৯। স্থান, কাল ও শক্তি — সৃষ্ট না অসৃষ্ট?
এ কথা সত্য যে, ‘সৃষ্টিকর্তা’ বলিয়া যদি কেহ থাকেন, তবে তিনি হইবেন এক ও অদ্বিতীয়। কিন্তু ধর্মজগতে তাঁহাকে চিত্রিত করা হইয়াছে বিবিধ রূপে এবং তাঁহার সংজ্ঞা ও সংখ্যা সব ক্ষেত্রে এক রকম নহে। বিশেষত ধর্মরাজ্যে তাঁহার পরিচয় পাওয়া যায় অনেক ক্ষেত্রেই ‘ব্যক্তি’ রূপে। বলা হয় যে, ঈশ্বর অনাদি, অনন্ত, অসীম ও নিরাকার; অথচ প্রত্যক্ষে না হইলেও পরোক্ষে তাঁহার চোখ, মুখ ও কান আছে — তাহার আভাস পাওয়া যায় অনেক ক্ষেত্রে। এমন কি তাঁহার পুত্র-কন্যা-পরিবারেরও বর্ণনা পাওয়া যায় কোন কোন ক্ষেত্রে। সৃষ্টিকর্তা হইলেন — যিনি সৃষ্টি করেন বা করিয়াছেন। কোন সৃষ্ট পদার্থ স্রষ্টার চেয়ে বয়সে অধিক হইতে পারে না, এমন কি সমবয়সীও না। কোন কুমার একটি হাড়ি তৈয়ার করিল, এক্ষেত্রে হাড়ি কখনও কুমারের বয়োঃজ্যেষ্ঠ বা সমবয়সী হইতে পারে না। অর্থাৎ কর্তার আগে কর্ম অথবা কর্তা ও কর্ম একই মুহূর্তে জন্মিতে পারে না, ইহাই স্বতঃসিদ্ধ নিয়ম।
কোন পদার্থের সৃষ্টিকাল যতই অতীত বা মহাতীত হউক না কেন, উহা কখনও অনাদি হইতে পারে না। যাহা ‘সৃষ্টি’ তাহা নিশ্চয়ই কোন এক সময়ে উৎপত্তি হইয়া থাকিবে। কিন্তু বিশ্বে এমন কোন কোন বিষয় আছে, আমরা যাহার আদি, অন্ত, সীমা ও আকার কল্পনা করিতে পারি না। যেমন, স্থান, কাল ও শক্তি। বলা হইয়া থাকে যে, ঈশ্বর অনাদি, অনন্ত, অসীম ও নিরাকার। পক্ষান্তরে স্থান, কাল এবং শক্তিও অনাদি, অনন্ত, অসীম ও নিরাকার। যথা ক্রমে এ বিষয় আলোচনা করিতেছি।
১. স্থান — বিশ্বের দৃশ্যাদৃশ্য যাবতীয় পদার্থই কোন না কোন স্থানে অবস্থিত আছে। ‘স্থান’ (Space) পদার্থপূর্ণ অথবা পদার্থশূন্য, দুইই থাকিতে পারে। কিন্তু ‘স্থান’কে থাকিতেই হইবে।
বিশ্বের যাবতীয় পদার্থই কোন না কোন সময়ে উৎপত্তি হইয়াছে। এমন কি পবিত্র বাইবেল গ্রন্থে সৃষ্টির দিন-তারিখও দেওয়া আছে। সে যাহা হউক, কোন কিছু বা সব কিছু সৃষ্টির পূর্বে — পদার্থশূন্য থাকিলেও যে ‘স্থান’ ছিল না, তাহা কল্পনা করা যায় না। সুতরাং বলিতে হয় যে, ‘স্থান অনাদি।‘
পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রাদি সৃষ্টি হইয়া কোন ‘স্থান’ এ অবস্থান করিতেছে এবং উহারা বিলয় হইলেও ঐ স্থান সমূহ থাকিবে। কেননা শূন্য স্থান কখনও বিলয় হইতে পারে না। সুতরাং বলিতে হয় যে ‘স্থান অনন্ত’।
পরম বিজ্ঞানী আইনস্টাইন বলিয়াছেন, “বিশ্ব অসীম অথচ সসীম।” অর্থাৎ নক্ষত্র-নিহারিকাদর পার্থিব জগত সসীম, কিন্তু ‘স্থান’ অসীম। বিশ্বের ‘শেষ প্রান্ত’ বলিয়া এমন কোন সীমারেখা কল্পনা করা যায় না, যাহার বহির্ভাগে আর ‘স্থান’ নাই। সুতরাং “স্থান অসীম”।
আমরা দেখিতে বা অনুভব করিতে পারি শুধু পদার্থকে, স্থানকে নয়। স্থান পদার্থের ন্যায় লাল, কালো, সবুজাদি রং এবং লম্বা-চওড়া ইত্যাদি আকৃতি বিশিষ্ট নয়। স্থানের কোন অবয়ব নাই। উহা আকৃতিহীন ও অদৃশ্য। অর্থাৎ নিরাকার।
২. কাল — কাল বা সময়কে আমরা দেখিতে পাই না, দেখিতে পাই শুধু ঘটনাকে। কেহ কেহ বলেন যে ‘কাল’ বা ‘সময়’ নামে কোন কিছু নাই, ‘কাল’ হইল ঘটনা পর্যায়ের ফাঁক মাত্র। সাধারণত কালকে আমরা তিন ভাগে বিভক্ত করিয়া থাকি। যথা — ভূত, ভবিষ্যত ও বর্তমান। কিন্তু কেহ কেহ বলে যে ‘বর্তমান’ নামে কোন কালই নাই। কেননা কাল সতত গতিশীল। যাহা গতিশীল তাহার স্থিরতা বা বর্তমানতা অসম্ভব। ভবিষ্যৎ হইতে কাল তীব্রগতিতে আসে এবং নিমেষে অতীতে চলিয়া যায়। এক সেকেণ্ডকে হাজার ভাগ করিলে যে সময়টুকু পাওয়া যায়, সেই সময়টুকু কাল দাঁড়াইয়া থাকে না ‘বর্তমান’ নামে আখ্যায়িত হইবার প্রত্যশায়। বর্তমান হইল — অতীত এবং ভবিষ্যতের সন্ধিস্থল মাত্র। উহার কোন বিন্দুতেই কাল এতটুকু স্থিত বা বর্তমান থাকে না। তবে আমরা যে বর্তমান যুগ, বর্তমান বৎসর, বর্তমান ঘটনা ইত্যাদি বলিয়া থাকি, উহা হইল অতীত এবং ভবিষ্যতের সংমিশ্রণ। যাক সে কথা।
ঈশ্বর জগত সৃষ্টি করিয়াছেন কোন এক সময়ে। কিন্তু ‘সময়’ কে সৃষ্টি করিয়াছেন কোন সময়ে, তার কোন হদিস পাওয়া যায় না। এরূপ কল্পনা করা মোটেই কষ্টকর নয় যে, এমন একটি সময় ছিল, যখন কোনরূপ সৃষ্টিই ছিল না। কিন্তু সৃষ্টির পূর্বে যে, ‘কাল’ ছিল না, তাহা কল্পনা করা যায় না। কাজেই বলিতে হয় যে, কাল ‘অনাদি’। পক্ষান্তরে — মহাপ্রলয়ে সমস্ত সৃষ্টি ধ্বংস হইবার পর — কাল আর থাকিবে না, তাহাও মানব কল্পনার বাহিরে। সুতরাং বলিতে হয় যে, কাল ‘অনন্ত’।
বিশ্বে, মহাবিশ্ব অথবা আরও বাহিরে এমন কোন জায়গা নাই, যেখানে কাল নাই। কালকে কোন স্থানে সীমিত রাখা যায় না। সুতরাং কাল ‘অসীম’। অধিকন্তু কাল ‘নিরাকার’ও বটে।
৩. শক্তি — ‘শক্তি’ বলিতে আমরা বুঝি যে, উহা কাজ করিবার ক্ষমতা। শক্তিকে জানিতে বেশী দূরে যাইতে হয় না। কেননা উহা আমাদের নিজেদের মধ্যেই আছে, যাহার সাহায্যে আমরা উঠা-বসা, চলা-ফেরা ও নানাবিধ কাজকর্ম করিয়া থাকি। কিন্তু শুধু গায়ের শক্তিতেই সকল রকম কাজ করা যায় না, অন্যান্য রকম শক্তিরও দারকার। গায়ের শক্তিতে কোন কিছু দেখা বা শোনা যায় না, গায়ে জোর থাকা সত্ত্বেও অন্ধ বা বধির ব্যক্তিরা দেখে না বা শোনে না, উহার জন্য চাই দর্শন ও শ্রবণ শক্তি। শুধু তাই নয়, আরও অনেক রকম শক্তি আমাদের দরকার এবং উহা আছেও। যেমন — বাকশক্তি, ঘ্রাণশক্তি, স্পর্শশক্তি, ধীশক্তি, মননশক্তি ইত্যাদি এবং সর্বোপরি জীবনীশক্তি। আমাদের দেহের মধ্যে যেমন রকম-রকম শক্তি আছে, তেমন প্রকৃতিরাজ্যেরও নানাবিধ শক্তি আছে; যেমন — তাপশক্তি, আলোকশক্তি, বিদুৎশক্তি, রাসায়নিক শক্তি ইত্যাদি।