স্কাউট থেকে আমরা বেরিয়ে এলুম। বাইরে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল। তার হাতে একটা কেবল, কেবলের প্রান্তে কিছু একটা আটকানো রয়েছে। লোকটি আমাদের অভিবাদন জানিয়ে সেই কেবলটি স্কাউটের একটি অংশের সঙ্গে জুড়ে দিল।
আমি সেদিকে চাইতে রামু বলল, তোমাদের মটর গাড়ী যেমন পেট্রল পাম্পে দাঁড়ালে পাম্প থেকে নজল লাগানো হোসপাইপ দিয়ে পেট্রল ট্যাংকে পেট্রল ভরে দেওয়া হয়, এটাও সেই রকম করা হচ্ছে। তবে পেট্রলের বদলে আমরা অন্য শক্তি বা জ্বালানি ভরে দিচ্ছি। বাইরে যাবার জন্যে স্কাউট সব সময় প্রস্তুত রাখা হয়, কে জানে কার কখন ডাক পড়বে।
ভেতরটা বিরাট, প্রচুর জায়গা। এই ক্যারিয়ারশিপে ছটা স্কাউট থাকে। এর ভেতর যেমন কারখানা ও ল্যাবরেটরি আছে, তেমন সকল রকম আরামের ব্যবস্থাও আছে।
আমি শুধু ভাবছি, এত বড় একটা মহাকাশযান এমন নিশ্চল হয়ে কি করে দাড়িয়ে আছে।
একধারে মহাকাশযানটি চালাবার জন্যে বেশ বড় একটি কন্ট্রোল রুম রয়েছে। দেওয়ালে নানা রকম চর্ট, ম্যাপ, গ্রাফ। এর মধ্যে আবার এক জায়গায় একটি শক্তিশালী টেলিস্কোপ বসানো আছে।
সমস্ত মহাকাশযানটা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। কোনো গোলমাল নেই, নেই কোনো তাড়াহুড়োর লক্ষণ। একটা রেডিও রুম তো থাকা দরকার, কিন্তু সেরকম কিছু দেখা গেল না।
আমাকে বসতে বলা হলো। বসবার ব্যবস্থাও বেশ ভালো। সোফা, কৌচ, ডিভান এবং অনুচ্চ টেবিল দ্বারা সুসজ্জিত। সোফাগুলিও বেশ আরামপ্রদ। বেশ সুন্দর কোমল আলোয় মহাকাশযানটি আলোকিত। আমি আরাম করে বসলুম। যা কিছু দেখছি সবেতেই অবাক হচ্ছি। কিন্তু এবার যা দেখলুম তাতে আরও অবাক দেখলুম দুটি অপূর্ব সুদরী যুবতী (হুর-গেলমন?) আমার দিকে এগিয়ে আসছে। যুবতী এবং এত সুদরী মহাকাশচারী আমি আশা করিনি বলেই অবাক হলুম।
ওরা এসে প্রথমে তাদের হাত দিয়ে আমার হাত স্পর্শ করল এবং পরে অতি আলতোভাবে ওষ্ঠ দিয়ে আমার গাল স্পর্শ করল মাত্র। ওরা যে সুদরী সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু তাদের ত্বক প্রায় স্বচ্ছ ভালো করে তাদের অনাবৃত দেহ দেখলে বোধহয় দেহের অভ্যন্তরের রক্ত চলাচল এবং অন্যান্য ক্রিয়াকলাপ দেখা যাবে। একজন আমাকে এক গ্লাস পানীয় দিল শেরাবুন তহুর?)। পান করলুম, শুধু জল কিন্তু একটু ঘন। তেষ্টা পেয়েছিল, সব জলটুকু পান করে ফেললুম। জল পান করতে করতে লক্ষ্য করলুম যুবতী দুটির পরনে গোড়ালি পর্যন্ত বুলওয়ালা এবং কবজি পর্যন্ত হাতওয়ালা একরকম হালকা রঙের গাউন। সেই পোষাক কি কাপড়ের তা বলতে পারব না, তবে দেখে মনে হয় সিন্ধ। পায়ে স্যাণ্ডাল।
দুটি মেয়ের গায়ের রঙে সামান্য পার্থক্য। দুজনেই ফর্সা, তবে একজন ওরই মধ্যে সামান্য মলিন শুনলুম সে মঙ্গলবাসিনী। আমি তার নাম দিলুম ইলমুথ আর অপরজন শুনলুম ভেনাসবাসিনী। তার নাম ভেনাস দেওয়াই উচিত ছিল, কিন্তু আমি তার নাম দিলুম কালনা।
আমরা বসে কথা বলতে আরম্ভ করলুম। জানতে পারলুম যে, ওরা আরও বড় মহাকাশযান এবং দূরপাল্লার মহাকাশযান তৈরী করেছে। প্রতিটি মহাকাশযান স্বয়ংসম্পূর্ণ। ওরা মহাকাশে ঘুরে বেড়ায়। যে গ্রহে জীব আছে এবং তারা মানুষের মতই জীব, তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করাই হলো তাদের উদ্দেশ্য। তারাও অনেকে মহাকাশযান তৈরি করেছে এবং তারাও অন্য গ্রহের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করার উদ্দেশ্যে সেইসব গ্রহে যাওয়া-আসা করে। ব্যতিক্রম পৃথিবী। পৃথিবীবাসীরা গ্রহান্তরের জীবদের নাকি সুনজরে দেখে না।
আমি প্রশ্ন করলুম, তোমাদের ক্যারিয়ারশিপগুলোর গতিবেগ প্রতি সেকেণ্ডে কত মাইল ? অরথন উত্তর দিল। সে বলল, মহাশূন্যে যে প্রবাহ বইছে আমরা সেই প্রবাহ অনুসরণ করে প্রবাহ স্রোতে ভেসে যাই। সেই প্রবাহ স্রোতের যে গতি, আমাদের গতিও তাই।
অরথন আর ইলমুখ উঠে পড়ল। অরথন বলল, তাদের সময় হয়ে গেছে। আমি মনে মনে ভাবি, কিসের সময়? অরথন বোধহয় আমার মনের কথা বুঝতে পেরেছিলো, বলল, দেখতেই পাবে।
একটু পরেই দেখি, ওরা দুজনে এলো পাইলটের পোশাক পরে। আমাদের পৃথিবীর পাইলটের মতো নয়। এদের পোশাক অনেক হাল্কা। দেখে মনে হয় যেন স্কি করতে যাচ্ছে। কিন্তু যারা কি করে তারা পশমের মোটা পোশাক পরে। এদের পোশাকের স্টাইলটা সেই রকম কিন্তু অনেক হান্ধা। ওরা দুজনে এবার বিরাট স্পেস ক্যারিয়ার চালিয়ে নিয়ে যাবে।
কোথায় নিয়ে যাবে? কোনো একটি গ্রহে? মঙ্গল, ভেনাস, শনি? আমিই কি প্রথম মানুষ হবো এই গ্রহ তিনটির একটিতে অবতরণ করতে, নাকি আমার আগে ওরা অন্য মানুষ নিয়ে গেছে?
আমি বসে ফিরকন, রামু এবং কালনার সঙ্গে কথা বলতে লাগলুম। ওদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে এইটুকু বুঝেছিলুম যে, ওরা আমাদের পৃথিবীর সমস্ত খবরই রাখে। মাঝে মাঝে কন্ট্রোল রুম থেকে অরথন বা ইলমুথ এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে। ওরা আমার ওপর বেশ অনেক দিন থেকে নজর রেখেছিল এবং ঠিকই করে রেখেছিল যে, আমাকে ওরা ওদের মহাকাশযানে নিয়ে আসবে এবং ওদের নিজেদের পরিচয় ও উদ্দেশ্য জানাবে, যাতে আমি নাকি সে সব কথা পৃথিবীতে ফিরে এসে মর্ত্যবাসীদের জানাতে পারি। জানাতে তো পারি এবং জানাচ্ছিও। কিন্তু আমার কথা ক’জন বিশ্বাস করবে? অথচ আমি যা বলছি এর প্রতিটি কথা সত্য — কেউ বিশ্বাস করুক আর না-ই করুক।
এই তো ১৯৫১ সালে কোরিয়ার পশ্চিমে ইনচন উপসাগরে একটি সিপ্লেন থেকে সমুদ্রের ভেতরে একটি মিসাইল ক্ষেপণ করা হলো। উৎক্ষিপ্ত মিসাইলটি সবেগে সমুদ্রে ডুবে গেল, প্রতিক্রিয়ার ফলে সমুদ্রের জল একশ ফুট পর্যন্ত উচ্চে উঠল এবং একটু পরে দেখা গেল সেই শূন্যে মিলিয়ে গেল। ঠিক অনুরূপ ঘটনা ঘটেছিল স্কটল্যাণ্ড থেকে কিছু দূরে সমুদ্রে। এই ঘটনা শুনে কেউ তা বিশ্বাস করেনি। কিন্তু এ দৃশ্য বহু নরনারী প্রত্যক্ষ করেছে।
কন্ট্রোল রুম থেকে ইলমুথ একবার বেরিয়ে এসে বলল, আমরা এখন তোমাদের পৃথিবী থেকে পঞ্চাশ হাজার মাইল দূরে। ইলমুথ একটা পোর্টহেল খুলে দিয়ে আঙ্গুল দিয়ে দেখাল, ঐ তোমাদের পৃথিবী।