আমি দেখলুম – আমাদের পৃথিবীর ওপর সূর্যের আলো পড়েছে পৃথিবী জুলজুল করছে, কিন্তু চাঁদের মতো তার আলো স্নিগ্ধ নয়।
অন্ধকার আকাশে আমি দেখলুম কত নক্ষত্র, কেউ জোনাকির মতো ঝিকঝিক করছে, কারও দীপ্তি প্রখর, কারো স্নান। আমি অভিভূত ও আমাকে সমস্ত ক্যারিয়ার দেখাল। বলল, এটা তো ছোট, এতে মাত্র তিরিশজন মানুষ আছে, কিন্তু আমাদের এমন স্পেসশিপ আছে যা হাজার হাজার মানুষ বহন করতে পারে।
আমি প্রশ্ন করি, সেই বিশাল স্পেসশিপের মালিক কোন গ্ৰহ?
কোনো গ্রহই নয়। যখন যার দরকার সে ব্যবহার করতে পারে। ইলমুখ বলল, তুমি বুঝি কেবল তিনটি গ্রহের কথা ভাবছ? এই মহাশূন্যে অনেক গ্রহ আছে, যেখানে সভ্য ও উন্নত মানুষ বাস করে। তাদের কেউ আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে, আবার অনেকে তোমাদের চেয়েও পিছিয়ে আছে।
আমি জিজ্ঞাসা করি, তুমি যে এখন কন্ট্রোল রুম থেকে চলে এসেছ, তা তোমার ডিউটি কে করছে?
কেন? রোবট আছে। সে এই স্পেসশিপ চালাচ্ছে। তবে কন্ট্রোল রুমে অরথন আছে, আমি ফিরে গেলে অরথন আসবে, তোমার সঙ্গে কথা বলবে।
দেওয়ালে কয়েকখানা ছবি টাঙানো রয়েছে। বেশিরভাগ প্রাকৃতিক দৃশ্য। কিন্তু আমার চোখের সামনে একটা দরজার মাথায় বেশ বড় একখানা ছবি টাঙানো রয়েছে। ছবিখানা দেখে আমার মনে হলো এ ছবি নিশ্চয়ই কোনো দেবতার।
সে দেবতার নাম কি? আমি কালনাকে প্রশ্ন করি — এ ছবি কি কোনো দেবতার? তাঁর নাম কি?
তোমরা যাকে দেবতা বল ইনি তা নন, তবে ইনি হলেন আমাদের মহত্তম পুরুষ। আমি একে দেখিনি, এর কত বয়স আমি জানি না, কোন গ্রহে থাকেন তা-ও জানি না, তবে শুনেছি এরই নির্দেশে আমরা পরিচালিত হই।
তোমাদের ভেতর কেউ দেখেনি? আমি প্রশ্ন করি।
হ্যা দেখেছেন, তাকে তুমিও শীঘ্রই দেখতে পারে, তোমাদের ভাষায় তিনি আমাদের প্রভু (ঈশ্বর)। আমরাও রূচিৎ তাকে দেখতে পাই। এই মহাকাশযানে তিনি আছেন, কিন্তু আজও তার দর্শন পাইনি। তোমাকে কিছু বলবার জন্য তিনি এসেছেন, তোমার সঙ্গে আমরাও তার দর্শন পাব, তার কথা শুনবো, তার দেওয়া উপদেশ পালন করব।
পৃথিবী ছাড়ার পর থেকে আমি বোধহয় মহাশূন্যে একঘন্টাকাল বিচরণ করছি, কিন্তু এর মধ্যে আমার মনের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন ঘটে গেছে। বসে বসে এইসব কথাই চিন্তা করছি।
হঠাৎ অনুভব করলুম আমার সামনের চেয়ারে কোনো জ্যোতির্ময় পুরুষ বসে আছেন। মুখ তুলে দেখি ঠিক তাই। তাঁকে দেখে আমার মনে হলো, আমি কি মীশুর সামনে বসে আছি? তাকে দেখছি?
না, ইনি যীশু নন, তবে নিঃসন্দেহে একজন মহাপুরুষ। শুনলুম এর বয়স হাজার বৎসর। সে কি? দেখে তো মনে হচ্ছে শত বৎসর পূর্ণ হতে এখনও অনেক দেরি।
আমার মনের ভাব বুঝতে পেরে রামু বলল, আমরা যেমন পুরনো জামা ত্যাগ করে নতুন জামা পরি, ইনিও তেমনি পুরনো দেহ ত্যাগ করে নতুন দেহে প্রবেশ করেন।
তিনি (মহাপ্রভু) কিন্তু আমার সঙ্গে খুব সাধারণভাবে কথা আরম্ভ করলেন। বললেন, তোমাকে আমরা আমাদের ছোট ও বড় আকাশযান দেখিয়েছি, নক্ষত্ৰলোকের সঙ্গে কিছু পরিচয় করিয়ে দিয়েছি, যাতে তুমি পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে তোমার দেশবাসীকে এসব কথা বলতে পারো। পৃথিবী যে পারমাণবিক শক্তি নিয়ে পরীক্ষা করছে এবং মারণাস্ত্র তৈরী করছে, এজন্য তিনি শংকিত। পার্থিব মানুষের ঐখানেই ক্রটি, তারা শান্তিতে বাস করতে পারছে না।
তিনি বললেন, আমাদের বিষয়ে তোমাদের কিছুই জানা নেই, আমরা আমাদের বিষয়ে জানাবার জন্যে দীর্ঘদিন থেকে চেষ্টা করছি, কিন্তু তোমাদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছি না। তিনি অনেক কথা বললেন, যার মূল সুর হলো শান্তি।
তাঁর কাছ থেকে জানলুম যে, তাঁরা পৃথিবীতে মাঝে মাঝে সৎ মানুষ পাঠাচ্ছেন, যারা মানুষকে সংশিক্ষা দিয়ে উন্নত স্তরে পৌছে দিতে পারেন। যীশু হলেন এইরকম একজন মানুষ। যীশুকে তারাই পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। পৃথিবী থেকে কিছু মানুষ তারা উঠিয়ে (মে’রাজে) এনে, তাদের শিখিয়ে আবার পৃথিবীতে ফেরত পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, পৃথিবীর মানুষ তাদের বুঝতে পারেনি, তাদের শিক্ষা গ্রহণ করেনি , তাদের তারা পাগলা গারদে নিক্ষেপ করেছে বা হত্যা করেছে।
বিদায় নেবার আগে তিনি বললেন যে, এখনও সময় আছে। তিনি আশা করেন যে, পৃথিবীর মানুষ সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে শান্তিতে বাস করবে। শেষ কথা বললেন, সেই মহত্তম পুরুষ যাকে আমরা মানবশ্রেষ্ঠ বলে মনে করি, যার ছবি তুমি দেখতে পাচ্ছ, তাঁর আশীৰ্বাদ তোমার ওপর বর্ষিত হােক। পৃথিবীতে ফিরে গিয়ে তুমি আমাদের কথা বোলো।
তিনি বিদায় নেবার সঙ্গে সঙ্গে রামু ফিরকন, কালনা এবং অরথন এসে আমার সঙ্গে নানা বিষয় আলোচনা করতে লাগল। মাঝে মাঝে ইলমুথ এসে যোগ দেয়।
বেশ আলোচনা চলছিল এমন সময় রামু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, চল এবার তোমাকে পৌছে দিয়ে আসি, আজ সময় হয়ে গেছে। স্কাউট রেডি করা হয়েছে। ফিরকন আমাদের সঙ্গে যাবে।
সকলের কাছে বিদায় নিয়ে আমি রামু ও ফিরকনের সঙ্গে স্কাউট গিয়ে উঠলুম। রামু কন্ট্রোলের সামনে বসল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল।
আমি চুপ করে বসে আছি। আমি যেন আমার মধ্যে নেই। মনকে কিছুতেই স্থির করতে পারছি না। কি দেখলুম, কি শুনলুম এবং কি করব, নানারকম চিন্তা, সকল চিন্তাধারাকে কিছুতেই একটি ধারায় আনতে পারছি না।
কতক্ষণ যে এই অবস্থায় ছিলুম জানি না, ফিরকনের কথায় চমক ভাঙল, আমরা এসে গেছি, পৃথিবীতে পৌঁছে গেছি। এবার আমরা পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করছি না, মাত্র ছইঞ্চি ওপরে ভাসছি।