অপরজন মাথায় খাটাে, বয়স বোধহয় তিরিশ হয়নি, গোল মুখ বালকের মতো। বেশ ফর্সা, চোখের তারা নীলাভ ধূসর। মাথার চুল বাদামী এবং কোকড়ানো। কারও মাথায় টুপি নেই। দুজনে যেনো দুই ভিন্ন দেশের মানুষ।
দ্বিতীয় যুবক মি. অ্যাডামস্কি বলে হ্যাণ্ডশেক করবার জন্যে হাসিমুখে তার হাত বাড়িয়ে দিলো। তখনও আমি জানি না এরা কে ? কিন্তু যেই আমি হ্যাণ্ডশেক করলাম, আমনি আমার রক্ত চঞ্চল হয়ে উঠল।
এইতো ১৯৫২ সালের ২০ নভেম্বর তারিখে অ্যারিজোনার মরু প্রান্তরে ভেনাস গ্রহের সেই যুবক আমার সঙ্গে এইভাবে হ্যাণ্ডশেক করেছিল। এতক্ষণ আমার মনে সন্দেহ উকিঝুকি মারছিল, মারছিল, কিন্তু এবার আমি বুঝলাম এরা ভিন্ন গ্রহের মানুষ। কিন্তু দুজনের চেহারার এত পার্থক্য কেন ? পার্থক্য কেন পরে জানতে পেরেছিলুম।
ওদের মধ্যে যার বয়স কম সে আমাকে বলল, আমরা আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। আপনাকে আমরা এখন একটু বাইরে নিয়ে যেতে চাই। আপনার কি সময় হবে?
নিশ্চয় চলুন। আমি কিছু চিন্তা না করেই রাজি হয়ে গেলুম।
হােটেল থেকে আমরা বেরিয়ে পড়লুম, আমি মাঝখানে, ওরা দুপাশে দুজন। এক জায়গায় অনেক গাড়ী রাখা ছিল। একটা গাড়ীতে আমাকে ওরা উঠতে ইশারা করে নিজেরাও উঠল। কমবয়সী যুবকটি ড্রাইভারের সিটে বসল। গাড়ীখানা আমেরিকায় তৈরী, কালো রং, বেশ বড়, পন্টিয়াক সিডান।
আমরা বসার সঙ্গে সঙ্গে সে গাড়ী ছেড়ে দিল এবং যে কোন সুদক্ষ ড্রাইভারের মতো গাড়ী চালিয়ে নিয়ে চলল। পথ তার উত্তমরূপে চেনা বলে মনে হলো। আমার খুব অবাক লাগছিল, আমি কোনো কথা বলতে পারছিলুম না, মনে নানা প্রশ্ন।
নীরবতা ভঙ্গ করে অপর যুবকটি যেন আমার মনের কথা বুঝতে পেরে বলল, আপনার ধৈর্যের প্রশংসা করতে হয়, কারণ এতক্ষণ পর্যন্ত আপনি আমাদের সম্বন্ধে কোনো কৌতুহল প্রকাশ করেননি, জিজ্ঞাসাও করেননি আমরা আপনাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছি।
আমি মৃদু স্বরে বললুম, আমি জানি তোমরা নিজেরাই বলবে।
মৃদু হেসে যুবক বলল, ঐ ছেলেটা যে গাড়ী চালাচ্ছে ও হলো মঙ্গল গ্রহের বাসিন্দা, যাকে তোমরা বল মার্স আর আমি আসছি শনি অর্থাৎ স্যাটার্ণ থেকে।
যুবকের বাচনভঙ্গি স্পষ্ট এবং উচ্চ কণ্ঠে কথা বলে। কথা বলার ধরণ এমন চমৎকার যে, অবিশ্বাস করার কোনো কারণ পাওয়া যায় না।
গাড়ী চালাতে চালাতে কনিষ্ঠ যুবক বলল, আমরা হলুম আমাদের গ্রহের সঙ্গে যোগাযোগকারী ব্যক্তি, যাদের আপনারা বলেন “কস্টাইম্যান (সেকালের ফেরেস্তা?)। আমরা পৃথিবীতে কয়েক বছর হলো আছি, গোড়ার দিকে আমাদের ইংরেজী উচ্চারণে কিছুটা জড়তা ছিল, কিন্তু এখন তা আমরা কাটিয়ে উঠেছি। আমরা এখন আপনাদের সঙ্গে মিশে গেছি। অন্য গ্রহের মানুষ বলে কেউ আমাদের চিনতে পারে না, অবশ্য আমরাও আমাদের পরিচয় কারো কাছে প্রকাশ করি না।
জ্যেষ্ঠ যুবক বলল, সেটা বিপজ্জনক হবে, তবে দেখুন, পৃথিবীর মানুষ তাদের যতটা না চিনতে পারে, আমরা তার চেয়ে বেশী চিনতে পারি।
আমি বললুম, বুঝেছি, তুমি বলতে চাইছ যে, আমি আমাদের আর একজন মানুষকে যতটা না চিনতে পারি, তার চেয়ে তোমরা আমাদের আরও ভালো করে চিনতে পার, এই তো? ঠিক তাই, আচ্ছা একটা কথা, আপনি তো বিশ্বাস করেন যে, অন্য গ্রহে আমাদের মতোই মানুষ আছে এবং এজন্য আপনাকে অনেক বিদ্রুপ সহ্য করতে হয়েছে, কারণ আপনাদের বিজ্ঞানীরা বলেন যে, অন্য কোনো গ্রহে জীবন অসম্ভব। অতএব আপনি যদি এখন গাড়ী থামিয়ে চিৎকার করে রাস্তার মানুষদের বলেন যে, দেখ এই দুটি মানুষ, এরা পৃথিবীর নয়, একজন মঙ্গল গ্রহের এবং অপরজন শনি গ্রহের – তাহলে অবস্থাটা কি হবে?
তাহলে আমাকে তো পাগল বলবেই এবং তোমাদেরও হেনস্থা কম হবে না। কেউ বিশ্বাসই করবে না।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। আমার মনে কিন্তু এক মিনিটের জন্যেও সন্দেহ জাগেনি। আমি ওদের কথা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করেছি।
জ্যেষ্ঠ যুবক বলল, আমরা অবশ্য মাঝে মাঝে আমাদের গ্রহে ছুটি কাটিয়ে আসি। হ্যা, বলিনি, আমরা দুজনই এখানে চাকুরী করি এবং আমাদের মতো আরও অন্য গ্রহবাসী আছে।
আমার ইচ্ছে হয়েছিল, একবার জিজ্ঞাসা করি, তোমরা কি বিয়ে করেছ? তোমাদের বৌছেলেমেয়ে কি এখানে থাকে? কিন্তু পরমুহূর্তে মনে হলো, না ওরা একাই থাকে। কে জানে ওদের গ্রহে বিবাহ করার রীতি আছে, না অন্য কোনোরকম রীতি আছে। টেলিপ্যাথির দ্বারা ওরা যদি আমার মনের কথা বুঝতে পারে, তা হলে ওরা নিজেরাই জবাব দেবে।
আমি আবার মনে মনে ভাবতে লাগলুম, পৃথিবীতে তো আরো অনেক লোক আছে এবং অনেক বিজ্ঞানীও আছেন যারা বিশ্বাস করেন অন্য গ্রহে মানুষ থাকতে পারে না। তা ভিন্ন গ্রহের এই বাসিন্দারা তেমন মানুষ বা বিজ্ঞানীর সঙ্গে যোগাযোগ না করে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করল কেন? অবশ্য বায়ান্ন সালে বিশে জুন তারিখে ভেনাসের সেই মানুষটি আমাকে বলে গিয়েছিল যে, আমার সঙ্গে আবার যোগাযোগ করবে। কিন্তু এদের দুজনের মধ্যে কেউ তো ভেনাসের মানুষ নয়। কারণ যা-ই হোক, মনে মনে আমি কৃতজ্ঞ।
স্যাটারিয়ান অর্থাৎ শনিবাসী আমার মনের কথা বুঝতে পেরে বলল, তোমার সঙ্গে কিন্তু আমরা প্রথম যোগাযোগ করলুম না, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু কেউ আমাদের বিশ্বাস করেনি, কেউ করেছে, সে কথা সে অপরকে বলেছে, তার কথা তো বিশ্বাস করেনি উল্টো প্রচুর লাঞ্ছনা সহ্য করতে হয়েছে, এই ভয়ে বাকী ক’জন যারা আমাদের বিশ্বাস করেছে তারা আর মুখ খোলেনি।