আদিম মানব সমাজে সৃষ্টিকর্তা সম্বন্ধে উক্তরূপ শিশুসুলভ কল্পনা হাস্যকর হলেও ওর উৎপত্তির কারণ এখন আর অজ্ঞাত নয়। কোনো কোনো অবোধ শিশু যখন তার মায়ের কাছে জিজ্ঞেস করে, “মা আমি এলাম কোখেকে?” তখন তার মা একটু বেকায়দায় পড়ে যায়। কেননা শিশুর সৃষ্টি অর্থাৎ তার ভ্রাণতত্ত্ব সম্বন্ধে সে বিশেষ কিছুই জানে না, একমাত্র যৌনমিলন ছাড়া। আবার যেটুকু জানে, তা-ও প্রকাশ্যে বলতে পারে না। পক্ষান্তরে কিছু একটা না বললেও তার মুরুত্ববীয়ানা বজায় থাকে না। তাই আত্মমর্যাদা ও মুরুত্ববীয়ানা বজায় রাখার জন্য মা শিশুকে বলে – তুমি আকাশ থেকে পড়েছে, তোমাকে পড়ে পেয়েছি বাগানে, তোমার বাবা তোমাকে কিনে এনেছে বাজার থেকে ইত্যাদি। তখন সরলমনা শিশু মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে তার মায়ের বাণী। এভাবেই তৈরী হচ্ছিলো আদিম মানবদের ঐসব ঈশ্বর ও জগত সৃষ্টির উপাখ্যানগুলো মানুষের জাতীয় জীবনের শৈশবে। কিন্তু কোনো শিশু যদি মাতৃভক্তির আতিশয্যে যৌবনেও তার মায়ের ঐসব বাণী বিশ্বাস করে, তবে সে দুটি খেতাব পেতে পারে ; তার একটি হচ্ছে মাতৃভক্ত অপরটি ‘উন্মাদ।
মানুষের জাতীয় জীবনের শৈশবে তৎকালীন অঞ্চলবিশেষের গোষ্ঠিপতি, মোড়ল বা সমাজপতিরা শিশুর মায়ের মতোই বুঝিয়েছেন অবোধ জনসাধারণকে বিশ্বসৃষ্টি ও সৃষ্টিকর্তা সম্বন্ধে নানান কালপনিক কাহিনী, যা বিশ্বাস করেছে তারা মনেপ্রাণে শিশুদের মতোই। বিশেষত পরবর্তীরা তা উপভোগ করেছে উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পত্তির মতো।
মানুষের জাতীয় জীবনের কৈশোরে আগেকার মতবাদগুলো আর পুরোপুরি বজায় থাকলো না, কিছুটা মার্জিত রূপ নিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করলে ধমীয় মতবাদরূপে। তখন সৃষ্টিকর্তা আবির্ভূত হলেন — পরমেশ্বর, পরমপিতা, যিহোভা, অহুরমযদা ইত্যাদি, শেষমেশ নিরাকার ব্রহ্ম। তা হলো যেনো ঝোপ কেটে জঙ্গল রোপণ করা। আর আজও মহান তপস্বীরা সগৌরবে বাস করেন (তাঁদের মনোরম) সেই জঙ্গলে।
মানুষের জাতীয় জীবনের যৌবনে বিংশ শতকের এ বিজ্ঞানের যুগেও বিজ্ঞানীরা যখন পদার্থের পরমাণু ভেঙ্গে তার অন্তর্নিহিত শক্তিকে কাজে লাগাচ্ছেন, মহাকাশে পাড়ি দিচ্ছেন এবং প্রস্তুতি নিচ্ছেন গ্রহান্তরে যাবার জন্য, তখনো তপস্বীরা গবেষণা চালাচ্ছেন ‘মার্গ দিয়ে বদবায়ু বেরুলে তাতে ভগবানের আরাধনা চলে কি-না — এই জাতীয় ব্যাপার নিয়ে।
০৪. আধুনিক দেবতত্ত্ব
প্রখ্যাত পুরাতত্ত্ববিদ এরিক ফন দানিকেনের মতে – ‘দেবতা বলে আমরা যে এক শ্রেণীর অস্তিত্ববিহীন কাল্পনিক জীবের নাম শুনে থাকি, তাঁরা সকলেই অস্তিত্ববিহীন কাল্পনিক জীব নন। বহু দেবতার বাস্তবতার প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন দেশের পুরাতত্ত্বের মাধ্যমে। গ্রীস, মিশর, ব্যাবিলন ও ভারতাদির পুরাণ-পুথিপত্তরসমূহে দেখা যায় যে, দেবতারা স্বর্গের অধিবাসী। তাঁরা এসেছিলেন স্বৰ্গদেশ থেকে পৃথিবীতে। বস্তুত তারা ছিলেন মহাকাশের কোনো অজানা গ্রহবাসী সুসভ্য মানুষ। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা এবং সাংস্কৃতিক জীবনে তারা ছিলেন পৃথিবীবাসী মানুষের চেয়ে বহুগুণে উন্নত। মানুষ যেমন আজ মহাকাশযান তৈরী করে মহাকাশযাত্রা শুরু করেছে, প্রস্তুতি নিচ্ছে গ্রহান্তরে যাবার জন্য, এমনভাবে উদ্যোগ নিয়েছিলেন তাঁরা হাজার হাজার বছর পূর্বে। যার ফলে তাঁরা আবিষ্কার করেছিলেন ‘পৃথিবী নামক আমাদের এ গ্রহটিকে। তাঁরা অবতরণ করেছিলেন ভূপৃষ্ঠে, বসবাসও করেছিলেন কিছুদিন কোনো কোনো দেশে কোনো এক যুগে। সে যুগের মানুষ তাদের অবয়ব, শৌর্য-বীর্য ও জ্ঞান-গরিমা দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়েছিলো। সেদিনের মানুষের কাছে তারা পেয়েছিলেন ভক্তি, অর্ঘ্য, নৈবেদ্য এবং দেব, প্রভু ঈশ্বর ইত্যাদি আখ্যা। যেমন পেয়েছিলেন কলম্বাস সাহেব আমেরিকার আদিম অধিবাসীদের কাছে। দেবতারা রথে (বিমানে) চড়ে আবলীলাক্রমে যাতায়াত করতেন স্বর্গে ও মর্ত্যে। অর্থাৎ বিমানযোগে পৃথিবী ও মহাকাশে তাদের নিজ গ্রহে। কোনো কোনো অভিযাত্রীদল একবার অভিযান চালিয়ে স্বগৃহে ফিরে যেতেন, কোনো কোনো দল আস্তানা করতেন, কোনো কোনো দল স্থাপন করতেন উপনিবেশ। যারা আস্তানা-উপনিবেশ স্থাপন করতেন, যে উদ্দেশ্যেই হোক – তারা মানুষের কোনো দলপতি, সমাজপতি বা রাষ্ট্রপতিকে বশবর্তী করে তার মারফতে (মানুষের কল্যাণ কামনায়) স্বমত প্রচার করতেন। তারা তাদের একান্ত ভক্তদের বর (আশীৰ্বাদ), রথ (বিমান) বা অস্ত্ৰাদি দান করতেন (অধুনা যেমন দান করে থাকে উন্নত দেশগুলো অনুন্নত দেশগুলোকে)। আবার অবাধ্য ব্যক্তিদের অভিশাপ দিতেন; আবশ্যক হলে যুদ্ধ করতেন।
ভাববাদী যিহিস্কেল (ইজেকিয়েল)-এর ঈশ্বরদর্শন সম্বন্ধে এক দীর্ঘ বিবরণ দৃষ্ট হয় পবিত্র বাইবেল গ্রন্থে। তাতে দেখা যায় যে, একদা (খৃ: পূ: ৫৯২) সদলে ঈশ্বর এসেছিলেন কবার নদীর তীরে যিহিকেলের সাথে সাক্ষাৎ করতে। দানিকেনের মতে – তা ছিলো গ্রহান্তরের কোনো এক বিমানবিহারী অভিযাত্রীদলের কবর নদীর তীরে অবতরণ। বিবরণটির কিয়দংশ এখানে উদ্ধৃত করছি।
“আমি দৃষ্টি করলাম, আর দেখ, উত্তর দিক হইতে ঘূর্ণিবায়ু, বৃহৎ মেঘ ও জাজ্জ্বল্যমান অগ্নি আসিল এবং তাহার চারিদিকে তেজ ও তাহার মধ্যস্থানে অগ্নির মধ্যবর্তী প্রতপ্ত ধাতুর ন্যায় প্রভা ছিল। আর তাহার মধ্য হইতে চারি প্রাণীর মূর্তি প্রকাশ পাইল। তাহদের আকৃতি এই – তাহাদের রূপ মনুষ্যবৎ। আর প্রত্যেকের চারি চারি মুখ ও চারি চারি পক্ষ। তাহদের চরণ সোজা, পদতল গো-বৎসের পদতলের ন্যায় এবং তাহারা পরিকৃত পিতলের তেজের ন্যায় চাকচিক্যশালী। তাহাদের চারপাশ্বে পক্ষের নীচে মানুষের হস্ত ছিল। চারি প্রাণীরই ঐরূপ মুখ ও পক্ষ ছিল ; তাহাদের পক্ষ পরস্পরসংযুক্ত ; গমনকালে তাহারা ফিরিত না ; প্রত্যেকে সম্মুখ দিকে গমন করিত।” উদ্ধৃতাংশটির স্থূল মর্ম এই – বিদ্যুৎচালিত কোনো আকাশযানযোগে সেখানে অবতরণ করলো একদল অভিযাত্রী, সংখ্যায় তারা চারজন।