কন্ট্রোল থেকে উঠে এসে রামু আমার হাত স্পর্শ করে বলল, তোমাকে ফিরকন তোমার হোটেলে পৌছে দেবে। আশা করি তোমার সঙ্গে আবার দেখা হবে।
ফিরকন ও আমি স্কাউট থেকে বেরিয়ে এলুম। কিছুদূর হেঁটে গিয়ে গাড়ীতে উঠলুম। সেই পন্টিয়াক গাড়ী সেই নির্জন প্রান্তরে তখনও দাঁড়িয়ে ছিল। ফিরকন গাড়ী চালিয়ে আমাকে নিয়ে চলল। পথে একটাও কথা হলো না। আমি অভিভূত, কথা বলার ক্ষমতা হারিয়েছি। জানি না আমার মতো এই বিরল অভিজ্ঞতা আর কারও হয়েছে কি না !
হোটেলের সামনে থেকে গাড়ী থামিয়ে ফিরকন আমার হাত স্পর্শ ক্রে বলল, শিগগির আবার দেখা হবে, তোমাকে আমরা জানিয়ে জানিয়ে দেব মানে তুমি নিজেই অনুভব করবে – কবে, কখনও কোথায় আমাদের দেখা হবে (এর পরেও নাকি এ মহাকাশচারীদের সাথে জর্জ অ্যাডামস্কির একাধিকবার যোগাযোগ ঘটেছিল। শেষবারে ঘটেছিলো ১৬ মার্চ, ১৯৬২ সালে – লেখক)।
আমি গাড়ী থেকে বেরিয়ে এসে হাত তুলে ফিরকনকে বিদায় জানালুম। রাস্তা তখন নির্জন, একটিও লোক ছিল না। হোটেলে প্রবেশ করে নিজের ঘরে ঢুকলুম। এই প্রথম আমার ঘড়ির কথা মনে পড়ল, দেখলুম শেষরাত্রি, ৫টা বেজে ১০ মিনিট। এই কয়েক ঘন্টার মধ্যে মহাশূন্যে আমি অন্তত পঞ্চাশ হাজার মাইল ঘুরে এসেছি।
খাটের প্রান্তে বসে পড়লুম। শুতে ভুলে গেলুম। কিন্তু চিন্তা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙল বেলা আটটার সময়।
ব্রেকফাষ্ট সেরে বাসে চেপে আমি প্যালোমারে ভ্যালি সেন্টারে আমার বাড়িতে ফিরে এলুম।
প্ল্যানেট মিসট্রি, চিরঞ্জীব সেন, ১ম প্রকাশ ১৩৮৬, পৃ. ৫৬–৬৪, ৬৬–৭৭।
দূর অতীতের মানুষের কাছে স্বর্গ তথা আকাশ ভ্রমণ করাটা ছিলো একটি অলৌকিক ব্যাপার। তা বিশ্বাস করা শুধুমাত্র ধমীয় দৃষ্টিতেই সম্ভব ছিলো – ঐশ্বরিক ঘটনা বলে। অলৌকিকে বিশ্বাস রাখে এবং রাখে না, এমন কিছু মানুষ সেকালেও ছিলো এবং একালেও আছে। কিন্তু লৌকিকে বিশ্বাস রাখে না, এমন মানুষ সব যুগেই বিরল। কেননা বাস্তবকে অবিশ্বাস করার মানে নিজেকেই অবিশ্বাস করা।
মহাকাশ তথা স্বর্গ ভ্রমণ এখন আর অলৌকিক নয়, বর্তমানে তা হচ্ছে একান্তই লৌকিক ঘটনা। মানুষ চাঁদে অবতরণ করেছে, তা এখন গুরুবাদীরাও অস্বীকার করতে পারেন না। শুক্র, মঙ্গল ইত্যাদি গ্রহে রকেট পাঠানো হচ্ছে। নিকট ভবিষ্যতে হয়তো সেখানেও মানুষ অবতরণ করবে।
সৌরজগতের ভিতরে ও তার বাইরে নক্ষত্র-জগতের কোনো গ্রহে কোনোরূপ বুদ্ধিমান জীব আছে কি-না, তার খোজখবর নেওয়া হচ্ছে এবং তাদের সাথে বেতার যোগাযোগের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে নাকি ইংগিতও পাওয়া যাচ্ছে দূর আকাশে বুদ্ধিমান কোনোরূপ জীব থাকার।
জর্জ অ্যাডামকির মহাকাশ ভ্রমণের বিবৃতিটি হচ্ছে লৌকিক ঘটনার একটি বাস্তবভিত্তিক বর্ণনা। জানি না আধুনিক সুধীমহল বিশেষত বিজ্ঞানীমহল তা কোন পর্যায়ে নিয়ে যাবেন। অ্যাডামকির বর্ণনার বাস্তবতা প্রমাণিত হলে — দূরতীতের সকল মহাকাশচারীদের মহাকাশ্চারণও অনুরূপ সত্য, একথা অনুমান করা অসঙ্গত নয়।
ঈশ্বর নিরাকার ও সর্বব্যাপী, ধৰ্মজগতে ইহা সর্বত্র স্বীকৃত। ধর্মজগতের বাইরে নাস্তিকমহলে তথাকথিত ঈশ্বরকে মেনে নেয়া হয় না বটে, তবে তাঁরাও এমন একটি মৌলিক শক্তিকে ‘বিশুনিয়ন্তা বলে মেনে নিয়ে থাকেন যে, সে শক্তিও নিরাকার এবং সর্বব্যাপী। এ ক্ষেত্রে আস্তিক ও নাস্তিক মতবাদে বিশেষ পার্থক্য নেই। কিন্তু নাস্তিকরা – ‘নিরাকার অথচ ‘সাকার, এরূপ দ্বিমুখী ঈশ্বরতত্ত্ব মেনে নিতে রাজী নন। তাই তাঁদের বলা হয় নাস্তিক।
ধৰ্মজগতে সাকার ও নিরাকার – এ দুধরণের মতবাদ প্রচলিত থাকলেও নিরাকারবাদীগণও প্রকারান্তরে সাকারবাদীই বটে। যেহেতু বলা হয় যে, ঈশ্বর দেখেন, শোনেন, কথা বলেন, ক্রুদ্ধ হন, খুশি ও বেজার হন, সময়ে হাটাচলাও করেন এবং তিনি বসে আছেন মহাশূন্যের একটি নির্দিষ্ট স্থানে (সিংহাসনে)। সেখানে বসেই নাকি তিনি দূতের মারফতে পৃথিবীর মানুষকে সদুপদেশ দান করেন, যাবতীয় কার্য পরিদর্শন ও পরিচালনা করেন এবং সময় সময় পৃথিবীতেও আসেন ; যেমন এসেছিলেন হযরত মুসা (আ.)-এর সাথে বাক্যালাপ করার জন্য তুর পর্বতে।
মহাকাশ ভ্রমণকারী মনীষীগণ মহাকাশ ভ্রমণে গিয়ে যে ঈশ্বরের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন এবং যার কাছে মানব-কল্যাণের জন্য নানাবিধ আদেশ-উপদেশ প্রাপ্ত হয়েছিলেন — তিনি প্রভু, মহাপ্ৰভু যিনিই হােন, তিনি সর্বব্যাপী ও নিরাকার ঈশ্বর নন, নির্দ্ধিতায় তা ‘অনুমান’ করা চলে।
০৬. শয়তানের জবানবন্দি
বোশেখ মাস, আকাশ পরিষ্কার, বায়ু স্তর। রাতটি ছিল অতি গরমের। বৈঠকঘরের বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছি ; ঘুম আসে না গরমে। মনে হয় যেনো জাহাজে বয়লারের কাছে শুয়েছি অন্যত্র জায়গা না পেয়ে। মনটা ছোটাছুটি করছে তাপের লেজ ধরে কল্পনাজগতের নানা পথে। ভাবছি তাপ দুপ্রকার – কৃত্রিম ও প্রাকৃতিক। কৃত্রিম তাপ কমানো যায়, বাড়ানো যায়, নতুবা তাপের উৎস থেকে দূরে সরে যাওয়া যায়। কিন্তু প্রাকৃতিক তাপের বেলায় সবসময় তা পারা যায় না। আজকের এ তাপের উৎস হচ্ছে সূর্য। যার স্থানীয় তাপমাত্র ৬০০০ হাজার ডিগ্রী (সে) এবং দূরত্ব ৯ কোটি ৩০ লক্ষ মাইল। শোনা যায় যে, দোজখের আগুনের তাপ নাকি সে আগুনের চেয়ে ৭০ গুণ বেশী। অর্থাৎ ৪,২০,০০০ ডিগ্রী (সে) এবং তা হবে মানুষের কাছে দূরত্বহীন। কেননা সে আগুনের ভিতরেই নাকি থাকতে হবে তাবৎ বিধমী বা অধাৰ্মিক মানুষকে। তা-ও আবার দশ-বিশ বছর নয়, অনন্তকাল। মানুষের এহেন কষ্টভোগের কারণ নাকি একমাত্র শয়তান। তাই বিশ্বাসী মানুষ মাত্রেই শয়তানের উপর অত্যন্ত ক্ষ্যাপা।