জর্জ স্কুলে বেশিদিন পড়তে পারেন নি। কিন্তু তাই বলে যে লেখাপড়া শেখেননি তা নয়। বরঞ্চ বাড়িতে পড়ে তার বয়সী বালক-বালিকা অপেক্ষা বেশীই শিখেছিলেন। যখন তিনি একটু বড় হলেন, মনে যখন কিশোর, তখন তিনি ভাবতে শুরু করলেন – মানুষ ঝগড়া-বিবাদ না করে মিলে-মিশে থাকতে পারে না কেন? তখন থেকেই তিনি ভাবুক। আকাশের প্রতি আকর্ষণ ছিল সবচেয়ে বেশী। কিন্তু তিনি ইতিহাস এবং ভূগোল উত্তমরূপে পড়েছিলেন।
তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চান। কিন্তু জানতেন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবার সঙ্গতি তার বাপমায়ের নেই। এজন্যে তাঁর কোনো অভিযোগ ছিলো না। তিনি নিজে কাজ করতেন, রোজগার করতেন ; কিন্তু সংসারে দিয়ে এমন উদ্ধৃত্ত থাকতো না যা দিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারেন।
সারা দেশটাকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ভাবলেন। যেখানে যা বা যার কাছে যা পারলেন তিনি তাই শিখতে লাগলেন ; কোনো ব্যক্তিবিশেষের কাছেই হোক, লাইব্রেরীতেই হোক কিংবা মিউজিয়মেই হোক। শিক্ষা তাঁর সম্পূর্ণ হয়েছিলো।
১৯১৩ সালে জর্জ আমিতে যোগদান করেন। থাটিন্থ ক্যাভালরির সঙ্গে তাঁকে ডিউটিতে পাঠানো হয় মেকসিকো সীমান্তে। ১৯১৯ সালে তিনি আর্মি থেকে ছাড়া পান। তাঁর কাজের প্রশংসা করা হয়েছিলো। ইতিমধ্যে ১৯১৭ সালে বড়দিনের দিন মেরি সিমবারকির সাথে তাঁর বিয়ে হয়েছিলো। আমি থেকে ছাড়া পেয়ে রুজি-রোজগারের চেষ্টায় জর্জ অ্যাডামস্মিক বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন। এশহর থেকে ওশহর, ওগ্রাম থেকে এগ্রাম ঘুরে বেড়ান, যেখানে কাজ পান সেখানেই থেকে যান। এতে তাঁর অভিজ্ঞতাও বাড়ে প্রচুর, ভালোও লাগে ঘুরে বেড়াতে।
এভাবে চল্লিশ বছর পর্যন্ত কাটিয়ে দেবার পর অ্যাডামস্কি স্থির করলেন – আর ঘুরে বেড়ানো নয়, এবার থিতু হয়ে বসা যাক। লাগুনা বিচ নামে একটি গ্রাম বেছে নিলেন এবং সেখানে তিনি মাষ্টারী আরম্ভ করে দিলেন।
১৯৪০ সালে অ্যাডামকি লাগুনা বিচ থেকে ভ্যালি সেন্টারে উঠে গেলেন। “ভ্যালি সেন্টার হলো ক্যালিফোর্নিয়ায় পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মানমন্দির মাউন্ট প্যালোমার যাবার রাস্তায়। তাঁর বাড়ির নাম ‘প্যালোমার গার্ডেন’।
অ্যারিজোনার মরু অঞ্চলে ডেজার্ট সেন্টার গ্রাম। ১৯৫২ সালের ২০ নভেম্বর বৃহস্পতিবার সেখানে মহাকাশ (ভেনাস গ্রহ) থেকে ফ্লাইং সসারে আগত জনৈক মহাকাশচারীর সাথে অ্যাডামকির সাক্ষাৎ হয়। সে সাক্ষাৎকারের বিবরণ লিখে তিনি প্রকাশ করেন ফ্লাইং সসারস্ হ্যাভ ল্যাণ্ডেড নামে একখানা যুগান্তকারী বই। অতঃপর ১৯৫৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ার ফ্লাইং সসারে চেপে দুজন মহাকাশচারী অ্যাডামস্কিকে তাদের সাথে মহাকাশ ভ্রমণে নিয়ে যায় এবং ভ্রমণান্তে তাঁকে পৃথিবীতে তাঁর নিজালয়ে পৌঁছে দিয়ে যায়। এবারের ভ্রমণ বৃত্তান্ত লিখে তিনি ইনসাইড দি ফ্লাইং সসার নামে আর একখানা পুস্তক প্রকাশ করেন। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, উক্ত পুস্তকে জর্জ অ্যাডামকি তাঁর মহাকাশ ভ্রমণের যে বিবৃতি প্রকাশ করেছেন, তার সাথে সেকালের মেরাজের কাহিনীসমূহের মৌলিক পার্থক্য বিশেষ কিছুই নেই।
এখন জর্জ অ্যাডামকির সে ভ্রমণকাহিনীর কিছু অংশ তাঁর নিজের কথায়ই বলছি –
১৯৫৩ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ার আমি লসএঞ্জেলস শহরে এসে পৌছলুম। আমি বাস করি শান্ত একটি শহরে আর লসএঞ্জেলসে যত মানুষ, তত গাড়ী, তত গোলমাল আর রাত্রিবেলায় চোখ ধাধানে আলো। এই শহর আমার ভালো লাগে না। তবুও আমাকে আসতে হয়েছে, কারণ আমি ডাক পেয়েছি। কিসের ডাক? শীঘ্রই জানা যাবে।
শহরের কেন্দ্রস্থলে একটা হোটেলে আমি উঠেছি। নিজের ঘরে ঢুকে জানালা দিয়ে বাইরের আকাশে একবার চেয়ে দেখলুম। কেন? জানিনা। কোনো প্রেরণা লাভের উদ্দেশ্যে ? তাও তো বলতে পারছি না।
এখন সবে বিকেল চারটি বেজেছে। নিচে ককটেল বারে কিছু লোক আমাকে চিনে ফেলল। খ্যাতির বিড়ম্বনা। ইতিমধ্যে আমার বই ‘ফ্লাইং সসারস্ হ্যাভ ল্যাণ্ডেড প্রকাশিতও হয়েছে, রেডিও ও টিভিতে বক্তৃতা দিয়েছি। ক্লাবে, কলেজ হলে, বিজ্ঞান সভাতেও বক্তৃতা দিয়েছি, কাগজেও ছবি ছাপা হয়েছে।
আমাকে ওরা এক জায়গায় বসিয়ে নানা প্রশ্ন করতে লাগল। আমার খারাপ লাগছিল না। কোথা দিয়ে তিন ঘটা কেটে গেল। নিজের ঘরে ফিরে গেলুম। পোশাক পাল্টে বাইরে খেয়ে এলুম।
একজন মহিলার সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। তাকে টেলিফোন করলুম। তিনি বললেন, আমাকে যেতে হবে না। তিনিই আমার হােটেলে আসছেন। রাত্রি প্রায় সাড়ে দশটা পর্যন্ত কথা বলে মহিলা চলে গেলেন। আমি তাঁকে স্ট্রটকারে তুলে দিয়ে হােটেলের লবিতে বসে একটা সান্ধ্য সংস্করণ পড়তে লাগলুম।
কাগজ পড়তে ভালো লাগছে না। মন ভীষণ চঞ্চল। কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছি না। এমন সময় দুজন যুবক আমার দিকে এগিয়ে এলো। দুজনেই আমার অপরিচিত। কিন্তু তারা যেন আমাকে অনেকদিন থেকে চেনে। এইভাবে তারা আমার দিকে এগিয়ে এসে একজন আমাকে ডাকল, মি. অ্যাডামস্কি।
দুজনকে দেখে মনে হয় উঠতি ব্যবসায়ী। একজন ছফুটের ওপর লম্বা, বয়স আন্দাজ তিরিশ। দেহবর্ণ ইংরেজীতে যাকে বলে রাষ্ট্ৰী। চোখের তারা ঘোর বাদামী, দৃষ্টিতে বেশ কৌতুক মাখা। মাথার কালো চুল ব্যাকাব্রাশ করা।