১১। হজরত নূহ নবীর সময়ের মহাপ্লাবন পৃথিবীর সর্বত্র হইয়াছিল কি?
ধর্মাচার্যগণ বলিয়া থাকেন যে, হজরত নূহের সময় নানাবিধ পাপাচার করায় মানুষ ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে খোদাতা’লা পৃথিবীর এক গজব (মহাপ্লাবন) নাজেল করেন। চল্লিশ দিবারাত্র অবিরাম বৃষ্টির ফলে সমস্ত পৃথিবী জলে ডুবিয়া গিয়াছিল। এমন কি পর্বতের উপরেও ১৫ হাত জল জমিয়াছিল। পৃথিবীতে মানুষ, পশু, পাখী, কীট-পতঙ্গাদি কোন প্রাণীই জীবিত ছিল না। হজরত নূহ তার জাহাজে যে সকল প্রাণীদের আশ্রয় দিয়াছিলেন, মাত্র তাহারাই জীবিত ছিল।
হজরত আদম হইতে হজরত নূহ দশম পুরুষ এবং উক্ত মহাপ্লাবন হইয়াছিল হজরত আদমের জন্মের তারিখ হইতে ১৬৫৬ বৎসর পরে (২০)। মাত্র এক জোড়া মানুষ হইতে এত অল্প সময়ের মধ্যে তখন পৃথিবীতে মানুষ খুব বেশী জন্মিতে পারে নাই। বিশেষত সেকালের মানুষ ছিল শান্ত ও সরল প্রকৃতির। তথাপি তাহাদের পাপকার্য সহ্য করিতে না পারিয়া আল্লাহ জগতময় মহাপ্লাবন-রূপ গজব নাজেল করিলেন, আর বর্তমানে সহ্য করেন কিরূপে? বর্তমান জগতে পাপ কর্ম নাই কি?
ধর্মীয় মতে ইরান, তুরান, ইরাক ও আরবের কোন কোন অংশেই তখন লোকের বসতি ছিল। বাকী এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকায় কোন লোকই ছিল না এবং আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া ছিল অজ্ঞাত। এমতাবস্থায় সমস্ত পৃথিবী ব্যাপিয়া মহাপ্লাবন হইবার কারণ কি এবং মানুষের পাপের জন্য অন্যান্য প্রাণীরা মরিল কেন?
মানুষের জীবন হরণ করা আজ্রাইল ফেরেস্তার কাজ। সে আল্লাহর আদেশ পাইলে যে কোন সময়ে, যে কোন অবস্থায়ই মানুষের ‘জান-কবজ’ করিয়া নিতে পারেন এবং গুটিকতক পাপীর ‘জান-কবজ’ করা হয়ত তাঁহার এক মুহূর্তের কাজ। মানুষের মৃত্যুই যদি আল্লাহর কাম্য হইত, তবে তিনি আজ্রাইলকে দিয়া উহা এক মুহূর্তে করাইতে পারিতেন। কিন্তু তাহা না করাইয়া তিনি চল্লিশ দিন স্থায়ী প্লাবনের ব্যবস্থা করিলেন কেন?
ভূমণ্ডলে জলের পরিমাণের হ্রাস-বৃদ্ধি নাই, আছে শুধু স্থানান্তর ও রূপান্তর। কোন দেশের উপর যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়, তৎসন্নিহিত সাগরাদির জল সেই পরিমাণ কমিয়া যায়। কেননা বাষ্পাকারে ঐ জল সাগরাদি হইতেই আসিয়া থাকে আর জলের একটি বিশেষ ধর্ম এই যে, বাহিরের কোন শক্তি প্রয়োগ না হইলেও উহার উপরিভাগ থাকে সমতল।
অরারট পর্বতের চতুর্দিকেই ভিন্ন ভিন্ন সাগর অবিস্থত। যথা- কৃষ্ণ সাগর, কাষ্পিয়ান সাগর, পারস্য উপসাগর, লোহিত সাগর, ভূমধ্য সাগর ইত্যাদি। অরারট পর্বতের চূড়ার উপর নাকি পনের হাত জল জমিয়াছিল এবং হজরত নূহের জাহাজখানা ঐ পর্বতের চূড়ায় আটকাইয়াছিল (তৌরিতে লিখিত অরারট পর্বতকে মুসলমানগণ বলেন “যুদী” পাহাড়)। কিন্তু ঐ পরিমাণ সাগরগুলির জল কমিয়াছিল কিনা? যদি কমিয়া থাকে, তাহা হইলে-সাগরের নীচু জলের সহিত অরারট পর্বতের উঁচু জল চল্লিশ দিন স্থিরভাবে দাঁড়াইয়া থাকিল কিরূপে, জল কাত হইয়াছিল কি?
প্রবল প্রবাহের ফলে হয়ত সমুদ্রের জল আসিয়া কোন দেশ প্লাবিত করিতে পারে এবং বায়ুর বেগ প্রশমিত না হওয়া পর্যন্ত ঐ জল স্থল ভাগের উপর দাঁড়াইয়া থাকিতে পারে। কিন্তু আলোচ্য প্লাবনে কোন রূপ বায়ুপ্রবাহ ছিল না, ছিল অবিরাম বৃষ্টি (২১)। ঐ প্লাবনে কোনরূপ ঝড়-বন্যা হওয়ার প্রমাণ আছে কি?
হজরত নূহের জাহাজখানা নাকি দৈর্ঘ্যে ৩০০ হাত, প্রস্থে ৫০ হাত ও উচ্চতায় ৩০ হাত ছিল এবং প্লাবনের মাত্র সাতদিন পূর্বে উহা তৈয়ারের জন্য খোদাতা’লার নিকট হইতে হজরত নূহ ফরমায়েশ পাইয়াছিলেন (২২)।
বর্তমান বিজ্ঞানের যুগে লোহা-লক্কড়, কলকব্জা ও ইঞ্জিন-মেশিনের অভাব নাই। তথাপি ঐ মাপের একখানা জাহাজ মাত্র সাত দিনে কোন ইঞ্জিনিয়ার তৈয়ার করিতে পারেন না। হজরত নূহ উহা পারিলেন কিরূপে? নদ-নদী ও সাগর বিরল মরু দেশে সূত্রধর ও কাঠের অভাব ছিল না কি? বিশেষত কাঠ চেরাইয়ের যন্ত্র ছিল কি? অধিকন্তু ইহারই মধ্যে-পৃথিবীর যাবতীয় পশু-পক্ষী ও কীট-পতঙ্গাদি জোড়া জোড়া এবং যাবতীয় গাছ-পালার বীজ সংগ্রহ করিয়া জাহাজে বোঝাই করিলেন কোন সময়?
উক্ত প্লাবনে নাকি পৃথিবীর সকল প্রাণীই বিনষ্ট হইয়াছিল, মাত্র জাহাজে আশ্রিত কয়েকটিই জীবিত ছিল। বর্তমান জগতের প্রাণীই নাকি ঐ জাহাজে আশ্রিত প্রাণীর বংশধর। তাই যদি হয়, তবে মানুষ ও পশু-পাখী ওখান হইতে আসিতে পারিলেও কেঁচো ও শামুকগুলি বাংলাদেশে আসিল কিভাবে?
০৭. ষষ্ঠ প্রস্তাব [বিবিধ]
ষষ্ঠ প্রস্তাব (বিবিধ)
১। আদম কি আদি মানব?
হিন্দু মতে- ব্রহ্মার মানসপুত্র “মনু” হইতে মানব উৎপত্তি। ইহুদী, খৃষ্টান ও মুসলমানদের মতে- “আদম” হইতে আদ্মী বা মানুষ উৎপত্তি হইয়াছে এবং পারসিকগণের মতে- আদি মানব “গেও-মাড”।
জীবতত্ত্ববিদ পণ্ডিতগণের মতে, জীবসৃষ্টির আদিতে অতিক্ষুদ্র এককোষবিশিষ্ট জীব “এ্যামিবা” (Amoeba)
ক্রমবিবর্তন ও ক্রমবিবর্ধনের ফলে প্রথমে ব্যাক্টেরিয়া, তাহা হইতে স্পঞ্জ, মৎস্য, সরীসৃপ, পশু ইত্যাদি বহু কোষী জীবে রূপান্তরিত হইয়া শেষে বন-মানুষ (Anthropoides) ও তাহাদের ক্রমোন্নতির ফলে বর্তমান সভ্য মানুষ উৎপত্তি হইয়াছে। কয়েক কোটি বৎসর পূর্বে পৃথিবীর অবিচ্ছিন্ন জলরাশিতে “এ্যামিবা” জন্মলাভ করিয়াছিল এবং বিবর্তনের ফলে তাহা হইতে পৃথিবীর সর্বত্র নানাবিধ জীব সৃষ্টি হইয়াছে।
মানুষের আদি জন্ম সম্পর্কে এ সকল ভিন্ন ভিন্ন মতবাদ শুনিয়া সাধারণ লোক কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছিতে পারে কি? যে সম্প্রদায়ের মধ্যে যে মতবাদ প্রচলিত আছে, তাহারা মানুষকে সেই মতবাদই বিশ্বাস করাইতে চায়। কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে ইহাতে যে সকল প্রশ্ন জাগে, তাহার কিছু আলোচনা করা যা’ক।
হিন্দু মতে- মনুর জন্ম ভারতে এবং খৃষ্টানাদি সেমিটিক জাতির মতে আদমের প্রথম বাসস্থান আরব দেশ। অন্যান্য যে কোন মতেই হউক, মানুষের আদি জন্ম এশিয়ার বাহিরে নয়।
আদি মানব যদি এশিয়ায়ই জন্মলাভ করিয়া থাকিত, তাহা হইলে বংশ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে এবং ইউরোপ ও আফ্রিকার মধ্যেই বসতি বিস্তার ঘটিত। কেননা ইহারা পরস্পর প্রায় অবিচ্ছিন্ন। কিন্তু আমেরিকা ও অষ্ট্রেলিয়ার আদিম অধিবাসীগণ কি প্রকারে জন্মিল? কলম্বাস সাহেবের আমেরিকা ও ক্যাপ্টেন “কুক”-এর অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কারের পূর্বে, সেখানে কি কোন লোক যাতায়াতের প্রমাণ আছে?
আদম যেখানে বাস করিতেন, তাহার নাম ছিল “এদন উদ্যান”। সেই উদ্যানটি বর্তমান তুরস্ক দেশের পূর্বাঞ্চলে ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রীস (ফরাৎ ও হিদ্দেকল) নদীদ্বয়ের উৎপত্তির এলাকার মধ্যে অবস্থিত ছিল (৮ নং টীকা দ্রষ্টব্য)। মহাপ্রভুর নিষিদ্ধ ফল ভক্ষণের অপরাধে আদম এদন উদ্যান হইতে বিতাড়িত হইয়া বহু বৎসর ঘোরাফেরার পর আরবের আরাফাতে তাঁহার স্ত্রীর সহিত মিলিত হন এবং ঐ অঞ্চলেই কালাতিপাত করেন।
আদিকালে পৃথিবীতে মানুষ ছিল অল্প এবং ভূ-পৃষ্ঠের সর্বত্র মানুষের বসতি ছিল না, ছিল উর্বর অঞ্চলে। তাই প্রথম লোক বসতি ও সভ্যতা বৃদ্ধি পাইয়াছিল নীল, ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রীস নদী বিধৌত মিশর ও মেসোপমিয়ায় এবং ভারতের সিন্ধু নদের অববাহিকা অঞ্চলে। কালদিয়া, ব্যাবিলোনিয়া প্রভৃতি দেশগুলিও ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রীস নদীর অববাহিকা অঞ্চল এবং “এদন” স্থানটিও তাহাই।
জীব বিজ্ঞানীদের মতে, পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব ঘটিয়াছে মাত্র প্রায় ৩০ হাজার বৎসর পূর্বে। আদমের আবির্ভাবের সমকালে বা তারও পূর্বে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে যে মানুষের বসতি ছিল, ভূতত্ত্ব ও প্রত্নতত্ত্ববিদগণ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চল হইতে তার ভুরি ভুরি প্রমাণ পাইয়াছেন।
চীন ও ভারতীয়দের ন্যায় দূরদেশের কথা না-ই বলিলাম, আরবের নিকটবর্তী- মিশর, প্যালেস্টাইন ও ব্যাবিলোন ইত্যাদির মত স্থানে মানব সভ্যতার যে অজস্র নিদর্শন পাওয়া গিয়াছে, নিম্নে তার মধ্যে মাত্র কয়েকটির আলোচনা করা যাইতেছে, যাহা আদমের সমকালীন বা তারও পূর্বের বলিয়া সাক্ষ্য দেয়। যথা-
খৃঃ পূর্বঃ ৪০০৪ সালে হজরত আদম সৃষ্টি হয়।
খৃঃ পূর্বঃ ৩০৭৪ সালে হজরত আদমের মৃত্যু হয়।
খৃঃ পূর্বঃ ৪২৪১ সালে মিশরে সিরিয়াস নক্ষত্রের আবিষ্কার হইতে বর্ষ গণনা আরম্ভ হয়।
খৃঃ পূর্বঃ ৪৪৪১ সালে মিশরে “সোথিক চক্র” আবিষ্কৃত হয়। (ঊষাকালে উদয় হইতে মহাকাশ প্রদক্ষিণ করিয়া
সিরিয়াস নক্ষত্রটির আবার পূর্ব স্থানে ফিরিয়া আসিতে সময় লাগে প্রায় ১৪০০ বৎসর। এই
সুদীর্ঘ কালটিকে বলা হয় “সোথিক চক্র”)।
খৃঃ পূর্বঃ ৪২২১ সালে মিশরে পঞ্জিকা আবিস্কৃত হয়।
খৃঃ পূর্বঃ ৩০৯৮-৩০৭৫ সালে মিশরে নীলনদের পশ্চিমে গিজাতে রাজা খুপুর সমাধির উপর ১৩ একর জমি
ব্যাপিয়া ৪৮১ ফুট উঁচু একটি পিরামিড তৈয়ার হয় (৪৩)।
খৃঃ পূর্বঃ ৫০০০ সালের তৈয়ারী পাথরের হাতিয়ারের সহিত সোনা, রূপা, তামা প্রভৃতি ধাতুর জিনিস পাওয়া
গিয়াছে মিশরের অন্তর্গত নেগাদা, এমিডোস, এল-আমরা প্রভৃতি অঞ্চলের কবরগুলিতে।
খৃঃ পূর্বঃ ৪০০০ সালে মিশরে চাষাবাদ ছিল, তার প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে নীল নদের পশ্চিমে ফাইয়ুম ও
মেরিমডে অঞ্চলে এবং মধ্য ইরানের পশ্চিম সীমান্তে “সিয়াল্ফ্” অঞ্চলে।
খৃঃ পূর্বঃ ৫০০৮-৪৫০০ সালে প্যালেস্টাইনের কারমেল পাহাড়ের “ওয়াদি-এল-নাটুর্ফ” স্থানের প্রাচীন অধিবাসী নাটুফিয়ানরা কিছু চাষাবাদ করিত তার প্রমাণ আছে।
খৃঃ পূর্ব ৪৩০০ সালের পূর্বের লোক বসতির প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে- পশ্চিম ইরানের কাশানের কাছাকাছি “টেল-শিয়াল্ফ” নামক স্থানে। সেখানে ১৭টি ভগ্ন স্তূপে ৯৯ ফুট উঁচু একটি ঢিবির সব চাইতে নীচের ভগ্নস্তূপটিতে লোক বসতির প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে।
খৃঃ পূর্ব ৭০০০ সালে লোক বসতির প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে- মোসালের নিকটস্থ “টেপ পাওয়া”তে। সেখানে ২৬টি ভগ্নস্তূপ মিলিয়া ১০৪ ফুট উঁচু একটি ঢিবির সব চাইতে নীচের ভগ্নস্তূপটিতে লোকের বসতি ছিল।
খৃঃ পূর্ব ৩৪০০ সালে মিশরে রাজা মেনেসের রাজত্ব আরম্ভ হয়।
খৃঃ পূর্ব ৮০০০ সালে লোক বসতির প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে- সিরিয়ার উত্তর উপকূলে “বাস-সামরা”তে। সেখানে ৪০ ফুট উঁচু একটি ঢিবির নীচে লোক বসতির চিহ্ন আছে (৪৪)।
পবিত্র তৌরিত গ্রন্থে বর্ণিত আছে- “আর সদা প্রভু ঈশ্বর পূর্ব দিকে এদনে, এক উদ্যান প্রস্তুত করিলেন, এবং সেই স্থানে আপনার নির্মিত ঐ মনুষ্যকে রাখিলেন। আর সদা প্রভু ঈশ্বর ভূমি হইতে সর্ব জাতীয় সুদৃশ্য ও সুখদায়ক বৃক্ষ, এবং সেই উদ্যানের মধ্যস্থানে জীবন বৃক্ষ ও সদসদ জ্ঞানদায়ক বৃক্ষ উৎপন্ন করিলেন। আর উদ্যানে জল সেচনার্থে এদন হইতে এক নদী নির্গত হইল, উহা তথা হইতে বিভিন্ন হইয়া চতুর্মুখ হইল,” (৪৫) ।
উক্ত বিবরণে দেখা যায় যে, সদা প্রভু পূর্ব দিক এদনে এক উদ্যান প্রস্তুত করিলেন। কিন্তু উহা কোন্ স্থান হইতে পূর্ব অর্থাৎ আদমের সৃষ্টি স্থান, না তৌরিত লেখকের বাসস্থান, তাহা স্পষ্ট বোধগম্য হয় না। হয়ত লেখকের বাসস্থান হইতে হইবে। তৌরিতের লেখক বোধ হয় যে, কেনান দেশের হিব্রু সম্প্রদায়ের কোন অনামা ব্যক্তি ছিলেন এবং “এদন” স্থানটি কেনান দেশ হইতে প্রায় পূর্ব দিকে অবস্থিত ছিল।
তৌরিতের বর্ণনা মতে- সদাপ্রভু ভূমি হইতে সর্ব জাতীয় “সুদৃশ্য” ও “সুখাদ্যদায়ক” বৃক্ষ ঐ বাগানে উৎপন্ন করিলেন। সচরাচর আমরা দেখিয়া থাকি যে, পরমেশ্বরের সৃষ্ট (প্রকৃতিজাত) গাছ-গাছড়ার সমাবেশকে কখনও “বাগান” বলা যায় না, বলা যায়- “বন” বা “জঙ্গল”। কেননা জল, বায়ু তাপের আনুকূল্যে উর্বর মাটিতে হরেক রকম উদ্ভিদই জন্মিয়া থাকে এবং উহাতে সুখাদ্য, কুখাদ্য ও সুদৃশ্য বৃক্ষের হয় একত্র সমাবেশ। অবাঞ্ছিত বৃক্ষোৎপাটন পূর্বক “বাঞ্ছিত বৃক্ষ সমাবেশ” কে বলা হয় “উদ্যান” বা ‘“বাগান”। এই “বাগান” সর্বত্রই মানুষের তৈয়ার, ঈশ্বরের নহে। যেমন স্বর্ণ, রোপ্য ইত্যাদি ঈশ্বর-সৃষ্টি (প্রকৃতিজাত) হইলেও অলঙ্কারসমূহ মানুষের তৈয়ারী, কোন অলঙ্কারই ঈশ্বর-সৃষ্ট নহে। কাজেই বলা যাতে পারে যে, এদনের ঐ উদ্যানটি মানুষের তৈয়ারী ছিল, পরমেশ্বরের নহে।
জীবতত্ত্ববিদগণের মতে, মানুষ এককালে গুহাবাসী ছিল এবং বন্য ফলমূল ভক্ষণ করিত। নিয়মিত ফলমূল সংগ্রহ করা দুঃসাধ্য কাজ, হয়ত বা ফলমূল দুষ্প্রাপ্যও ছিল। তাই আদিম মানবরা রুচিসম্মত ও সুখাদ্যদায়ক বৃক্ষাদি কোন নির্দিষ্ট স্থানে রোপণ করিয়া খাদ্যের ব্যাপারে স্বনির্ভর হইতে চেষ্টা করিয়াছিল। মানব সভ্যতার আদিতে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে এইরূপ “বাগান চাষ”-এর প্রচলন হইয়াছিল। এমতাবস্থায় মনে উদয় হতে পারে যে, এদনের উল্লেখিত উদ্যানটি ঐরূপ একটি বাগান চাষেরই ক্ষেত্র।
আদম সৃষ্টি হইয়া সেইদিন বা তার পরের দিন হইতে ঐ বাগানের ফল ভক্ষণ শুরু করিয়াছিলেন। কোন ফলের বীজ রোপিত হইলে তাহাতে বৃক্ষোৎপন্ন হইয়া দুই-চারদিনের মধ্যেই ফল ধরে না, উহাতে বেশ কয়েক বৎসর সময়ের দরকার হয়। কাজেই একথা স্বীকার্য যে, ঐ বাগানের ফলোৎপাদক বৃক্ষসমূহ আদম সৃষ্টির বহুদনি পূর্বে রোপিত হইয়াছিল। এদন উদ্যানটি পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। কাজেই ওখানকার বাগানে জলসেচের গুরুত্ব ও আবশ্যকতা ছিল অত্যধিক, তাহা তৌরিত গ্রন্থে উল্লেখ আছে নিয়মিত জল সেচের সামান্য ত্রুটিতেও বাগানটি নষ্ট হইয়া যাইত। কিন্তু তাহা হয় নাই। ইহাতে প্রশ্ন আসে যে, আদম সৃষ্টির পূর্বে উহার সেচকার্য করিত কে? উত্তরে স্বভাবতই মনে আসে যে, আদমের পূর্বেও মানুষ ছিল।
সেচকার্য করিত “কে”, না বলিয়া “কাহারা” বলাই সঙ্গত। কেননা সেই সেচকার্য সম্পাদন করা কাহারো একার পক্ষে সম্ভব ছিল না। যেহেতু বাগানটি আয়তনে ছোট ছিল না, বেশ বড়ই ছিল। তৌরিতে বর্ণিত আছে “পরে তাহারা সদা প্রভু ঈশ্বরের রব শুনিতে পাইলেন, তিনি দিবাবসানে উদ্যানে গমনাগমন করিতেছিলেন, তাহাতে আদম ও তাঁহার স্ত্রী সদা প্রভু ঈশ্বরের সন্মুখ হইতে উদ্যানস্থ বৃক্ষসমূহের মধ্যে লুকাইলেন” (৪৬)। যেহেতু আদম তখন উলঙ্গ ছিলেন।
“বৃক্ষ” বৃক্ষই, উহা লতা-গুল্ম বা ঝোপ নহে। আদম লুকাইয়া ছিলেন উদ্যানস্থ “বৃক্ষসমূহের” মধ্যে, কোন একটি বিশেষ বৃক্ষের আড়ালে বা কোন ঝোপের মধ্যে নহে। আম, জাম, তাল, নারিকেল বিশেষত খেজুর (খুরমা) ইত্যাদি বৃক্ষের গোটা কাণ্ডই শাখা-পত্রহীন এবং উহাদের অবস্থানও সাধারণত দূরে দূরে। অধিকন্তু “স্বর্গ” নামধেয় “এদন উদ্যান”টিতে যে ঝোপ-জঙ্গল ছিল না, তাহাও নিশ্চিত। এমতাবস্থায় ওখানে কোন লোক কাহারো দৃষ্টির আড়ালে হইতে হইলে, তাহার যে কতটুকু দূরে যাওয়া আবশ্যক তাহা অনুমান সাপেক্ষ। এহেন বাগানটির রক্ষণাবেক্ষণ যথা- কোপান (বোধ হয় সেটা ছিল লাঙ্গল চাষের পূর্ববর্তী কোদাল যুগ (৪৭) বীজ সংগ্রহ ও উহা রোপণ-বপন বিশেষত জল সেচ ইত্যাদি কাজে বহু লোকের আবশ্যক ছিল এবং আবশ্যক ছিল তাহাদের কঠোর পরিশ্রমের।
বহু লোকের একত্রে বসবাস এবং কোন এক সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা মোতাবেক কাজ করিতে হইলে একজন অধিনায়কও থাকা দরকার। আর ইহা একটি চিরাচরিত নিয়ম যে অধিনায়কের আদেশ অমান্যকারী ব্যক্তি শাস্তির যোগ্য।
শোনা যায় যে, স্বর্গবাসীরা কোনরূপ কায়িক শ্রম করেন না। এমন কি কোন বৃক্ষের ফলও তাঁহারা ছিড়িয়া খাননা বা উহা হাতে ধরিয়া মুখেও দেন না, ঈপ্সিত ফল আপনি আসিয়াই স্বর্গবাসীর মুখে প্রবেশ করে। মনে হয় যে, এদন উদ্যানে আদম ছিলেন উদ্যানের অন্যান্যদের বিশেষত অধিনায়কের (প্রভুর) অপ্রীতিভাজন।
প্রখ্যাত সমাজ বিজ্ঞানী মর্গানের মতে- আদি মানবরা দলবদ্ধ হইয়া বসবাস করিত। সেই দল বা সমাজ ছিল জ্ঞাতি ভিত্তিক। দলের প্রত্যেকের সহিত প্রত্যেকের থাকিত জ্ঞাতি সম্পর্ক। মর্গান তাহার নাম দিয়াছিলেন “জেনটাইল সোসাইটি” বা জ্ঞাতি ভিত্তিক সমাজ বা “ক্লান”। ক্লানের বাসিন্দারা সকলে মিলিয়া মিশিয়া কাজ করিত। হয়ত এরূপ নিয়মও ছিল যে, কোন ব্যক্তি কোন কাজ না করিলে তার জন্য ক্লান উৎপন্ন ফলাদি ভক্ষণ নিষিদ্ধ। ক্লানের নিয়ম মানিয়া, সকলের উপর নির্ভর করিয়া, সকলের সহযোগিতায় বাঁচার চেষ্টা করিলেই বাঁচা সম্ভব ছিল, নচেৎ নয়। কোন দল হইতে কেহ বিতাড়িত হইলে, সে বনে-জঙ্গলে ও পাহাড়-পর্বতে ঘুরিতে ঘুরিতে দিশাহারা হইত, বা মারা যাইত (৩৭)।
পূর্বোক্ত বিষয়গুলি পর্যালোচনা করিলে মনে আসিতে পারে যে, আদম হয়ত এশিয়া মাইনর বা আর্মেনিয়া দেশের কোন ক্লানের বিতাড়িত ব্যক্তি এবং আরব দেশে আগন্তক প্রথম মানুষ, সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে আদিম মানুষ নয়। হজরত আদমের আদিত্বের বাস্তব ও তত্ত্বগত কোন কোন প্রমাণ আছে কি?