৩। হজরত মুসা সীনয় পর্বতে কি দেখিয়াছিলেন?
শোনা যায়- হজরত মূসা মিশর হইতে সদলে বাহির হইবার পর তৃতীয় মাসের প্রথম দিনে সীনয় পর্বতের পাদদেশে উপস্থিত হন এবং তৃতীয় দিন ভোরে ঐ পর্বতের উপরে আল্লাহকে দেখিতে ও তাঁহার বাক্য শুনিতে পান। এই সম্বন্ধে তৌরিতের লিখিত বিবরণটি এইরূপ “পরে তৃতীয় দিন প্রভাত হইলে মেঘ গর্জন ও বিদ্যুৎ এবং পর্বতের উপরে নিবিড় মেঘ হইল; আর অতিশয় উচ্চ রবে তুরীধ্বনি হইতে লাগিল। পরে ম#2507;শি ঈশ্বরের সঙ্গে সাক্ষাৎ কবিরার জন্য লোকদিগকে শিবির হইতে বাহির করিলেন আর তাহারা পর্বতের তলে দণ্ডায়মান হইল। তখন সমস্ত সীনয় পর্বত ধূমময় ছিল। কেননা সদা প্রভু অগ্নিসহ তাহার উপর নামিয়া আসিলেন আর ভাটির ধূমের ন্যায় তাহা হইতে ধূম উঠিতে লাগিল এবং সমস্ত পর্বত অতিশয় কাঁপিতে লাগিল। আর তুরীর শব্দ ক্রমশ অতিশয় বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। তখন মোশি কথা কহিলেন এবং ঈশ্বর বাণী দ্বারা তাঁহাকে উত্তর দিলেন (২৯)।”
উক্ত বিবরণে দেখা যায় যে, ঐদিন ভোরে সীনয় পর্বতে (কোহেতূরে) মেঘ গর্জন, বিদ্যুৎ চমক ও তুরীধ্বনি (শিলা বৃষ্টির সময়ে মেঘস্থিত অবিরাম গর্জন) হইতেছিল এবং মুহুর্মুহু বাক্য শ্রবণ ও তাঁহার নূর (আলো) দর্শন করিয়াছিলেন, এই বলিয়া যে একটি আখ্যান আছে, উহা মেঘ-গর্জন ও বিদুøতালোকে হইতে পারে না কি?
প্রখ্যাত পুরাতত্ত্ববিদ এরিখফল দানিকেনের মতে ইহুদীদের আরাধ্য দেবতা ‘যিহোবা’ নিরাকায় ঈশ্বর নহেন, তিনি ব্যক্তিসত্তার অধিকারী ভিন্ন গ্রহবাসী মানুষ। যিহোবার তূরপর্বতে অবতরণের আখ্যানটি আসলে ভিন্ন গ্রহবাসী কোন বৈমানিকের বিমান যোগে পৃথিবীতে আগমন ও তূরপর্বতে অবতরণ।
মানবরূপী পাহাড়বাসী ‘যিহোবা’ আল্লাহ্তা’লা বলিয়া স্বীকৃতি পান কিরূপে? নতুবা হজরত মূসা (আঃ)-কে ‘কলিমুল্লাহ্’ বলা হয় কেন? [এই পঙতিটি রচনাবলীতে নেই]
৪। হযতর সোলায়মানের হেকমত না কেয়ামত?
শোনা যায় যে, হজরত সোলায়মান একাধারে বাদশাহ্ এবং পয়গম্বর ছিলেন। পয়গম্বর হিসাবে তাঁর প্রসিদ্ধি বোধ হয় খুব বেশী ছিল না। কিন্তু ‘বাদশাহ’ বিশাল সাম্রাজ্য, বিভিন্ন জাতির উপর একাধিপত্য ও তাঁর বিপুল ঐশ্বর্যের বিষয় পর্যালোচনা করিলে মনে হয় যে, তিনি সেই যুগের একজন প্রথম শ্রেণীর সম্রাট ছিলেন। সবচেয়ে বিস্ময়কর ছিল তাঁর সুতীক্ষ্ণ বুদ্ধি।
কোন কোন ধর্ম প্রচারক বলিয়া থাকেন যে, হজরত সোলায়মান-পশু-পাখী, কীট-পতঙ্গ এমনকি পিপীলিকারও ভাষা জানিতেন এবং উহারা তাঁর আদেশ মানিয়া চলিত; জ্বীন-পরী, দেও-দানব এমনকি পবনও। অধিকন্তু তিনি হাওয়ায় উড়িতে পারিতেন।
হজরত সোলায়মান ইতর প্রাণীর ভাষা জানিতেন কি না এবং জ্বীন-পরীরা তাঁর আজ্ঞাবহ ছিল কি না, তাহা
প্রশ্ন নহে। এখানে প্রশ্ন হইল এই যে, তিনি যে হাওয়ায় উড়িতে পারিতেন বলিয়া দাবী করা হয়, তাহা কি তাঁর হেকমত, না কেরামত। অর্থাৎ তিনি কি কোন কৌশলে উড়িতেন, না আল্লাহ্র কৃপায় উড়িতেন? যদি তিনি আল্লাহ্র দয়ায়ই উড়িয়া থাকেন, তাহা হইলে লক্ষাধিক পয়গম্বরের মধ্যে অপর কেউ উড়িতে পারিলেন না কেন? তাঁহাদের প্রতি কি আল্লাহ্র ঐরূপ অনুগ্রহ ছিল না?
লঙ্কেশ্বর রাবণের পুত্র মেঘনাদ (ইন্দ্রজিৎ)-এর শূন্যে উড়িবারও একটি প্রবাদ আছে। তিনি নাকি ছিলেন অসভ্য রাক্ষস জাতি এবং নানা দেব-দেবীর উপাসক। তিনি যে কোন কৌশলে উড়িতেন তাহা বলা যায় না এবং তিনি যে আল্লাহ্র রহমতে উড়িতেন, তাহাও কল্পনা করা যায় না। তবে তাঁর বিমানে (রথে) আরোহণ সম্ভব হইল কিরূপে? উহা কি রামায়ণের কবি বাল্মিকীর কল্পনা মাত্র? তাহাই যদি হয়, তবে সোলায়মানের বেলায় ঐরূপ হইত পারে কি না?
ভগবানের দয়া অথবা জ্ঞানের ক্রিয়া, যাহাই হউক, হজরত সোলায়মানের বিমানে আরোহণ যে সত্য, তার প্রমাণ কি? তিনি কি শুধু স্বদেশেই উড়িতেন?
আধুনিক বিজ্ঞানীগণ বিদ্যুৎ ও পেট্রোল খরচ এবং নানারূপ দুর্ঘটনার (Accident) ভয়কে উপেক্ষা করিয়া সারে জাহান সফর করেন। হজরত সোলায়মান কি বিনা খরচে বিঘ্নহীন বিমানে আরোহণ করিয়াও দেশান্তর গমন করেন নাই? যদি করিয়াই থাকেন তাহা হইলে তৎকালের কোন সভ্য দেশের ইতিহাসের উহা লিপিবদ্ধ নাই কেন? চীনদেশ না হয় একটু দূরেই ছিল, গ্রীক বা মিশর দেশে কি তিনি কখনও যান নাই? অথবা সে দেশের ঐ যুগের কোন ঐতিহাসিক ঘটনা বর্তমানে জানা যায় না কি?
হজরত সোলায়মান সিংহাসন লাভ করেন খৃঃ পূঃ ৯৭১ সালে (৩০) এবং মহাবীর আলেকজান্ডার ভারতে আসেন খৃঃ পূঃ ৩৩০, সময়ের ব্যবধান মাত্র ৬৪১ বৎসর। ভারতবর্ষ হইতে গ্রীসের দূরত্ব, হজরত সোলায়মানের বাসস্থান জেরুজালেমের দূরত্ব হইতে প্রায় ৭/৮ শত মাইল অধিক। তথাপি গ্রীকাধিপতি আলেকজান্ডার হাঁটিয়াই ভারতে আসিয়াছিলেন। আর হজরত সোলায়মান কি উড়িয়াও এ দেশে আসিতে পারিলেন না? যদি আসিয়াই থাকিতেন, তাহা হইলে- আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের ঘটনা যখন এদেশের ঐতিহাসিকগণ ভুলিতে পারিলেন না তখন হজরত সোলায়মানের ভারতে আগমনের বিষয় ভুলিলেন কিরূপে?
৫। যীশু খ্রীষ্টের পিতা কে?
‘পিতা’ এই শব্দটিতে সাধারণত আমরা জন্মদাতাকেই বুঝিয়া থাকি, অর্থাৎ সন্তান যাহার ঔরসজাত তাহাকেই। কিন্তু উহার কতিপয় ভাবার্থও আছে। যেমন- শাস্ত্রীয় মতে পিতা পাঁচজন। যথা- অন্নদাতা, ভয়দাতা, শ্বশুর, জন্মদাতা ও উপনেতা। কেহ কেহ আবার জ্ঞানদাতা অর্থাৎ শিক্ষা-গুরু এবং জ্যেষ্ঠভ্রাতাকেও পিতৃতুল্য বলিয়া মনে করেন। এ মতে পিতা সাতজন (৩১) ।
শোনা যায় যে, যীশুখ্রীষ্ট (হজরত ঈসা আঃ) অবিবাহিতা মরিয়মের গর্ভে জন্মলাভ করিয়াছিলেন। তাঁহার কেহ পিতা নাই, তিনি ঈশ্বরের পুত্র? কিন্তু তিনি কি ভগবানের ঔরসে ভগবতীর গর্ভজাত গণেশের ন্যায় পুত্র? সেমিটিক জাতির প্রত্যেকেই ইহাতে বলিবেন “না”। তবে তিনি ঈশ্বরের কোন শ্রেণীর পুত্র? “সৃষ্টিকর্তা” বলিয়া যদি পরমেশ্বরকে “পিতা” বলা যায়, তবে তিনি তাঁর সৃষ্ট সকল জীবেরই পিতা, যীশুর একার নয়। মহাপ্রভুর দয়া-মায়া, ভালবাসা ইত্যাদি এমন কোন বিষয় আছে, যাহা অন্য আম্বিয়াদের প্রতি ছিল না, যদ্বারা যীশু একাই মহাপ্রভুর পুত্রত্ব দাবী করিতে পারেন? মহাপ্রভু নাকি হজরত মূসাকে সাক্ষাৎদান ও তাঁর সাথে বাক্যালাপ করিয়াছিলেন, হজরত সোলায়মানকে হাওয়ায় উড়াইয়াছিলেন এবং হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-কে মে’রাজে নিয়া তাহার সহিত নানাবিধ কথোপকথন করিয়াছিলেন। ইহারা কেহই মহাপ্রভুর পুত্র নহেন কেন? পক্ষান্তরে- তৎকালীন ইহুদীগণ রাষ্ট্র ও ধর্মদ্রোহিতার অপরাধে যীশুখ্রীষ্টকে ক্রুশে আরোহণ করাইয়া তাঁর হস্ত ও পদে পেরেক বিদ্ধ করিয়া যখন অন্যায় ও নিমর্মভাবে হত্যা করিল তখন তাঁর পিতা ন্যায়বান পুত্রের পক্ষে একটি কথাও বলিলেন না বা তাঁহাকে উদ্ধারের কোন ব্যবস্থা করিলেন না। কোন পিতা তার পুত্রহত্যা দর্শনে নীরব ও নির্বিকার থাকিতে পারেন, এরূপ দৃষ্টান্ত কোথায়ও আছে কি?
হয়ত কেহ বলিতে পারেন যে, খোদাতায়ালা ফেরেস্তার মারফতে বিবি মরিয়মের প্রতি তাঁর ‘বাণী’ পাঠাইয়াছিলেন এবং সেই বাণীর বদৌলতেই তাঁর গর্ভ হইয়াছিল এবং তাহাতে যীশু জন্মিয়াছিলেন। তাই তিনি খোদার পুত্র বলিয়া আখ্যায়িত। তাই যদি হয়, তবে- হজরত জাকারিয়া নবীর স্ত্রী ইলীশাবেত চিরবন্ধ্যা হেতু কোন সন্তানাদি না হওয়ার বৃদ্ধা বয়সে ফেরেস্তার মারফতে খোদাতা’লার ‘বাণী’ প্রাপ্তে তাঁর নাকি গর্ভ হইয়াছিল এবং সেই গর্ভে হজরত ইয়াহিয়া নবী জন্মলাভ করিয়াছিলেন। তিনি খোদার পুত্র নহেন কেন?
বিজ্ঞানীদের মতে- পুরুষের প্রধান জননেন্দ্রিয় শুক্রাশয় (Testes)। উহার ভিতর এক শ্রেণীর কোষ (Cell) আছে, তাহাকে বলা হয় শুক্রকীট। সেগুলি দেখিতে ব্যাঙাচির মত। কিন্তু এত ছোট যে, অনুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া তাহাদের লেখা যায় না। ইহারা শুক্রাশয়ের ভিতরে যথেচ্ছ সাঁতরাইয়া বেড়ায়।
শুক্রাশয়ের সাথে দুইটি সরু নল দিয়া মূত্র নলির যোগ আছে। সঙ্গমের সময় শুক্রকীটগুলি ঐ নল বাহিয়া মূত্র নলির ভিতর দিয়া স্ত্রী অঙ্গে প্রবেশ করিতে পারে।
মেয়েদের প্রধান জননেন্দ্রিয় ডিম্বাধার (Overiss)। ইহা তলপেটের ভিতর ছোট দুইটি গ্ল্যান্ড। ইহার সহিত সরু নলের দ্বারা জরায়ুর যোগ আছে। ডিম্বাধারের ভিতর ডিম্বকোষ প্রস্তুত হয়। ডিম্বাধারের ভিতর ডিম্বকোষ প্রস্তুত হইয়া পূর্ণতালাভ করিলেই উহা নলের ভিতর দিয়া জরায়ুতে নামিয়া আসে।
স্ত্রী-পুরুষের মিলনের সময়ে- পুরুষের বীর্যের সহিত শুক্রকীট স্ত্রী-অঙ্গ দিয়া প্রবেশ করিয়া জরায়ুর ভিতর ঢোকে। সেখানে স্ত্রীর ডিম্বকোষ তৈয়ারী থাকে শুক্রকীটের আগমনের অপেক্ষায়। শুক্রকীটগুলি জরায়ুতে প্রবেশ করিয়াই লেজ নাড়িয়া (ব্যাঙাচির মত ইহাদের লেজ থাকে) সাঁতার কাটিয়া ডিম্বকোষের দিকে ছুটিয়া আসে। উহাদের মধ্যে মাত্র একটিই ডিম্বকোষের ভিতর ঢুকিতে পারে। কেননা একটি ঢোকা মাত্রই ডিম্বকোষের বাহিরের পর্দায় এমন পরিবর্তন ঘটে যে, অন্য কোন শুক্রকীট আর ঢুকিতে পারে না। ডিম্বকোষের মধ্যে ঢুকিবার সময় শুক্রকীটের লেজটি খসিয়া বাহিরে থাকিয়া যায়।
মানুষের বেলায় সচরাচর প্রতি মাসে নির্দিষ্ট দিনে একটি করিয়া ডিম্বকোষে স্ত্রীলোকের ডিম্বাধারে প্রস্তুত হইয়া থাকে। কোন জন্তুর তিন মাষ, কোন জন্তুর ছয় মাস, কাহারো বা বৎসরান্তে একবার ডিম্বকোষ জন্মে। যদি সেই সময় শুক্রকীটের সঙ্গে উহার মিলন না হয়, তবে দুই চারদিনের মধ্যেই ডিম্বকোষটি শুকাইয়া মরিয়া যায়। আবার যথা সময়ে (ঋতুতে) আর একটি প্রস্তুত হয়।
শুক্রকীট ও ডিম্বকোষের মিলন হইলে- মিলনের পরমুহূর্ত হইতে ডিম্বকোষের মধ্যে আশ্চর্য পরিবর্তন ঘটিতে থাকে। ডিম্বকোষের মধ্যে ঢুকিবার পর শুক্রকীটের কোষকেন্দ্র আরও বড় হইতে থাকে এবং খানিকটা বড় হইয়া ডিম্বকোষের কোষকেন্দ্রের সঙ্গে একেবারে মিশিয়া যায়। নানা বৈচিত্র্যময় পরিবর্তনের পর আরম্ভ হয় বিভাজন। একটা হইতে দুইটা, হইতে চারিটা এবং তাহা হইতে আটটা, এইভাবে ক্রমাগত বৃদ্ধি পাইয়া তিন সপ্তাহের মধ্যে ডিম্বকোষ সমূহ সংখ্যায় বাড়িয়া গিয়া আয়তনে এত বড় হয় যে, তখন তাহাকে ‘ভ্রূণ’ বলিয়া চেনা যায়। মানুষের বেলায় শরীরের সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে ফুটিয়া উঠে। কিন্তু তখনও উহা ১/৫ ইঞ্চির বেশী বড় হয় না। দুই মাস পরে পুরা এক ইঞ্চি হয় এবং তখন হইতে উহাকে ‘মানুষের ভ্রূণ’ বলিয়া চেনা যায়। পুরাপুরি শিশুর মত হইতে সময় লাগে আরও সাত মাস, নুন্যাধিক নয় মাস পর জরায়ু মাতৃজঠর ত্যাগ করিয়া ভূমিষ্ঠ হয় ‘মানব শিশু’।
নারী ও পুরুষের মিলনের অর্থই হইল- শুক্রকীট ও ডিম্বকোষের মিলন সাধন। নারী ও পুরুষের প্রতিক্রিয়া ব্যতীত শুক্র ও ডিম্বকোষের মিলন সম্ভব হইতে পারে। কোন পুরুষের বীর্য সংগ্রহ পূর্বক তাহা যথা সময়ে কোন কৌশলে নারীর জরায়ুর মধ্যে প্রবেশ করাইয়া শুক্রকীট ও ডিম্বকোষের মিলন ঘটাইতে পারা যায় এবং তাহাতে সন্তানোৎপত্তি হইতে পারে। কিন্তু কোনও না কোন প্রকারের যৌনমিলন ব্যতীত সন্তানোৎপত্তি হওয়া সম্পূর্ণ অসম্ভব।
সমাজ বিজ্ঞানীগণ বলেন যে, সভ্যতা প্রাপ্তির পূর্বে মানুষ ও পশু-পাখীর আহার-বিহার, চাল-চলন ইত্যাদিতে বিশেষ পার্থক্য ছিল না, এমনকি যৌন ব্যাপারেও না। তখন তাহাদের যৌন মিলন ছিল পশু-পাখীদের মতই যথেচ্ছ। কেননা তাহাদের মধ্যে বিবাহ প্রথা ছিল না। সেকালের অসভ্য মানবসমাজে কাহারো জনক নির্ণয় করা ছিল প্রায় দুঃসাধ্য। মানব সভ্যতার ক্রমবৃদ্ধির একটি মস্ত বড় ধাপ হইল বিবাহ প্রথার প্রবর্তন। ইহাতে মানুষের জনক নির্ণয় সাধ্যায়ত্ত হইয়াছে বটে, কিন্তু পূর্ণায়ত্ত হইয়াছে কি? এ কথা বলিলে হয়ত অসত্য বলা হইবে না যে, সামাজিক তথা আনুষ্ঠানিক পরিণয়াবদ্ধ স্বামী বর্তমান থাকিতে উপস্বামীকে ধারণ সভ্য মানব সমাজে বিরল নয়। এইরূপ ক্ষেত্রে কোন সন্তান জন্মিলে প্রায় সর্বত্র বিবাহিত স্বামীকেই বলা হয় শিশুর পিতা এবং মনে করা হয় “জনক” (স্মরণ রাখা উচিত যে, “পিতা ও জনক” এক কথা নয়। “পিতা” = পালন কর্তা এবং “জনক” = জন্মদাতা)। এহেন অবস্থায় শিশুর জনক চিরকাল অপ্রকাশ্যই থাকিয়া যায়। কিন্তু জাতকের দৈহিক অবয়ব, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, রুচি, ধর্মাধর্ম বা বিষয় বিশেষের প্রতি অনুরাগ-বিরাগ ইত্যাদি বিষয় সমূহে জনকের সহিত বহু সাদৃশ্য থাকে। কিন্তু উহা কেহ তলাইয়া দেখে না বা সকল ক্ষেত্রে দেখা সম্ভব নয়।
যীশুখ্রীষ্টের আবির্ভাবের সময় সখরিয়া (হজরত জাকারিয়া আঃ) নামক জনৈক ব্যক্তি ছিলেন ইহুদীদের ধর্মযাজক ও জেরুজালেম মন্দিরের সোবাইত বা পুরোহিত। শোনা যায় যে, যীশুর মাতা মরিয়মকে তাঁর পিতা এমরান মরিয়মের তিন বৎসর সময় জেরুজালেম মন্দিরের সেবা কাজের জন্য প্রেরণ করেন এবং সেখানে তিনি সখরিয়া কর্তৃক পালিতা হন (৩২)। সখরিয়ার কোন সন্তান ছিল না, তাঁর ঘরে ছিলেন অতিবৃদ্ধ বন্ধ্যা স্ত্রী ইলীশাবেত (৩৩)।
সখরিয়া তাঁর ১২০ বৎসর বয়সের সময় ফেরেস্তার মারফতে পুত্রবর প্রাপ্ত হন ও তাহাতে ইলীশাবেত গর্ভবতী হন এবং ইহার ছয় মাস পরে ফেরেস্তার মারফতে পুত্রবর প্রাপ্ত হইয়া ১৬ বৎসর বয়সে মরিয়মও গর্ভবতী হন।
অবিবাহিতা মরিয়ম সখরিয়ার আশ্রমে থাকিয়া গর্ভবতী হইলে লোক লজ্জার ভয়ে ধর্মমন্দির ত্যাগ করিয়া নিজ জ্ঞাতি ভ্রাতা যোসেপের সঙ্গে জেরুজালেমের নিকটবর্তী বৈৎলেহম (বয়তুলহাম) নামক স্থানে গিয়া অবস্থান করেন এবং ঐ স্থানে যথা সময়ে এক খর্জুর বৃক্ষের ছায়ায় যীশুখ্রীষ্ট ভূমিষ্ট হন।
অবিবাহিতা মরিয়ম এক পুত্রসন্তান প্রসব করিয়াছেন ইহা জানিতে পারিয়া (মরিয়ম ও সখরিয়ার
স্বজাতীয়) ইহুদীগণ তাঁহাকে তীব্র ভৎর্সনা করিতে থাকে এবং তাহারা মরিয়মের পালন পিতা সুবৃদ্ধ সখরিয়াকে ধৃত করিবার চেষ্টা করে এবং সখরিয়া এক বৃক্ষ কোটরে লুকাইয়া থাকেন। কিন্তু ইহুদীগণ খোঁজ পাইয়া করাত দ্বারা ঐ বৃক্ষটি ছেদন করার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধ সখরিয়া দ্বিখণ্ডিত হইয়া প্রাণ ত্যাগ করেন (৩৪)। মরিয়ম সদ্যজাত শিশুটিকে ক্রোড়ে লইয়া যোসেফের সঙ্গে রাত্রিযোগে স্বদেশ ত্যাগ করিয়া মিশরে চলিয়া যান এবং সেখান হইতে গালীর প্রদেশের নাসরৎ নগরে যাইয়া কালাতিপাত করেন (৩৫)।
তৎকালে সে দেশের রাজার নাম ছিল হেরোদ, তিনি জাতিতে ছিলেন ইহুদী। তাই রাজ্য শাসিত হইত তৌরিতের বিধান মতে। তৌরিতের বিধান মতে- “ব্যভিচার” ও “নরহত্যা” এই উভয়বিধ অপরাধেরই একমাত্র শাস্তি “প্রাণদণ্ড” (৩৬)। এখানে ব্যভিচারের অপরাধে সখরিয়ার প্রাণদণ্ডের বিষয় জানা যায় বটে কিন্তু সখরিয়াকে বধ করার অপরাধে কোন ইহুদীর প্রাণদণ্ডের বিষয় জানা যায় না। ইহাতে মনে আসিতে পারে যে, সখরিয়া নিরপরাধ হইলে, তাঁহাকে বধ করার অপরাধে নিশ্চয় ঘাতক ইহুদীর প্রাণদণ্ড হইত। কেননা সখরিয়া ছিলেন তৎকালীন ইহুদী সমাজের একজন উচ্চস্তরের ব্যক্তিত্বশালী ও মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি।
এতদ্বিষয়ে পর্যালোচনা করিলে মনে স্বতঃই প্রশ্ন জাগে যে, যীশুখ্রীষ্টের জনক- মহাপ্রভু, না সখরিয়া?
(যীশুর প্রসঙ্গে হিন্দু শাস্ত্রে লিখিত মহর্ষি পরাশরের ঔরসে অবিবাহিতা মৎস্যগন্ধার গর্ভজাত মহামনীষী ব্যাসের কাহিনী অনুধাবন যোগ্য। তবে উহাতে পরাশরের বিকল্পে স্বর্গদূতের পরিকল্পনা নাই।)