৬। জ্বীন জাতি কোথায়?
শোনা যায় যে, এই জগতে জ্বীন নামক এক জাতীয় জীব আছে। তাহাদের নাকি মানুষের মত জন্ম, মৃত্যু, পাপ-পুণ্য এবং পরকালে স্বর্গ বা নরক বাসের বিধান আছে। কোন জীব যদি পাপ-পুণ্যের অধিকারী হয় তবে সে জাতি যে জ্ঞানবান, তাহা অনুমান করা অসঙ্গত নহে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, অদ্যাবধি পৃথিবীতে জ্বীন জাতির অস্তিত্বের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। ক্যাপ্টেন কুক, ড্রেক, ম্যাগিলন প্রভৃতি ভূ-পর্যটকগণের পর্যটনের ফলে পৃথিবীতে অনাবিষ্কৃত দেশ “নাই” বলিলেই চলে। কিন্তু জ্বীন জাতির অস্তিত্বের সন্ধান মিলিল কৈ? তবে কি তাহারা গ্রহ-উপগ্রহ বা নক্ষত্রলোকে বাস করে?
দশটি গ্রহ এবং তাহাদের গোটা ত্রিশেক উপগ্রহ আছে। খুব শক্তিশালী দূরবীক্ষণের সাহায্যেও ঐ সকল গ্রহ
বা উপগ্রহে কোন রকম জীবের সন্ধান পাওয়া যায় নাই। আর যতদূর জানা গিয়াছে তাহাতে বুঝা যায় যে, নক্ষত্রগুলি সবই অগ্নিময় এবং উহাদের তাপমাত্রা কোনটিরই দুই হাজার ডিগ্রীর কম নয়, কোন কোনটির তেইশ হাজার ডিগ্রীর উপর। ওখানে কোনরূপ জীব বাস করা দূরের কথা, জন্মিতেই পারে না। যদি বা পারে, তাহা হইলে বাসিন্দাদের দেহও হওয়া উচিত অগ্নিময় এবং কেহ কেহ বলেনও তাহাই। বলা হয় যে, জ্বীনগণ আগুনের তৈয়ারী। তাহাই যদি হয়, তবে তাহাদের পরকালে আবার দোযখ বা অগ্নিবাস কিরূপ? পক্ষান্তরে-তাহারা যদি এই পৃথিবীতেই বাস করে, তবে তাহারা কোন (অদৃশ্য) বস্তুর তৈয়ারী?
ইহুদী শাস্ত্রে “শেদিম” নামে একশ্রেণীর কাল্পনিক জীবের বর্ণনা পাওয়া যায়। জ্বীনগণ তাহাদের প্রেতমূর্তি নয় কি?
৭। সূর্য বিহীন দিন কিরূপ?
দিন, রাত, মাস ও বৎসরের নিয়ামক সূর্য এবং গতিশীল পৃথিবী। ইহার কোনটিকে বাদ দিয়া আমরা দিবা, রাত্রি, মাস ও বৎসর কল্পনা করিতে পারি না। কেননা সূর্য থাকিয়াও পৃথিবী বিশেষত তার গতি না থাকিলে পৃথিবীর একাংশে থাকিত চিরকাল দিবা এবং অপর অংশে থাকিত রাত্রি। সেই অফুরন্ত দিন বা রাত্রিতে মাস বা বৎসর চিনিবার কোন উপায় থাকিত না। পক্ষান্তরে সূর্য না থাকিয়া শুধু গতিশীল পৃথিবীটা থাকিলে, সে চিরকাল অন্ধকারেই ঘুরিয়া মরিত, দিন-রাত-মাস-বৎসর কিছুই হইত না।
শোনা যায় যে এস্রাফিল ফেরেস্তা যখন আল্লাহ্র আদেশে সিঙ্গা ফুঁকিবে, তখন মহাপ্রলয় হইবে। তখন পৃথিবী এবং চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ-নক্ষত্রাদি বিলয় হইবে। একমাত্র আল্লাহ ব্যতীত আর কিছুই থাকিবে না। এমন কি যে এস্রাফিল সিঙ্গা ফুঁকিবে সেও না। এহেন অবস্থায় চল্লিশ দিন (মতান্তরে ৪০ বৎসর) পরে আল্লাহ এস্রাফিলকে পুনঃ সৃষ্টি করিবেন এবং আল্লাহর হুকুমে সে পুনরায় সিঙ্গা ফুঁকিবে ফলে পুনরায় জীব ও জগৎ সৃষ্টি হইবে।
মহাপ্রলয়ে (কেয়ামতের) পরে সূর্য বা তদনুরূপ আলোবিকিরণকারী কোন পদার্থই থাকিবে না। এইরূপ অবস্থার পরে এবং পুনঃ সৃষ্টির পূর্বে “চল্লিশ দিন বা বৎসর” হইবে কিরূপে? যদিই বা হয়, তবে ঐ দিনগুলির সহিত রাত্রিও থাকিবে কি? থাকিলে, সূর্য ভিন্ন সেই “দিন” ও “রাত্রি” কিরূপে হইবে? আর দিনের সঙ্গে রাত্রি না থাকিলে, অবিচ্ছিন্ন আলোকিত “দিন”-এর সংখ্যা “চল্লিশ” হইবে কিরূপে?
৮। ফরায়েজে “আউল” কেন?
মৃত ব্যক্তির ত্যাজ্য সম্পত্তি তার ওয়ারিশগণের মধ্যে বণ্টনব্যবস্থাকে বলা হয় “ফরায়েজ নীতি”। ইহা পবিত্র কোরানের বিধান। মুসলিম জগতে এই বিধানটি যেরূপ দৃঢ়ভাবে প্রতিপালিত হইতেছে, সেরূপ অন্য কোনটি নহে। এমনকি পবিত্র নামাযের বিধানও নহে। ইহার কারণ বোধ হয় এই যে, ফরায়েজ বিধানের সঙ্গে জাগতিক স্বার্থ জড়িত আছে। কিন্তু পবিত্র নামাজের সাথে উহা নাই। থাকিলে বোধ হয় যে নামাজীর সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পাইত। সে যাহা হউক, এই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধানটিতেও একটি “আউল” দেখা যায়। এই কথাটির ধাতুগত অর্থ যাহাই হউক, এতদ্দেশে উহাতে মনে করা হয়- “অগোছাল” বা “বিশৃঙ্খল”।
ফরায়েজ বিধানের মধ্যে কোন কোন ক্ষেত্রে এমনও দেখা যায় যে, মৃতের ত্যাজ্য সম্পত্তি তাহার ওয়ারিশগণের মধ্যে নির্ধারিত অংশ মোতাবেক বণ্টন করিলে কেহ পায় এবং কেহ পায় না। উদাহরণ স্বরূপ দেখানো যায় যে, যদি কোন মৃত ব্যক্তির- মা, বাবা, দুই মেয়ে ও স্ত্রী থাকে, তবে- মা ১/৬, বাবা ১/৬, দুই মেয়ে ২/৩ এবং স্ত্রী ১/৮ অংশ পাইবে। কিন্তু ইহা দিলে স্ত্রী কিছুই পায় না। অথচ স্ত্রীকে দিতে গেলে সে পাইবে ১/৮ অংশ। এ ক্ষেত্রে মোট সম্পত্তি “১” এর স্থলে ওয়ারিশগণের অংশে সম্পত্তি হয় ১১/৮। অর্থাৎ ষোল আনার স্থলে হয় আঠার আনা। সমস্যাটি গুরুতর বটে। মুসলিম জগতে উক্ত সমস্যাটি গুরুতর বটে।
মুসলিম জগতে উক্ত সমস্যাটি বহুদিন যাবত অমীমাংসিতই ছিল। অতঃপর সমাধান করিলেন হজরত আলী (রাঃ) (৪০)। তিনি যে নিয়মের দ্বারা উহার সমাধান করিয়ছিলেন, তাহার নাম “আউল”।
হজরত আলী (রাঃ)-এর প্রবর্তিত “আউল” বিধানটি এইরূপঃ মৃত-অনামা ব্যক্তি (ফরায়েজ মতে)।
মা বাবা মেয়ে (২) স্ত্রী
১/৬ ১/৬ ২/৩ ১/৮
প্রথমত, উক্ত রাশি চারিটিকে সমান হর বিশিষ্ট করিতে হইবে এবং তাহা করিলে উহা হইবে
৪/২৪ , ৪/২৪ , ১৬/২৪ ও ৩/২৪ ; ইহার যোগফল হইবে ২৭/২৪। অতএব দেখা যাইতেছে যে, যেখানে মূল সংখ্যা (হর) ছিল ২৪, সেখানে অংশ বাড়িয়া (লব) হইয়া যাইতেছে ২৭। সুতরাং ‘২৭’ কেই মূল সংখ্যা (হর) ধরিয়া অংশ দিতে হইবে। অর্থাৎ দিতে হইবে –
৪/২৭ + ৪/২৭ + ১৬/২৭ + ৩/২৭ = ২৭/২৭ = ১।
পবিত্র কোরানে বর্ণিত আলোচ্য ফরায়েজ বিধানের সমস্যাটি সমাধান করিলেন হজরত আলী (রাঃ) তাঁর গাণিতিক জ্ঞানের দ্বারা এবং মুসলিম জগতে আজও প্রচলিত উহাই। এ ক্ষেত্রে স্বভাবতই মনে উদয় হয় যে, তবে কি আল্লাহ গণিতজ্ঞ নহেন? হইলে পবিত্র কোরানের উক্ত বিধানটি ত্রুটিপূর্ণ কেন?
আল্লাহ পবিত্র কোরানে পরিষ্কার ভাষায় বলিয়াছেন যে, যাহারা আল্লাহর হুকুম পালন করিয়া তাঁর ফরায়েজ আইন মান্য করিবে, তাহারা বেহেস্তী হইবে এবং অমান্যকারীরা হইবে দোজখী। যথা- “ইহা অর্থাৎ এই ফরায়েজ আইন ও নির্ধারিত অংশ আল্লাহর সীমা রেখা এবং আল্লাহর নির্ধারিত অংশসমূহ। যাহারা আল্লাহর আদেশ এবং তাঁহার রছুলের আদেশ মান্য করিবে, তাহাদিগকে আল্লাহ্ বেহেস্তে স্থানদান করিবেন…(৩৮)।
পুনশ্চ- “যে কেহ আল্লাহ্র আদেশ, আল্লাহ্র আইনে নির্ধারিত অংশ ও তাঁহার নির্ধারিত সীমা লঙ্ঘন করিবে, তাহাকে আল্লাহ দোজখবাসী করিবেন, তথায় সে চিরকাল থাকিবে এবং তথায় তাহার ভীষণ অপমানজনক শাস্তিভোগ করিতে হইবে।” (৩৯)
পবিত্র কোরানে বর্ণিত ফরায়েজ বিধানের মধ্যে ক্ষেত্র বিশেষে কতগুলি (হজরত আলীর প্রবর্তিত) “আউল” নীতির পর্যায়ে পড়ে এবং উহাতে কোরান মানিয়া বণ্টন চলে না, আবার “আউল” মানিলে হইতে হয় দোজখী। উপায় কি?
ফরায়েজ বিধানের একশ্রেণীর ওয়ারিশকে বলা হয় “আছাবা”। অর্থাৎ অবশিষ্ট ভাগী। মৃতের ওয়ারিশগণের নির্ধারিত অংশ দেওয়ার পর যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে, তবে তাহা আছাবাগণ পাইয়া থাকে। আছাবাদের মধ্যে অংশ বণ্টনের একটি বিশেষ নিয়ম এই যে, নিকটবর্তী ওয়ারিশ একজনও থাকিলে দূরবর্তী কেহ অংশ পায়না এবং এই নিয়মের ফলেই পুত্র না থাকিলে পৌত্র (নাতি) কিছুই পায় না। কিন্তু অধুনা রাষ্ট্রীয় বিচারগতিগণ পুত্র না থাকিলেও পৌত্রকে অংশ দিতে শুরু করিয়াছেন। যে বিচারপতিগণ উহা করিতেছেন, তাঁহারা পরকালে যাইবেন কোথায়?