প্রায় দেড় ঘটা গাড়ী চলল। কোথায় যাচ্ছি বুঝতে পারছি না, বাইরে অন্ধকার (মে’রাজের ঘটনা সমস্তই ঘটেছে রাতে), এদিকের পথ-ঘাট আমি ভাল চিনিও না। আমিও জিজ্ঞাসা করিনি আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, ওরাও বলেনি।
সোজা রাস্তা ছেড়ে এবার গাড়ী ডানদিকে একটা কাঁচা রাস্তা দিয়ে চলতে লাগল।
মঙ্গলবাসী বলল, তোমাকে আমরা অবাক করে দেব, অপেক্ষা কর।
মনে মনে বলি, অবাক তো করেই দিয়েছ।
যাই হোক, গাড়ী যাচ্ছে। রাস্ত নির্জন, কোনো গাড়ী বা মানুষ চলছে না। পনের মিনিট কাটল। কিন্তু দূরে ওটা কি? ঝিকমিক করছে, আবার অনুজ্জ্বল কি যেন একটা দাড়িয়ে আছে মাটির ওপর।
গাড়ী যখন আরও খানিকটা এগিয়ে গেল, তখন চিনতে পারলুম, অ্যারিজোনার ডেজার্ট সেন্টারে তিন মাস আগে দেখা সেই রকম একটা ফ্লাইং সসার। ওরা ওটাকে বলল – স্কাউট (বোরাক?)।
এই সসার বা স্কাউট আমার দেখা সসারের মতো প্রায়, তবে এর কিছু বেশী বোধহয়, কুড়ি ফুট হবে।
গাড়ী থামল। স্কাউটের কাছে গাড়ী থেমেছে। গাড়ীতে বসে দেখতে পেলুম স্কাউটটির সামনে দাঁড়িয়ে একজন মানুষ কি কাজ করছে। গাড়ী থেকে নেমে আমরা সকলে সেই স্কাউটের কাছে এগিয়ে গেলুম। কাছে আসতে মানুষটি ঘুরে দাঁড়াল, আরে এতো আমার পরিচিত সেই ভেনুশিয়ান।
সে হাসিমুখে আমাকে অভ্যর্থনা করে বলল, তোমার জন্যে অপেক্ষা করছিলুম। লক্ষ্য করলুম, সেবার সে কথা বলেনি, আকারে-ইঙ্গিতে ও টেলিপ্যাথির সাহায্যে আমরা ভাববিনিময় করেছিলুম। কিন্তু এবার সে কথা বলল, তবে এদের মতো স্পষ্ট নয়।
সে আরও বলল, স্বকাউটটার একটা যন্ত্রাংশ খারাপ হয়ে গিয়েছিল, সেটা এই ফঁাকে মেরামত করে নিলুম। কথা বলতে বলতে সে ছোট ধাতব একটা পদাৰ্থ বালির ওপর ফেলে দিলো। আমি সেটা তুলে নিলুম এবং সেটি আমার কাছে এখনো আছে।
রাসায়নিকরা সেই ধাতুখণ্ডটি পরে পরীক্ষা করে রায় দিয়েছিলেন যে, এটি কোনো মৌলিক ধাতু নয়, একাধিক ধাতু মিশ্রিত অ্যালয়, তবে কি কি ধাতু মিশিয়ে অ্যালয় তৈরী হয়েছে তা তারা বলতে পারেননি।
আমি যখন সেই ধাতুখণ্ডটি তুলে নিয়ে পকেটে রাখছিলুম, তখন ভেনুশিয়ান মৃদু হেসে জিজ্ঞাসা করেছিল, ওটা নিয়ে কি করবে? আমি বলেছিলুম, পরে কাজে লাগতে পারে, তোমাদের সংস্পর্শে যে এসেছিলুম তার হয়তো প্রমাণ দিতে পারবো।
মৃদু হেসে ভেনুশিয়ান বলেছিল, তোমরা আর্থম্যানরা সুভেনির সংগ্রহ করতে ভালবাস, তাই না?
আমি প্রতিবাদ করিনি। আমিও মৃদু হেসেছিলুম।
এই ভেনুশিয়ানের সঙ্গে পরে আমার মাঝে মাঝে দেখা হয়েছিল, তবে মঙ্গলবাসী ও শনিবাসীর সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছিলুম। ওদের নাম জানিনা, জিজ্ঞাসাও করিনি। কিন্তু তাদের পরিচয়ের সুবিধের জন্য আমি মনে মনে ওদের নাম দিলুম। মঙ্গলবাসীর নাম দিলুম ফিরকন, শনিবাসীর নাম দিলুম রামু আর ভেনুশিয়ানের নাম দিলুম অরথন।
ফিরকন, রামু এবং অরথন এবার থেকে আমার সঙ্গী। পরে আরও সঙ্গী জুটেছিল। অরথন স্বাউটের ভেতর ঢুকবার সময় আমাকেও ভেতরে যেতে ইশারা করল। আমার হৃৎপিণ্ড বুঝি লাফিয়ে উঠলো। আমার আশা পূর্ণ হতে চলেছে। ফ্লাইং সসারের ভেতরে প্রবেশ করতে পারবো, হয়তো ওরা আমাকে মহাকাশে নিয়েও যাবে।
ফিরকন ও রামু আমাকে অনুসরণ করল। ফিরকন মনে সেই মঙ্গলবাসী বলল, কি তোমাকে বলেছিলুম না অবাক করে দেব?
অ্যাডামস্কি বলছেন, প্রথমেই আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো ছোট একটি ঘরে। ঘর ছোট হলে কি হবে, দরজা কিন্তু বেশ উচু। ঘরে ঢুকবার সময় শনিবাসী লম্বা রামুকেও মাথা নীচু করতে হলো না। ঘরে ঢুকে রামু মেঝের এক জায়গায় পা দিয়ে টিপতেই দরজা নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। মেঝের নিচে এবং স্কাউটের মাথায় কোথাও মৃদু একটা আওয়াজ হচ্ছে।
ঘরে ঢুকে আমি অবাক। কোনদিকে চাইব? ছোট ঘর হলেও দেখবার ও লক্ষ্য করবার মতো কত কি রয়েছে! দরজা বন্ধ, জানালাও দেখা যাচ্ছে না, চারিদিক বন্ধ অথচ নিশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে না। আরও লক্ষ্য করলুম যে, রামু ফিরকন বা অরথন মহাশূন্যে উঠবার জন্য বিশেষ কোনো পোশাক পরছে না বা আমাকেও পরতে দিচ্ছে না। তবে কি এরা আমাকে নিয়ে উপরে উঠবে না? সন্দেহের দোলায় দুলতে লাগলুম।
আমাকে এরা মহাশূন্যে বা অন্য কোনো গ্রহে নিয়ে যাক বা না যাক, আমি ততক্ষণে এই স্কাউটের গঠনপ্রণালী দেখে নিই।
প্রথমেই নজর করলুম, ঘরের মাঝখানে একটি স্তম্ভ, ছাদ থেকে মেঝে পর্যন্ত নেমে এসেছে। এই স্তম্ভটি নাকি মহাশূন্য থেকে চুম্বকশক্তি আহরণ করে আর সেই শক্তি হল এই স্কাউট চালক। স্তম্ভটি মেঝেতে দাড়িয়ে আছে বেশ বড় ও পরিষ্কার গোলাকার একটি লেন্সের ওপর। আর সেই লেন্স ঘিরে দুইপ্রান্তে দুটি অর্ধবৃত্তাকার বসবার বেঞ্চি রয়েছে।
লেন্সটির ব্যাস বোধহয় ছফুট হবে। লেন্সটির গঠন নিখুঁত। পরিষ্কার কিন্তু স্বচ্ছ নয়, অর্ধস্বচ্ছ।
ফিরকন আমাকে একটি বেঞ্চে বসতে বলল, নিজে আমার পাশে বসে যন্ত্রপাতির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিতে লাগল। উল্টোদিকের বেঞ্চে বসল রামু আর অরথন গেল কন্ট্রোল রুমে।
এবার বোধহয় স্কাউট ওপরে উঠবে। আমার সেকি পুলক, কি উত্তেজনা। অরথন কন্ট্রোল রুমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ও রামুর সামনে রবারের মতো কোনো জিনিস দিয়ে তৈরী একটা বার ধীর গতিতে পড়ল। ফিরকন আমাকে ওটা ধরতে বলল। স্কাউট ওপরে উঠবার আগে বাকুনি প্রতিরোধ করবার জন্যে এই বার। আমাদের প্লেনের সিটবেল্ট আর কি। আমার কাছে সব অবিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে। কিন্তু অবিশ্বাস করি কি করে? সবই তো আমার চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।