১. রাবণের রাজমহলকে (কখনো লঙ্কাকেও) হলা হয়েছে ‘স্বর্ণপুরী’। এতে রাবণের ঐশ্বর্য, শিল্প-নিপুণতা, সৌন্দর্যপ্রিয়তা, রুচিবোধ ইত্যাদি বহু গুণের পরিচয় মেলে। কিন্তু রামচন্দ্রের বাড়িতে এমন কিছুর উল্লেখ দেখা য্যা না, যার দ্বারা তাঁর ওসব গুণের পরিচয় পাওয়া যায়।
২. লঙ্কায় সীতাদেবী রক্ষিতা হয়েছিলেন রাবণের তৈরী অশোক কাননে। তা ছিলো রাবণের প্রমোদ উদ্যান, যেমন আধুনিক কালের ইডেন গার্ডেন। সে বাগানটিতে প্রবেশ করলে কারও শোকতাপ থাকতো না। তাই তার নাম ছিলো অশোক কানন। সে বাগানটির দ্বারা রাবণের সুরুচি ও সৌন্দর্যপ্রিয়তার পরিচয় পাওয়া যায়। অধিকন্তু তিনি যে একজন উদ্ভিদবিদ্যা বিশারদ ছিলেন তা-ও জানা যায়। তার প্রমাণ মেলে একালের সুপ্রসিদ্ধ খনার বচনে। খনা বলেছেন—
“ডেকে কয় রাবণ,
কলা-কচু না লাগাও শ্রাবণ।”
শত শত জাতের ফল-ফুল ও লতাগুল্মের বৃক্ষরাজির একস্থানে সমাবেশ ঘটিয়ে তা লালন-পালন ও সৌন্দর্যমণ্ডিত করে রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু জানা যায় না রামচন্দ্রের বাড়িতে কোনো ফুল-ফলের গাছ আদৌ ছিলো কি-না।
৩. রামচন্দ্র লঙ্কায় গিয়েছিলেন কপিকুলের (বানরের) সাহায্যে মাটি-পাথর কেটে বাঁধ নির্মাণ করে, দীর্ঘ সময়ের চেষ্টায়। কিন্তু লঙ্কা থেকে ভারতের দণ্ডকারণ্য তথা পঞ্চবটী বনে রাবণ যাতায়াত করেছিলেন “পুষ্পক” বিমানে আরোহন করে অতি অল্প সময়ে। রাবণ যে একজন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী বা বৈমানিক এবং কারিগরিবিদ্যা-বিশারদ ছিলেন, তা তার জ্বলন্ত প্রমাণ! এ ক্ষেত্রে রাবণের সহিত শ্রীরামের তুলনাই হয় না।
৪. রামচন্দ্র যুদ্ধ করেছেন সিএ মান্ধাতার আমলের তীর-ধনু নিয়ে। আর রাবণ আবিষ্কার করেছিলেন এক অভিনব যুদ্ধাস্ত্র, যার নাম ‘শক্তিশেল’। তা শক্তিতে ছিলো যেনো বন্দুকের যুগের ডিনামাইট। নিঃসন্দেহে এতে রাবণের বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় মেলে।
৫. রামচন্দ্রের নিক্ষিপ্ত শরাঘাতে রাবণের মুমূর্ষু সময়ে তাঁর কাছে গিয়ে রামচন্দ্র রাজনীতি সম্বন্ধে তাঁর উপদেশপ্রার্থী হয়েছিলেন এবং মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও তিনি রামচন্দ্রের সে প্রার্থনা পূর্ণ করেছিলেন ধীর ও শান্তভাবে, সরল মনে। এতে প্রমাণিত হয় যে, রাবণ সে যুগের একজন রাজনীতি-বিশারদ ছিলেন। অধিকন্তু ছিলেন ধৈর্য, সহন ও ক্ষমাশীল এবং প্রতিহিংসাবিমুখ এক মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
৬. রামায়ণ মহাকাব্যে রাবণকে বলা হয়েছে ‘দশানন’। কিন্তু বাস্তবে রাবণের দশটি মুণ্ডু নিশ্চয়ই ছিলো না। তবে তাঁর মাথায় মজ্জা অর্থাৎ জ্ঞান ছিলো দশটা মুণ্ডুর সমান। তা-ই রূপকে বিদ্রুপে অংকিত হয়েছে ‘রাবণ দশমুণ্ডু’ রূপে।
৭. রাক্ষস বা নরখাদক বলা হয়েছে রাবণকে। উপরোক্ত আলোচনাসমূহের পরে এ বীভৎস বিশেষনটি সম্বন্ধে আর কিছু সমালোচনা আবশ্যক আছে বলে মনে হয় না। তবুও প্রিয় পাঠকবৃন্দের কাছে একটি প্রশ্ন না রেখে পারছি না। রাবণের দাদা হচ্ছে পুলস্ত্য, পিতা বিশ্রবা, ভ্রাতা কুম্ভকর্ণ ও বিভীষণ, বৈমাত্রেয় ভ্রাতা কুবের এবং পুত্র ইন্দ্রজিৎ (প্রসিদ্ধ বৈমানিক); এঁরা সকলেই ছিলেন সভ্য, ভব্য, সুশিক্ষিত, গুণী ও জ্ঞানী ব্যক্তি। এঁরা কেউই ‘রাক্ষস’ বা কাঁচামাংসভোজী মানুষ ছিলেন না। রাবণও তাঁর শৈশবকালাবধি মাতা-পিতার রান্না করা খাবারই খেয়েছেন নিশ্চয়। অতঃপর যৌবনে হঠাৎ করে একদিন তিনি খেতে শুরু করলেন জীবের কাঁচামাংস! বিমান বিহার, শক্তিশেল নির্মাণ ও অশোক কানন তৈরী করতে জানলেও তিনি রান্নার পাকপাত্র গড়তে বা রান্না করতে জানেন নি। বেশ ভালো। কিন্তু তিনি কোথায় বসে, কোন দিন, কাকে খেয়েছেন—তার একটিরও নামোল্লেখ নাই কেন?
৮. রাবণের সন্তানাদি সম্বন্ধে একটি প্রবাদ আছে—
“একলক্ষ পুত্র আর সোয়ালক্ষ নাতি,
একজন না থাকিল বংশে দিতে বাতি।”
আর অপর একটি প্রবাদ আছে—
“যাহা কিছু রটে
তার কিছু বটে।”
প্রবাদবাক্যের লক্ষ পুত্র না হোক তার শতাংশ সত্য হলেও রাবণের পুত্রসংখ্যা হয় এক হাজার এবং তার অর্ধাংশ সত্য হলেও সে সংখ্যাটি হয় পাঁচশ’। আর তা-তো বিস্ময়ের কিছু নয়। জন্মান্ধ ধৃতরাষ্ট্রও ছিলেন একশ’ এক পুত্রের জনক। আর রাম? তাঁর পুত্রের সংখ্যা কথিত হয় মাত্র দু’টি, বলা চলে একটি। কেননা তারা ছিল সীতার এক গর্ভজাত, যমজ সন্তান। তদুপরি সে পুত্রযুগল জন্মেছিলো নাকি রামচন্দ্রের বিবাহের তেপ্পান্ন বছর পর (বাস্তব ১২+১৪=২৬ বছর পর)। বছরের এ হিসেবটা প্রিয় পাঠিকদের কাছে একটু বেমানান বোধ হতে পারে। তাই বছরগুলোর একটা হিসাব দিচ্ছি। বিবাহান্তে রামচন্দ্র গৃহবাসী ছিলেন ১২ বছর, বনবাসী ১৪ বছর এবং গৃহে প্রত্যাবর্তন করে রাজাসনে কাটান নাকি বাকি ২৭ বছর (ঐ ২৭ বছর উদ্দেশ্যমূলক, কাল্পনিক)। এর পর ‘কলঙ্কিণী’ বলে প্রাথমিক অন্তঃসত্ত্বা সীতাদেবীকে নির্বাসিত করা হয় বাল্মীকির তপোবনে, সেখানে জন্মে সীতার যুগল সন্তান কুশ ও লব।
সীতাদেবী বন্ধ্যা ছিলেন না এবং উক্ত তেপ্পান্ন বছরের মধ্যে বনবাসকালের দশ মাস (অশোক কাননে রাবণের হাতে সীতা বন্দিনী ছিলেন ১০ মাস) ছাড়া বায়ান্ন বছর দু’মাস সীতা ছিলেন রামচন্দ্রের অঙ্কশায়িনী। তথাপি এ দীর্ঘকাল রতিবিরতি রামচন্দ্রের বীর্যহীনতারই পরিচয়, নয় কি?