২। আকাশ কি?
“আকাশ” বলিতে সাধারণত শূন্যস্থান বুঝায়। কিন্তু কোন কোন ধর্মাচার্য বলিয়া থাকেন যে আকাশ সাতটি। ইহা কিরূপে হয়? যাহা শূন্য, তাহা সংখ্যা দ্বারা সূচিত হয় কিরূপে? যাঁহারা আকাশকে সংখ্যা দ্বারা বিভক্ত করেন, তাঁহারা কি ‘আকাশ’ বলিতে “গ্রহ”কে বুঝেন? কিন্তু গ্রহ তো সাতটি নহে, নয়টি (অধুনা ১০টি)। হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান ও মুসলমান ইত্যাদি ধর্ম প্রবর্তন ও তৎসংক্রান্ত শাস্ত্রাদি প্রণয়ণকাল পর্যন্ত পরিচিত গ্রহের সংখ্যা ছিল ছয়টি। তবে-রাহু, কেতু ও সূর্যকে গ্রহ দলে ধরিয়া নামকরণ হইয়াছিল। নবগ্রহ প্রকৃত পক্ষে সূর্য গ্রহ নহে এবং রাহু ও কেতু হইল চন্দ্র ও পৃথিবীর ছায়া। প্রকৃত গ্রহ হইল- বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনি; এই ছয়টি। গ্রহ আকাশ বা শূন্য নহে।
কেহ কেহ সপ্তাকাশকে পদার্থের তৈয়ারী বলিয়া মনে করেন। তাহারা বলেন যে, আকাশ প্রথমটি জলের, দ্বিতীয় লৌহের, তৃতীয় তাম্রের, চতুর্থ স্বর্ণের তৈয়ারী। উহারা আরও বলেন যে, ছাদে ঝুলান আলোর মত চন্দ্র, সূর্য ও নক্ষত্রাদি আকাশে ঝুলান আছে। কিন্তু এ সবের প্রমাণ কিছু আছে কি? কোন কোন ধর্মবেত্তা আকাশের দূরত্ব নির্ণয় করিয়া গিয়াছেন। কেননা বলা হইয়া থাকে যে, পৃথিবী হইতে প্রথম আসমান ও তদূর্ধ্বে প্রত্যেক আসমান হইতে প্রত্যেক আসমান পাঁচশত বৎসরের পথ দূরে দূরে অবস্থিত।
কোন গতির সাহায্যে দূরত্ব নির্ণয় করিতে হইলে সেই গতির বেগও জানা দরকার। সে যুগে রেল, স্টিমার বা হাওয়াই জাহাজ ছিল না। সাধারণত পায়ে হাঁটিয়াই পথ চলিতে হইত। “পাঁচ শত বৎসরের পথ” এই বলিয়া যাঁহারা আকাশের দূরত্ব নির্ণয় করিয়াছেন, তাঁহারা উহা হাতীর, ঘোড়া, উট, গাধা বা মানুষের গতি অথবা হাঁটা গতি, না দৌড়ের গতি; তাহা কিছু বলেন নাই। সে যাহা হউক, মানুষের পায়ে হাঁটা গতিই মাইলে হিসাব করিয়া দেখা যায় যে, ধর্মীয় মতে কোন আকাশের দূরত্ব কত মাইল।
যথারীতি আহার ও বিশ্রাম করিয়া একজন লোক সাধারণত দৈনিক বিশ মাইল পথ চলিতে পারে। তাহা হইলে এক চান্দ্র বৎসরে অর্থাৎ ৩৫৪ দিন চলিতে পারে ৭ হাজার ৮০ মাইল। সুতরাং পাঁচ শত বৎসরে চলিতে পারে ৩৫ লক্ষ ৪০ হাজার মাইল। ধর্মীয় মতে ইহা প্রথম আকাশের দূরত্ব, অর্থাৎ চন্দ্রের দূরত্ব। কিন্তু বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবী হইতে চন্দ্রের দূরত্ব প্রায় ২ লক্ষ ৩৯ হাজার মাইল। উপরোক্ত হিসাব মতে চতুর্থ আকাশের দূরত্ব ১ কোটি ৪১ লক্ষ ৬০ হাজার মাইল। কিন্তু বিজ্ঞানীদের মতে উহা প্রায় ৯ কোটি ৩০ লক্ষ মাইল। সে যাহা হউক, আকাশে যে সমস্ত জ্যোতিষ্ক আছে, জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণ উহার দূরত্ব প্রাপ্ত হইয়াছেন যান্ত্রিক ও গাণিতিক সূত্রে। কিন্তু ধর্মগুরুগণ উহা পাইলেন কোথায়, কি সূত্রে?
ধর্মীয় মতে প্রথম আকাশ জলের তৈয়ারী এবং চন্দ্র সেই জলে ভাসিতেছে। অধুনা প্রথম আকাশে অর্থাৎ চন্দ্রের দেশে মানুষ যাওয়া-আসা করিতেছেন এবং তাঁহারা দেখিতেছেন যে, চন্দ্র ভাসিতেছে শূন্যে এবং ওখানে জলের নাম-গন্ধও নাই।
শাস্ত্রীয় মতে-চতুর্থ আকাশের দূরত্ব দেড় কোটি মাইলেরও কম। অথচ আধুনিক বিজ্ঞানীগণ ৩ কোটি মাইলেরও অধিক দূরে শুক্র ও মঙ্গল গ্রহে রকেট প্রেরণ করিতেছেন। কিন্তু কোথাও লোহা, তামা বা সোনার আকাশ (ছাদ) দেখিতেছেন না, সবটাই শূন্য।
ধর্মগুরুদের আকাশ বিষয়ক বর্ণনাগুলি অলীক কল্পনা নয় কি?
৩। দিবা-রাত্রির কারণ কি?
সাধারণত আমরা দেখিয়া থাকি, যে সূর্য প্রত্যহ পূর্বদিক হইতে উদিত হইয়া পশ্চিম দিকে অস্ত যায়। কিন্তু সূর্য তো কোন জীব নয় যে সে নিজেই দৌড়াইতে পারে। তবে সে চলে কি রকম? ইহার উত্তরে কেহ কেহ বলিয়া থাকেন যে, চতুর্থ আসমানে একখানা সোনার নৌকায় সূর্যকে রাখিয়া ৭০ হাজার ফেরেস্তা সূর্যসহ নৌকাখানা টানিয়া পূর্বদিক হইতে পশ্চিম দিকে লইয়া যায় ও সারা রাত আরশের নীচে বসিয়া আল্লাহর এবাদত করে এবং প্রাতে পুনরায় সূর্য পূর্বদিকে হাজির হয় (মলাট পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)। পক্ষান্তরে হিন্দুদের পুরাণ শাস্ত্রে লিখিত আছে যে কশ্যপ মুনির ঔরসে তৎপত্নী অদিতির গর্ভে সূর্যের জন্ম হয়। এই হেতু সূর্যের আর এক নাম ‘আদিত্য’। ইনি সপ্ত-অশ্ব-যুক্ত রথে চড়িয়া আকাশ ভ্রমণ করেন এবং অরুণ ঐ রথের সারথি।
জ্যোতির্বিদ পণ্ডিতগণ বলিয়া থাকেন যে, সূর্য এক জায়গায় দাঁড়াইয়া আছে আর তাহা হইতে প্রায় ৯ কোটি ৩০ লক্ষ মাইল দূরে থাকিয়া পৃথিবী স্বীয় মেরুদণ্ডের উপর ২৪ ঘণ্টায় একবার ঘুরপাক খায়। ইহাতেই দিবারাত্রি হয় এবং সূর্যকে গতিশীল বলিয়া আমাদের ভ্রম হয়।
যদিও- “সূর্য এক জায়গায় দাঁড়াইয়া আছে” ইহা বলা হইল কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সূর্য এক জায়গায় দাঁড়াইয়া নাই। পৃথিবীর আহ্নিক এবং বার্ষিক গতির ন্যায় সূর্যেরও দুইটি গতি আছে। সূর্য স্বীয় মেরুদণ্ডের উপর প্রায় ২৭ দিনে একবার ঘুরপাক খাইতেছে এবং সে আমাদের নক্ষত্র জগতের ব্যাসের ১/৩ দূরে থাকিয়া প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১৭৫ মাইল বেগে নক্ষত্র জগতের কেন্দ্রকে প্রদক্ষিণ করিতেছে (১৭)। ইহার একপাক শেষ করিতে সূর্যের সময় লাগে প্রায় সাড়ে বাইশ কোটি বৎসর। কিন্তু মানুষ তার সহজ দৃষ্টিতে সূর্যের এই দুইটি গতির একটিরও সন্ধান পায় না।
সে যাহা হউক, দিবা-রাত্রির যে তিনটি কারণ বর্ণিত হইল, ইহার মধ্যে প্রামাণ্য ও গ্রহণীয় কোনটি?