যে কারণে দীর্ঘ সময় মাটিতে বসে থাকতে পারি। সমস্যা হয় না।
চেয়ার-টেবিলের যুগে আমি লিখি মেঝেতে বসে। তারাশঙ্করের আত্মজীবনীতে পড়েছি, তিনি মেঝেতে বসে টুলবক্সের মতো ছোট্ট জলচৌকিতে লিখতেন। জলচৌকির ডালা খোলা যেত। ডালার ভেতর থাকত কাগজ এবং কলম। আমার অনুপ্রেরণা তারাশঙ্কর না। চেয়ার-টেবিলে বসে লেখার সময় নিজেকে কেমন যেন অফিসের কর্মচারী মনে হয়। মেঝেতে ছোট্ট একটা জলচৌকি অনেক আপন, অনেক ঢিলেঢালা।
তবে কবি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার আপ্রাণ চেষ্টার সময় আমি অফিসার অফিসার ভঙ্গিতে সোফায় বসে লিখেছি। সেবছরই আমাদের নতুন সোফা কেনা হয়েছে। তখনো আমার নিজের লেখার জলচৌকি হয় নি। লেখালেখির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মেঝেতে বসে করার চিন্তাও মাথায় নেই।
দেড় থেকে দু’ঘণ্টা কঠিন পরিশ্রম করে আমি বারো লাইনের একটা কবিতা (না-কি পদ্য) প্রসব করে ফেললাম। ঘটনার সমাপ্তি এখানে হলেই ভালো হতো, তা হলো না। খাম ডাকটিকিট কিনে আনলাম। দৈনিক পাকিস্তান-এর মহিলা পাতার সম্পাদিকাকে একটা চিঠি লিখলাম—
প্রিয় আপা,
সালাম জানবেন। আমার নাম মমতাজ আহমেদ শিখু।
আমি একটি কবিতা পাঠালাম…
মমতাজ আহমেদ আমার ছোটবোনের নাম। সে তখন ক্লাস টেনে পড়ে। আমার ধারণা হয়েছিল, ক্লাস টেনে পড়া একটি কিশোরীর কবিতা হিসাবে আমার কবিতাটা চলতে পারে।
কী সর্বনাশ! পরের সপ্তাহেই কবিতাটা ছাপা হয়ে গেল। আমার যারা পাঠক, তারা কিন্তু জীবনের প্রথম লেখা কবিতাটার দু’টা লাইনের সঙ্গে পরিচিত, কারণ এই দুটা লাইন আমি আমার দ্বিতীয় উপন্যাস শঙ্খনীল কারাগার-এ ব্যবহার করেছি।
দিতে পারো একশ ফানুস এনে
আজন্ম সলজ্জ সাধ একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই।
প্রথম কবিতা ছাপা হয়ে যাওয়া কবির জন্যে বিরাট ব্যাপার। আমি সোফায় বসে কাব্যচর্চা করতেই থাকলাম এবং দৈনিক পাকিস্তান এ বেশ কিছু মমতাজ আহমেদ শিখুর কবিতা ছাপা হয়ে গেল। আল্লাহপাকের অসীম করুণা, কবিতা নামক সেইসব আবর্জনার এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই।
লেখায় সামান্য ভুল করলাম। মমতাজ আহমেদ শিখু নামে প্রকাশিত কবিতা আমার প্রথম কবিতা না। স্বনামে স্কুল-ম্যাগাজিনে প্রথম কবিতা ছাপা হয়েছে। ঈশ্বর-বিষয়ক অতি উচ্চশ্রেণীর ভাব-বিষয়ক ইংরেজি কবিতা। কবিতার নাম ‘God’। কবিতাটা ছাপা হয়েছে কবির ছবিসহ। ছবির নিচে লেখা Humayun Ahmed Class X Section B. কবিতার প্রথম কয়েকটি লাইন মনে আছে—
Let the earth move
Let the sun shine
Let them to prove
All are in a line
Move এর সঙ্গে prove এর অন্তর্মিল। Shine এর সঙ্গে line,
মাইকেল মধুসূদন হবার চেষ্টা থেকে যে ইংরেজি কবিতা রচিত হলো, তা কিন্তু না। স্কুল-ম্যাগাজিনের দায়িত্বে যে স্যার ছিলেন, তাঁকে আমি বাংলায় গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনী সবই লিখে জমা দিয়েছি। প্রতিটি রচনা পড়েই তিনি বলেছেন, মোটামুটি অখাদ্য। যাই হোক, তোর যখন এত আগ্রহ, তুই বরং ইংরেজিতে যা ইচ্ছা লিখে নিয়ে আয়, ছেপে দেব। ইংরেজি সেকশানে কোনো লেখা জমা পড়ে নি।
স্কুল-ম্যাগাজিন প্রকাশিত হবার কয়েকদিন পরের ঘটনা। আমাদের ক্লাসের ইংরেজির শিক্ষক (স্যারের নাম মনে করতে পারছি না) এক কপি স্কুল-ম্যাগাজিন হাতে ক্লাসে ঢুকলেন, এবং আমাকে মহালজ্জায় ফেলে আমার লেখা কবিতা পড়ে শোনালেন। তিনি তার ছাত্রের ইংরেজি কাব্য প্রতিভায় মুগ্ধ। কবিতা পাঠ শেষ হবার পর তিনি বললেন, হুমায়ূন, তুই ইংরেজি কবিতা লেখার চর্চা ছাড়বি না। আমি দোয়া দিলাম। খাস দিলে দোয়া দিলাম।
আমাদের ইংরেজি স্যার নিশ্চয়ই এখন জান্নাতবাসী। ইংরেজি কাব্য রচনায় স্যারের দোয়া কাজে লাগে নি। কিন্তু পুরোপুরি ব্যর্থ হয় নি। ইংরেজি কবিতা না লিখলেও কিছু গদ্য তো লিখেছি! যদিও একজন গদ্যকার কবির পদধূলিরও নিচে থাকেন। সমারসেট মমের একটি উদ্ধৃতি দেই।
The crown of literature is poetry. It is its end and aim. It is the sublimest activity of the human mind. It is the achivement of beauty and delicacy. The writer of prose step aside when the poet passes.