৪। পৃথিবী কিসের উপর প্রতিষ্ঠিত?
কেহ কেহ বলেন যে, পৃথিবী একটি বলদের শৃঙ্গের উপর আছে। কেহ বলেন পৃথিবী একটি মাছের উপর এবং কেহ বলেন পৃথিবী জলের উপর অবস্থিত। তাই যদি হয়, তবে সেই মাছ, বলদ বা জল কিসের উপর অবস্থিত। অধুনা বহু পর্যটক জল ও স্থল এবং বিমান পথে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করিতেছেন। কিন্তু তাঁহারা কেহ ওসবের সাক্ষাৎ পান না কেন? বিশেষত পৃথিবী যদি বলদের শৃঙ্গের উপর অবস্থিত থাকিয়া থাকে, তবে সেই বলদটির পানাহারের ব্যবস্থা কি?
আধুনিক পণ্ডিতগণ বলেন যে, পৃথিবী কোন কিছুর উপর প্রতিষ্ঠিত নহে। পৃথিবীর কোন দৃশ্যমান অবলম্বন নাই। ইহার সকল দিকেই আকাশ বা শূন্যস্থান। ফুটবল খেলোয়াড়ের পায়ের আঘাতে একটি ফুটবল যেমন ভন্ ভন্ করিয়া ঘুরিতে ঘুরিতে আকাশে (শূন্য) চলিতে থাকে, পৃথিবীও তদ্রূপ সূর্যকে কেন্দ্র করিয়া ভর আকর্ষণে বাঁধা থাকিয়া শূন্যে ঘুরিতেছে। সূর্যের চারি ধারে একবার ঘুরিয়া আসিতে পৃথিবীর সময় লাগে ৩৬৫ দিন ৬ ১/৪ ঘণ্টা। ইহাকে বলা হয় সৌর বৎসর বা “বৎসর”। বাস্তব ঘটনা ইহাই নয় কি?
৫। ভূমিকম্পের কারণ কি?
কেহ কেহ বলেন, যে পৃথিবীধারী বলদ ভারাক্রান্ত হইয়া কখন কখন শৃঙ্গ পরিবর্তনের চেষ্টা করে এবং তাহার ফলে পৃথিবী কম্পিত হয়। যদি ইহাই হয়, তবে একই সময় পৃথিবীর সকল অঞ্চলে ভূমিকম্প হয় না কেন?
ভূতত্ত্ববিদ পণ্ডিতগণের মতে আগ্নেয়গিরির অগ্লুৎপাত ও ভূগর্ভস্থ অতিশয় উষ্ণ গলিত পদার্থের হঠাৎ শীতলস্পর্শে বাষ্পীয় রূপ ধারণে উহা#2494; বিস্ফোরণের চেষ্টা বা অকস্মাৎ ভূস্তর ধ্বসিয়া যাইয়া ইত্যাদি কারণে ভূমিকম্প হয়।
৬। বজ্রপাত হয় কেন?
কোন কোন ধর্মপ্রচারক বলিয়া থাকেন যে, স্বর্গরাজ্য হইতে বিতাড়িত হওয়ার পরেও শয়তান স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ
করিতে পারিত এবং আল্লাহ কর্তৃক পৃথিবীতে প্রযোজ্য ভবিষ্যৎ কার্যাবলীর নির্দেশ পূর্বাহ্নেই জানিয়া আসিয়া পৃথিবীতে ভবিষ্যদ্বাণী করিত। পৃথিবীর লোক শয়তানের ভবিষ্যদ্বাণী সফল হইতেছে দেখিয়া তাহার উপর বিশ্বাস করিত। অর্থাৎ শয়তান যাহার মুখ দিয়া ভবিষ্যদ্বাণী করাইত তাহাকেই লোকে ভগবানের ন্যায় বিশ্বাস করিত এবং সর্বশক্তিমান আল্লাহর কথা একেবারেই ভুলিয়া যাইত। এইরূপে শয়তান খোদাতা’লার বিরুদ্ধাচরণ করিত এবং লোকদিগকে কুপথে লইয়া যাইবার সুযোগ পাইত। কিন্তু হজরত মোহাম্মদ (সঃ)-এর জন্মের পরে স্বর্গরাজ্যে শয়তান যাহাতে প্রবেশ করিতে না পারে এবং উপরোক্ত পদ্ধতিতে মানুষকে বিপথে নিতে না পারে, এজন্য খোদাতা’লা শয়তানের স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ চিরতরে নিষিদ্ধ করিয়া দেন এবং ফেরেস্তাগণকে কড়া হুকুম দিয়া দেন, যেন শয়তান আর স্বর্গরাজ্যে প্রবেশ করিতে না পারে। অধিকন্তু শয়তান বিতাড়নের অস্ত্রস্বরূপ ফেরেস্তাগণকে বজ্রবাণ প্রদান করেন। যখনই শয়তান স্বর্গরাজ্যে প্রবেশের চেষ্টা করে তখনই ফেরেস্তাগণ শয়তানের উপর বজ্রবাণ নিপেক্ষ করেন। উহাকে আমরা “বজ্রপাত” বলিয়া থাকি।
উপরোক্ত বিবরণ যদি সত্য হয়, তবে সকল সময় এবং বিনা মেঘে বজ্রপাত হয় না কেন? শীত ঋতুতে বজ্রপাত হইতে শোনা যায় না কেন? সাধারণত আকাশে চারি শ্রেণীর মেঘ জন্মিয়া থাকে, কিন্তু উহার সকল শ্রেণীর মেঘে বজ্রপাত হয় না কেন? চৌদ্দশত বৎসর পূর্বে পৃথিবীতে বজ্রপাত ছিল না কি?
সচরাচর দেখা যায় যে, অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানেই বজ্রপাত হয় বেশী। যথা- মাঠের উঁচু শস্য ক্ষেত্র, বাগানের তাল-নারিকেলাদি বৃক্ষ, শহরের উঁচু দালানাদি এমন কি মসজিদের চূড়াতেও বজ্রপাতের কথা শোনা যায়। শয়তান কি ঐ সমস্ত উঁচু জায়গায়ই বাস করে?
হিন্দুগণ বলিয়া থাকেন যে, দধীচি মুনির অস্থি দ্বারা বজ্রবাণ তৈয়ারী এবং উহা ব্যবহার করেন দেবরাজ ইন্দ্র, তাঁর শত্রু নিপাতের জন্য ‘জৈমিনিশ্চ সুমন্তশচ বৈশম্পায়ন এবং চ। পুনস্ত্যঃ পুলহো জিষ্ণু ষড়েতে বজ্র বারকা।” এই মন্ত্রটি উচ্চারিত হইলে সেখানে বজ্রপাত হয় না ।(১৮) পক্ষান্তরে মুসলমানগণ বলিয়া থাকেন “লা হওলা অলা কুয়াতা ইল্লাবিল্লাহেল আলিউল আজিম” এই কালামটি পাঠ করিলে সেখানে বজ্রপাত হয় না। এসবের পরীক্ষামূলক সত্য কিছু আছে কি?
বিজ্ঞানীগণ পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছেন যে, বজ্রবারক (Lightning proof) ব্যবহার করিলে সেখানে বজ্রপাত হয় না। শহরে উঁচু দালানাদি তৈয়ার করিয়া ইঞ্জিনিয়ারগণ উহার উপরে “বজ্রবারক” সন্নিবেশিত করেন এবং তাহাতে বজ্রপাত হইতে দালানাদি রক্ষা পাইয়া থাকে। তবে কি বজ্রবারক দেখিয়াই শয়তান দূর হয়? যদি তাহাই হয়, তবে শয়তান দূর করিবার জন্য অন্যরূপ কোসেস না করিয়া “বজ্রবারক” ব্যবহার করা হয় না কেন?
বজ্রপাত সম্বন্ধে বৈজ্ঞানিক তথ্য কিছুটা জটিল। তবে সংক্ষিপ্ত এইরূপঃ গ্রীষ্মকালে কোন কোন অঞ্চলে সময় বিশেষে বায়ুর ঊর্ধ্বগতি হয়। ঐ সময় ঐ অঞ্চলের আকাশে যদি মেঘ থাকে এবং সেই মেঘের জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হইয়া যদি নিম্নগতি সম্পন্ন হয়, তাহা হইলে সেই নিম্নগতি সম্পন্ন মেঘ ও ঊর্ধ্বগতি সম্পন্ন বায়ুর সংঘর্ষের ফলে সময় সময় মেঘের জলকণা ভাঙ্গিয়া অণু ও পরমাণুতে পরিণত হয়। সংঘর্ষের মাত্রাধিক্যে কোন কোন সময় আবার ঐ সকল পরমাণু ভাঙ্গিয়া উহার সমস্ত ইলেক্ট্রন ও প্রোটন মুক্ত হইয়া পড়ে। ইহার ফলে মেঘের মধ্যে বিদ্যুৎ সৃষ্টি হয়। এইরূপ বিদ্যুৎযুক্ত মেঘ আকাশে থাকিলে তন্নিগ্ন ভূমিতে আর এক দফা বিদ্যুৎ সৃষ্টি হয়, ইহাকে “আবিষ্ট বিদ্যুৎ” বলে। এইরূপ অবস্থায় আকাশের বিদ্যুৎ ও মাটিস্থ আবিষ্ট বিদ্যুতের সঙ্গে পরস্পর আকর্ষণ চলিতে থাকে। মিশিবার জন্য ভূ-পৃষ্ঠের অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে যাইয়া উঁকি মারিতে থাকে। বিদ্যুৎতাশ্রিত স্থানটি সূঁচাগ্রবৎ হইলে ওখানে বিদ্যুৎ জমিতে পারে না, অল্পে অল্পে মুক্ত হইয়া আকাশের বিদ্যুতে সঙ্গে মিশিয়া যায়। কিন্তু ঐ স্থানটি সূচাগ্রবৎ না হইলে ওখান হইতে বিদ্যুৎমুক্ত হইতে পারে না। বরং ক্রমশ জমিয়া শক্তিশালী হইতে থাকে। আকাশের মেঘে যে বিদ্যুৎ থাকে, তাহা হইতে মাটির আবিষ্ট বিদ্যুতের শক্তি বেশী হইলে, তাহা আকাশের বিদ্যুৎকে টানিয়া ভূ-পাতিত করে। এইভাবে আকাশের বিদ্যুৎপতনকে আমরা বজ্রপাত বলি। বিদ্যুৎ পতনের তীব্রগতির পথে যে সকল বায়বীয় পদার্থ ও
ধুলিকণা থাকে, উহা জ্বলিয়া তীব্র আলোর সৃষ্টি হয় এবং বায়ু কম্পনের হয় শব্দ।
প্রিয় পাঠক পাঠিকাগণ, একটু অনুধাবন করিলেই বুঝিতে পারিবেন যে, বজ্রপাত কেন উঁচুস্থানে হয়, কেন সকল মেঘে ও শীতকালের মেঘে হয় না, কেন উঁচু গাছ কাছে থাকিলে নীচু গাছে হয় না এবং বজ্রবারক ব্যবহার করিলে কেন সেখান বজ্রপাত হয় না।
(ধর্মযাজকগণ আলোচ্য বিষয়গুলি পর্যবেক্ষণ করিয়া দেখিবেন কি?)