উক্ত আলোচনাসমূহের দ্বারা অনুমান হয় যে, সেকালের ধমীয় বিধিবিধান ও সামাজিক আইন-কানুনসমূহ প্রায় সমস্তই প্রণয়ন ও প্রবর্তন করেছেন স্বৰ্গবাসী দেবতা বা ঈশ্বর নামীয় ব্যক্তিরাই – মুনি-ঋষি, নবী-আম্বিয়া, কোনো সমাজপতি বা কোনো রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে।
সেকালে দেবতারা স্বর্গ থেকে নেমে আসতেন পৃথিবীতে বলতে গেলে ঘনঘনই। আর বিভিন্ন দেশে তাদের সংখ্যাও ছিলো অগণ্য। আরবের লাত-মানাত, কেনানে বাহু ইত্যাদি নানারকম ছিলেন দেবতা। আবার বিভিন্ন দেশের কতক দেবতারা ছিলেন একই ধাঁচের। যেমন মিশরে – আসিরিস, আইসিস, হোরাস , ব্যাবিলনে – আলু, বেল, ঈয়া ; ভারতে – ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু, শিব ইত্যাদি। যে যুগে সমগ্র পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা বোধহয় যে এক কোটিও ছিলো না, সে যুগে নাকি হিন্দুদের দেব-দেবীর সংখ্যা ছিলো প্রায় তেত্রিশ কোটি। ভারতীয় দেব-দেবীরা তো ঘাটিই করেছিলেন হিমালয় পর্বতের কোনো কোনো অঞ্চলে। শিবের ঘাটি ছিলো কৈলাস পর্বতে, নাম ছিলো তার কৈলাসপুরী এবং ইন্দ্রের ঘাঁটি ছিলো সুমেরু পর্বতে, নাম ছিলো তার অমরাবতী (এ সুমেরু পৃথিবীর উত্তর মেরু নয়, সে যুগের ভারতবাসীরা ভারতের উত্তরকেই পৃথিবীর উত্তর বলে মনে করত। আলোচ্য সুমেরু ও কৈলাস পর্বত হিমালয়েই অংশবিশেষ)। ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু ইত্যাদি দেবতারা সেখানেই থাকতেন সপরিবারে। ভারতীয় দেবতাদের অধিনায়ক (রাজা) ছিলেন ইন্দ্র, তার রাজপুরীর নাম ছিলো বৈজয়ন্তা। দেবরাজ ইন্দ্রের সে পুরকেই বলা হতো ‘স্বর্গ। সেখানে ছিলো সুখ সাধনের নানাবিধ সামগ্রী। যথা – নন্দন কানন (এদন উদ্যান?), পারিজাত বৃক্ষ, সুরভি গাভী, উচ্চৈঃশ্ৰবা অশ্ব, ঐরাবত হস্তী, তৃপ্তিদায়ক আহার্য এবং দেবতাদের মনোরঞ্জনের জন্য ছিলো অঙ্গরা, কিন্নর, গন্ধৰ্ব ইত্যাদি গীতন্ত্যশীলা অঙ্গনা। এ ছাড়াও ছিলো — রথ (বিমান), সারথি (বিমান চালক), ধনু বজ ইত্যাদি নানাবিধ যুদ্ধাত্র। সে সুরম্য স্থানটি লাভের অভিলাষে এবং অন্যান্য স্বার্থসিদ্ধির মানসে সেকালের ভারতীয় আর্যরা দেব-দেবীগণের তুষ্টির উদ্দেশ্যে করেছিলো নানাবিধ যাগযজ্ঞ, হােম-বলি, স্তবস্তুতি এবং পূজা-অৰ্চনার প্রবর্তন ও প্রচলন।
পূর্বে বলা হয়েছে যে, কোনো কোনো সময় কোনো কোনো দেবতা ভক্তের স্তুতিবাক্যে তুষ্ট হয়ে তাকে বর, অস্ত্র ইত্যাদি দান করতেন। হয়তো কাউকে রথ (বিমান) উপহার দিতেন। আবার কেউ বিদ্রোহী হলে তাকে সবংশে নিধন করতেন।
রাবণের বৈমাত্রেয় ভ্রাতা কুবেরের স্তবে তুষ্ট হয়ে তাঁকে পুষ্পক নামক একখানা বিমান প্রদান করেন। কিন্তু সে বিমানখানা রাবণ ছিনিয়ে নিয়ে তিনি তার মালিক হন। দেবতারা এতে কোপিত হয়ে রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। রাবণের পুত্র মেঘনাদ সেই বিমানখানার সাহায্যে দেবরাজ ইন্দ্রকে বিমানযুদ্ধে পরাজিত করে ইন্দ্ৰজিৎ’ আখ্যপ্রাপ্ত হন এবং সেই বিমানখানার সাহায্যেই রাবণ সীতাদেবীকে হরণ করেন। পরিশেষে রাবণের মৃত্যু হলে রামচন্দ্র সীতাদেবীসহ ঐ বিমানখানা নিয়ে অযোধ্যায় যান। বোধহয় যে, যত্নাভাবে বিমানখানা সেখানেই বিনষ্ট হয়েছে। পক্ষান্তরে সেকালের বীর্যবন্ত রাজা দণ্ডক দেববিরোধী হওয়ায় ব্ৰহ্মা তার ব্ৰহ্মাস্ত্র (বোধহয়, এ কালের ডিনামাইট বা পারমাণবিক বোমা জাতীয় কোনো অস্ত্র) দ্বারা প্রজাপুক্তসহ রাজা দণ্ডককে সবংশে নিধন ও তার রাজ্যটি বিনষ্ট করেন। বহুকাল জনহীন থাকায় রাজ্যটি অরণ্যে পরিণত হয়। রাজা দণ্ডকের সেই রাজ্যটিকেই বলা হয় “দণ্ডকারণ্য (অধুনা আবাদ হচ্ছে)। আবার পাশ্চাত্যে দেবতারা তাদের কোনো কোনো ভক্তকে নিয়ে বিমানবিহার করেছেন। পক্ষান্তরে দেববিরোধী জনগণকে শাস্তি প্রদানের উদ্দেশ্যে তাঁরা ধ্বংস করেছেন ‘সদোম’ ও ‘যমোরা দেশকে।
মুনিঋষি ও দেবদেবীগণ প্রায় একইকালে বর্তমান ছিলেন এবং প্রায় একইকালে ঘটেছে তাঁদের তিরোভাব। এযুগে দেখা যায় না ওঁদের কাউকে। ওঁরা সকলেই এখন কালের কোলে ঘুমিয়ে আছেন। কিন্তু দেবতারা নাকি সবাই অমর এবং গঙ্গা, মনসা, চন্দ্র, সূর্য ইত্যাদি বহু দেবদেবী আজও বেঁচে আছেন। অথচ জাভে, অহুর মজদ, ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু, শিব, কাৰ্ত্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী, সরস্বতী ইত্যাদি দেবদেবীগণের কারো সাক্ষাৎ মেলে না। তারা গেলেন কোথায়? উত্তরে বলেছেন দানিকেন – ঐ শ্রেণীর দেবতারা আসলে হচ্ছেন গ্রহান্তরের মানুষ। তাঁরা ফিরে গেছেন মহাকাশে আপন গৃহে, হয়তো এখন মারা যেতেও পারেন। কেননা দেবতারা দীর্ঘজীবী হলেও অমর নন।
দেবতারা কোথায় গেলেন, তা বলেছেন দানিকেন সাহেব। কিন্তু কেন গেলেন, তা বলেননি তিনি। তবে তার মূল কারণ হয়তো যুগের সুযোগ-এর অভাব। সেকালের মানুষের মন ছিলো সরল, জ্ঞানের পরিধি ছিলো সংকীর্ণ। তাই তাদের গুরু পুরোহিতগণ যা বলতেন, তা তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস ও মান্য করতো অকাট্য-অভ্রান্ত বলে এবং দেবতাগণও স্বমত প্রচারের সুযোগ পেতেন তাঁদের ভক্তবৃন্দের মাধ্যমে। উত্তরোত্তর জ্ঞানবৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের গুরুবাদিতা হ্রাস পেতে থাকে। ফলে কমতে থাকে দেবতাগণের মহিমা। অবশেষে বুদ্ধ জ্ঞোনী) দেব যখন আবির্ভূত হয়ে প্রচার করলেন দেব-দেবীর স্তবস্তুতি ও পূজা-অৰ্চনার অসারতা-অযৌক্তিকতা, তখন থেকেই দেবতাদের পাত্তা গুটীতে হলো চিরতরে! যদিও ভারতীয় দেবতাদের ঔপনিবেশিক স্বৰ্গধামটি আর্য ভারত থেকে বেশী দূরে নয়, তথাপি আর কোনো দেবদেবীর ভারতের ভূমিতে পদার্পণের কথা শুনা যায় না, বুদ্ধদেবের আবির্ভাবের পরে। কেননা এ যুগে তাদের ভক্ত মুনি-ঋষি মেলে না। অভিন্ন কারণেই যীশুখৃষ্টের আবির্ভাবের পরে পশ্চিমাঞ্চলেও দেবতাদের আনা-গোনা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।