২। নীল নদের জল শুকাইল কেন?
কেহ কেহ বলেন যে, ফেরাউনের দাসত্বমুক্ত হইয়া বনিইস্রায়েলগণ মিশর দেশ ত্যাগ করিয়া স্বদেশ (কেনান দেশে) আসিবার সময় নীল নদী পার হইয়াছিলেন। কিন্তু বাস্তবিক তাহা নহে। বনিইস্রায়েলগণ মিশরের যে অঞ্চলে বাস করিতেন, তাহার নাম ‘গোশন’ বা ‘রামিষেষ’ প্রদেশ। নীল নদী ইহার পশ্চিমে অবস্থিত। কাজেই ওখান হইতে কেনান দেশে (পূর্বদিকে) আসিতে হইলে নীল নদী পার হইতে হয় না, পার হইতে হয়- লোহিত সাগর বা সুয়েজ উপসাগর অথবা মোররাত বা তিমছাহ্ হৃদ। তৌরিতে বলা হইয়াছে-সুপ সাগর।
ধর্মযাজকগণ বলেন যে খোদাতা’লার হুকুমে হজরত মুসা তাঁর হাতের (লাঠি) দ্বারা জলের উপর আঘাত করিতেই নদীর এপার হইতে ওপার পর্যন্ত একটা (মতান্তরে বারটি) রাস্তা হইয়া গেল এবং রাস্তার উভয় পার্শ্বে প্রাচীরের আকারে জলরাশি দাঁড়াইয়া রহিল। জলধির তলদেশ দিয়া শুকনা পথে বনি ইস্রায়েলগণ এপারে আসিলে ফেরাউন সসৈন্যে ঐ পথ দিয়া বনিইস্রায়েলগণের পশ্চাদ্ধাবন করিল। ফেরাউন ঐ পথের মধ্যভাগে আসিলে হঠাৎ জল প্রাচীর ভাঙ্গিয়া পড়িল এর ফেরাউন সদলে ডুবিয়া মরিল।
আবার কেহ কেহ বলিয়া থাকেন যে, বনি ইস্রায়েলদের বারোটি বংশ বা দলের জন্য বারোটি ভিন্ন ভিন্ন রাস্তা হইয়াছিল এবং প্রত্যেক রাস্তার মাঝখানে জলের প্রাচীর ছিল। ঐ সকল রাস্তায় চলিবার কালে এক দলের লোক অন্য দলের লোককে দেখিতে না পাইয়া উদ্বিগ্ন হইলে ঐ সকল প্রাচীরের গায়ে জানালা এবং খিড়কীও হইয়াছিল।
বলা হইয়া থাকে যে, আল্লাহ্ হায়াত, মউত, রেজেক ও দৌলত এই চারিটি বিষয় ভিন্ন আর সমস্ত কাজের ক্ষমতাই মানুষকে দান করিয়াছেন। আল্লাহ মানুষকে শিখাইয়াছেন- রেল, স্টিমার, হাওয়াই জাহাজ, ডুবো জাহাজ ও রকেট তৈয়ারী করিতে; তিনি শিখাইয়াছেন- টেলিগ্রাফ, টেলিফোন, রেডিও ও টেলিভিশন তৈয়ার করিতে এবং আরও কত কিছু। কিন্তু এই পারমাণবিক যুগের কোন মানুষকে আজ পর্যন্ত আল্লাহ জলের দ্বারা (বরফের নহে)- প্রাচীর, জানালা, খিড়কী-কবাট ইত্যাদি তৈয়ার করা শিক্ষা দিলেন না কেন?
কিছুটা অপ্রাসঙ্গিক হইলেও এখানে আর একটি বিষয়ের অবতারণা করিতেছি। ধর্মযাজকদের কথিত- জলের প্রাচীর ও খিড়কী-কবাটাদির আখ্যান কতটুকু সত্য তাহা জানি না; কিন্তু “ফেরাউন”-এর মৃত্যুটা সম্পূর্ণ সত্য নহে। অনেকে মনে করেন যে, “ফেরাউন” কোন বিশেষ ব্যক্তির নাম এবং সে হাজার বৎসর জীবিত ছিল। আসলে “ফেরাউন” কোন ব্যক্তি বিশেষের নাম নয় এবং হাজার বছর বাঁচিয়াও ছিল না। সেকালের মিশরাধিপতিদের উপাধি ছিল “ফেরাউন”। ফেরাউনদের মধ্যে কেহ কেহ দুর্দান্ত ছিল বটে, কিন্তু কেহ কেহ ছিলেন গুণী, জ্ঞানী ও মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী। হজরত মূসার আমলে মিশরের ফেরাউন বা সম্রাট ছিলেন প্রথম “সেটি”র পুত্র দ্বিতীয় “রেমেসিস”। হজরত মূসার জন্মের আগের বৎসর খৃষ্টপূর্ব ১৩৫২ সালে তিনি সিংহাসন লাভ করেন এবং ৬৭ বৎসর রাজত্ব করিয়া খৃষ্টপূর্ব ১২৮৫ সালে জলামগ্ন হইয়া প্রাণ ত্যাগ করেন (২৪)। ফেরাউন দ্বিতীয় রেমেসিস হাজার বৎসর জীবিত ছিলেন না। তবে তাঁর- “ফেরাউন”, এই উপাধিটা জীবিত থাকিতে পারে।
শোনা যায় যে, মিশরে ইস্রায়েল বংশের প্রতিষ্ঠাতা হজরত ইউসুফকে কূপ হইতে তুলিয়া লইয়া বণিকগণ কেনান দেশ হইতে মিশরে নিয়া বিক্রয় করিয়াছিল। হজরত ইউসুফের ভাইগণ কেনানে দুর্ভিক্ষের সময় স্বদেশ হইতে মিশরে যাইয়া একাধিক বার খাদ্যশস্য আনিয়াছিলেন এবং শেষবারে হজরত ইয়াকুব নবীকে সঙ্গে লইয়া সপরিবারে কেনান দেশ হইতে মিশরে যাইয়া সেখানে তাঁহারা স্থায়ীভাবে বসবাস করিয়াছিলেন। উহাতে তাঁহারা কেহ কখনও নদী বা সাগরে বাধা পান নাই। কিন্তু হজরত মূসা বাধা পাইলেন কেন?
বলা যাইতে পারে যে, পূর্ববর্তী মিশর ভ্রমণকারী কেনানীয়রা যে পথে মিশরে যাতায়াত করিতেন, হজরত
মূসা “পলাতক” বলিয়া সেপথে না চলিয়া শত্রুর অনুগমন ব্যর্থ করিবার জন্য বাঁকা পথে চলিয়া লোহিত সাগর বা সুয়েজ উপসাগর পার হইয়া সীসনয় বা তূর পর্বতে পৌঁছিয়াছিলেন।
বনি ইস্রায়েলগণের মিশর ত্যাগ করাটাকে কেহ কেহ ‘পলায়ন’ বলিয়া থাকেন। কিন্তু আসলে উহা পলায়ন বা গোপন ব্যাপার ছিল না। হজরত মূসার অভিশাপে নাকি ফেরাউন ও তাঁর জাতির উপর ভয়ানক গজব নাজেল হইয়াছিল। সেই গজবে অতিষ্ঠ হইয়া ফেরাউন বনি ইস্রায়েলগণকে তাঁহাদের স্বদেশে যাইতে অনুমতি দিয়াছিলেন। বিশেষত বিশাল পশুপাল ও যাবতীয় মালামালসহ বনি ইস্রায়েলদের যে সুপাবিশাল বাহিনী সংগঠিত হইয়াছিল তাহাতে নারী ও শিশু ছাড়া শুধু পুরুষের সংখ্যাই ছিল ছয় লক্ষ (২৫)। এত লোকের রাষ্ট্রত্যাগ করার ঘটনাকে পলায়ন বা গোপন ব্যাপার বলা যায় কিরূপে? হজরত মূসার মিশর ত্যাগ সম্বন্ধে তৌরিত কেতাবে নিম্নলিখিত বিবরণ পাওয়া যায়। যথা- “তখন রাত্রিকালেই ফরৌণ মোশি ও হারোনকে ডাকাইয়া বলিলেন, তোমরা উঠ, ইস্রায়েলদিগকে লইয়া আর প্রজাদের মধ্য হইতে বাহির হও, তোমাদের কথানুসারে মেষপাল ও গো-পাল সঙ্গে লইয়া চলিয়া যাও এবং আমাকেও আর্শীবাদ কর। ..আর সদাপ্রভু মিশ্রীয়দের দৃষ্টিতে তাহাদিগকে (বনি ইস্রায়েলগণকে) অনুগ্রহ পাত্র করিলেন, তাই তাহারা যাহা চাহিল মিশ্রীয়রা তাহাদিগকে তাহাই দিল। এইরূপে তাহারা মিশ্রীয়দের ধন হরণ করিল (২৬)।”
উক্ত বিবরণে দেখা যায়, তখন ফেরাউন ও মিশরবাসীগণ সরল মনেই বনি ইস্রায়েলগণকে মিশর ত্যাগ করিতে আদেশ দিয়েছিলেন। তাঁহারা তখন ভাবিতেছিলেন যে, বনি ইস্রায়েলগণ তাঁহাদের দেশের আপদস্বরূপ, উহাদিগকে দেশ হইতে তাড়াইতে পারিলেই তাঁহারা নিরাপদ হইবে। তাই তাঁহারা বিস্তর ধনরত্ন দিয়াও বনি ইস্রায়েলগণকে তাঁহাদের স্বদেশে যাইবার সাহায্য করিয়াছিলেন। অবশ্য মিশরীয়দের এই মনোভাবের পরিবর্তন হইয়াছিল, কিন্তু তাহা অনেক পরে। পুনঃ বনি ইস্রায়েলগণকে আটক করিবার ইচ্ছা ফেরাউনের যখন হইয়াছিল, তখন পর্যন্ত বনি ইস্রায়েলগণ মিশর অতিক্রম করিয়া “পীহহীরোত” নামক স্থানের নিকট সমুদ্রতীরে শিবির স্থাপনান্তে বিশ্রাম করিতেছিলেন। এমতাবস্থা হজরত মূসা নিশিন্ত মনে সহজ ও সরলপথে পূর্বদিকে (স্বদেশের দিকে) না চলিয়া, বাঁকা পথ ধরিয়া প্রায় দুইশত মাইল দক্ষিণে যাইয়া লোহিত সাগর পাড়ি দেওয়ার হেতু কি?
কেহ কেহ বলেন যে, হজরত মূসা যে জলাশয় পার হইয়াছিলেন, পূর্বে উহা ভূমধ্যসাগরের সাথে যুক্ত ছিল এবং উহার গভীরতা ছিল নিতান্ত কম। উহা ভূমধ্যসাগরের পূর্বাংশে অবস্থিত ছিল বলিয়া পূর্বীয় বায়ু প্রবাহের দরুন ভূমধ্যসাগরের পূর্বাংশের জল হ্রাস হইলে উহা সম্পূর্ণ শুকাইয়া যাইত এবং ঐ বায়ুপ্রবাহ বন্ধ হইলে পুনরায় উহা জলপূর্ণ হইত। যেমন- আমাদের বাংলাদেশের দক্ষিণ বায়ুপ্রবাহে জল কমিয়া যায়। ইহার ফলে নদী ও উপকূল-ভাগের অগভীর স্থান শুকাইয়া যায়। এই মতের অনুকূলে তৌরিত গ্রন্থে একটি বিবরণ পাওয়া যায়। বিবরণটি এইরূপ- “তাহাতে সদা প্রভু সেই সমস্ত রাত্রি পূর্বীয় বায়ু দ্বারা সমুদ্রকে সরাইয়া দিলেন ও তাহা বিশুষ্ক করিলেন। তাহাতে জল (গভীর ও অগভীর) দুই ভাগ হইল আর ইস্রায়েল সন্তানেরা শুষ্ক পথে সমুদ্র মধ্যে প্রবেশ করিলে (২৭)।”
উক্ত বিবরণে দেখা যায় যে, ঐ তারিখে সমস্ত রাত্রি পূর্বদিকে হইতে বায়ু প্রবাহিত হইয়াছিল। অর্থাৎ প্রায় বার ঘণ্টা স্থায়ী বন্যা হইয়াছিল। কাজেই অগভীর জলাশয়টি শুকাইয়া যাওয়ায় বনিইস্রায়েলগণ প্রায় শুকনা পথেই উহা পার হইয়াছিলেন। উহাদের পথানুসরণ করিয়া ফেরাউন যখন ঐ জলাশয়ের মধ্যভাগে আসিলেন, তখন রাত্রি শেষ হইয়াছিল এবং বন্যাও থামিয়াছিল। কাজেই তখন অতি দ্রুত ভূমধ্যসাগরের জল আসিয়া ফেরাউনকে ডুবাইয়া মারিল। যেহেতু পূর্বীয় বায়ু কেবলমাত্র রাত্রেই প্রবাহিত হইয়াছিল এবং ভোরে উহা থামিয়াছিল। এই মর্মে তৌরিতের অন্যত্র লিখিত আছে “তখন মোশি (মুসা) সমুদ্রের উপর হস্ত বিস্তার করিলেন, আর প্রাতঃকাল হইতে না হইতে সমুদ্র সমান হইয়া গেল। তাহাতে মিশ্রীয়েরা তাহার দিকেই পলায়ন করিল, আর সদা প্রভু সমুদ্রের মধ্যে মিশ্রীয়দিগকে ঠেলিয়া দিলেন (২৮)।”
অধুনা কোন কোন গবেষক বলেন যে, হজরত মূসা ‘তিমছাহ্ হ্রদ’ পার হইয়াছিলেন। তখন উহাতে জোয়ার-ভাটা হইত। হ্রদ বা সমুদ্রোপকূলের জোয়ার-ভাটা এক আশ্চর্য ব্যাপার। আমাদের বঙ্গোপসাগরের উপকূলে এরূপ দৃশ্য হয়ত কেহ কেহ দেখিয়া থাকিবেন। উহাকে ‘সরডাকা’ বা ‘বানডাকা’ বলে।
ভাটার শেষে যেখানে শুকনা ভূমি দেখা যায়, জোয়ার হওয়া মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে সেখানে হয় অথৈ জল। ঐ জল এত দ্রুত বেগে আসিয়া থাকে যে, পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকিলে, ওখানে যাইয়া কেহই বাঁচিতে পারে না। এমন কি সময় সময় অভিজ্ঞ লোকও মারা পড়ে।
ঐরূপ জলাশয় পার হইবার বিপদ ও উপায় অর্থাৎ জোয়ার ও ভাটা সম্বন্ধে বনিইস্রায়েলগণ বোধ হয় পূর্বেই জ্ঞাত ছিলেন। হয়ত তাঁহারা জানিতেন যে ভাটার প্রথমাবস্থায় ওপার হইতে যাত্রা না করিলে জোয়ারের পূর্বে এপারে পৌঁছিতে পারা যায় না। তাই ভাটার প্রথমবস্থায় হ্রদে কিছু জল থাকিতেই হজরত মুসা তার হাতের আশা দ্বারা (অন্ধের পথ চলিবার মত) অগভীর স্থান নির্ণয় পূর্বক সদলে হ্রদ পাড়ি দিয়াছিলেন। ফেরাউনের তখন একমাত্র লক্ষ্য বনিইস্রায়েলগণকে আক্রমণ ও ধৃত করা, জোয়ার বা ভাটার প্রতি লক্ষ্য ছিল না। হয়ত শাহী উমরতবাসী ফেরাউনের ঐ বিষয় অভিজ্ঞতাও ছিল না। তিনি ভাটার প্রথম বা শেষ অবস্থার প্রতি লক্ষ্য না করিয়াই চলিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। বনিইস্রায়েলগণ যখন এপারে আসিয়াছিলেন, ফেরাউন তখন মধ্যহ্রদে রেমেসিস সদলে ডুবিয়া মরিলেন (খৃঃ পৃঃ ১২৮৫) ।
হজরত মুসার জলাশয় পার হইবার বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মতবাদের মধ্যে বাস্তব ও গ্রহণযোগ্য কোনটি?