ফরৌণ ইখনাটন এটনকে ঈশ্বর বলেছেন, এবং নিজেকে তাঁর ‘প্রিয়জন বলে দাবী করেছেন। আর এরূপ দাবী তো প্রায় সকল ধর্মবেত্তাই করেছেন। তাঁরা নিজেকে কেউ বলেছেন ঈশ্বরের প্রতিনিধি, কেউ বলেছেন প্রিয়জন, কেউ বলেছেন বন্ধু (দোস্ত) এবং কেউ তো পুত্রত্বেরও দাবী করেছেন। কিন্তু তাঁরা কেউ-ই ঈশ্বরের ঈশ্বরত্বের দাবী করেননি, ইখনাটনও তা করেননি।
১. পবিত্র কোরান – সূরায়ে আনআম, রু ৯, ৭৯ আ ।
ইখনাটন মিশরে একেশ্বরবাদ প্রচার করেছেন, এটনকে (সূর্যকে) ঈশ্বর) বলেছেন, দেবদেবীর মূর্তি ধ্বংস করেছেন এবং ঈশ্বরের নামে মন্দির ড়েছেন। এ প্রসংগে হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর জীবনাখ্যান তুলনা করা যেতে পারে। তিনিও কেনানে একেশ্বরবাদ প্রচার করেছেন, সূর্যদেবকে ঈশ্বর বলেছেন? (অবশ্য সে মতটি পরে পাল্টেছেন), দেবদেবীর মূর্তি ধ্বংস করেছেন এবং ঈশ্বরের নামে মন্দির (কাবা গৃহ) গড়েছেন। উভয়ে একই প্রকার কাজই করেছেন। অথচ তাদের একজন পেলেন পয়গম্বরী, আরেকজন হলেন কাফের।
এ যাবত যে সকল বিষয় আলোচনা করা হলো, তা সবই অতীত কাহিনী। বর্তমান প্রসঙ্গ হলো মোশি ও ফরৌণকে নিয়ে। এ হলো ইখনাটনের শতাধিক বছর পরের ঘটনা। মোশির সময় যিনি মিশরের ফরেীণ ছিলেন, তার নাম দ্বিতীয় রামেসিস (খৃ: পূ: ১৩১৭–১২৫১)। তার চরিত্র ছিলো ইখনাটনের চরিত্রের বিপরীত। ইখনাটনকে ধাৰ্মিক বললে রামেসিসকে বলতে হয় বিধমী। নতুবা ইখনাটনকে বিধমী বললে রামেসিসকে বলতে হয় ধাৰ্মিক ব্যক্তি। মূলত রামেসিস ছিলেন একজন ধর্মনিরপেক্ষ শাসনকর্তা। তিনি মিশরীয়দের ধর্মকর্মে পুনঃ স্বাধীনতা দান করেছিলেন। জবরদস্তি করে কোনো দেবতার পূজা করতে বলেননি বা নিষেধ করেননি কাউকে তিনি ইখনাটনের মতো। ধর্মের স্বাধীনতা পেয়ে মিশরীয়রা পুনঃ নানা দেবদেবীর পূজা শুরু করলো এবং পুরোহিতরা তাঁদের সাবেক মর্যাদা ও ক্ষমতা ফিরে পেলেন।
রামেসিস কারো ধর্মাধর্ম নিয়ে মাথা ঘামাননি মোটেও, আধুনিক কালের শাসকদের মতোই। তিনি মনোযোগী ছিলেন দেশের শান্তি-শৃঙ্খলা, অর্থ ও শিলেপান্নতি বিধানে এবং রাজ্যবিস্তারে। তাঁর প্রধান কীর্তি হলো একটি পিরামিড ও দুটাে মদির নির্মাণ।
মিশরের পিরামিডসমূহ পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের অন্যতম। তারই একটি পিরামিডের নির্মাতা ফরৌণ রামেসিস। তাঁর নির্মিত পিরামিডটি আজো অক্ষত অবস্থায় বিদ্যমান আছে, হয় তার গর্ভে আছে প্রায় তিন হাজার বছরের পুরাতন তাঁর মৃতদেহটিও। তিনি যে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্পকলা ও ঐশ্বর্যে অতি উন্নত ছিলেন, তাঁর নির্মিত একটি পিরামিড ও মন্দির দুটােই তার জুলন্ত প্রমাণ। নিম্নোক্ত বিবরণটি দ্বারা উক্ত মদিরদ্বয়ের স্থাপকের যোগ্যতার কিছুটা পরিচয় পাওয়া যাবে।
রাজা রামেসিস দুটাে মদির গড়িয়েছিলেন নীলনদের তীরে উত্তর মিশরের আবু-সিম্বিলে। বড়টাতে আছে রাজার চারটি মূর্তি। লম্বায় এক একটা ষাট ফুট। আসোয়ান বাঁধ তৈরী করার সময় নীলনদের জলধারার স্ফীতির হাত থেকে মদির দুটােকে বাঁচাবার প্রশ্ন উঠে। আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টার ফলে ইউনেসকোর (UNESCO) তত্ত্বাবধানে পাশ্চাত্য প্রকৌশলীদের মিলিত চেষ্টায় মদির দুটােকে ঠাইনাড়া করে ১৮০ ফুট ওপরে বসানো হয়। কয়েক বছর ধরে মাপজোক, হিসেবনিকেশ, আঁকা-জোকাতো ছিলোই, তার ওপর ছিলো নানা প্রাযুক্তিক সমস্যার সমাধানের প্রশ্ন। আধুনিক সব যন্ত্রপাতি এলো, কিন্তু পরিবহনের নানা যন্ত্রপাতি থাকা সত্ত্বেও বিশাল সেই প্রস্তরদানবকে বয়ে নিয়ে যাবার জন্যই তৈরী করতে হলো আরো অনেকগুলো যন্ত্র। মূর্তিগুলোকে কেটে ফেলতে হলো টুকরো টুকরো করে, কেননা পৃথিবীর বৃহত্তম ক্রেনেরও সাধ্য ছিলো না সে দানবদের নড়াবার, ১৮০ ফুট ওপরে টেনে তোলা তো দূরের কথা।
যাই হােক, কাটা টুকরোগুলোকে নম্বর দিয়ে তাদের নতুন জায়গায় নিয়ে আবার জোড়া লাগানো হলো। আধুনিক যন্ত্রপাতির বিরাট সমাবেশ যারা দেখেছিলেন, তাঁরা অবাক মনে প্রশ্ন করেছিলেন, “বিংশ শতাব্দীর প্রযুক্তি ছাড়াই সেই প্রাচীন মিশরীয়রা প্রকাণ্ড এ মদির কেমন করে খাড়া করেছিলেন?”
ফরেীণ দ্বিতীয় রামেসিস ছিলেন মোশির সমকালীন মিশরের শাসনকর্তা। তাঁর জ্ঞান-বিজ্ঞান, শৌর্য-বীৰ্য, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গুণ-গরিমা বিসর্জন দিয়ে তাকে এক কুৎসিৎ আখ্যায় আখ্যায়িত করা হয়েছে ‘খোদায়ী দাবীদার বলে। এর কারণ অনুমান করা চলে যে, তিনি কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মান্ধ ছিলেন না, ছিলেন ‘মুক্তমন-এর অধিকারী। মানব সমাজের বিভিন্ন দেশে এরূপ বহু দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়, যেখানে বহু প্রতিভাবান ব্যক্তির যাবতীয় গুণগরিমা ও সৌরভ-গৌরবকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে বাস্তবাদিতার অপরাধে।
মোশির সর্বপ্রধান বিভূতি ছিলো নাকি তাঁর হস্তের আসা (লাঠি)। তিনি তাঁর হাতের আসাখানি ভূমিতে ছেড়ে দিলে তা নাকি সৰ্প হয়ে যেতো এবং জীবন্ত সপের ন্যায় চলাফেরা করতে পারতো ও শক্রকে তাড়া করতো। মোশির জন্ম খ. পূ. ১৩৫৯ সালে এবং হযরত ইব্রাহিমের জন্ম খ. পূ, ২৩৪০ সালে। সুতরাং হযরত ইব্রাহিমের জন্ম মোশির জন্মের ৯৮১ বছর পূর্বে। সেই হযরত ইব্রাহিমের হাতে নির্মিত পবিত্র কাবা গৃহখানা আজও বিদ্যমান আছে। কিন্তু মোশির হাতের আসাখানা গেল কই?
০৩. ভগবানের মৃত্যু
মাধব – কি বলছেন মশাই আপনি, ভগবান কি নেই ?
নবীন — আমি শুনেছি যে, ভগবান নেই।
মাধব — ভগবান কোথায় গেছে?
নবীন — বোধ হয় যে, মারাই গেছে।
মাধব – কে বলেছে যে, ভগবান মারা গেছে, সংবাদদাতারা কেউ কি তার মৃত্যু স্বচক্ষে দেখেছেন?
নবীন — না, তা কেউ দেখেনি, ভগবানের কোনো বন্ধু-বান্ধব এমনকি তার স্ত্রী-পুত্ররাও তার মৃত্যু দেখেনি। সকলেই বলে অনুমান করে, তবে অনুমানটা সত্যি।
মাধব – ঘটনার বিস্তারিত খবর কিছু শুনেছেন কি?
নবীন — শুনেছি বেচারা ডুবিয়ে বায়লা মাছ ধরতে গিয়েছিলো গাঙ্গে, আর ফিরে আসেনি। কতোদিন গত হলো, কেউ তাকে কোথাও দেখেনি এবং শোনেওনি কোথায়ও তাকে দেখেছে বলে। হয়তো ভগবান জগতে নেই।
মাধব — আহা, বেচারা যদি মাছ ধরতে গাঙ্গে না যেতো, তাহলে তাকে এভাবে কুমীরের হাতে প্রাণ দিতে হতো না।
নবীন — না, এভাবে বা এ সময় না হলেও অন্যভাবে বা অন্য সময় ভগবানের মৃত্যু হতো। এইতো কমাস আগে ঈশ্বর ধোপা কলেরা ও খোদা বকস বসন্ত রোগে মারা গেলো ঘরে বসেই।