৯। স্ত্রী ত্যাগ ও হিলা প্রথার তাৎপর্য কি?
কেহ কেহ স্ত্রীকে অর্ধাঙ্গিনী বলিয়া থাকেন। এ কথাটির বিশেষ তাৎপর্য আছে। অর্ধ-অঙ্গিনী বা সিঁকি অঙ্গিনী না হইলেও আদি পুরুষ হজরত আদমের বাম পঞ্জরের অস্থি হইতেই নাকি প্রথমা নারী হাওয়া বিবি সৃষ্টি হইয়াছিলেন। তাই বিবি হওয়াকে আদমের অঙ্গজ হিসাবে “অঙ্গিনী” বলা খুবই সমীচীন। ইহা ছাড়া সংসার জীবনে নারীরা পুরুষদের একাংশ হিসাবেই বিরাজিতা।
মানুষের হস্তপদাদি কোন অঙ্গ রুগ্ন হইলে উহার প্রতিকারের জন্য চিকিৎসা করান হয়। রোগ দুরারোগ্য হইলে ঐ রুগ্নাঙ্গ লইয়াই জীবন কাটাইতে হয়। রুগ্নাঙ্গ লইয়া জীবন কাটাইতে প্রাণহানীর আশঙ্কা না থাকিলে কেহ রুগ্নাঙ্গ ত্যাগ করে না। স্ত্রী যদি স্বামীর অঙ্গই হয়, তবে দুষিতা বলিয়া তাহাকে ত্যাগ করা হয় কেন? কোন রকম কায়-ক্লেশে জীবন যাপন করা যায় না কি?
জবাব হইতে পারে যে, সখের বশবর্তী হইয়া কেহ কখনও স্ত্রী ত্যাগ করে না। সাংসারিক বিশৃঙ্খলা ও মানসিক অশান্তি যখন চরমে পৌঁছে তখনই কেহ কেহ স্ত্রী ত্যাগ করিতে বাধ্য হয়। কথাটি কতকাংশে সত্য, কিন্তু যাহারা একাধিক স্ত্রী ত্যাগ করিয়া বাছা বাছা রমণীর পাণি গ্রহণ করেন তাহারা কি কায়মী বিবাহিতদের (হিন্দুদের) চেয়ে দাম্পত্য সুখে অধিক সুখী?
রসায়ন শাস্ত্রের (Chemistry) নিয়মে দুইটি পদার্থের মিশ্রণ ঘটাইতে হইলে পূর্বেই জানা উচিত যে, পদার্থ দুইটি মিশ্রণযোগ্য কি না। কেহ যদি জলের সহিত বালু বা খড়িমাটি মিশাইতে চায় তাহা পারিবেন না। সাধারণত তৈল ও জল একত্র মিশে না। তবে উহা একত্র করিয়া বিশেষভাবে রগড়াইলে সাময়িকভাবে মিশিয়া পুনরায় বিযুক্ত হয়। কিন্তু চিনি বা লবণ জলে মিশাইলে উহা নির্বিঘ্নে এক হইয়া যায়। বিবাহ ব্যাপারে পাত্র-পাত্রী নির্বাচনও এইরূপ একটি মিশ্রণ।
পাত্র ও পাত্রী মৌলিক চরিত্রসমূহ শেষোক্ত পদার্থের ন্যায় মিশুক কি-না, তাহা বিচার না করিয়া- জল-খড়ি ও তৈল-জল মিশ্রণের মত যথেচ্ছা মিলন প্রচেষ্টার বিফলতাই “তালাক” প্রথার কারণ নয় কি?
এতদ্দেশে অনেক হিন্দুর ভিতর কোষ্ঠী ও ঠিকুজীর সাহায্যে বিবাহ পাত্র-পাত্রী নির্বাচনের প্রচেষ্টা চলিতে দেখা যায়। মানুষের জন্ম মুহূর্তে তিথি, লগ্ন ও রাশির সংস্থান এবং চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্রাদির আকারে বিশেষ স্থানে অধিষ্ঠান জাতকের দেহ-মনের উপর কতখানি প্রভাব বিস্তার করিতে পারে আর এ বিষয়ে ফলিত জ্যোতিষ (Astrology)-এর সিদ্ধান্ত অভ্রান্ত কি না তাহা জানি না। কিন্তু ইহাতে অন্তত ইহাই প্রমাণিত হয় যে, হিন্দুগণ জানিতে চেষ্টা করেন যে, বিবাহে বর-কন্যার মিল হইবে কি না। মুসলমানদের বিবাহ প্রথায় পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে যদি কোনরূপ মনোবিজ্ঞান সম্মত বিচার প্রণালী উদ্ভাবন ও প্রবর্তন করা যাইত, তাহা হইলে তালাক প্রথা এত অধিক প্রসারলাভ করিত না।
স্বামী ও স্ত্রীর মনোবৃত্তি বা স্বভাবের বৈষম্য বশতই যে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন হয়, তাহা সুনিশ্চিত। তবে এই বৈষম্য দুই প্রকারে হইতে পারে। কোন ক্ষেত্রে হয়তো স্ত্রীই দোষী, কিন্তু স্বামী সাধু ও সচ্চরিত্র। আবার কোন কোন ক্ষেত্রে স্ত্রী সচ্চরিত্রা কিন্তু স্বামী অসচ্চরিত্র ও বদমায়েশ। ভালর সহিত মন্দর বিরোধ অবশ্যম্ভাবী। কাজেই উপরোক্ত যে কোন ক্ষেত্রেই স্বামী ও স্ত্রীর মনোমালিন্য হইতে পারে এবং তাহাতে বিবাহ বিচ্ছেদও ঘটিতে পারে। দোষ যাহারই হউক না কেন, বাহিরের লোক উহার বিশেষ কিছু জানিতে পারে না। কিন্তু পরিণাম উভয় ক্ষেত্রেই এক। অর্থাৎ স্ত্রী ত্যাগ।
তালাকের ঘটনা যেভাবেই ঘটুক না কেন, ত্যাজ্য স্ত্রীকে পুনঃগ্রহণে স্ত্রী যে নির্দোষ, ইহাই প্রমাণিত হয়। মনে হয় যে ক্রোধ, মোহাদি কোন রিপুর উত্তেজনায় স্বামী ক্ষণিকের জন্য আত্মবিস্মৃত হইয়াই অন্যায়ভাবে স্ত্রী ত্যাগ করে এবং পরে যখন সম্বিৎ (জ্ঞান) ফিরিয়া পায়, তখন স্থির মস্তিষ্কে সরলান্তঃকরণে ত্যাজ্য স্ত্রীকে পুনঃগ্রহণে বদ্ধপরিকর হয়। অর্থাৎ স্বামী যখন তার নিজের ভ্রম বুঝিতে পারে, তখনই ত্যাজ্য স্ত্রীকে পুনরায় গ্রহণ করিতে অভিলষিত হয়। ইহাতে দেখা যায় যে, স্ত্রীর উপর মিথ্যা দোষারোপ করিয়া অথবা ক্রোধাদির বশবর্তী হইয়া স্ত্রী ত্যাগে স্বামীই অন্যায়কারী বা পাপী। অথচ পুনঃগ্রহণযোগ্য নির্দোষ স্ত্রীকে পুনঃগ্রহণে “হিলা” প্রথার নিয়মে স্বামীর পাপের প্রায়শ্চিত্ত করিতে হয় সেই নির্দোষ স্ত্রীকেই। অপরাধী স্বামীর অর্থদণ্ড, বেত্রাঘাত ইত্যাদি না-ই হউক, অন্ততঃ তওবা (পুনরায় পাপকর্ম না করিবার শপথ) পড়ার বিধান নাই, আছে নিষ্পাপিনী স্ত্রীর ইজ্জত হানির ব্যবস্থা। একের পাপে অন্যকে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হয় কেন?
ত্যাগের পর স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে দাম্পত্যবন্ধন থাকে না বটে; কিন্তু দাম্পত্য ভাবটা কি সহজেই তাহাদের হৃদয় হইতে মুছিয়া যায়? যদি যায়-ই, তবে হিলা প্রথার নিয়মানুসারে অস্থায়ী (Temporary) কলেমাটা যে কোন লোকের সাথে বিশেষত পূর্ব স্বামীর চাচা, ফুফা, মামার সহিত না হইয়া প্রায়ই ভগ্নিপতি বা ঐ শ্রেণীর কুটুম্বদের সহিত হয় কেন? ত্যাগের পর স্বামী তার মস্তিষ্কের উত্তেজনা বা ক্রোধাদি বশত স্ত্রীর প্রতি কিছুদিন বীতস্পৃহ থাকিলেও সরলা
স্ত্রী সহজে স্বামীরূপ হৃদয় হইতে মুছিয়া ফেলিতে পারে না। এ অবস্থায় যদি সে স্বামীর পুনঃগ্রহণের কথা জানিতে পারে, তাহা হইলে তাহার হৃদয়পটে পূর্ব দাম্পত্য-জীবনের স্মৃতি আরও গাঢ়রূপে অঙ্কিত হয়।
এমতাবস্থায় স্ত্রী পূর্ব স্বামীর পুনঃগ্রহণের প্রস্তাবে সানন্দে সম্মতি দেয়। কিন্তু ইহার পরে হিলাকৃত নবীন দুলহার অস্থায়ী কলেমার ইজাব (সম্মতি) দেওয়াটা কি তার আন্তরিক?
হিলা প্রথায় বর নির্বাচনে বেশ একটু কারসাজী আছে। বয়স্কা হইলেও হিলাকৃত বর নির্বাচনে স্ত্রীর কোন অধিকার থাকে না, নির্বাচনকর্তা সর্বক্ষেত্রেই পূর্বস্বামী। প্রথমত সে বিচার করে যে, সিন্দুকের চাবি কাহার হস্তে দেওয়া উচিত। নবীন দুলহা তার হাতের লোক কি-না। সে তাহার নির্দেশমত সময়োচিত কাজ করিবে কি না। সর্বোপরি লক্ষ্য রাখা হয় যে, নবদম্পতির মধ্যে ভালবাসা জন্মিতে না পারে।
এইরূপ হিসাব মিলাইয়া প্রাক্তন স্বামীর দ্বারা বর নির্বাচিত হইলে, সেই বিবাহকালীন স্ত্রীর ইজাব বা সম্পত্তির কোন মূল্যই থাকিতে পারে না বা থাকে না। স্ত্রী সম্মতি যাহা দিল তাহা তাহার পূর্ব-স্বামী লাভের জন্য, হাল স্বামীর জন্য নয়। অর্থাৎ সে জানে যে, তার এই বিবাহ মাত্র একদিনের জন্য এবং এই বিবাহের মাধ্যমেই হইবে তার পূর্ব স্বামী লাভ। তখন সে মনে মনে এই সিদ্ধান্তই করে–