Site icon BnBoi.Com

ফাউন্টেনপেন – হুমায়ূন আহমেদ

ফাউন্টেনপেন - হুমায়ূন আহমেদ

অপেক্ষা

মানবজীবন হলো অপেক্ষার জীবন। ছোটখাটো অপেক্ষা দিয়ে জীবনের শুরু–মা কি আমাকে চকলেট কিনে দেবে? বাবা কি আজ ঘোড়া ঘোড়া খেলবে? বাবা ঘোড়া হবে, আমি তার পিঠে উঠে হেট হেট করব।

জীবনের শেষে অপেক্ষার ধরন সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। তখন অপেক্ষা মৃত্যুর। এই মৃত্যুকে মহিমান্বিত করার অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘মরণরে উঁহু মম শ্যাম সমান।‘ মহাপুরুষদের কাছে মৃত্যুর অপেক্ষা হয়তোবা আনন্দময়।

আমি সাধারণ অভাজন হওয়ার কারণে মৃত্যুচিন্তা মাথায় এলে অস্থির হয়ে যাই। আমি চলে যাব, তারপরেও আকাশ ভেঙে জোছনা নামবে, ‘সবাই যাবে বনে’। আষাঢ় মাসে আকাশ অন্ধকার করে মেঘ জমবে। তরুণীরা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গাইবে, ‘এসো করো স্নান নবধারা জলে’। সেই অপূর্ব নবধারা জল দেখার জন্যে আমি থাকব না, এর কোনো মানে হয়?

প্রসঙ্গ আপাতত থাকুক। নানাবিধ অপেক্ষার গল্প করা যাক।

আধুনিক নগরজীবনে নতুন কিছু অপেক্ষা’র সৃষ্টি হয়েছে যা আগে ছিল না। যেমন, গাড়িতে বসে, গরমে সিদ্ধ হতে হতে যানজট খোলার অপেক্ষা। এই অপেক্ষা অর্থবহ করার অনেক চেষ্টা আমি করেছি, যেমন গাড়ির সিটপকেটে সহজে হজম হয় এমন বই। অ্যাসিমভের Book of Facts. উন্মাদ পত্রিকার সম্পাদক আহসান হাবীবের কিছু রসিকতার বই। রিপ্লের একটা বই যেখানে উদ্ভট উদ্ভট কাহিনী। এর বাইরে আছে মোবাইল ফোনে সাপের খেলা।

জ্যামে আটকা পড়লে কোনো কিছুই ভালো লাগে না। বইয়ের পাতা খুলতেই পারি না। মোবাইল ফোনের সাপ নিয়ে তখন খেলতে বসি। সাপকে আপেল, চেরি ফল খাইয়ে লম্বা করাই হলো খেলার নিয়ম। কিছুক্ষণ সাপকে খাওয়ানোর পরে মনে হয় এখন কী করা যায়? অন্যদের কথা জানি না, জ্যামে আটকা পড়লে অবধারিতভাবে আমার ছোট বাথরুম পায়। তখন গভীর শঙ্কা নিয়ে ভাবি, আগামী তিন ঘণ্টায় যদি জ্যাম না ছোটে তাহলে কী কেলেংকারি হবে কে জানে!

যানজটে সবাই অসুখী হন তা-না। ভিক্ষুক এবং ফেরিওয়ালারা দন্ত বিকশিত করে হাসেন। ভিক্ষুকের হাত থেকে বাঁচার কূটকৌশল একজন আমাকে শিখিয়েছেন। ভিক্ষুক যখন ভিক্ষা চাইবে তখন তাদের দিকে তাকানো যাবে না। ভাব করতে হবে ভিক্ষুকরা অদৃশ্য মানব। এদেরকে দেখা যাচ্ছে না। ‘মাফ করেন’–বাক্যটাও ওদের দিকে তাকিয়ে বলা যাবে না। চোখে চোখ পড়লেই নাকি ধরা খেতে হয়।

জলজ্যান্ত মানুষকে অদৃশ্য মানব ভাবা কঠিন কর্ম। আমি ভিক্ষুকদের দিকে তাকাই। যথেষ্ট বিনয়ের সঙ্গে বলি, মাফ করেন। মাফ চাইতে গিয়ে আমার জীবনে একটা ঘটনা ঘটেছে। জনৈক ভিক্ষুক বলেছে, স্যার সকাল থাইকা আমি খালি মাফই করতেছি। আর কত মাফ করব?

এমন বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ ভিক্ষুকের কাছ থেকে আশা করা যায় না। আমি মানিব্যাগ খুলে ১০০ টাকার একটা নোট বের করলাম।

কয়েকদিন আগে পত্রিকায় একজন ভিক্ষুকের ছবি ছাপা হয়েছে। সে নাকি ভিক্ষা করে কোটিপতি হয়েছে। সে তার সন্তানদের সমাজে আদর্শ ভিক্ষুক হিসেবে দেখতে চায় এবং তাদের সাফল্য কামনা করে।

ইদানীং পত্রিকায় কোটিপতিদের নিয়ে ফিচার হচ্ছে। কেউ কাঁচামরিচের ক্ষেত করে কোটিপতি, কেউ ঝিংগা চাষ করে কোটিপতি। কোটিপতিদের ছবিও ছাপা হয়। ছবিতে তাদের অত্যন্ত বিমর্ষ দেখায়। কোটিপতি হয়ে তারা এমন বিমর্ষ কেন কে জানে! পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে এক এক ধরনের খবরের জোয়ার আসে। একটা সময় গেছে গাই গরুর। সবাই গাই গরু পাচ্ছে। তাদের ছবি ছাপা হচ্ছে। বেশিরভাগ সময়েই চিন্তিত কৃশকায় এক তরুণী গরুর দড়ি ধরে ভীত চোখে গরুর দিকে তাকিয়ে থাকে। এখন জোয়ার চলছে কোটিপতির। সম্প্রতি পড়লাম শামুক বিক্রি করে কোটিপতি।

অপেক্ষা বিষয়ে বলতে গিয়ে অন্য বিষয়ে চলে এসেছি। মূল বিষয়ে আসা যাক। অপেক্ষার শ্রেণীভেদ–

কসাইয়ের অপেক্ষা

কসাই অপেক্ষা করে একদিন তার ছেলে এমন নামি কসাই হবে, যে, একটা আস্ত গরু এক ঘণ্টায় নামিয়ে ফেলবে।

ছাত্রলীগের অপেক্ষা

পড়াশোনা, ভালো রেজাল্ট–এইসব নিয়ে এরা মাথা ঘামায় না। তাদের অপেক্ষা টেন্ডার নিয়ে। তারা বাকি জীবন ছাত্রলীগের সেবা করে যেতে চায়। সময় হলে বয়স্কভাতার জন্যে আবেদনের ইচ্ছাও তারা পোষণ করেন। বর্ষাকালে কই মাছ উজায়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসা মানে ছাত্রলীগের বর্ষাকাল। তারা একসঙ্গে উজায়া যায়।

তাদেরকে থামানোর নানান চেষ্টার কথা শুনছি। কোনোটিই মনে হয় কাজ করছে না।

লিচু খাওয়া নিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ মারামারি করেছে। দশজন আহত। এই খবর কিছুক্ষণ আগে পড়েছি। লিচুর পরপরই আমের সিজন আসছে। ভয়ে আছি, তখন না জানি কী হয়।

আমি তখন শহীদুল্লাহ হলের হাউস টিউটর। শহীদুল্লাহ হল ছাত্রলীগের এক কর্মী কী একটা কাজে যেন এসেছে। আমি তাকে বললাম, এই তোমরা তো আওয়ামী লীগের লেজ।

সেই ছেলে চোখ কপালে তুলে বলল, স্যার, এটা কী বলেন? আওয়ামী লীগ আমাদের লেজ।

সাম্প্রতিক ঘটনা দেখে ঐ ছাত্রের কথাই ঠিক বলে মনে

ডাক্তারদের অপেক্ষা

তাদের অপেক্ষা রোগের জন্যে। তাদের কোনো জাতীয় সঙ্গীত থাকলে তার প্রথম পঙক্তি হতো–”আয় রোগ আয়, উড়াল দিয়ে আয়।”

কিছুদিন আগে হৃদয়ঘটিত সমস্যা নিয়ে ল্যাব এইডে ডাক্তার বরেন চক্রবর্তীর কাছে গিয়েছিলাম। বরেন চক্রবর্তী লেখক মানুষ বলেই লেখকদের বিশেষ খাতির করেন। অ্যাপয়েন্টমেন্ট পাওয়ার জন্যে চার ঘণ্টা প্লাস্টিকের লাল চেয়ারে বসে থাকতে হয় না। দেড় থেকে দু’ঘণ্টার মধ্যে ভেতরে ডাক পড়ে।

বরেন চক্রবর্তী যে রসিক মানুষ তা জানা ছিল না। তাঁর একটি রসিকতায় যথেষ্ট মজা পেয়েছি। পাঠকদের সঙ্গে রসিকতাটা ভাগাভাগি করা যেতে পারে।

বরেন চক্রবর্তীর নিয়ম হচ্ছে, রোগীকে বিছানায় শুইয়ে প্রথমেই রোগীর দুই পায়ের পাতা স্পর্শ করা (পালস দেখার জন্যে)। একদিন তা-ই করছেন। রোগী বলল, শুরুতেই আপনি পায়ে ধরেন কেন?

বরেন চক্রবর্তী বললেন, ইচ্ছা করে কি আর পায়ে ধরি? বিবেকের দংশনে পায়ে ধরি।

রোগী : ব্যাপারটা বুঝলাম না। কিসের বিবেকের দংশন।

বরেন চক্রবর্তী : এই যে আপনার চিকিৎসা শুরু হলো। ল্যাব এইড হাসপাতালে ভর্তি হবেন। জলের মতো টাকা যাবে। আপনার অর্থ ব্যয়ের পেছনে আমার একটা ভূমিকা আছে বলেই বিবেকের তাড়নায় প্রথমেই আপনার পায়ে ধরছি।

ল্যাবএইড কর্তৃপক্ষ ডাক্তার বরেন চক্রবর্তীর রসিকতা কীভাবে নেবেন কে জানে! তবে ক্ষমতাধর সব রাজনৈতিক নেতাই ডাক্তার বরেন চক্রবর্তীর বাধা রোগী। ডাক্তার বরেনের জন্যে এটা একটা আশার কথা।

ভয়ঙ্কর অপেক্ষা

বঙ্গবন্ধুর খুনিদের দীর্ঘদিবস দীর্ঘরজনী ফাঁসির অপেক্ষাকে আমি বলব ভয়ঙ্কর অপেক্ষা। প্রতি মুহূর্তেই মৃত্যুকে চোখের সামনে দেখা। এদের একজন মুসলেম উদ্দিনকে যখন ফাঁসিতে ঝুলানো হচ্ছে তখন সে জল্লাদদের বলল, আমি অসুস্থ মানুষ। আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না? জানি না সেইসময় শিশু রাসেলের জলভরা করুণ মুখের ছবি একবারও তার মনে পড়েছিল কি না।

যুদ্ধাপরাধীদের অপেক্ষা

তারা অবশ্যই নাজাতের অপেক্ষায় আছেন। ‘Everybody is paid back by his own coin’–এই ইংরেজি আপ্তবাক্যটি তাদের মর্মমূলে পৌঁছেছে বলেই আমার ধারণা।

পাদটিকা

বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকায় অভিনেতা সোহেল রানা আমাকে উদ্দেশ করে কিছু কথা বলেছেন। যেমন, ছবি নামে আমি যেসব রসগোল্লা বানিয়েছি তা কেউ দেখে না।

অতি সত্যি কথা। ছবি বানানোর শখ পূরণের জন্যে আমি অনেক টাকাই নষ্ট করেছি। ভবিষ্যতেও করব। ন্যাড়া একবার বেলতলায় যায়, আমার মাথায় এখনো কিছু চুল অবশিষ্ট আছে বলে বারবার বেলতলায় যাই।

সোহেল রানার দ্বিতীয় বক্তব্য–”আপনি দেশ নিয়ে স্বাধীনতার ৩০ বছরেরও বেশি সময় পরে জোছনা ও জননীর গল্প উপন্যাসটি লিখেছেন। সত্যিকার দেশপ্রেম আপনার মধ্যে থাকলে আপনি অনেক আগেই এ ধরনের লেখা লিখতেন। এ থেকেই আপনার দেশপ্রীতি যে কতটুকু তা বোঝা যায়। তাই আপনি ভারতীয় ছবির পক্ষে লিখবেন, বলবেন, এতে তো অবাক হওয়ার কিছু নেই।”

আমার দেশপ্রেমের অবস্থা সর্বনিম্ন পর্যায়ের তা জেনে শঙ্কিত বোধ করছি। এখন কী করা যায়? কোনো একদিন দেশপ্রেম জাগ্রত হবে তার জন্যে অপেক্ষা? অপেক্ষায় থাকলাম।

কুইজ

বাথরুমে যে টয়লেট পেপার ব্যবহার করা হয় তা কাদের আবিষ্কার?

উত্তর : চীনাদের (১৩৯১) সন।

ফিলাডেলফিয়ার Scott paper company টয়লেট পেপারের বোল বাজারে আনে ১৮৭৯ সনে।

আমি আমেরিকার এক হোটেলে বিন লাদেনের ছবি ছাপা টয়লেট পেপার দেখেছি।

একটি ভৌতিক গল্পের পোস্টমর্টেম

সম্প্রতি আমার উপর দায়িত্ব পড়েছে একটি ভৌতিক গল্পকে কাটাছেঁড়া করার। আমি যে খুব আগ্রহের সঙ্গে দায়িত্ব নিয়েছি তা-না। গল্প থাকবে গল্পের মতো। তাকে কাঁটাছেঁড়া করা হবে কেন? একজন মানুষের জীবনে নানান ধরনের অভিজ্ঞতা ঘটে। অভিজ্ঞতাগুলো তার ব্যক্তিগত গল্প। এইসব গল্পের কিছু থাকে অতিপ্রকৃত বা ভৌতিক। এই গল্পগুলো সে গভীর মমতায় লালন করে। বৃদ্ধবয়সে নাতি-নাতনিদের নিয়ে অভিজ্ঞতার গল্প বলতে বলতে নিজে রোমাঞ্চিত হন। নাতি-নাতনিরা অবাক হয়ে বলে, সত্যি এমন ঘটেছিল। সাধারণত এ ধরনের গল্পে পালক যুক্ত হতে হতে মূল গল্প হারিয়ে যায়।

গল্পে আছে এক মহিলার এক ছেলের জন্ম দিয়েছে, গায়ের রঙ কালো। ধাত্রী তার বাড়ি ফিরে গল্প করল, অমুক মহিলার এক ছেলে হয়েছে। গায়ের রঙ কাকের মতো কালো। লোকমুখে গল্প ছড়াতে লাগল। শেষ অংশ হচ্ছে–এক মহিলা একটা কাকের জন্ম দিয়েছে। কাকটা কা কা করছে তবে ফাঁকে ফাঁকে ‘মা’ ডাকছে। কা কা মা। মা কা কা…

জটিল ভৌতিক অভিজ্ঞতা প্রায় সময়ই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয় না। যিনি গল্পটি বলছেন তার আত্মীয়ের অভিজ্ঞতা। সেই আত্মীয় আবার জীবনে কখনো মিথ্যা বলেন টাইপ।

যখন আমার বয়স কম ছিল, তখন বেশ কয়েকবার গল্পের পেছনে দৌড়িয়েছি। বরিশাল বিএম কলেজে কেমিস্ট্রির M.Sc. পরীক্ষার এক্সটারনাল হিসেবে একবার গিয়েছি। সেখানে শুনলাম মাইল তিনেক দূরে একটা ভাঙা রহস্যময় কুয়া আছে। কুয়ার পানির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে পানি হঠাৎ খলবল করে উঠে এবং প্রশ্নের উত্তর দেয়।

পরীক্ষার ভাইবা শেষ করে নৌকা নিয়ে আমি অদ্ভুত কুয়া দেখতে গেলাম। বরিশালের সরু খালবিলে নৌকা নিয়ে যাওয়া এক ধরনের দিগদারি। জোয়ার ভাটা দেখে নৌকা ছাড়তে হয়। তিন মাইল যেতেই আমার সন্ধ্যা পার হয়ে গেল। ফলাফল শূন্য। কুয়াতে মুখ রেখে অনেকক্ষণ “হ্যালো হ্যালো, তুমি কে? কথা বলো।” এইসব করলাম। কুয়া বা কুয়ার পানি কোনো জবাব দিল না। খলবলানিও নেই। যিনি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি বললেন, আজকের ঘটনাটা বুঝলাম না। মনে হয় আপনেরে ভয় খাইছে। কুয়া কেন আমাকে ভয় খাইছে কে বলবে?

পরীক্ষা নিতে একবার গেলাম পটুয়াখালি সরকারি কলেজে। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শিক্ষক হয়েছি। গা থেকে ছাত্রের গন্ধ যায় নি। সিনিয়র শিক্ষকরা এত দূরে পরীক্ষা নিতে আসতে চান না বলেই আমাকে পাঠানো।

কলেজ কম্পাউন্ডের একটা ঘরে আমার থাকার জায়গা। আমার জন্যে আলাদা বাবুর্চি। এই বাবুর্চি মনে হয় লবণ ছাড়া রান্নার কোর্স নিয়েছে। কোনো খাবারেই লবণ হয় না। তবে সে লবণের অভাব পুষিয়ে দিত ভূতের গল্প করে। তাদের বাড়িতে একটি পোষা ভূত আছে। এই ভূতকে যদি বলা হয় চাপকল টিপে পানি বের করতে, সে বাধ্য ছেলের মতো চাপকল টিপে পানি বের করে। ঘর ঝাঁট দেয়। চাপকল উঠানামা করে। কল চাপতে কাউকে দেখা যায় না। বাবুর্চি বলল, স্যার কষ্ট করে যদি আমার বাড়িতে পায়ের ধুলা দেন তাহলে আপনাকে ভূতের খেলা দেখায়ে দিতাম। যেতে হবে রাতে।

রাতেই গেলাম। ভূতের চাপকলে পানি তোলা। উঠান ঝাঁট দেওয়া কিছুই দেখলাম না। বাবুর্চি বলল, আপনি অপরিচিত তো আপনারে দেখে শরম পাইছে। সামনে আসতেছে না।

বাবুর্চি তার বাড়িতে খাবার আয়োজন করে রেখেছিল। প্রতিটি আইটেমের লবণ ঠিক ছিল। খেতেও হয়েছিল অসাধারণ। তার বাড়িতে খাওয়া তপসে মাছের স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে।

ধানমণ্ডির ফ্ল্যাটে কেউ কেউ সরাসরি আমাকে ভূত বা জ্বিন দেখাতে আসেন। একজন এসেছিলেন কক্সবাজার কিংবা দোহাজারি থেকে। তিনি নিজে একজন কবি এবং ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। তিনি বললেন, স্যার আমি জ্বিন দেখাতে পারব না। চর্মচক্ষে তাদের দেখা যায় না। যারা বলে জ্বিন দেখাবে তারা মিথ্যা কথা বলে। তবে আমি জিনের মাধ্যমে খাবার এনে খাওয়াব। আপনি কী খেতে চান বলুন।

আমি বললাম, মুরগির রোস্ট।

জ্বিন জাতি ঝাল জাতীয় খাবার আনে না। মিষ্টি জাতীয় কোনো নাম বলুন।

আমি বললাম, বগুড়ার মিষ্টি দই।

শুকনা খাবারের নাম বলতে হবে। ভেজা খাবার এরা আনে না।

লাড্ডু খেতে পারি। লাড্ডু কি আনতে পারবে?

অবশ্যই পারবে। বাতি নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করতে বলুন। জ্বিনরা আলোতে আসে না।

বাতি নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করা হলো। লাড্ডুর জন্যে অপেক্ষা করতে করতে আধঘণ্টা পার হলো। লাড্ডু পাওয়া গেল না। ভদ্রলোক বললেন, জ্বিন আসতে চাচ্ছে না।

গায়ক এস আই টুটুল একবার কুষ্টিয়া থেকে দুজন জ্বিনসাধক নিয়ে এল। এরা নাকি সুপার জেনুইন। মুহূর্তের মধ্যে জ্বিন হাজির করবে। জ্বিন আমাদের প্রশ্নের উত্তর দেবে। জ্বিন এল না। প্রশ্নের উত্তর অনেক পরের ব্যাপার। দুই জ্বিনসাধক টুটুলকে বলল, স্যারের সঙ্গে এক কঠিন জ্বিন থাকে। এই জ্বিনকে দেখে ভয় পেয়ে তাদের জ্বিন আসে নাই। আমাকে বাদ দিয়ে আসর বসালেই নাকি জ্বিন আসবে। আমি তাতেই রাজি হয়েছি। টুটুল ইউরোপ-আমেরিকা করে বেড়াচ্ছে বলে আসর বসানোর সময় বের করতে পারছে না।

ছোটবেলায় যেসব ভূতের গল্প শুনতাম এখন আর শুনি না। আমার মার আপন চাচির মুখে শুনেছি, জন্মের পর পর জ্বিন বা ভূত তাকে নিয়ে উঁচু তালগাছের মাথায় রেখে দিয়েছিল। সারা গ্রামের মানুষ মশাল-লণ্ঠন জ্বেলে তালগাছ ঘিরেছে। গাছে মই লাগিয়ে শিশুকে নামিয়ে এনেছে। আমার মা বললেন, ঘটনা সত্য। তিনি ছোটবেলা থেকেই শুনছেন।

মাতৃহারা বানর মানবসন্তান চুরি করে গাছে নিয়ে যায়। এমন কিছু কি ঘটেছে?

গ্রামাঞ্চলে জ্বিন বা ভূত তাড়ানোর ওঝাদের একসময় ভালো প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। এই শ্রেণী এখন মনে হয় উঠে গেছে। গতবার গ্রামে গিয়ে ওঝার সন্ধান করলাম। ওঝাদের কাছ থেকে কিছু মন্ত্র লিখে নেব। গল্প-উপন্যাস লেখায় কাজে দেবে। জ্বিন-ভূতের একজন ওঝাকে পাওয়া গেল। সে তার পুরনো পেশা ছেড়ে দিয়ে রুয়াইল বাজারে পানে খাওয়ার ঝিনুকের চুন বিক্রি করে। তাকে খবর দিয়ে আনা হলো। সে দুঃখের সঙ্গে বলল, পল্লী বিদ্যুতের কারণে জ্বিন-ভূত নাই বললেই হয়। সেই কারণেই সে ওঝগিরি ছেড়ে দিয়েছে। জ্বিন -ভূত তাড়াবার কিছু মন্ত্র তার কাছ থেকে আদায় করার চেষ্টা করলাম। সে মন্ত্র জানাতে রাজি হলো না। সম্ভবত তার। কাছে কোনো মন্ত্র নেই।

আমার শৈশবের কিছু অংশ কেটেছে নানার বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। সেখানে ভূতের আছর হওয়া এবং ওঝা দিয়ে ভূত তাড়ানো দেখেছি। বেশির ভাগ সময় আছর হতো যুবতী মেয়েদের উপর। ওঝা এসে মন্ত্র-তন্ত্র পাঠ করার পর আছর হওয়া কন্যা যে কাজটি প্রথম করত তা হলো টেনেটুনে শাড়ি খুলে ফেলা। ঘটনা। দেখে বয়স্করা নিশ্চয় মজা পেতেন। আমার কাছে দৃশ্যটা ছিল ভীতিকর। ওঝার সঙ্গে কথোপকথন হতো। মেয়েটিই বিকৃত গলায় কথা বলত।

ওঝা : তুই কে?

মেয়ে : আমি অমুক (একটা নাম বলত। পুরুষের নাম।)

ওঝা : একে ধরেছিস কেন?

মেয়ে : সে সিনান করে আমার গায়ের উপর দিয়ে হেঁটে গেছে। এইজন্যে ধরেছি।

ওঝা তখন মন্ত্র শুরু করতেন। মন্ত্রের সবটাই অশ্লীলতম বাক্যে ভর্তি।

মন্ত্র পাঠ এবং সরিষার দানা ছুঁড়ে মারার পর ভূত চলে যেত। মেয়েটা তখন পরনের খুলে ফেলা শাড়ি দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে কুকুরের মতো চারপায়ে দ্রুত ঘরের দিকে যেত। বেশির ভাগ সময় দরজার চৌকাঠে বাড়ি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেত।

পুরো বিষয়টা অবদমিত যৌন কামনার প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই না। গায়ের কাপড় খুলে ফেলা, আগ্রহ নিয়ে ওঝার অশ্লীল কথাবার্তা শোনার অন্য কারণ নেই। গায়ের কাপড় খুলে ফেলার বিষয়টি এত নিয়মিত ঘটত যে ময়মনসিংহের গ্রাম্য বাগধারায় বিষয়টি উঠে এসেছে। উদাহরণ–”জ্বর হয়ে বৌ নেংটা হইল, সেই থেকে বৌয়ের অভ্যাস হইল।” এই বাগধারার অর্থ একবার প্রবল জ্বরের ঘোরে নতুন বৌ গায়ের কাপড় খুলে ফেলে দিল। কেউ তাকে কিছু না বলায় সে লাই পেয়ে গেছে। এখন অকারণেই সে গায়ের কাপড় খোলে।

আগেই বলেছি সবার জীবনেই কিছু ভৌতিক অভিজ্ঞতা ঘটে। আমার জীবনেও বেশ কয়েকবার ঘটেছে। আমি যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। সবার পেরেছি তা-না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যুক্তি পরাস্ত হয়েছে। যুক্তির পরাজয় আমার পক্ষে মানা কঠিন। কারণ আমার মধ্যে মিসির আলি বাস করেন। তিনি মনে করেন যুক্তির বাইরে কিছুই নেই।

নুহাশপল্লীর একটা ভৌতিক অভিজ্ঞতা বলি-সন্ধ্যা মিলিয়েছে। আমি একা নুহাশ পল্লীর দিঘির দিকে যাচ্ছি। ওষুধি বাগানের কাছাকাছি এসে মনে হলো, কেউ আমাকে অনুসরণ করছে। অনুসরণকারীর পায়ে নূপুর। নূপুরের শব্দ করে করে সে আসছে। আমি দাঁড়িয়ে পড়লে নুপূরের শব্দ বন্ধ। হাঁটা শুরু করলেই নূপুরের শব্দ। তিনবার পরীক্ষা করলাম। তিনবারই এই ঘটনা। আতঙ্কে শরীর জমে যাওয়ার মতো অবস্থা। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করব তাও পারছি না। মস্তিষ্ক উত্তপ্ত। চিৎকার করে কাউকে ডাকব? নাকি দৌড়ে পালাব? দোটানা অবস্থায় নিজে নিজেই রহস্য ভেদ করলাম। আমার প্যান্টের বেল্টটা ঠিকমতো লাগানো হয় নি। বেল্টের ধাতব আংটা ঝুলছে। যখনই হাঁটছি তখনি সেই আংটা শরীরের সঙ্গে বাড়ি খেয়ে ঝুন ঝুন শব্দ তুলছে। তাতেই মনে হচ্ছে নূপুর পায়ে কেউ একজন আমাকে অনুসরণ করছে।

তবলার ঠুকঠাক অনেক হয়েছে। এখন মূল গল্পে যাই। একটি ভূতের গল্পের পোস্টমর্টেম করি।

প্রস্তাবনা

মাসুদ আখন্দ তার বাবা-মা’র সঙ্গে সুইডেনে থাকত। এখন সে বাংলাদেশে এসে ফিল্ম মেকিং জাতীয় কাজকর্ম করে বেঁচে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছে। তার বাবা-মা থাকেন সুইডেনে। আমি ইউরোপে বেড়াতে গেলে মাসুদের বাবা-মা দুজনের সঙ্গেই পরিচয় হয়েছিল। দুজনই নিতান্তই ভালো মানুষ। তাদের একটাই কষ্ট, নিজ দেশ ফেলে অন্যের দেশে বাস করতে হচ্ছে।

সম্প্রতি মাসুদের বাবা মারা গেছেন। তার মা এসেছেন বাংলাদেশে। এই মহিলার শৈশব জীবনে একটি অলৌকিক ঘটনা ঘটেছে। তার ধারণা এই ঘটনাটির কোনো ব্যাখ্যা নেই। একমাত্র মিসির আলিই ব্যাখ্যা দিতে পারেন। তিনি মিসির আলির বিকল্প হিসেবে তাঁর ছেলেকে পাঠালেন আমার কাছে। আমি যদি ব্যাখ্যা দিতে পারি।

মূল গল্প

মেয়েটির বয়স সাত কিংবা আট (মাসুদের মার কথা বলছি)। তার নানার বাড়িতে কী একটা উৎসব। সে একদিনের জন্যে নানার বাড়ি যাবে। নানার বাড়ি খুব যে দূরে তা-না। হাঁটাপথে দু’ঘণ্টার মতো লাগে। ঠিক হয়েছে মেয়েটাকে তার বাড়ির কামলা ভোরবেলা নিয়ে যাবে। আবার ওইদিনই ফেরত নিয়ে আসবে।

কামলার নাম ঠাকুর। নাম ঠাকুর হলেও সে মুসলমান। মেয়েটির বাড়ি থেকে খানিকটা দূরে ঘর তুলে স্ত্রীকে নিয়ে থাকে। তাদের কোনো সন্তানাদি নেই। ঠাকুর এই মেয়েটিকে নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করে।

যেদিন উৎসবে যাওয়ার কথা সেদিন ঠাকুর অন্ধকার থাকতে থাকতে চলে এল। সেই সময় ঘড়ি দেখার চল ছিল না। কারও বাড়িতে ঘড়ি থাকত না। পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে সময় আঁচ করার চেষ্টা করা হত। ঠাকুর যে গভীর রাতে এসেছে তা কেউ বুঝতে পারল না। মেয়েটা ঠাকুরের সঙ্গে রওনা হলো। ঠাকুর প্রায় দৌড়ে যাচ্ছে। মেয়েটা যতই বলে চাচা আস্তে হাঁটেন ততই ঠাকুর দ্রুত পা ফেলে।

একসময় ঠাকুর মেয়েটিকে নিয়ে তার নানার বাড়িতে উপস্থিত হলো। বাড়ির সবাই ঘুমাচ্ছে। তাদের ডেকে তোলা হলো। মেয়ের নানা গভীর রাতে মেয়েটিকে নিয়ে আসার জন্যে ঠাকুরকে অনেক গালাগালি করলেন। ঠাকুর মাথা নিচু করে গালি শুনল তারপর অভিমান করেই একা ফিরে গেল। যাওয়ার সময় কারও কাছ থেকে বিদায়ও নিল না।

গল্পের অতিপ্রাকৃত বা ভৌতিক অংশ হচ্ছে, পরদিন ঠাকুরকে ডেকে পাঠানো হলো। কৈফিয়ত তলবের জন্যে কেন সে কাউকে কিছু না জানিয়ে মেয়েটাকে রেখেই চলে গেছে। গভীর রাতে বাচ্চা একটা মেয়েকে নিয়ে কেনইবা সে রওনা হলো!

গল্পের ভৌতিক অংশ হলো গত তিন দিন তিন রাত ধরে ঠাকুর জ্বরে অচেতন। বিছানা থেকে নামার অবস্থা তার নেই। তার স্ত্রী জানাল, গত তিন দিন ধরে সে তার স্বামীর পাশে। মানুষটা এখন যায় তখন যায় অবস্থা। ঠাকুর চিচি করে বলল, আম্মারে নিয়া আমি কোনোখানে যাই নাই। আমি ঘাড় ফিরাইতে পারি না এমন অবস্থা।

তাহলে বাচ্চা মেয়েটিকে কে নিয়ে গেছে? ভূত, জ্বিন?

গল্পের পোস্টমর্টেম

জ্বিন-ভূতের কোনো দায়িত্ব পড়ে নি মেয়েটিকে নানার বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার। কাজেই জ্বিন-ভূত বাদ।

ঠাকুর মেয়েটিকে পৌঁছে দিয়েছে, এটা সবাই দেখেছে। মেয়েটি বা তার নানার বাড়ি লোকজন ঠাকুরকে দেখেছে। ঠাকুর জ্বরে তিন দিন ধরে অচেতন বা প্রায় অচেতন এটাও সত্যি। এখানে মিথ্যা ভাষণের প্রয়োজন নাই।

তাহলে মেয়েটিকে কে নিয়ে গেছে।

আমার ব্যাখ্যা ঠাকুরই নিয়ে গেছে। সে গভীর রাতে ঘরের মধ্যে বের হয়েছে (স্লিপ ওয়াকিংয়ের মতো) তার মাথায় আছে বাচ্চা মেয়েটিকে পৌঁছে দিতে হবে। সে ঘোরের মধ্যেই বের হয়েছে। ঘোরের মধ্যে মেয়েটিকে পৌঁছে দিয়ে আবার বিছানায় এসে শুয়েছে।

প্রশ্ন আসতে পারে, এই সময় তার স্ত্রী কোথায় ছিল?

স্ত্রী ঘুমাচ্ছিল। রোগীর সেবা করতে গিয়ে সে ক্লান্ত এবং অঘুমা। তার ঘুমিয়ে পড়াই স্বাভাবিক। দীর্ঘসময় তার ঘুম ভাঙে নি, কারণ রোগী পাশে শুয়ে আহ্ উহ্ করছে না। রোগী বাচ্চা মেয়েটিকে পৌঁছে দিতে গিয়েছে।

পাদটিকা

একটি চমৎকার ভৌতিক গল্প হত্যা করা হলো। কাজটা ভুল এবং অন্যায়। ভৌতিক গল্প থাকবে গল্পের মতো। সে সবাইকে ভয় দেখাবে। এতেই তার সার্থকতা এবং পূর্ণতা। রবীন্দ্রনাথ বলছেন—

চিরকাল এইসব রহস্য আছে নীরব রুদ্ধ ওষ্ঠাধর।
জন্মান্তের নবপ্রাতে সে হয়তো আপনাতে পেয়েছে উত্তর।

তাঁর কথাই মনে রাখা আমার উচিত ছিল। গল্প হত্যা করার প্রয়োজন ছিল না।

এবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি

আমার শৈশবের একটি অংশ নাপিতের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে কেটেছে। বাবা এক হিন্দুস্তানি (ভোজপুরি নাপিতের ব্যবস্থা করেছিলেন যে বাসায় এসে বাচ্চাদের চুল কেটে দিত। নরুন দিয়ে নখ কাটত। নাপিতের স্বাস্থ্য এবং গোঁফ ছিল দেখার মতো। তাকে দেখামাত্র পালিয়ে যাওয়া ছিল আমার প্রথম রিফ্লেক্স অ্যাকশান। পালিয়ে রক্ষা নেই, নাপিতই আমাকে ধরে আনত। মাটিতে বসিয়ে দুই হাঁটু দিয়ে মাথা চেপে ধরত। কান্নাকাটি চিৎকারে কোনো লাভ হতো না। ছেলেমেয়েদের কান্না এবং চিৎকারকে মা কোনোরকম গুরুত্ব দিতেন না। তার থিওরি হলো বাচ্চারা কাদবে, চিৎকার করবে, এটা তাদের ধর্ম। হাত-পা না ভাঙলেই হলো।

ক্লাস ফোরে ওঠার পর ভোজপুরি নাপিতের হাত থেকে মুক্তি পেলাম। মা এক দিন হাতে একটা সিকি (পঁচিশ পয়সা) ধরিয়ে দিয়ে বললেন, যা সেলুনে চুল কেটে আয়। জীবনের প্রথম সেলুনে চুল কাটতে গেলাম। নাপিতের প্রথম প্রশ্ন, পয়সা এনেছ?

আমি হাতের মুঠি খুলে সিকি দেখালাম।

চুপ কইরা বইসা থাকো। পাও নাড়াবা না। সেলুন কোনো দুষ্টামির জায়গা না।

আমি চুপ করে বসে দোকানের সাজসজ্জা দেখতে লাগলাম। বোররাক নামক এক প্রাণীর বাঁধানো ছবি। বোররাক হচ্ছে একটা পাখাওয়ালা ঘোড়া। এর পিঠে চড়েই নবিজী (দঃ) মেরাজ শরীফে গিয়েছিলেন।

দ্বিতীয় ছবিটি ক্ষুদিরামের। তাঁর গলায় ফাঁসের দড়ি। কয়েকজন ইংরেজ তাকে ঘিরে তাকিয়ে আছে। একজনের হাতে ঘড়ি। সে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হয় ঘড়ি দেখে ইশারা দেওয়ার পর ফাঁসি কার্যকর হবে।

ক্ষুদিরামের ফাঁসি নিয়েই অতি বিখ্যাত গান–এবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি। গানের প্রসঙ্গ আনলাম। কারণ আমি বিদায় নিতে চাচ্ছি–পাঠকদের কাছ থেকে। ফাউনটেনপেন অনেকদিন লেখা হলো, কালি শেষ হয়ে যাবে সেটাই স্বাভাবিক।

ছবির কাজে হাত দিচ্ছি। এখন ব্যস্ততা ছবি নিয়ে। ছবির নাম ঘেঁটুপুত্র কমলা। ছবি নিয়ে বলি, আমার মতো প্রবীণরা ‘ঘেটু’ শব্দের সঙ্গে পরিচিত। এই সময়ের তরুণরা না।

সুনামগঞ্জ এলাকার জলসুখা গ্রামের বাউল আখড়ায় প্রথম ঘেঁটুগান শুরু হয়। নাচ-বাজনা এবং গান। খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার, গানের সুর হলো ক্লাসিক্যাল ধারায়।

একটি রূপবান বালককে মেয়ে সাজানো হতো। সে নেচে নেচে গান করত। মাঝে মাঝে দর্শকদের কোলে বসে তাদের গলা জড়িয়ে ধরত।

সংগীতের এই ধারায় অতি দ্রুত কদর্যতা ঢুকে যায়। নারীবেশী কিশোরদের জন্যে পুরুষরা লালায়িত হতে শুরু করেন। একসময় বিত্তবানদের মধ্যে ঘেঁটুপুত্র কিছুদিনের জন্যে বাড়িতে এনে রাখা রেওয়াজে পরিণত হয়। বিশেষ করে সিলেট ময়মনসিংহের হাওর অঞ্চলে তিন মাসের জন্যে ঘেঁটু রাখা রেওয়াজে পরিণত হয়। কারণ এই তিনমাস হাওর থাকে জলমগ্ন। আমোদ-ফুর্তিতে সময় কাটানো ছাড়া কিছু করার নেই। আমজনতা সময় কাটায় তাস খেলে, ‘দবা’ (দাবা) খেলে, গানবাজনা করে। শৌখিনদার বিত্তবানরা তিনমাসের জন্যে ঘেঁটুপুত্র নিয়ে আসেন। ঘেঁটুপুত্র রাত্রিযাপন করে শৌখিনদের সঙ্গে। শৌখিনদারের স্ত্রী চোখের জল ফেলেন। স্ত্রী ঘেঁটুপুত্রকে দেখেন তার সতীন হিসেবে। প্রাচীন সাহিত্যেও বিষয়টা উঠে এসেছে

“আইছে সতীন ঘেঁটুপুলা
তোরা আমারে বাইন্ধা
ফেল হাওরে নিয়া…”

প্রকাশ্য সমকামিতার বিষয়টা সেই সময়ের সমাজ কী করে স্বীকার করে নিয়েছিল আমি জানি না। তবে আনন্দের বিষয় ঘেঁটুগান আজ বিলুপ্ত। সেই সঙ্গে বিলুপ্ত সংগীতের একটি অপূর্ব ধারা।

আমার সংগ্রহের ঘেঁটুগানগুলো ‘ঘেঁটুপুত্র কমলা’য় ব্যবহার করব। প্রাচীন আবহ তৈরির চেষ্টা করব। কেন জানি মনে হচ্ছে এটিই হবে আমার শেষ ছবি।

ইচ্ছা ছিল সম্পূর্ণ নিজের টাকায় ছবিটা করব। অন্যের টাকায় ছবি করার অর্থ নিজেকে কিছুটা হলেও বন্ধক রাখা। দুঃখের ব্যাপার হলো ছবি তৈরিতে যে বিপুল অংকের অর্থ লাগে তা আমার নেই।

ছবি বানাতে গিয়ে টাকার সমস্যায় পড়লেই আমি আসাদুজ্জামান নূরের কাছে। যাই। নূর প্রথম যে বাক্যটি বলেন তা হলো, টাকা কোনো ব্যাপারই না। আপনার কত টাকা লাগবে?

এবারও অতীতের মতো একই কথা বলে আমার হাত থেকে বাচার জন্যেই হয়তো জার্মানিতে গিয়ে বসে রইলেন। তাঁর আর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।

IDLC নামক এক অর্থ-প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। ছবি বানানোর জন্যে তারা আমাকে টাকা ধার দেবে কি না। তাদের এক কর্মকর্তা বলেছেন, ছবি বানানোর জন্যে আমরা টাকা দিই না। তবে আপনাকে অবশ্যই দেব।

এদের কথা শুনে আমার প্রাথমিক শঙ্কা দূর হয়েছে। তারচেয়ে বড় কথা, শেষ খুঁটি চ্যানেল আইয়ের সাগর তো আছেই। সাগরের সঙ্গে প্রচলিত একটি গল্প এরকম—

পত্রিকায় ফিল্মের ওপর ফ্রিল্যান্স লেখা লেখে এমন এক সাংবাদিক গিয়েছে। মুখ কাঁচুমাচু করে বলেছে, সাগর ভাই, একটা ছবি বানানোর খুবই শখ।

সাগর : নাটক, সিনেমা এইসব আগে কখনো বানিয়েছ?

সাংবাদিক; না। তবে এইসব বিষয়ে আমার ব্যাপক পড়াশোনা।

সাগর : চিত্রনাট্য কি তৈরি?

সাংবাদিক : শুরু করেছি, এখনো শেষ হয় নাই।

সাগর : ছবির বাজেট কত?

সাংবাদিক : আপনি যা দেন তার মধ্যে শেষ করে ফেলব ইনশাআল্লাহ।

সাগর : খোঁজ নাও তো শেরাটনের বলরুম কবে খালি।

সাংবাদিক : কেন সাগর ভাই?

সাগর : ছবির মহরত করবে না?

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, জীবন শুকায়ে গেলে করুণাধারায় যেতে হয়। ফিল্মমেকারের জীবন শুকায়ে গেলে তারা যায় সাগরের কাছে। লোনা পানির সাগর না, চ্যানেল আইয়ের সাগর।

‘ঘেটুপুত্র কমলা’ ছবি নিয়ে ব্যস্ততার পর্ব চলছে এখন। ফাউনটেনপেনের আর কোনো পর্ব লেখা এই কারণেই বন্ধ।

পাদটিকা

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কিন্তু ঘেঁটুগানের ফসল (লেটো গান, জিনিস একই)। তাঁর সংগীতের প্রথম পাঠ হয় লেটো গানের দলে।

কুইজ

বিশ্বকাপ ফুটবল শুরু হয়েছে। আমরা সাপ-লুডু ছাড়া তেমন কিছু খেলতে পারি না। তাতে কী হয়েছে? আমাদের আহাদের সীমা নেই। পাড়ায় পাড়ায় ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার ফ্ল্যাগ উড়ছে। অনেক বছর আগে আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে হেরে গিয়েছিল। আমি তখন ময়মনসিংহে ‘অয়োময়’ নামের ধারাবাহিক নাটকের ইউনিটের সঙ্গে আছি। আর্জেন্টিনার পরাজয়ের পর পর বিশাল জঙ্গি মিছিল বের হলো। স্লোগান–আর্জেন্টিনার পরাজয় মানি না, মানি না।

এক দড়িতে দুজনের ফাঁসিও চাওয়া হলো। একজন রেফারি, আরেকজন হচ্ছে আর্জেন্টিার বিপক্ষের গোলদাতা। তাঁর নাম মনে নেই।

বিশ্বকাপ উপলক্ষে কুইজ বিশ্বকাপ নিয়েই হওয়া উচিত।

প্রশ্ন : ফুটবল খেলার শুরুটা কীভাবে হয়?

উত্তর : চীনের মিং ডায়ানাষ্টির গোড়ার দিকে শুরু। মিং রাজাদের হাতে পরাজিত সেনাপতিদের কাটা মুণ্ড সম্রাটের সামনে রাখা হতো। সম্রাট কাটা মুণ্ডুতে লাথি দিতেন। মুণ্ডু গড়িয়ে যেত, সম্রাট আনন্দ পেতেন। তাঁর আনন্দ থেকেই– ফুটবল।

ওরফে বাচ্চু

আমার ডাকনাম ছিল কাজল। বিভূতিভূষণের অপরাজিত উপন্যাস থেকে বাবা এই নাম তার প্রথম ছেলের জন্যে রাখলেন। আমার জন্মের পরপর মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মস্তিষ্কবিকৃতি। কাউকে চিনতে পারেন না। কাজেই আমাকে চলে যেতে হলো নানার বাড়ি। আমি নানিজানের বুকের দুধ খেয়ে বড় হতে থাকলাম। নানিজান আদর করে আমাকে ডাকতেন বাচ্চু। বাচ্চা থেকে বাচ্চু। নানিজানের আদরের নামের কাছে পরাস্ত হলো বাবার সাহিত্যনির্ভর নাম।

এখন কোনো পত্রিকা যদি আমার ডাকনাম ব্যবহার করে আমাকে অপমান করতে চায় তাহলে ঘটনা কেমন দাঁড়াবে? তারা যদি লেখে- হুমায়ূন আহমেদ ওরফে বান্ধু–তাহলে কি আমি অপমানিত বোধ করব?

কবি শামসুর রাহমানের ডাকনাম বাচ্চু। তাকে অপমান করতে যদি লেখা হয়–শামসুর রাহমান ওরফে বা–তাহলে কি দেশবরণ্যে এই কবি অপমানিত হবেন?

সম্প্রতি ট্যাবলয়েডশ্রেণীর একটি পত্রিকা বাংলাদেশ প্রতিদিন এই কাজটি করছে। তারা প্রথম আলোর সম্পাদককে অপমান করার জন্যে লিখছে–মতিউর রহমান ওরফে বাচ্চু। অপমানের এই কৌশলের বালখিল্যতা তারা ধরতে পারছে না দেখে আমি বিস্মিত হচ্ছি। একজন সম্মানিত মানুষের সম্মান আমরা রাখব না? রুচিবোধের বিষয়ও তো আছে!

মতি ভাইয়ের (মতিউর রহমান) সঙ্গে আমার বর্তমান সম্পর্ক বরফের চেয়েও শীতল, তারপরেও তাকে অপমানের এই হীন কৌশল দেখে রাগে গা জ্বলে যাচ্ছে। আমার ডাকনাম বাচ্চু, এটাও একটা কারণ হতে পারে।

যে সাংবাদিকের মাথায় ‘ওরফে বাচ্চু’র উর্বর আইডিয়া এসেছে তার মতো এক সাংবাদিকের সঙ্গে আমার একবার দেখা হয়েছিল। গল্পটা বলা যেতে পারে।

তখন শহীদুল্লাহ হলের আমি হাউস টিউটর। লেখক-পরিচিতি বা খ্যাতি কিছুই হয় নি। পত্রিকায় ইন্টারভিউ দেওয়ার জন্যে লালায়িত থাকি, যদি তাতে লোকজনের কাছে আমার নামটা পৌঁছে। কেউ ইন্টারভিউ নিতে আসে না।

এক ভোরবেলায় ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটল। ইন্টারভিউ নিতে সাংবাদিক বাসায় উপস্থিত। তিনি বললেন, আপনার উপর বিশাল প্রতিবেদন ছাপা হবে, ছবিসহ। বাসায় ছবি আছে?

আমি খুঁজে-পেতে একটা ছবি বের করে তাকে দিলাম। আগ্রহ নিয়ে ইন্টারভিউর প্রশ্নের জবাব দেওয়া হলো।

সাংবাদিক বললেন, এখন আমার খরচটা দিন চলে যাই।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কিসের খরচ?

আপনার উপর বিশাল প্রতিবেদন যাচ্ছে তার খরচ।

সবাই দেয়। আমি আপনাকে খরচ দিব না। আমার প্রতিবেদনের প্রয়োজন নাই।

সাংবাদিক রাগাবেন না হুমায়ূন ভাই। উল্টাপাল্টা নিউজ করে দিব, সাত হাত পানির নিচে চলে যাবেন।

পানির নিচে গেলেও সমস্যা নাই। আমি সাঁতার জানি।

এই সাংবাদিক নিউজ’ করলেন। তখন মনে হলো খরচ দেওয়াই ভালো ছিল।

সাংবাদিকরা উপদেবতার মতো। তারা খরচে তুষ্ট থাকেন। মতি ভাই, খরচ দিয়ে দেখতে পারেন।

থাক এই প্রসঙ্গ। বিখ্যাত কিছু ব্যক্তির অপমানের কৌশলের গল্প করা যাক।

মোগল সম্রাট শাহজাহান খেতে বসেছেন। তার সঙ্গে খেতে বসেছেন পারস্য থেকে আসা রাষ্ট্রদূত। রাষ্ট্রদূত কড়মড় করে মুরগির রান চিবুচ্ছেন। শাহজাহান বিরক্ত হয়ে বললেন, হাড় সব খেয়ে ফেলছেন। কুকুরের জন্যে কিছু রাখবেন না?

রাষ্ট্রদূত আঙুল উঁচিয়ে পোলাওয়ের থালা দেখিয়ে বললেন, ওই তো রেখেছি। কুকুর খাবে।

সম্রাটকে অপমান করার জন্যে এই কথা বলা। পোলাও সম্রাটের অতি প্রিয় খাবার। পারস্যের রাষ্ট্রদূত এটা জানেন।

সম্রাট হুমায়ূনের ভাই বিদ্রোহী কামরান মির্জাকে গ্রেফতার করে সম্রাটের সামনে আনা হয়েছে। যে তরবারি ঝুলত কামরান মির্জার কোমরে, সেই তরবারি তার গলায় ঝুলিয়ে তাকে উপস্থিত করা হয়েছে। একজন রাজপুরুষের জন্যে অপমানের শেষ সীমানা।

কবিরা আবেগতাড়িত মানুষ। এরা অতি সহজেই অপমানিত হন। তার একটি গল্প বলি।

অনেক কাল আগে সুনামগঞ্জে গিয়েছি হাসন উৎসবে। দেশের অনেক কবিও গিয়েছেন। আমাদের জায়গা হয়েছে সার্কিট হাউসে। ভালো আয়োজন। হঠাৎ কবিদের একজনের মাথা গরম হয়ে গেল। কারণ অতিথি তালিকায় তার আগে জুনিয়র একজন কবির নাম চলে এসেছে। তিনি উৎসবে যোগ না দিয়ে ঢাকায় চলে এলেন।

বাংলাদেশের কবিরা নামের আগে-পরের বিষয়ে স্পর্শকাতর। তাদের নানান ভাগও আছে। সত্তর দশকের কবি, ষাট দশকের কবি ইত্যাদি।

ঔপন্যাসিকেরা কবিদের মতো এত স্পর্শকাতর না। তারা বিভিন্ন দশকে বিভক্তও না। আমি কখনো বলতে শুনি নিউনি সত্তর দশকের ঔপন্যাসিক।

কবিদের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। আমি নিজে শরিফ মিয়ার ক্যান্টিনে, কবিদের কিছু হাতাহাতি দেখেছি। ঔপন্যাসিক বা গল্পকারদের হাতাহাতি এখনো দেখা হয় নি।

এখন ব্যক্তিগত কিছু অপমানের গল্প।

বিটিভিতে তখন ‘বহুব্রীহি’ নামের একটি ধারবাহিক নাটক চলছে। বাংলা সাহিত্যের জনৈক অধ্যাপক আমাকে টেলিফোন করে বললেন, আমার কাজের মেয়ে আপনার এই নাটক মন দিয়ে দেখে। কাজের মেয়ের মন জয় করাও খারাপ না।

তোমাদের জন্যে ভালোবাসা নামের একটা সায়েন্স ফিকশন লিখেছিলাম। মনে হয় বাংলাদেশে প্রকাশিত প্রথম বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী। বইটি পড়ে সাহিত্যের এক অধ্যাপক বললেন, লেখার আগে কি গাঁজায় দম দিয়ে নিয়েছিলেন? গাঁজায় দম না দিয়ে এই জিনিস লেখা যায় না।

আমার চামড়া মোটা এবং খসখসে বলেই মনে হয় কোনো অপমান আমার গায়ে লাগে না। তবে কোনো অপমানই আমার গায়ে লাগে না কথাটা ভুল বললাম। ছেলেমেয়ের অপমান গায়ে লাগে।

আমার মেজো মেয়ে শীলা ইকনমিক্সে প্রথম শ্রেণীতে এম এ ডিগ্রি পাওয়ার পর তাকে মিষ্টি এবং ফুল পাঠালাম। সে তা ফেরত পাঠাল। সঙ্গে একটা চিঠি ভুল করে মিষ্টির প্যাকেট খুলে একটা মিষ্টি খেয়ে ফেলেছি। সরি।

সব মানুষকে তার দীর্ঘ বা স্বল্প জীবনে নানান তপমানের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। অপমান আগুণের মতো, মানুষকে শুদ্ধ এবং পবিত্র করে।

.

পাদটিকা

মুনীনাঞ্চ মতিভ্রমঃ
জিহ্বা টলতি ধীরস্য
পাদষ্টলতি হস্তিনঃ।

ধীর ব্যক্তিরও জিহ্বা কখনো কখনো বিচলিত হয়। হাতিরও কখনো কখনো পদস্খলন হয়।

.

কুইজ

‘যে ঈশ্বর পৃথিবীতে ক্ষুধার্ত মানুষকে অন্ন দিতে পারেন না তিনি পরকালে আমাদের পরম সুখে রাখিবেন ইহা আমি বিশ্বাস করি না।‘

কে বলেছেন এই কথা?

উত্তর : স্বামী বিবেকানন্দ।

কেটেছে একেলা বিরহের বেলা

উৎসর্গ
ব্যক্তিগতভাবে আমি এই তরুণকে চিনি না, কিন্তু মুগ্ধ হয়ে তার ক্রিকেট খেলা দেখি।
সাকিব আল হাসান।
(সাকিবের কাছে কুইজ–ক্রিকেটে এগারোজন খেলোয়াড় খেলেন। কেন বারোজন না বা কেন দশজন না? সংখ্যাটা এগারো কেন?)

.

বৃক্ষের নিকটে গিয়ে বলি,
দয়াবান বৃক্ষ তুমি একটি কবিতা দিতে পারো?
বৃক্ষ বলে, আমার বাকল ফুঁড়ে আমার মজ্জায়
যদি মিশে যেতে পারো, তবে
হয়তোবা পেয়ে যাবে একটি কবিতা।

-শামসুর রাহমান

.

ভূমিকা

বলপয়েন্ট, কাঠপেন্সিল-এর পর ফাউন্টেনপেন। তারপর কী লিখব? লেখার অভাব আছে, কলমের অভাব নেই। নিব কলম, খাগের কলম, শ্লেট পেনসিল…। কলম নিয়ে আমার লেখা কি চলতেই থাকবে? পাঠকদের আশ্বস্ত করছি না। এখন কিছুটা ক্লান্ত। ক্লান্তির কাছে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ পর্যদস্ত হয়েছেন (ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু)। সেখানে আমি আবার কে?

হুমায়ূন আহমেদ
দখিন হাওয়া
ধানমণ্ডি

.

কেটেছে একেলা
বিরহের বেলা

এক মাস ধরে বইমেলা চলছে। আমি ঘরে বসে বিরহের বেলা কাটাচ্ছি। মেলায় যেতে না পারার বিরহ। সম্প্রতি ঘরে সিগারেট খাওয়া নিষিদ্ধ ঘোষণা করায় আমাকে কিছুটা সময় বারান্দায় বসে থাকতে হয়। বারান্দাটা এমন যে এখান থেকে দালানকোঠা ছাড়া কিছু দেখা যায় না। তবে একটা আমগাছ চোখে পড়ে। আমগাছে মুকুল এসেছে। বসন্তের নমুনা বলতে এইটুকুই।

আমাকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখলেই পুত্র নিষাদ পাশে এসে বসে। সে এখন ‘কেন?’-স্টেজে আছে। এই স্টেজের বাচ্চারা ‘কেন?’ ‘কেন?’ করতেই থাকে।

বাবা, বারান্দায় বসে আছ কেন?

আমগাছ দেখছি।

আমগাছ দেখছ কেন?

দেখতে ভালো লাগছে, তাই দেখছি।

ভালো লাগছে কেন?

জানি না।

জানো না কেন?

বাবা! যথেষ্ট বিরক্ত করেছ। এখন তোমাকে ধরে আমি একটা আছাড় দিব।

আছাড় দিবে কেন?

পুত্র কেন কেন করতে থাকুক, আমি মূল রচনায় ফিরে যাই। বইমেলা বিষয়ক রচনা।

মেলায় নিজে যেতে না পারলেও টিভি চ্যানেল এবং পত্রিকার কলামে মেলা দেখা হচ্ছে। ভালোমতোই হচ্ছে। মাঠে না গিয়ে ঘরে বসে টেলিভিশনে ক্রিকেট খেলা দেখার মতো। অনেক খুঁটিনাটি চোখে পড়ছে। মেলায় উপস্থিত থাকলে চোখে পড়ত না।

কিছু লেখক এবং প্রকাশককে দেখলাম ঐতিহ্য নিয়ে চিন্তায় অস্থির। ঐতিহ্য বজায় রাখতেই হবে। মেলা বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণেই হতে হবে। অন্য কোথাও হওয়া যাবে না।

গায়ে গা লাগিয়ে মানুষ হাঁটছে। বই হাতে নিয়ে দেখার সুযোগ নেই। বাচ্চারা ভিড়ে অস্থির হয়ে কাঁদছে। কেউ কেউ হারিয়ে যাচ্ছে। বখাটে ছেলেরা থাকছে যদি সুযোগ বুঝে কোনো তরুণীর গায়ে হাত রাখা যায়। তসলিমা নাসরিন দেশে নেই। তরুণী লাঞ্ছিত হলেও লেখার কেউ নেই। লাঞ্ছিত হলেও ঐতিহ্য তো বজায় থাকবে।

টিভিতে বইমেলা দেখে আমি মাঝে মাঝেই আতঙ্কে অস্থির হয়েছি। যদি আগুন লাগে, যেখানে আগুন লেগেছে সেখানে কি দমকলের গাড়ি পৌঁছতে পারবে? ছোটাছুটি শুরু হলে বাচ্চারা কোথায় যাবে? কলকাতার অতি প্রশস্ত বইমেলাও একবার আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছিল। সে-সময় আমি কলকাতার বইমেলায়। কী ভয়ঙ্কর অবস্থা হয়েছিল আমার জানা আছে।

ঐতিহ্য-প্রেমিকদের বলছি, ঐতিহ্যও বদলায়। একসময় আমাদের পূর্বপুরুষরা ধুতি পরতেন। ধুতি পরার ঐতিহ্য থেকে আমরা সরে এসেছি।

আগের লেখকরা ঝর্ণা কলমে লিখতেন। এখন অনেকেই কম্পিউটারে লেখেন। ঝর্ণা কলম নামক ঐতিহ্যের মৃত্যু।

বাংলা একাডেমীর পাশেই বিশাল মাঠ পড়ে আছে। সেই মাঠ কারও চোখে পড়ছে না। আমরা আটকে আছি খুপড়িতে। বাংলা একডেমীর কর্তারা কেন মেলা পরিচালনা করছেন তাও বুঝতে পারছি না। মেলা পরিচালনা করবেন প্রকাশকরা। নীতি তারা নির্ধারণ করবেন।

বইমেলায় হেঁটে বেড়ানো, নতুন প্রকাশিত বই হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখার আনন্দ থেকে বাংলা একাডেমী পাঠককে বঞ্চিত করছে। মেলা তাদের হাতের মুঠোয় রেখে দিয়েই কাজটা করছে।

প্রসঙ্গক্রমে অতীতের এক বইমেলার ঘটনা বলি। আমি একটা স্টলে বসেছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাংলা একডেমীর ডিজি আমার কাছে চলে এলেন। তাঁর নাম, আচ্ছা থাক, নাম বললাম না। ডিজি’র চোখমুখ শক্ত। তিনি বললেন, আপনি মেলায় থাকতে পারবেন না।

আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন পারব না?

তিনি বললেন, আপনার কারণে মেলায় বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। দুর্ঘটনা ঘটবে। আপনাকে এক্ষুনি উঠে যেতে হবে।

আমি বললাম, ব্যবস্থা করে দিন যাতে বিশৃঙ্খলা না হয়। লেখক হিসেবে আমার অধিকার আছে মেলায় আসার। বইমেলা শুধু পাঠক-প্রকাশকের মেলা না। লেখকদেরও মেলা।

আপনার সঙ্গে তর্কে যাব না। আপনাকে মেলা ছেড়ে চলে যেতে হবে।

আমি বেশ মন খারাপ করে বাসায় চলে এলাম। তারপর অবশ্য ঘটনা অনেকদূর গেল। অনেক প্রকাশক ঘোষণা করলেন তারা মেলা করবেন না। সংসদে পর্যন্ত বিষয়টি উঠল। বাংলা একাডেমীর ডিজি আমার ধানমণ্ডির বাসায় উপস্থিত হয়ে বলতে শুরু করলেন আমার লেখা তার কত পছন্দ। ইত্যাদি।

আমি মেলায় যাওয়া এরপর থেকে বন্ধই করে দিলাম। এক দিন কিংবা দুদিন শুধু যাই। আমার অবস্থা চিলের মতো। চিল আকাশে ওড়ে, তার মন পড়ে থাকে মাটিতে। আমি আমার ঘরের বারান্দায় বসে থাকি, আমার মন পড়ে থাকে বইমেলায়।

আমি যে ফ্ল্যাটে থাকি তার পাশের ফ্ল্যাটেই থাকেন মাজহারুল ইসলাম, ‘অন্যপ্রকাশ’-এর মালিক। তিনি হুমায়ূন আহমেদ টাইপ বাজারি লেখকদের বই ছেপে কুখ্যাতি অর্জন করেছেন। তার স্টলের সামনে নাকি ভিড় লেগে থাকে। অপরিপক্ক তরুণ-তরুণীরা মাছির মতো ভিড় করে বাজারি লেখকদের বই কিনতে চায়।

ভালো কথা, বাজারি লেখক–বিষয়টা আরও পরিষ্কার করা দরকার। বাজারি লেখক মানে তুচ্ছ লেখক। তেল-সাবান-পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ বিক্রেতা টাইপ লেখক। এদের বই বাজারে পাওয়া যায় বলেও বাজারি। যাদের বই বাজারে পাওয়া যায় না, তাঁদের বাড়িতে কার্টুনভর্তি থাকে, তারা মহান লেখক, মুক্তবুদ্ধি লেখক, কমিটেড লেখক, সত্যসন্ধানী লেখক। তাঁদের বেশিরভাগের ধারণা তারা কালজয় করে ফেলেছেন। এঁরা বাজারি লেখকদের কঠিন আক্রমণ করতে ভালোবাসেন। তাদের আক্রমণে শালীনতা থাকে। তারা সরাসরি কখনো আমার নাম নেন না। তবে বুদ্ধিমান পাঠকরা বুঝে ফেলেন কাকে ধরা হচ্ছে। তাদের আক্রমণের নমুনা, অন্যপ্রকাশের সামনে জনৈক বাজারি লেখকের বইয়ের জন্যে তরুণ-তরুণীর সমাবেশ দেখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে হয়। এরা সৎ সাহিত্য থেকে বঞ্চিত। কষ্টকল্পিত উদ্ভট চরিত্রের গালগল্পে বিভ্রান্ত। বাজারি লেখক এবং তার প্রকাশকের অর্থ জোগান দেওয়া ছাড়া এই তরুণ-তরুণীরা আর কিছুই করছে।

কালজয়ী এইসব মহান লেখকের সঙ্গে মাঝে মাঝে আমার দেখা হয়ে যায়। বেশিরভাগ দেখা হয় দেশের বাইরের বইমেলায়। আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে তারা কিছুটা বিচলিত বোধ করেন। কেন করেন তা আমার কাছে স্পষ্ট না। এমন একজনের সঙ্গে কথোপকথনের নমুনা–

কালজয়ী : কেমন আছেন?

আমি : জি ভালো।

কালজয়ী : ইদানীং কিছু কি লিখছেন?

আমি : একটা সস্তা প্রেমের উপন্যাস লেখার চেষ্টা করছি। যতটা সস্তা হওয়া দরকার ততটা সস্তা হচ্ছে না বলে অস্বস্তিতে আছি। আপনার দোয়া চাই যেন আরেকটা সস্তা লেখা লিখতে পারি।

কালজয়ী : (গম্ভীর)

আমি : আপনি কি মহান কোনো লেখায় হাত দিয়েছেন?

কালজয়ী : আপনার রসবোধ ভালো। আচ্ছা পরে কথা হবে।

.

কালজয়ীরা আবার স্তুতি পছন্দ করেন। তাঁরা নিজেদের গ্রহ মনে করেন বলেই উপগ্রহ নিয়ে ঘোরাফেরা করতে পছন্দ করেন। গ্রহদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ কখনোই থাকে না, কিন্তু উপগ্রহের সঙ্গে থাকে। উপগ্রহরা উপযাজক হয়েই টেলিফোন করেন। তাদের টেলিফোন পেলে আতঙ্ক বোধ করি। কেন আতঙ্ক বোধ করি তা ব্যাখ্যা করছি–

উপগ্রহের টেলিফোন এসেছে। কণ্ঠ উত্তেজিত। উত্তেজনার ভেতর চাপা আনন্দ।

হুমায়ূন ভাই! আপনাকে তো শুইয়ে ফেলেছে।

কে শুইয়েছেন?

বদরুদ্দিন উমর।

কোথায় শোয়ালেন?

সমকাল পত্রিকার সেকেন্ড এডিটরিয়েলে। উনি বলেছেন আপনার লেখায় শিক্ষামূলক কিছু নাই।

এটা তো উনি ঠিকই বলেছেন। আমি তো পাঠ্যবই লিখি না। আমার বই শিক্ষামূলক হবে কেন? জীবনে একটাই পাঠ্যবই লিখেছিলাম–কোয়ান্টাম রসায়ন। সম্ভবত উনার চোখ এড়িয়ে গেছে।

না হুমায়ূন ভাই, আপনি জিনিসটা হালকা দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। একটা বাদানুবাদ হওয়া উচিত। আপনি একটা কাউন্টার লেখা দিন। এটা আমার রিকোয়েস্ট।

আমি টেলিফোনের লাইন কেটে দিলাম। রাতের আড্ডায় (Old Fools Club) আমার সমকাল-এর পাতায় শুয়ে পড়ার ঘটনা বললাম। বন্ধুরা আনন্দ পেল। আমার যে-কোনো পতন আমার বন্ধুদের কাছে আনন্দময়। .

এখন শিক্ষা-বিষয়ে বলি। অতি বিচিত্র কারণে বাংলাদেশের মানুষ সব কিছুতেই শিক্ষা খোঁজে। গল্প-উপন্যাসে শিক্ষা, নাটকে-সিনেমায় শিক্ষা। একসময় ঈদে প্রচারিত হাসির নাটকের শুরুতেই আমি লিখে দিতাম- “এই নাটকে শিক্ষামূলক কিছু নেই।”

সাধারণ মানুষ এবং অসাধারণ সমালোকরাই শুধু যে শিক্ষা খোঁজেন তা না, দেশের প্রধানরাও শিক্ষা নিয়ে আগ্রহী। তারাও একে অন্যকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যে নানান ব্যতিক্রমী কর্মকাণ্ড হাতে নেন।

শিক্ষা নিয়ে এত উদ্বেগের পরেও জাতি হিসেবে আমরা ক্রমেই মূর্খ হচ্ছি কেন কে বলবে!

আচ্ছা শিক্ষা আপাতত থাকুক। মহান কালজয়ীরা বর্তমানের কুসাহিত্য নিয়ে চিন্তায় অস্থির হতে থাকুন, আমি ফিরে যাই বইমেলায়। আপনারা কি জানেন, মেলায় প্রকাশিত চমৎকার সব প্রচ্ছদের বইগুলির বেশিরভাগ লেখক প্রবাসী? তারা বৎসরে একবার ডলার পাউন্ড পকেটে নিয়ে দেশে আসেন। প্রকাশকদের সঙ্গে চুক্তি হয়। খরচ তাদের। প্রকাশকরা শুধু বই ছেপে দেবেন। প্রবাসী লেখকদের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন খুব ঘটা করে হয়। আমাদের দেশের মন্ত্রীদের হাতে কাজকর্ম নেই বলেই হয়তো মোড়ক উন্মোচন নামক অনুষ্ঠানে তাঁদের ডাকলেই পাওয়া যায়।

দু’বছর আগের কথা। এক প্রবাসী কবির বই বের হয়েছে, তিনি চাচ্ছেন আমি বইটির মোড়ক উন্মোচন করি। আমি বললাম, না। আমি একদিনের জন্যে মেলায় যাই। সেই দিনটা মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে নষ্ট করব না।

ভদ্রলোক এবং তার স্ত্রী অত্যন্ত মন খারাপ করলেন। তাদের মন খারাপ দেখে আমার নিজের মন খারাপ হয়ে গেল। আমি তখন বিকল্প প্রস্তাব দিলাম। আমি বললাম, আপনারা নুহাশপল্লীতে চলে আসুন। নুহাশপল্লীর দিঘিতে আমার একটা নৌকা আছে। আপনি নৌকায় বসে নিজের কবিতা আবৃত্তি করবেন। আমরা দিঘির ঘাটে বসে থাকব। পুরো অনুষ্ঠান ভিডিও করে আপনাকে একটা কপি দেব। সেই ভিডিও আপনি বন্ধুবান্ধবদের দেখাবেন। এরজন্যে আপনাকে একটি পয়সাও খরচ করতে হবে না। নুহাশ চলচ্চিত্র ভিডিও করে দেবে।

ভদ্রলোক আনন্দে অভিভূত হলেন।

যথাসময়ে অনুষ্ঠান হলো। তিনি নৌকায় দাঁড়িয়ে কবিতা আবৃত্তি করছেন। আমাদের ব্যবস্থা দেখে তার চোখে একটু পর পর পানি আসছে। তিনি চোখ মুছছেন। তার স্ত্রীও আমার পাশে বসেই কবিতা শুনছিলেন। তিনি এক পর্যায়ে জলভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে যা বললেন তার সরল বাংলা হলো, তাদের দুজনের জীবনে অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা আজকের অভিজ্ঞতা। তারা সারা জীবন এই সুখস্মৃতি অন্তরে লালন করবেন। তাঁর স্বামীর একটা কবিতার বইও যদি কেউ না কেনে তাতেও কিছুই আর যায় আসে না।

এই প্রবাসী কবির কথা থাকুক, অন্য আরেকজনের গল্প করি। তিনি কানাডা প্রবাসী কবি। তার নাম ইকবাল হাসান। প্রতি বছরই বইমেলায় তার কবিতার বই প্রকাশিত হয়। এই কবি আমাকে একবার ভালো বিপদে ফেলেছিলেন। বিপদের গল্পটি বলা যেতে পারে।

আমি গিয়েছি নিউইয়র্কে। বিশ্বজিৎ সাহা বইমেলার আয়োজন করেছেন। আমি বইমেলার অতিথি। মেলা উপলক্ষে কানাডা থেকে কবি ইকবাল হাসান এসেছেন। তিনি আমাকে ধরে বসলেন, একটা ইন্টারভ্যু তাঁকে দিতেই হবে। আমার নিশ্চয়ই তখন শনির দশা চলছিল, কাজেই রাজি হয়ে গেলাম। ইন্টারভ্যুপর্ব শুরু হওয়া মাত্র বুঝলাম–ঘটনা অন্য। ইকবাল হাসানের প্রশ্নের নমুনা শুনলে পাঠকও বলবেন, ঘটনা অন্য। প্রশ্নের নমুনা–

‘অনেকেই এখন বলছেন আপনি উপন্যাস হিসেবে যা লেখেন তা আসলে অপন্যাস। আপনি কী বলেন?

‘আপনার হালকা লেখাগুলি কি বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে লেখা হয়?’

‘জীবনের গভীর বোধ আপনার লেখায় অনুপস্থিত কেন?’

‘একই গল্প আপনি একটু এদিক ওদিক করে লেখেন। আপনার এই সীমাবদ্ধতার কারণ কী?’

‘আপনার বানানো নাটক-সিনেমা, আপনার বইগুলির মতোই হালকা এবং অগভীর। এর কারণ কী?’

আমি হাসিমুখে সব প্রশ্নের উত্তর দিলাম। তিনি যে উত্তর শুনতে চাইছেন তা-ই বললাম। বললাম, আমার লেখা সস্তা। টাকার জন্যে লেখি–এইসব।

এবারের বইমেলায় (২০১০) ইকবাল হাসান এসেছেন। সমকাল পত্রিকায় কলাম লিখছেন। হঠাৎ সেখানে আমাকে নিয়ে এক লেখা। কী লেখা থাকবে জানি। ভদ্রভাবে গালাগালি। কবিরা সুন্দর কাব্যময় গদ্যে গালাগালি করতে পারেন। ইকবাল হাসানের লেখা পড়ে চমকালাম। ইকবাল হাসান উল্টাগীত ধরেছেন। রচনা পাঠ করে মনে হলো- হুমায়ূন আহমেদ একজন মহান লেখক। যারা তার নিন্দামন্দ করেন তারাও সুযোগ পেলেই গোপনে তার বই পড়েন। ইত্যাদি।

আমার খুশি হওয়া উচিত, কিন্তু খুশি হওয়া গেল না। মনে হলো কবি নিশ্চয়ই অসুস্থ। সুস্থ ইকবাল হাসান এ ধরনের লেখা অবশ্যই লিখবেন না।

তিনি পরে টেলিফোন করে জানতে চাইলেন আমি তার লেখা পড়েছি কি না।

আমি বললাম, পড়েছি। উল্টাগীত গাইছেন কেন?

কবি বললেন, আগে যখন আপনার ইন্টার নিয়েছি তখন আমি অপরিপক্ক ছিলাম।

আমি বললাম, এখন কি পেকেছেন?

কবি হতাশাগ্রস্ত গলায় বললেন, হুমায়ূন ভাই, আমি এ দেশের একমাত্র কবি যে আপনার নুহাশপল্লী নিয়ে কবিতা লিখেছে। আর কেউ কিন্তু লিখে নি। আপনি কেন এরকম করে আমার সঙ্গে কথা বলছেন।

আমি তাঁকে ধন্যবাদ দিলাম। তাঁর লেখা কবিতাটি পত্রস্থ করা হলো।

.

নুহাশপল্লী

নিঃশ্বাস ফেলবে কোথায়? নেবে শ্বাস?
শরীরকে দেবে অক্সিজেন? এখন বাতাসে
শুধু কার্বডাইঅক্সাইড শুষে নেবে তেমন বৃক্ষ কোথায়?
যেদিকে তাকাবে তুমি শুধু দূষিত বাতাস। বড় হয়ে
দেখবে, পৃথিবী সুন্দর কতো’–মধ্যবয়সে এসে দেখি,
এসব আশ্বাসবাণী শুধু শূন্যে ঝরে পড়ে। হাওয়া নেই
শহরে ও গ্রামে। সবকিছু গিলে খাচ্ছে বিষাক্ত আকাশ।

যদিও স্বপ্ন দ্যাখায় প্রভাতের বোদ আর রাতের নক্ষত্র
তবু ভাবি : মেঘে মেঘে বেলা তো অনেক হলো, আর কবে
আমাদের গ্রামগুলো নুহাশপল্লীর মতো স্বয়ংম্ভর হবে?

[আকাশপরী, ইকবাল হাসান, পৃষ্ঠা-১৫, দি রয়েল পাবলিশার্স, ঢাকা]

.

পাদটিকা

Insects sting, not for malice, but because they want to live. It is the same with critics; they desire our blood, not our pain.

Friedrich Nietzsche

পোকারা আমাদের উপর রাগ করে কামড়ায় না। তারা বেঁচে থাকতে চায় বলেই কামড়ায়। সমালোচকদের বেলাতেও কথাটা সত্য। তারা আমাদের রক্ত চায়, আমাদের কষ্ট চায় না।

ফ্রেডারিখ নীটশে

ক্ষুদে গানরাজ

স্যার, আপনি কি গান গাইতে জানেন?

না।

গান বোঝেন?

না।

রাগ বিষয়ে জ্ঞান আছে?

না।

মীড়, গমক, মূৰ্ছনা–এইসব কী?

জানি না কী।

তাহলে ক্ষুদে গানরাজের প্রথম বিচারক হলেন কী জন্যে?

এই প্রশ্নের একটাই উত্তর, ‘ভুল হয়ে গেছে। মানুষ হিসেবে ভুল করার অধিকার আমার আছে।’

মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন একবার শিশুদের কবিতা আবৃত্তির বিচারক হয়েছিলেন। ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স কুস্তি প্রযোগিতার বিচারক হয়েছিলেন।

ক্ষুদে গানরাজের আরেকজন বিচারকের নাম মেহের আফরোজ শাওন। সে আমার পরিচিত। সে গান জানে, গান বোঝে, রাগ জানে, মীড় গমক-মূর্ছনা জানে। এরকম একজন বিচারক পাশে থাকলে নির্ভয়ে থাকা যায়। তার আবার আমার প্রতি উচ্চ ধারণা। সে মনে করে আমার কান অত্যন্ত পরিষ্কার। গান ভালো হচ্ছে নাকি হচ্ছে না–এটা আমি অতিদ্রুত ধরতে পারি।

শাওন অন্য স্ত্রীদের চেয়ে আলাদা না। স্ত্রীরা নির্গুণ স্বামীর ভেতরও গুণ আবিষ্কার করে ফেলে।

বিচারকের দায়িত্ব পালন শুরু হলো। আমি কঠিন ভাইবা পরীক্ষা নিচ্ছি এরকম মুখ করে বসে থাকি। শাওন চাপা গলায় বলে, ভুরু কুঁচকে আছ কেন? বাচ্চাদের দিকে রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে আছ কেন? ওরা ভয় পাচ্ছে। আমার নিজেরই তোমার দিকে তাকাতে ভয় লাগছে, ওর ভয় পাবে না কেন!

আমি চাপা গলায় বললাম, ওরা আমাকে মোটেই ভয় পাচ্ছে না। তোমাকে ভয় পাচ্ছে। তুমি গানে ভুল ধরছ, আমি ধরছি না।

তুমি একজন বিচারক। ওরা ভুল করলে তুমি ধরবে না!

আমি বললাম, ভুল ধরার যে ছাকনি আমার কানে আছে সেটা নষ্ট হয়ে গেছে। আমি ভুল ধরতে পারছি না। যা শুনছি তা-ই মনে হচ্ছে শুদ্ধ।

পাঠকরা বলুন, যে বাচ্চাটি ক্লাস ওয়ানে উঠে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে তাল লয়-সুর ঠিক রেখে গান করছে আমি তার কী ভুল ধরব? ভুল ধরায় আমার কোনো আনন্দ নেই, আমার গান শোনাতেই আনন্দ।

মৃত্তিকা নামের যে মেয়েটি ক্ষুদে গানরাজের প্রধান সমন্বয়কারী তাকে আমি ছোটবেলা থেকে চিনি, আমার শহীদুল্লাহ হলের বাসায় সে তার বাবার হাত ধরে প্রায়ই আসত। এসেই দৌড়ে টয়লেটে ঢুকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ত বাথটাবে। তখন তাকে হাতি দিয়ে টেনে তোলাও ছিল অসম্ভব। এই মেয়েটি ছিল ক্ষুদে দস্যি। তানিশা নামের আরেকটি মেয়ে যে উপস্থাপনার কঠিন এবং বিরক্তিকর কাজটি হাসিমুখে করে তাকেও অতি শৈশব থেকে চিনি। সে আরেক দস্যি। তার প্রধান কাজ ছিল, বাইরে থেকে বাথরুমের ফুটো দিয়ে তাকিয়ে থাকা এবং কিছুক্ষণ পর পর বলা–দেখে ফেলেছি, দেখে ফেলেছি।

আসলে ক্ষুদে গানরাজে ঢুকে আমি ক্ষুদেদের জগতে ঢুকে পড়েছি। এতগুলি গানের পাখি আর দুজন একসময়কার ক্ষুদে দস্যিকে নিয়ে আমার যাত্রা। Alice in wonderland এর আশ্চর্য জগতে আমার বিচরণ।

জীবন শুকায়ে গেলে করুণাধারায় আশ্রয় নিতে হয়। রবীন্দ্রনাথ এই পরামর্শ দিয়েছেন। আমার জীবন শুকিয়ে যায় নি। সেই সম্ভাবনা একেবারেই নেই, তারপরেও আমি সুরের করুণাধারায় অবগাহন করতে পারছি এ আমার পরম সৌভাগ্য।

একটাই কষ্টকর ব্যাপার–বাচ্চারা যখন বাদ পড়ে যায়। কী অবাক দৃষ্টিতেই না তারা তাকায়। তাদের চোখের দৃষ্টি বলে দেয়-আমি এত সুন্দর করে গাইলাম আর তোমরা আমাকে বাদ দিয়ে দিলে! বড়দের জগতের নিষ্ঠুরতার পরিচয়ে তাদের ক্ষুদ্র ভুবন হয়ে যায় এলোমেলো। বাদ পড়ে যাওয়া ছেলেমেয়েদের প্রতি কিছু বাবা-মা অত্যন্ত হৃদয়হীন আচরণ করেন। একটি মেয়ে দর্শকদের ভোটের কারণে বাদ পড়ল। সে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। এর মধ্যে মঞ্চে উপস্থিত হলেন মেয়েটির মা। শুরু করলেন মার। কী আশ্চর্য কাণ্ড। তাঁর মেয়ে ক্ষুদে গানরাজ হবে এই স্বপ্নে মহিলার মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছে। তিনি তা জানেন না।

আমাদের ষোল কোটি মানুষের দেশে যোজন ক্রিকেট প্লেয়ার নেই, ষোলজন ফুটবল প্লেয়ার নেই, আর এতগুলি গানের পাখি? আমি খুবই অবাক হই। অনুষ্ঠান শেষে বিস্ময়বোধ নিয়ে বাড়ি ফিরি, আবারও বিস্ময় নিয়ে পরের অনুষ্ঠানে যাই। কেউ কেউ বাদ পড়ে, ইয়েলো জোন বা ডেনজার জোনে চলে যায়। তারা গলা ফাটিয়ে কাঁদতে শুরু করে। তাদের কান্না দেখে প্রধান বিচারক মেহের আফরোজ কাঁদেন। একটা ইন্টারেস্টিং দৃশ্য হিসেবে ক্যামেরা তা রেকর্ড এবং প্রচার করে। আমি ক্যামেরার ব্যাপারটা জানি বলে নিজের চোখ আড়াল করি। শিশুরা কাঁদছে, তানিশা কাঁদছে। দুই বিচারক কাঁদছে। কোনো মানে হয়?

গানের পাখিদের একটির নাম রানা। সে অবশ্যি সারাক্ষণই হাসে। বাদ পড়ে গেলেও দাঁত বের করে হাসে। উচ্চারণ ভয়াবহ খারাপ। আমাকে ডাকে ছার, স্যার না। ছেলেটি খুলনা শহরে রাস্তায় রাস্তায় গান গেয়ে ভিক্ষা করে বাবা-মার সংসার চালাতো। এখন ক্ষুদে গানরাজ হওয়ার সম্ভাবনা তার প্রবল। প্রথম দশজনের ভেতর সে চলে এসেছে ইউরোপ, আমেরিকায় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক জগতের হাতছানি এখনই তার জন্যে শুরু হয়েছে। তার জন্যে অপেক্ষা করছে অন্য এক জগত। যে জগত ভিক্ষাবৃত্তির জগত না।

আরেকটি ছেলের কথা বলি–নাম শান্ত মিয়া। বাড়ি পাবনা। তার মা বিড়ি বেঁধে দৈনিক নয় টাকা পায়। এতে মাতা-পুত্রের সংসার চলে। ছেলেটি প্রথম বারোজনের ভেতর চলে এসে বাদ পড়ল। আমাকে এবং শাওনকে কাঁদতে কাঁদতে বলল, এখন আমি কই যাব? মানুষের বাসাবাড়িতে কাজের ছেলের চাকরি নেওয়া ছাড়া আমার আর কোনো পথ নাই। আগেও কাজ করি খেতাম, এখনো খাব।

আমি তাকে বললাম, তোমার মাকে আমি নুহাশপল্লীতে একটা চাকরি দিতে পারি। তুমি থাকবে তোমার মা’র সঙ্গে। তোমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হবে। তুমি পড়াশোনা করবে। আগে পড়াশোনা তারপর গান। রাজি আছ?

শান্ত মিয়া বলল, স্যার আমি রাজি।

মাতা-পুত্র এখন নুহাশপল্লীতে আছে। শান্ত মিয়া ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয়েছে। শান্ত মিয়া অবসর সময়ে একটা কঞ্চি হাতে নুহাশপল্লীতে একা একা ঘুরে বেড়ায়। নিজের মনের আনন্দে গান করে—আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানিরে…

উকিল মুন্সির বিখ্যাত বিচ্ছেদি গান। তাঁর গান নুহাশপল্লীর বৃক্ষদের স্পর্শ করে। মানুষের কষ্ট সবার আগে টের পায় বৃক্ষরাজি। এই তথ্য আমরা জানি না।

পাদটিকা

Failure is very difficult for anyone to bear, but very few can manage the shock of early success.
—Maurice Valency (পরাজয় সহ্য করা সবার জন্যেই কঠিন, আবার শুরুতেই সাফল্যের ধাক্কাও অনেকেই হজম করতে পারে না।)

কুইজ

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে নালিশ গেছে। ভুল-ভাল উচ্চারণে জনৈক উর্দুভাষী (হিন্দিও হতে পারে) গায়ক তার দু’টা বিখ্যাত গান রেকর্ড করে ফেলেছে। রেকর্ড দুটি এই মুহূর্তে প্রত্যাহার করা উচিত।

রবীন্দ্রনাথ মন দিয়ে রেকর্ড শুনে বললেন, গায়কের কণ্ঠের মাধুর্যে উচ্চারণের ক্রটি ঢাকা পড়ে গেছে। রেকর্ড দু’টা থাকবে।

গায়কের নাম কী?

উত্তর : কে. এল. সায়গল (গায়ক এবং অভিনেতা)।

কী এক উৎসব উপলক্ষে আমরা অর্থাৎ ওল্ড ফুলস ক্লাবের সদস্যরা একটা হোটেলের বড় ঘরে জড়ো হয়েছি। সেখানে মধ্যবয়স্ক অচেনা এক ব্যক্তি ঢুকল। আমি ভুরু কুঁচকে তাকালাম। বৃদ্ধ বোকা সংঘের আড্ডায় কখনো অপরিচিতজনদের আসতে দেওয়া হয় না। এ কে? এখানে কী চায়?

পরিচয়ে জানলাম–তার একটা প্রেস আছে। সেই প্রেসে ‘অন্যপ্রকাশ’-এর বইয়ের কভার মাঝে মাঝে ছাপা হয়। সে এসেছে অন্যপ্রকাশের মালিক মাজহারের কাছে। তার কিছু টাকা দরকার।

বেচারা বিব্রত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বললাম, আপনি বসুন। সে সংকুচিত ভঙ্গিতে বসল।

আড্ডা জমে উঠল। আমি তার কথা ভুলেই গেছি। নিজের মনে কথা বলে যাচ্ছি। যুক্তিতর্কের আসর জমেছে। এখন মনে পড়ছে না কী একটা যুক্তি দিলাম। হঠাৎ সে বলল, এখন আপনি যে যুক্তিটা দিলেন তাতে ভুল আছে।

আমি বললাম, কী ভুল?

সে আমার যুক্তির ভুল ব্যাখ্যা করল। ব্যাখ্যা সঠিক। আমি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বললাম, আপনার কী নাম?

স্যার, আমার নাম সাদেক।

আপনি এত পিছনে কেন? কাছে এগিয়ে আসুন। সাদেক কাছে এগিয়ে এল। এই আসরেই তার নতুন নাম করা হলো ‘চ্যালেঞ্জার।

তার নামকরণে আমার কোনো ভূমিকা ছিল না। নামকরণ করেছিলেন ‘অবসর প্রকাশনার মালিক আলমগীর রহমান। সাদেক আলমগীর রহমানের দিকে একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে চ্যালেঞ্জ জিতে নেন বলেই নাম চ্যালেঞ্জার। সাদেক কী বিষয়ে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন তা বলতে চাইছি না। কোনো এক বিশেষ তরল পদার্থ গলধঃকরণ বিষয়ক চ্যালেঞ্জ। ধরা যাক পেপসি। আলমগীর আট বোতল পেপসি খেয়ে বমি শুরু করল। চ্যালেঞ্জার নয় বোতল খেয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সবার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল, যেন কিছুই হয় নি।

তাকে আমি প্রথম যে নাটকে নিলাম, তার নাম ‘হাবলঙের বাজার’। নাটকের কাহিনী হচ্ছে গরমের সময় ডাক্তার এজাজের মাথা এলোমেলো হয়। তার বিয়ের দিন খুব গরম পড়ার কারণে মাথা এলেমেলো হয়ে গেল। ঠিক করা হলো, মাথা কামিয়ে সেখানে মাথা গরমের এলাজ দেওয়া হবে। শট নেওয়ার আগে আগে দেখা গেল নাপিত আনা হয় নি। নাপিতের সন্ধানে লোক পাঠানো হলো। সে ক্ষুর-কাঁচি পাঠিয়ে দিল। নিজে এল না। তার ভয় সে এলেই তাকে নাটকে নামিয়ে দেওয়া হবে। আমি পড়লাম বিপাকে।

কীভাবে নাটক বানানো হয় তা দেখার জন্যে চ্যালেঞ্জার তার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছে। দু’জনই আগ্রহ নিয়ে নাটক বানানো দেখছে। আমি চ্যালেঞ্জারের দিকে তাকিয়ে বললাম, তুমি তো সব কিছুকেই চ্যালেঞ্জ হিসাবে নাও। এসো নাপিতের ভূমিকায় অভিনয় করো।

চ্যালেঞ্জার বলল, স্যার, আপনি যা বলবেন তা-ই করব। মাটি খেতে বলতে মাটি খাব। নাটক পারব না।

আমি বললাম, তুমি পারবে। নাও ক্ষুর হাতে নাও।

চ্যালেঞ্জার ছোট্ট একটা ভূমিকায় অভিনয় করল। আমি সঙ্গে সঙ্গে বুঝলাম, তার ভেতর সহজাত অভিনয়ের আশ্চর্য ক্ষমতা আছে।

তাকে একঘণ্টার একটি নাটকে প্রধান চরিত্র করতে বললাম, নাটকের নাম ‘খোয়াবনগর’। সেখানে আমার মেজো মেয়ে শীলা অভিনয় করেছিল। নাটকের শেষে আমি মেয়েকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা! চ্যালেঞ্জার নামের এই নতুন অভিনেতার অভিনয় তোমার কেমন লাগল?

শীলা বলল, আসাদুজ্জামান নূর চাচাকে আমার এ দেশের সবচেয়ে বড় অভিনেতা বলে মনে হয়। আমি আজ যার সঙ্গে অভিনয় করলাম, তিনি নূর চাচার চেয়ে কোনো অংশে কম না।

বাবা! তোমার কি মনে হয় একদিন সুপার স্টার হিসেবে তার পরিচয় হবে?

শীলা বলল, অবশ্যই।

‘উড়ে যায় বকপক্ষী’তে পাগলের ভূমিকায় অভিনয় করে সে নিজেকে সুপার স্টার প্রমাণিত করল।

আমি কোনো অবিচুয়ারি লিখছি না। চ্যালেঞ্জার এখনো জীবিত। আজ দুপুরে সে তার স্ত্রীকে ইশারায় বলল, সে আমাকে দেখতে চায়।

তার স্ত্রী তাকে নিয়ে বাসায় উপস্থিত হলো। দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। চ্যালেঞ্জারের কথা বলার ক্ষমতা নেই। যে কথা বলতে পারছে না, তার সঙ্গে কথা বলে তার যন্ত্রণা বাড়ানোর কোনো মানে হয় না।

চ্যালেঞ্জার সম্পর্কে দুটি ছোট গল্প বলতে ইচ্ছা করছে।

.

গল্প-১

আমি আমার মেয়ে বিপাশা এবং পুত্র নুহাশকে নিয়ে কক্সবাজার গিয়েছি। তখন আমি মূল পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। একা বাস করি। আমার এই দুই পুত্র-কন্যা হঠাৎ করেই ঠিক করল, বাবার সঙ্গে কিছু সময় কাটাবে। কাজেই তাদের নিয়ে এসেছি সমুদ্রের কাছে। উঠেছি হোটেল সায়মনে। খুব ভোরবেলা দরজায় নক হচ্ছে। দরজা খুলোম, অবাক হয়ে দেখি, এককাপ গরম চা এবং খবরের কাগজ হাতে চ্যালেঞ্জার দাঁড়িয়ে আছে। সে আমাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যে সারা রাত গাড়ি চালিয়ে ঢাকা থেকে চলে এসেছে।

গল্প-২

দখিন হাওয়ার ফ্ল্যাটে আমি একা থাকি। শীলার মা’র সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার কারণে ওল্ড ফুলস ক্লাবের সব সদস্য আমাকে ত্যাগ করেছে। কেউ ফ্ল্যাটে আসে না। হঠাৎ কারও সঙ্গে দেখা হলে তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়। অদ্ভুত ভঙ্গিতে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। আমার সেই দুঃসময়ের কাল বেশ দীর্ঘ ছিল। তখন প্রতিদিন দুপুরে এবং রাতে চ্যালেঞ্জার এসে বসে থাকত। সে আমার সঙ্গে খাবে। তার একটাই যুক্তি–স্যার, আপনি একা খেতে পছন্দ করেন না। আমি কখনোই আপনাকে একা খেতে দেব না। একসময় ওল্ড ফুলস ক্লাবের সদস্যরা আসতে শুরু করল। চ্যালেঞ্জার দূরে সরে গেল।

চ্যালেঞ্জারের নিজের একটা গল্প বলি। সে ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় তার সত্মা’র অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ছোট ছোট ভাইবোন নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসেছিল। তার নিজের ভাষ্যমতে, ‘স্যার, কতদিন গিয়েছে কোনো খাওয়া নাই। গ্লাসভর্তি চা নিজে খেয়েছি। ভাইবোনদের খাইয়েছি।‘ বড়ভাইয়ের দায়িত্ব সে পুরোপুরি পালন করেছিল, সব কটা ভাইবোনকে পড়াশোনা করিয়েছে, বিয়ে দিয়েছে। তারচেয়েও অদ্ভুত কথা, সে তার সৎমাকে নিজের কাছে এনে যতটুকু আদর-যত্ন করা যায় করেছে। মৃত্যুর সময় এই মহিলা তার সৎ ছেলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। বলেছিলেন, আমি কঠিন অন্যায়-অত্যাচার তোমাদের উপর করেছি। তারপরেও তুমি নিজের মায়ের মতো সেবাযত্ন আমাকে করলে। আমি দোয়া করি, তোমার জীবন হবে আনন্দ এবং ভালোবাসায় পূর্ণ।

দুষ্ট মানুষের প্রার্থনা মনে হয় আল্লাহপাক গ্রহণ করেন না। চ্যালেঞ্জার এখন জম্বী। তাকিয়ে থাকা ছাড়া তার কিছু করার নেই। ব্রেইন ক্যান্সার নামক কালান্তক ব্যাধি তার কাছ থেকে সবকিছু নিয়ে নিয়েছে।

বাংলাদেশের মানুষ সাহায্যের হাত গাঢ় মমতায় তার দিকে বাড়িয়েছে বলেই সে এখনো বেঁচে আছে।

তার সাহায্যের জন্যে চ্যানেল আই মহৎ উদ্যোগ নিয়েছিল। দিনব্যাপী অনুষ্ঠান। অনেকেই এগিয়ে এসেছেন। তবে সাহায্যের নামে কেউ কেউ প্রতারণাও করেছেন। চ্যানেল আইয়ের ক্যামেরার সামনে বড় বড় ঘোষণা দিয়েছেন। তাঁদের নাম প্রচারিত হয়েছে–এই পর্যন্তই। যারা এই কাজটি করেছেন তাঁদের নাম উল্লেখ করলাম না। আল্লাহপাক মানী মানুষের মান রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। তাঁরা মানী লোক।

এই প্রসঙ্গে আমি দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে একটি আন্তরিক ধন্যবাদ দিতে চাই। তাকে আমি একটি ব্যক্তিগত চিঠি লিখে জনাব আসাদুজ্জামান নূরের হাত দিয়ে পাঠাই। তিনি সঙ্গে সঙ্গেই সরকারি সাহায্যের ব্যবস্থা করেন। আল্লাহ তার মঙ্গল করুন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা ব্যক্তিগত পত্রটি সংযুক্ত হলো।

৫ আগস্ট, ২০০৯
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
দেশরত্ন শেখ হাসিনা

শ্রদ্ধাভাজনেষু,

আমার বিনীত সালাম গ্রহণ করুন।

আপনি প্রচুর বইপত্র পড়েন–এই তথ্য আমার জানা আছে। নাটক-সিনেমা দেখার সুযোগ পান কি না জানি না। সুযোগ পেলে চ্যালেঞ্জার নামের একজন শক্তিমান অভিনেতার অভিনয় আপনার দেখার কথা। অতি অল্প সময়ে সে অভিনয় দিয়ে দেশবাসীর হৃদয় হরণ করেছে।

বর্তমানে সে মস্তিষ্কের ক্যান্সারে আক্রান্ত। তার চিকিৎসা চলছে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসার বিপুল ব্যয়ভার তার পরিবার আর নিতে পারছে না।

আমি তার হয়ে আপনার কোমল মানবিক সত্তার কাছে আবেদন করছি। আপনার মঙ্গলময় হাত কি এই শক্তিমান অসহায় অভিনেতার দিকে প্রসারিত করা যায়?

বিনীত হুমায়ূন আহমেদ

.

পাদটিকা

How many loved your moments of glad grace
And loved your beauty with love false or true,
But one man loved the pilgrim soul in you,
And loved the sorrows of your changing face.

W.B. Yeats

ছাইঞ্চ মিয়া

স্যার, আমার নাম ‘ছাইঞ্চ’ মিয়া।

কী নাম বলেছ?

ছাইঞ্চ মিয়া।

গ্রামের মানুষদের মধ্যে অদ্ভুত অদ্ভুত নাম রাখার প্রবণতা আছে। তবে সেসব নাম সহজ হয়। উচ্চারণে অসুবিধা হয় না। ছাইঞ্চ যথেষ্ট জটিল। আমি বললাম, এই নামের অর্থ কী?

লেহা-পড়া। এই নামের অর্থ লেহা-পড়া।

আমি বললাম; সায়েন্স থেকে ছাইন্স? বিজ্ঞান?

জায়গামতো ধরছেন স্যার। এইটাই আমার নাম।

ঘটনা যা জানলাম তা হলো ছাইন্স মিয়ার আসল নাম ছাত্তার। সে আট ন’ বছর বয়সে নীলগঞ্জ স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক আজিজ মাস্টারের বাড়িতে কাজের ছেলে হিসেবে যোগ দেয়! আজিজ মাস্টার ছাত্তারের নানান বিষয়ে আগ্রহ এবং কৌতূহল দেখে তাকে আদর করে ডাকতেন সায়েন্স। সেখান থেকে ছাইঞ্চ মিয়া।

এখন তার বয়স পঁয়ত্রিশ। বেঁটেখাটো মানুষ। শক্ত সবল। গাত্রবর্ণ ঘোর কৃষ্ণ। গ্রামের মানুষদের সহজে টাক পড়ে না। এর মাথায় চুলের বংশও নেই। ছাইঞ্চ মিয়া কাজকর্ম কিছু করে না। স্কুলঘরের বারান্দায় ঘুমায়। ছাত্রদের হোস্টেলে রান্নাবান্নার বিনিময়ে খাবার পায়। মাছ মারায় তার বিশেষ পারদর্শিতা আছে। কৈ জাল দিয়ে কৈ মাছ ধরার ব্যাপারে সে একজন বিশেষজ্ঞ। সে নাকি কিছুদিন পরপর মাছ মারার নতুন নতুন কৌশল আবিষ্কার করে।

ছাইঞ্চ মিয়া হাত কচলাতে কচলাতে বলল, আপনার কাছে একটা প্রশ্ন নিয়া আসছি স্যার। অনেকরে জিজ্ঞাস করেছি কেউ বলতে পারে নাই। আজিজ স্যারে বাইচা থাকলে উনি পারতেন। উনার মতো জ্ঞানী মানুষ খোদার আলমে নাই বললেই চলে।

আমি বললাম, অনেকেই যখন পারে নাই তখন আমারও না পারার কথা। প্রশ্নটা কী?

জগতের সব ফল গোল। বেদানা, আপেল, বড়ই, আঙুর, আম, কাঁঠাল, ডাব, শরিফা। কিন্তু কলা ফলটা লম্বা। এর কারণ কী?

আমি একটু থতমত খেলাম। কী উত্তর দেব বুঝতে পারছি না। ছাইঞ্চ মিয়া বলল, বুঝতাছি আপনে পারতেছেন না। আমি নিজে নিজে একটা উত্তর বাইর করেছি। স্যার বলব?

বলো।

আল্লাপাক গোল পছন্দ করেন এইজন্যে সব ফল গোল। কলা আল্লাপাক পছন্দ করে না বিধায় কলা লম্বা। কলা খাওয়া এই কারণে ঠিক না। আমি সব ফল খাই, কলা খাই না।

আমি কিছু বললাম না। ছাইঞ্চ মিয়া বলল, যে ফল যত গোল সেটা তত ‘উবগার’, আমি হিসাবে এইটা পাই। স্যার ঠিক আছে?

প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমি বললাম, তুমি লেখাপড়া কতটুকু জানো?

বাংলা লেখতে পড়তে পারি। নয় ঘর পর্যন্ত নামতা জানি। আজিজ স্যার শিখায়েছেন। ৯ একে ৯, ৯ দুকুনে ১৮, তিন নং ২৭…

ছাইঞ্চ মিয়া নয়ের ঘরের নামতা শেষ করে উঠে দাঁড়াল। মাছ মারতে যাবে। তার কাছে শুনলাম সে কৈ মাছ ধরার একটা পদ্ধতি বের করেছে। এ পদ্ধতিতে শুধু ডিমওয়ালা কৈ মাছ ধরা পড়ে, ডিম ছাড়া কৈ কখনো না।

.

বিজ্ঞানের শুরুটা কোথায়?

জ্ঞানীরা বলেন, শুরু হলো কৌতূহলে। মানুষ কৌতূহলী হওয়ার কারণেই বিজ্ঞান। গাছের অনুভূতি আছে, কৌতূহল নেই বলেই বিজ্ঞানে গাছের অবদান নেই।

আমি জ্ঞানী না বলেই হয়তো জ্ঞানীদের কথা নিতে পারছি না। আমার মতে, বিজ্ঞানের শুরু খাদ্য অনুসন্ধানে। খাদ্য কোথায় পাওয়া যাবে, কীভাবে পাওয়া যাবে–এই ব্যাকুলতা থেকেই বিজ্ঞান। আর গাছের কৌতূহল নেই তাই আমরা ধরে নেব কেন? আমার মনে হয়, গাছ তার নিজের মতো করেই কৌতূহলী। আমরা তার কৌতূহল ধরতে পারছি না।

নুহাশপল্লীতে আমার দিন কাটে গাছপালার সঙ্গে। তাদের জগৎ বোঝার সাধ্যও আমার নেই। সেই চেষ্টাও বড় ধরনের বোকামি ছাড়া কিছু না। তারপরেও গাছপালার বনে হাঁটতে হাঁটতে ভাবি-গাছদের কি চিন্তা করার ক্ষমতা আছে? তারা কি ভাবতে পারে? কল্পনা করতে পারে?

বিশাল বৃক্ষকে ‘বনসাই’ বানানোর প্রবণতা আজকাল দেখতে পাচ্ছি। টবে বটগাছ, ঝুড়ি নেমে গেছে–এইসব। বনসাই বৃক্ষ যতবার দেখি ততবারই মন খারাপ হয়। একটা বিশাল বৃক্ষকে পঙ্গু বানিয়ে রাখার মানে কী? গত বৃক্ষমেলা থেকে অনেক দাম দিয়ে আমি দুটা বনসাই গাছ কিনলাম। একটা বট আরেকটা তেঁতুল। এই দুই বামুন বৃক্ষকে নুহাশপল্লীতে নিয়ে এসে বললাম, আজ তোদেরকে বনসাই অবস্থা থেকে মুক্তি দেব। তোরা সাধারণ বৃক্ষের মতো বড় হবি। এবং অবশ্যই বলবি–একজন মানুষ আমাদের কষ্ট বুঝতে পেরে মুক্তির ব্যবস্থা করেছেন। তোরা বলবি–মানুষের জয় হোক।

বনসাই গাছ দুটি পুতে দিলাম। এক বছরের আগেই তারা স্বাস্থ্যে, সৌন্দর্যে, প্রাণে ঝলমল করে উঠল। তারা এখন আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধা নিয়ে বড় হচ্ছে। আমার নানাবিধ পাগলামির একটি হচ্ছে, এই দুটি গাছের সঙ্গে কথা বলা। কথা বলার নমুনা (বটগাছের সঙ্গে)–

এই তোর অবস্থা কিরে? ঝুড়ি এর মধ্যেই নামিয়ে ফেলেছিস? ঝুড়ি নামানোর মতো অবস্থা তো হয় নি। ঘটনা কী? মালী তোকে ঠিকঠাক যত্ন করছে?

গাছের সঙ্গে তুই তুই করে কেন কথা বলি? জানি না।

গাছের কথা কিছুক্ষণ বন্ধ থাকুক। আবার এই প্রসঙ্গে ফিরে আসব, এখন বিজ্ঞান-কথা। একটা কুকুর দিয়ে শুরু করা যাক। সে ভরপেট খেয়ে উঠানে শুয়ে আছে। এই মুহূর্তে খাদ্যের সন্ধানে সে যাবে না। এর অর্থ এই না সে তার চারপাশের জগৎ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। শামুক তা-ই করত। খাওয়া শেষ হলেই খোলসের ভেতর ঢুকে খোলসের মুখ বন্ধ করে দিত। কুকুর তা করছে না। সে বিশ্রাম নিতে নিতেই এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। হঠাৎ কান খাড়া করে দূরের কোনো শব্দ শুনছে। সে তথ্য সংগ্রহ করছে। এই তথ্যের কিছুটা সে তার মস্তিস্কে জমা করে রাখবে। অনেকটাই ফেলে দেবে। যে প্রাণী যত উন্নত তার তথ্য সংগ্রহ এবং তথ্য জমা রাখার পদ্ধতিও তত উন্নত। সৌরজগতের সবচেয়ে উন্নত প্রাণী মানুষের তথ্য সংগ্রহের ক্ষমতা বিস্ময়কর। একজন মানুষ এক জীবনে পনেরো ট্রিলিয়ন তথ্য সংগ্রহ করে। এই তথ্য সংগ্রহের প্রায় সবটাই হলো কৌতূহলের কারণে।

পেনডোরার বাক্সের ঘটনা তো সবার জানা। গল্পটা এরকম–পেনডোরাকে একটা বাক্স দিয়ে বলা হলো, খবরদার এই বাক্স তুমি খুলবে না। কৌতূহলের কারণে পেনডোরা সেই বাক্স খুলল, বাক্স থেকে বের হলো, দুঃখ-কষ্ট, জরা, দুর্ভিক্ষ ভয়ঙ্কর সব জিনিস। সেই থেকেই এইসব পৃথিবীতে আছে। পেনডোরা কৌতূহলী না হলে আজ আমরা সুখে থাকতাম। পেনডোরার গল্পের সঙ্গে আদম হাওয়ার গল্পের মিল আছে। কৌতূহলের কারণেই হাওয়া গন্ধম ফল খেলেন, নিজের স্বামীকে খাইয়ে পৃথিবীতে নির্বাসিত হলেন। পৃথিবীর গ্লানি, দুঃখ-কষ্ট, জরা-মৃত্যু তাদেরকে স্পর্শ করল।

মানুষ তথ্য সগ্রহ করে, তথ্যগুলি সাজায়, তাদের ভেতর মিল-অমিল বের করে। মিল-অমিলের পেছনে কী তা বের করার চেষ্টা করে। এটাই বিজ্ঞান।

উদাহরণ দেই—

তথ্য

লোহা পানিতে ডুবে যায়, কাঠ ভাসে, তুলা ভাসে, পাখির পালক ভাসে, পিতল ডুবে যায়, পাথর ডুবে যায়…।

তথ্যের বিচার

লোহা, পিতল, পাথর পানিতে ডুবে যায়।

কাঠ, তুলা, পাখির পালক ভাসে।

বিজ্ঞান

পানির চেয়ে ভারী বস্তু ডুবে যাবে, পানির চেয়ে হালকা বস্তু ভেসে থাকবে।

জ্ঞান কিন্তু এইখানেই থেমে থাকবে না। আরও এগুবে। নতুন তথ্য যুক্ত। হবে। যেমন–

নতুন তথ্য

লোহা পানিতে ডুবে যায়, কিন্তু লোহার তৈরি নৌকা ভাসে। কেন? পিতল নদীতে ডুবে যায়, কিন্তু পিতলের কলসি পানিতে ভাসে। কেন?

এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্যে মানবজাতিকে অপেক্ষা করতে হলো। একদিন আর্কিমিডিস স্নানঘরের চৌবাচ্চায় নগ্ন হয়ে স্নান করতে নামলেন। নেমেই উত্তর পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, Eureka! কথিত আছে তিনি নগ্ন অবস্থায় রাজপথে নেমে গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগলেন, Eureka! Eureka! পেয়ে গেছি! পেয়ে গেছি!

লেখক হিসেবে আমাকে মাঝে মধ্যে একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। যেমন, আপনার কি মৃত্যুভীতি আছে?

উত্তরে আমি বলি, আমার মৃত্যুভীতি নেই, তবে মৃত্যুর বিষয়ে প্রবল বিদ্বেষ আছে। আমি মোটামুটি এক হাজার বছর বেঁচে তারপর মরতে চাই।

কেন?

কচ্ছপের মতো তুচ্ছ একটি প্রাণী তিন শ’, সাড়ে তিন শ’ বছর বাঁচে আর মানুষের মতো এত ক্ষমতাধর প্রাণী সত্তর-আশি বছরেই শেষ। এর কোনো অর্থ আছে?

এক হাজার বছর বাঁচতে চান কেন? বিজ্ঞানের মহান আবিষ্কারগুলি দেখে মরতে চাই। পেনডোরার বাক্স থেকে যেসব ভয়ঙ্কর জিনিস বের হয়েছিল বিজ্ঞান সব কটাকে আবার বাক্সে ঢোকাবে। সেই বাক্স বিজ্ঞান ধ্বংস করে দেবে। এই দৃশ্য দেখার আমার শখ।

বিজ্ঞান কিছু প্রশ্নের উত্তর দেবে। যেমন, আমরা কে? পৃথিবীতে কেন জন্ম নিয়েছি। আমরা কী উদ্দেশ্যে এসেছি?

সৃষ্টির মূল রহস্য বিজ্ঞানই ভেদ করবে। আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ বিজ্ঞান করবে। ফিলসফি না।

.

বিজ্ঞানের ছাত্র বলেই হয়তো বিজ্ঞানের প্রতি আমার আস্থা এবং ভরসা সীমাহীন। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। তার যাত্রা Abstract-এর দিকে। কোয়ান্টাম থিওরি, স্ট্রিং থিওরি সবকিছু আমার মতো সাধারণ মানুষের বোধের বাইরে চলে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা চলে যাচ্ছে ফিলসফির দিকে। সুফিরা যেমন বলেন, সবই মায়া; বিজ্ঞানও বলা শুরু করেছে, সবই মায়া।

কবি রিল্কে (Rainer Maria Rilke) তাঁর The Tenth Elegy-তে বলেছেন–

… how alien, alas are the streets
of the city of grief.

এখানে grief এর বদলে science লিখে দিলে খুব যুক্তিযুক্ত মনে হবে–

… how alien, alas are the streets
of the city of science.

আমি এক পর্যায়ে গাছপালার কাছে ফিরে আসব বলেছিলাম, এখন ফিরলাম।

গাছপালা খাদ্যের সন্ধানে যেতে পারে না। তাকে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে। থাকতে হয়। সূর্যের আলো তার গায়ে পড়ে। এখান থেকেই সে খাবার তৈরি করে। সে খাদ্যচিন্তা থেকে মুক্ত। মুক্ত বলেই সে তার চিন্তা অন্যদিকে নিতে পারে। তার অনুভূতি আছে। তার সেই অনুভূতির নিয়ন্ত্রকও থাকতে হবে। নিয়ন্ত্রণটা কোথায়?

আমার ভাবতে ভালো লাগে বৃক্ষরাজি অনেক রহস্যই জানে। তার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে এইসব রহস্য মানুষকে জানাতে পারছে না। মানুষও তার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে গাছের কাছ থেকে কিছু জানতে পারছে না। একদিন সীমাবদ্ধতা দূর হবে। বৃক্ষরাজি কথা বলা শুরু করবে। কী অদ্ভুত কাণ্ডই না তখন ঘটবে!

গাছপালা বিষয়ে নবিজী (দঃ)-র একটি চমৎকার হাদিস আছে। তিনি বলছেন, মনে করো তোমার হাতে গাছের একটি চারা আছে। যে-কোনোভাবেই হোক তুমি জেনে ফেলেছ পরদিন রোজ কেয়ামত। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ধ্বংস হয়ে যাবে। তারপরেও গাছের চারাটি তুমি মাটিতে লাগিয়ো।

.

পাদটিকা

দর্শন হলো একটি অপ্রয়োজনীয় এবং ভুল শাস্ত্র।

-দার্শনিক ইমাম গাজ্জালি

জ্বিন এবং পক্ষীকথা

নুহাশপল্লীর মাঠে বসে আছি। সময় সকাল দশটা। আমার সঙ্গে আছেন সিলেটের হ্যাঁরল্ড রশীদ। তিনি একজন সংগীত পরিচালক, চিত্রকর এবং শখের জ্যোতির্বিদ। তিনি আমাকে বৃহস্পতির চাঁদ এবং শনিগ্রহের বলয় দেখাতে এসেছেন। নিজের টেলিস্কোপ নিয়ে এসেছেন। রাতে টেলিস্কোপ সেট হবে।

আমরা রাতের জন্যে অপেক্ষা করছি। অপেক্ষার জায়গাটা সুন্দর। বেদী দেওয়া জাপানি বটগাছের নিচে বসেছি। আমাদের ঘিরে আছে ছয়টা চেরিগাছ। দু’টাতে ফুল ফুটেছে। নীল রঙের স্নিগ্ধ ফুল। চারদিকে নানান ধরনের পাখি ডাকছে। পাখির বিষয়ে আমার তেমন আগ্রহ নেই। সব পাখি চিনিও না। তাদের কিচিরমিচিরে ভোরবেলা জেগে উঠতে হয়। কাঁচা ঘুম ভাঙানোয় এদের ওপর খানিকটা রাগও করি। দু’টা কাঠঠোকরা পাখি আমাকে ভোরবেলায় অস্থির করে তোলে। এরা কাঠের ইলেকট্রিক পোলে গর্ত করে বাসা বানিয়েছে। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে এরা বাসা থেকে বের হয়। আমি যে ঘরে ঘুমাই তার কাঁচের জানালায় ঠোকর দেয়। মনে হয় জানালা ফুটো করতে চায় কিংবা আয়নায় নিজেকে দেখতে চায়। আরেকটি সম্ভবনা আছে–হয়তো এদের ঠোঁট কুট কুট করে। প্রচণ্ড শক্তিতে গ্লাসে ধাক্কা দিলে ঠোঁটে আরাম হয়।

পাখি দুটির বজ্জাতির গল্প হ্যাঁরল্ড রশীদের সঙ্গে করলাম। তিনি বললেন, আচ্ছা আপনার নুহাশপল্লীতে এত পাখি, আপনি কি কখনো এখানে মৃত পাখি দেখেছেন?

আমি বললাম, পাখির বাসা থেকে পড়ে মরে গেছে এমন দেখেছি।

পূর্ণবয়স্ক মৃত পাখি?

আমি বললাম, না।

পূর্ণবয়স্ক মৃত পাখি যে কোথাও দেখা যায় না এই বিষয়টা আমি জানি। অনেক বছর আগে Time বা Reader’s Digest পত্রিকায় একটা লেখা পড়েছিলাম “Where the dead birds go?” সেখানেও মৃত পাখির বিষয়টাকে রহস্য বলা হয়েছে।

হ্যারল্ড রশীদ দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, মৃত পাখিদের জ্বিন খেয়ে ফেলে, তাই আমারা মৃত পাখি দেখি না।

বলেন কী!

জ্বিনের খাবার হলো হাড়। পাখির হাড় তারা খেয়ে ফেলে।

হ্যারল্ড রশীদের কথা গসপেল মনে করার কোনো কারণ নেই।

আমি সঙ্গে সঙ্গে সাদাত সেলিম সাহেবকে টেলিফোন করলাম। উনি একজন পক্ষীবিশারদ। বর্তমানে ঢাকা ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। টেলিফোনে সহজে তাঁকে পাওয়া যায় না। আমার ভাগ্য ভালো, সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে গেলাম। আমি বললাম, বিশাল নুহাশপল্লীকে পক্ষীর অভয়াশ্রম বলা যায়। আমি কেন এখানে মৃত পাখি দেখি না?

সাদাত সেলিম যে জবাব দিলেন তা হ্যাঁরল্ড রশীদের জবাবের চেয়েও অদ্ভুত। তিনি বললেন, পাখিদের একটা সিক্সথ সেন্স আছে। এরা কখন মারা যাবে তা বুঝতে পারে। বুঝতে পারা মাত্র দলবল ছেড়ে গহীন অবণ্যের দিকে যাত্রা করে। লোকচক্ষুর অন্তরালে গহীন অরণ্যে তাদের মৃত্যু হয় বলেই আমরা লোকালয়ে মৃত পাখি দেখি না।

পক্ষী বিষয়ে সাদাত সেলিমের চেয়েও অনেক অদ্ভুত কথা একজন বলে গেছেন। তার নাম বাবর। তিনি মোঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা।

বাবর তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ বাবরনামায় লিখেছেন তাঁর সংগ্রহে একটি তোতা পাখি ছিল। তোতা পাখি কথা বলত। যা শুনত তা-ই বলত। তবে এই পাখির রক্ষক একদিন সম্রাটকে বলল, পাখিটা যে সব কথা শুনে শুনে বলে তা না। সে নিজ থেকেও কথা বলতে পারে। একদিন পাখিটা বলল, আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ঢাকনাটা খুলে দাও।

আরেকদিনের কথা, সম্রাট দলবল নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করেছেন। সঙ্গে তোতা পাখিও আছে। পথে এক জায়গায় তোতা পাখির রক্ষক ক্লান্ত হয়ে অপেক্ষা করছে। সবাই চলে গেছে। তখন পাখিটা বলল, সবাই চলে গেছে, আমরা বসে আছি কেন? আমরা কেন যাচ্ছি না?

সম্রাট বাবর তাঁর জীবনীতে গালগল্প ফাঁদবেন বলে মনে হয় না। তিনি সেই সময়কার হিন্দুস্থানের নিখুঁত বর্ণনা তাঁর গ্রন্থে দিয়ে গেছেন। পাখির যে রক্ষক সম্রাটকে এই কথা বলেছে তার নাম আবুল কাসিম জালায়ের। সম্রাট লিখেছেন, এ আমার অত্যন্ত বিশ্বস্ত।

নানান ধরনের পাখি সম্পর্কে বাবর লিখে গেছেন। কয়েকটা উদাহরণ–

লুজা

মাথা থেকে লেজ পর্যন্ত এর গায়ে কয়েক রকমের রঙ। গলায় কবুতরের গলার মতো চকচকে রঙ আছে। এ পাখি পর্বতের চূড়ায় বাস করে।

ফিং

বিশাল পাখি। এদের এক একটি ডানা লম্বায় মানুষ সমান। এর মাথা ও গলায় কোনো লোম নেই। এর গলায় থলের মতো একটা কিছু ঝুলে। এর পিঠ কালো, বুক সাদা। এ পাখি মাঝে মাঝেই কাবুলে দেখা যায়। একবার আমাকে একটা ফিং পাখি ধরে এনে দিল। পাখিটা পোষ মানল।

কোকিল

দৈর্ঘ্যে কাকের সমান, কিন্তু দেহ কাকের চেয়ে সরু। গান গায়। হিন্দুস্থানের বুলবুল। আমরা যেমন বুলবুল ভালোবাসি হিন্দুস্থানের লোকরা তেমনি কোকিল ভালোবাসে। ঘন গাছের বাগানে থাকে।

অদ্ভুত আরেক পাখির কথা আমি দাদাজানের কাছে শুনেছি। তিনি এই পাখির নাম বলেছেন ‘মউত পাখি’। যখন কোনো বাড়িতে কারও মৃত্যু ঘনিয়ে আসে তখন এই পাখি নাকি নিশিরাতে বাড়ির চালে এসে বসে অদ্ভুত গলায় ডাকতে থাকে। আমার সবচেয়ে ছোট ফুফুর মৃত্যুর দুই রাত আগে নাকি এমন একটা পাখি দাদাজানের বাড়ির টিনের চালে এসে বসে ডাকতে শুরু করে। আমার এই ফুপুর নাম মাহমুদা। মাত্র ১৩ বছর বয়সে তার মৃত্যু হয়। আমার মা সবসময় বলেন, এমন রূপবতী কিশোরী তিনি তার জীবনে দেখেন নি।

পক্ষীবিশারদ সাদাত সেলিমের মতে পাখি নিজের মৃত্যুর অগ্রীম খবর পায়। এই ক্ষেত্রে অন্য প্রাণীদের মৃত্যুর খবরও তাদের কাছে থাকার কথা।

পক্ষী প্রসঙ্গের এইখানেই ইতি। এখন চলে যাই অন্য প্রসঙ্গে। অমবস্যার রাত। আকাশভর্তি তারা। হ্যাঁরল্ড রশীদ তাঁর টেলিস্কোপ তারাদের দিকে তাক করেছেন।

আমরা প্রথম দেখলাম লুব্ধক নক্ষত্র। আকাশের উজ্জ্বলতম তারা। ইংরেজি নাম সিরিয়াস। অতি প্রাচীন এক সভ্যতার নাম মায়া সভ্যতা। মায়ারা বলত তারা এসেছে লুব্ধক নক্ষত্রের পাশের একটি নক্ষত্র থেকে। লুব্ধক নক্ষত্রের পাশে কোনো নক্ষত্র এতদিন পর্যন্ত পাওয়া যায় নি। এখন জোতির্বিদরা একটি নক্ষত্র আবিষ্কার করেছেন।

লুব্ধকের পরে আমরা দেখলাম একটা সুপারনোভা। তারপর দেখা হলো সপ্ত ভগিনি তারাগুচ্ছ (Seven sisters)। বৃহস্পতি ডুবে গিয়েছিল বলে বৃহস্পতি বা তার চাঁদ দেখা গেল না। শনিগ্রহের অবস্থান বের করতে হয় বৃহস্পতি গ্রহ থেকে। যেহেতু বৃহস্পতি নেই আমরা শনি দেখতে পারলাম না, তবে North star খুব খুঁটিয়ে দেখলাম।

নর্থ স্টারের বাংলা নাম ধ্রুবতারা। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গান আছে ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’। সূর্য পূর্বদিকে উঠে পশ্চিমে অস্ত যায়। আকাশের সমস্ত তারা পশ্চিমদিকে উঠে পূর্বদিকে অস্ত যায়। একমাত্র ব্যতিক্রম নর্থ স্টার বা ধ্রুবতারা। এই তারা আকাশ স্থির হয়ে থাকে। নাবিকরা এই তারা দেখে দিক ঠিক করেন। আমাদের দেশের নৌকার মাঝিরাও এই তারা খুব ভালো করে চেনে।

তারা দেখা চলছে, হঠাৎ আমাদের আসরে চকচকে কালো রঙের এক কুকুর উপস্থিত হলো। হ্যাঁরল্ড রশিদ বললেন, হুমায়ূন ভাই, এই কুকুরটা জ্বিন।

আমি বললাম, আপনার সমস্যা কী বলুন তো। সকালে বলেছেন মরা পাখি সব জ্বিন খেয়ে ফেলে। এখন বলেছেন কালো কুকুর জ্বিন।

হ্যারল্ড রশিদ বললেন, আমি বই পড়ে বলছি।

কী বই?

বইয়ের নাম জ্বিন জাতির অদ্ভুত ইতিহাস।

কে লিখেছেন? প্রকাশক কে?

এইসব মনে নাই।

বইটা কি আছে আপনার কাছে?

না।

আমি ঢাকায় ফিরে এসেই নুহাশ চলচ্চিত্রের এক কর্মকর্তাকে বাংলাবাজারে পাঠালাম, সে যেভাবেই হোক জ্বিন জাতির অদ্ভুত ইতিহাস গ্রন্থ জোগাড় করবে।

দুপুরবেলা সে জানাল পাঁচটা ইতিহাস সে পেয়েছে। সবগুলি কিনবে কি-না।

আমি বললাম, সব কিনবে।

সে বিকেলে পাঁচটা বই নিয়ে উপস্থিত হলো। আমি দেখলাম প্রতিটি বই হলো চীন জাতির ইতিহাস। সে চীনের ইতিহাসের সব বই কিনে নিয়ে চলে এসেছে।

যাই হোক শেষ পর্যন্ত জ্বিন জাতির বিস্ময়কর ইতিহাস বইটি পাওয়া গেছে। মূল বই আরবি ভাষায়। লেখক আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়তী (রহঃ), অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ হাদীউজ্জামান। আরেকটি বই পাওয়া গেছে জ্বিন ও শয়তানের ইতিকথা। এটিও আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়তীর (রহঃ) লেখা। বই দু’টি পড়ে জ্বিন জাতি সমন্ধে জেনেছি তার সারমর্ম–

জ্বিন শব্দের অর্থ

গুপ্ত, অদৃশ্য, লুকানো, আবৃত।

জ্বিন জাতির শ্রেণীবিভাগ

ক. সাধারণ জ্বিন।

খ. আমির : মানুষের সঙ্গে থাকে।

গ. আরওয়াহ : মানুষের সামনে আসে।

ঘ. শয়তান।

ঙ. ইফরী (শয়তানের চেয়েও বিপদজনক। এদের দেখা পেলে আযান দিতে হবে।)

জ্বিন কিসের তৈরি?

পবিত্র কোরান শরীফে বলা হয়েছে, “আমি আদমের আগে, জ্বিনকে সৃষ্টি করেছি লু’-র আগুন দিয়ে।” (সুরাহ আল হিজর, আয়াত ২৭)

হযরত ইবনে আব্বাস (রঃ) এই আয়াতের ব্যাখা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘লু’-র আগুনের অর্থ খুবই সুন্দর আগুন। হযরত উমার বিন দীনার (রঃ) বলেছেন, জ্বিন জাতি সৃষ্টি করা হয়েছে সূর্যের আগুন থেকে।

জ্বিনদের প্রকারভেদ

তিন শ্রেণীর জ্বিন আছে–

১। এরা হাওয়ায় উড়ে বেড়ায়। খাদ্য গ্রহণ করে না। নিজেদের মধ্যে বিয়ে হয় না। সন্তান উৎপাদন করে না।

২. এরা মানুষের সংস্পর্শে আসে। খাদ্য গ্রহণ করে। বিয়ে করে। সন্তান উৎপাদন করে।

৩. সাদা রঙের সাপ এবং সম্পূর্ণ কালো কুকুরও জ্বিন।

জ্বিনদের খাদ্য

নবীজি (সঃ) বলেছেন, তোমাদের খাদ্য এমন সব হাড় যার প্রতি আল্লাহর নাম নেওয়া হয়েছে তা-ই জ্বিনের খাদ্য। (তিরমিযী)

(আমরা শুনি জ্বিনরা মিষ্টি খেতে পছন্দ করে। তার কোনো উল্লেখ পাই নি।)

জ্বিনদের সঙ্গে মানুষের বিয়ে

এই নিয়ে আলেমদের মতভেদ আছে। এক দল বলছেন, জ্বিন যেহেতু সম্পূর্ণ অন্য প্রজাতির, কাজেই তাদের সঙ্গে মানুষের বিয়ে অবৈধ।

আলেমদের আরেক দল বলছেন, পবিত্র কোরান শরিফে আল্লাহ শয়তানকে বলেছেন, ‘তুই মানুষের সম্পদে ও সন্তানে শীরক হয়ে যা।’ (সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৬৪)

সন্তানে শারীক হতে হলে বিবাহ বাঞ্ছনীয়। কাজেই জ্বিনের সঙ্গে মানুষের বিয়ে হতে পারে।

মানুষ এবং জ্বিনের যৌনক্রিয়ায় যেসব সন্তান জন্মায় তারাই হিজড়া। (হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এদের আরবি নাম খুন্নাস।

.

পাদটিকা

নিউজিল্যান্ডের এক বাড়িতে দু’টা ভূত ধরে বোতলবন্দি করা। হয়েছে। একটি অল্পবয়সী দুষ্ট ভূত। অন্যটি শান্ত-ভদ্র ভূত। দু’টি ভূতই ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিলামে তুলে বিক্রি করা হয়েছে।

সূত্র : কালের কণ্ঠ, ইন্টারনেট

ডায়েরি

পৃথিবীখ্যাত জাপানি পরিচালক কুরাশুয়াকে জিজ্ঞেস করা হলো, একজন বড় পরিচালক হতে হলে কী লাগে?

কুরাশুয়া জবাব দিলেন, একজন ভালো অ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর লাগে।

এডগার এলেন পো-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, একজন বড় লেখক হতে হলে কী লাগে?

তিনি জবাব দিলেন, একটা বড় ডাস্টবিন লাগে। লেখা নামক যেসব আবর্জনা তৈরি হবে তা ফেলে দেওয়ার জন্যে।

লেখকরা ক্রমাগতই আবর্জনা তৈরি করেন। নিজেরা তা বুঝতে পারেন না। একজীবনে আমি কী পরিমাণ আবর্জনা তৈরি করেছি ভেবেই শঙ্কিত বোধ করছি। ‘ফাউনটেনপেন’ সিরিজের লেখাগুলি কি আবর্জনা না? যখন যা মনে আসছে। লিখে যাচ্ছি। চিন্তাভাবনার প্রয়োজন বোধ করছি না। লেখকের চিন্তাভাবনাহীন লেখা পাঠক যখন পড়েন তখন তারাও চিন্তাভাবনা করেন না। এই জাতীয় লেখার ভালো আশ্রয় ডাস্টবিন, পত্রিকার পাতা না। ঠিক করেছি কিছুদিন ফাউনটেনপেন বন্ধ থাকবে। ইমদাদুল হক মিলনকে বলব, ফাউনটেনপেনের কালি শেষ হয়ে গেছে।

কলমের কালি প্রসঙ্গে মনে পড়ল ছোটবেলায় ফাউনটেনপেনের কালি আমরা নিজেরা বানাতাম। কালির ট্যাবলেট পাওয়া যেত, এক আনা করে দাম। দোয়াতভর্তি পানি নিয়ে একটা ট্যাবলেট ফেলে দিলেই কালি। বিত্তবানদের ছেলেমেয়েরা এক দোয়াত পানিতে দু’টা ট্যাবলেট ফেলে কালি ঘন করত। কালো কালিতে কোনো এক অদ্ভুত আলো প্রতিফলনে সোনালি আভা বের

শৈশবে পড়াশোনা একেবারেই পছন্দ করতাম না। কিন্তু কালি আগ্রহের সঙ্গে বানাতাম। এই কালি ফাউনটেনপেনে ভরা হতো না। নিবের কলম দিয়ে লেখা হতো। অনেকের মতো আমার একটা অদ্ভুত দোয়াত ছিল। এই দোয়াত উল্টে গেলেও কালি পড়ত না। এই দোয়াতটাকে মনে হতো বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অবদান। দোয়াত উল্টে গেছে কালি পড়ছে না–ঘটনা কীভাবে ঘটছে ভেবে শৈশবে অনেকবার মাথা গরম করেছি।

এখন কালি প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্প। একবার ‘সুলেখা’ নামের কালির বিজ্ঞাপন লিখে দেওয়ার জন্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে হাত পাতা হলো।

কবি লিখলেন,

“সুলেখা কালি।
এই কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো।”

অদ্ভুত সুন্দর বিজ্ঞাপন না?

পাঠক, বুঝতে পারছেন আমি কীভাবে যা মনে আসছে লিখে যাচ্ছি? এই ধরনের লেখা আমি ব্যক্তিগত ডায়েরিতে কিছুদিন লিখতাম। ব্যক্তিগত ডায়েরি শেষ পর্যন্ত ব্যক্তিগত থাকে নি। দৈনিক বাংলায় ধারাবাহিকভাবে “আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই” শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।

ব্যক্তিগত ডায়েরির ব্যাপারটা আমি বুঝি না। এগুলি কেন লেখা হয়? যিনি লিখছেন তার পড়ার জন্যে? লেখক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হলে ঠিক আছে। তার ডায়েরি প্রকাশিত হলে সেই সময়ের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ বোঝা যাবে। জনাব তাজউদ্দিন আহমেদের অপ্রকাশিত ডায়েরি আমি সাপ্তাহিক পত্রিকায় নিয়মিত পড়ি। ২৩.১১.৫২ ও ২৪.১১ ৫২ তারিখে তার ডায়েরিতে কী লেখা?

২৩.১১.৫২

সকাল ৬টায় উঠেছি।

সকাল ৯টা থেকে রাত সোয়া ৯টা পর্যন্ত দোকানে। বিছানায় গেলাম রাত সাড়ে ১০টায়।

আবহাওয়া : আগের মতোই।

২৪.১১.৫২

ভোর ৫টায় উঠেছি।

দোকানে কাটালাম সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বেলা ১টা এবং বেলা আড়াইটা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত।

সাত্তার খান কয়েকদিন আগে আমার কাছ থেকে টি আর ফরম নিয়েছিলেন যা তিনি তার কাছে রেখেছিলেন। তিনি এলেন সকাল দশটার দিকে।

বিছানায় গেলাম রাত সাড়ে দশটায়।

আবহাওয়া : আগের মতোই।

২৭ তারিখে আবহাওয়া আগের মতোই ছিল না। তিনি লিখেছেন–

আবহাওয়া : আগের মতোই তবে ঠান্ডা একটু বেশি।

পাঠক হিসেবে ডায়েরি পড়ে আমি জানলাম, জনাব তাজউদ্দিন খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠেন। রাত দশটায় ঘুমুতে যান। আবহাওয়া থাকে আগের মতোই। তাঁর মতো অতি গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ কেন দিনের পর দিন গুরুত্বহীন বিষয় লিখে গেছেন কে জানে! তাঁর ডায়েরির গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলিই পাঠকের কাছে আসা উচিত।

সুরারিয়েলিস্টিক পেইনটিং-এর গ্রান্ডমাস্টার সালভাদর দালিও ডায়েরি রাখতেন। তবে সবদিনের না। যেদিন গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটত কিংবা নতুন কিছু ভাবতেন সেদিনই ডায়েরি লিখতেন। আমার কাছে যে কপি আছে সেটি ১৯৫২ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত। (Diary of a Genius). কাকতালীয়ভাবে একই সময়ে বাংলাদেশে (তখন পূর্বপাকিস্তান) জনাব তাজউদ্দিনও ডায়েরি লিখেছেন।

১৯৫৩ সালের সেপ্টেম্বরের ১৩ তারিখ তিনি লিখছেন–

সারা জীবন ছবি এঁকে গেলে আমি সুখী হতাম না। এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে Goethe-র মতো মানসিক পূর্ণতা আমার হয়েছে। Goethe প্রথমবার রোমে এসে যে ভঙ্গিতে বলেছেন-অবশেষে আমার জন্ম হচ্ছে। আমারও সেই অবস্থা।

এডগার এলেন পো মাঝে মধ্যে ডায়েরি লিখতেন। তাঁর ডায়েরির ভাষা ছিল দুর্বোধ্য। মাঝে মাঝে সংকেতিক ভাষাও ব্যবহার করতেন। তাঁর সাংকেতিক লেখার পাঠোদ্ধার হয় নি।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি ডায়েরি লিখতেন? তার লেখা ‘রাশিয়ার চিঠি’কে এক ধরনের ডায়েরি বলা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অত্যন্ত গোছানো মানুষ। কাউকে চিঠি লিখলে তার কপি রাখতেন! এইসব চিঠিই ডায়েরির কাজ করত।

সতীনাথ ভাদুড়ির ডায়েরি আমার কাছে বিস্ময়কর মনে হয়েছে। তিনি দিনলিপির পাশাপাশি গল্পের খসড়া লিখে গেছেন। গল্পের খসড়া এবং মূল গল্প পাশাপাশি পড়তে অদ্ভুত লাগে।

সতীনাথ ভাদুড়ির অনুকরণে কিছুদিন আমি ডায়েরিতে গল্পের খসড়া লেখার চেষ্টা করেছি এবং একদিন সকালের ‘দুর ছাই’ বলে ডায়েরি যথাস্থানে অর্থাৎ ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছি।

ডায়েরি না লিখলেও আমি নানান তথ্য কিন্তু লিখে রাখি। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একদিন বললেন, মুমূর্ষ বলতে আমরা মৃত্যুপথযাত্রী বুঝাই। অভিধান তা বলে না। অভিধানের অর্থ হচ্ছে–মরিবার ইচ্ছা। যার মরতে ইচ্ছা করে সে-ই মুমূর্ষ। আমার তথ্যখাতায় এটা লেখা। লেখার নমুনা—

১০ এপ্রিল ২০১০

জাদুকর জুয়েল আইচের জন্মদিনে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ মুমূর্ষ শব্দের আভিধানিক অর্থ জানালেন।

উনি বললেন, মুমূর্ষ শব্দের মানে আমরা জানি মরণাপন্ন। আসলে তা না। অভিধান বলছে মুমূর্ষ হলো মরিবার ইচ্ছা। আমি জানি উনি ভুল করছেন। মুমূর্ষ অবশ্যই মরণাপন্ন। মুমূর্ষা হলো মরিবার ইচ্ছা। এই ভুল তথ্য আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বক্তৃতার মাধ্যমে দেওয়া ঠিক না। গুরুত্বহীন মানুষের ভুলে তেমন কিছু যায় আসে না। গুরুত্বপূর্ণ মানুষের ভুলে যায় আসে।

পাদটিকা

পটল সামান্য একটা সবজি। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এই সবজির দু’টা ব্যবহার আছে।

‘পটলচেরা চোখ’

পটলকে লম্বালম্বিভাবে ফালা করলে টানা টানা চোখের মতো লাগে। সেই থেকে পটলচেরা চোখ।

‘পটল তোলা’

পটল ভোলা হলো মৃত্যু। তুচ্ছার্থে এর ব্যবহার। যেমন, হাবলু পটল তুলেছে।

পটল তোলার সঙ্গে মৃত্যুর কী সম্পর্ক আমি অনেকদিন জানতাম না। বাংলা ভাষার পণ্ডিতদের জিজ্ঞেস করেছি, তারাও কিছু জানাতে পারেন নি।

সম্প্রতি আমি এই বাগধারার উৎস জেনেছি। পাঠকদেরও জানাচ্ছি- “লিখে রাখো এক ফোঁটা দিলেম শিশির।”

ফলবান পটলগাছের সবগুলি পটল তুলে নিলে গাছটি মারা যায় বলেই পটল তোলা মৃত্যু বুঝায়।*

কুইজ

পাদটিকার সঙ্গে এখন থেকে কুইজ যুক্ত হচ্ছে। আজকের কুইজ–

কোন প্রাণীর হৃৎপিণ্ড থাকে তার মাথায়?

উত্তর : পিপীলিকা।

* তথ্যের উৎস : সরল বাঙ্গালা অভিধান, সুবল চন্দ্র মিত্র সংকলিত, নিউ বেঙ্গল প্রেস

নামধাম

মানুষের প্রথম পরিচয় তার নাম। দ্বিতীয় পরিচয় কি ‘ধাম’? নামধাম একসঙ্গে উচ্চারিত হয় বলেই এই জিজ্ঞাসা। আমি মনে করি না নামধাম মানুষের পরিচয়। চুরুলিয়াতে কাজী নজরুল নামের আরেকজন থাকলেই দুই নজরুলের এক পরিচয় হবে না। যদিও তাদের নামধাম এক।

নাম বিষয়ে আজকের লেখা পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরান শরীফের উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করি। সুরা বাকারায় আল্লাহপাক বলছেন, “আমি আদমকে প্রতিটি বস্তুর নাম শিখিয়েছি।” এখানে ‘নাম’ নিশ্চয়ই প্রতীকী অর্থে এসেছে। নাম হলো বস্তুর property বা ধর্ম। আল্লাহপাকের অনুগ্রহে আল্লাহপাক যে জ্ঞান আদমকে দিলেন সব ফেরেশতা তা থেকে বঞ্চিত হলো।

আমরা মানব সন্তানরা বস্তুর নাম জানি। আগ্রহ নিয়ে নতুন নতুন নাম দেই। গ্যালাক্সির নাম দিলাম ‘এনড্রমিডা’। মঙ্গলগ্রহের দুই চাঁদের একটির নাম দিলাম ‘ডিমোস’, আরেকটি ‘ফিবোস’।

কিছু কিছু নাম আমরা আবার বাতিলও করে দেই। উদাহরণ ‘মীরজাফর’। বাংলাদেশের কোনো বাবা-মা ছেলেমেয়ের নাম ’মীরজাফর’ রাখবে না। মীরজাফর এবং বিশ্বাসঘাতকতা আজ সমার্থক। মীরজাফরের চেয়েও বড় বিশ্বাসঘাতক ছিল সিরাজের হত্যাকারী মিরন। তার প্রতি আমাদের তেমন রাগ নেই যেমন আছে মীরজাফরের প্রতি। মিরন নাম নিষিদ্ধ না, কিন্তু মীরজাফর নিষিদ্ধ, কেন?

কুখ্যাতদের নামে বাবা-মা তাদের সন্তানদের নাম রাখেন না, আবার অতি বিখ্যাতদের নামেও রাখেন না। ইংল্যান্ডের বাবা-মা’রা তাদের সন্তানের নাম শেক্সপিয়র রাখেন না। আইনস্টাইন নাম রাখা হয় না। তবে আমেরিকার ফার্গো শহরে আমার এক অধ্যাপকের কুকুরের নাম ছিল আইনস্টাইন। তিনি আইনস্টাইনকে সম্মান দেখানোর জন্যে তার প্রিয় কুকুরের এই নাম রেখেছিলেন।

চিন্তায় এবং কর্মে আমেরিকানদের মতো জাতি দ্বিতীয়টি নেই। তাদের দু’টা নামের নমুনা দেই (এই দু’জন নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে আন্ডার গ্রাজুয়েট ক্লাসের ছাত্র)।

Mr. Long Frog (TET TIE)
Mr. Brown Fox (খয়েরি শিয়াল)

এখন আমার নিজের নামের জটিলতা বিষয়ে বলি। ১৯৭২ সাল। মা গিয়েছেন বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা তুলতে। টাকা তুলতে পারলেন না। কারণ বাবা কোনো এক অদ্ভুত কারণে মাকে প্রভিডেন্ট ফান্ডের নমিনি করে যান নি। তিনি নমিনি করে গেছেন তার বড় ছেলেকে। কাজেই আমি গেলাম। আমিও টাকা তুলতে পারলাম না। কারণ বাবা তার ছেলের নাম লিখেছেন শামসুর রহমান। আমার নাম হুমায়ূন আহমেদ। আমি বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আমার বাবার অনেক অদ্ভুত স্বভাবের একটি হচ্ছে তিনি কিছুদিন পরপর ছেলেমেয়েদের নাম বদলাতেন। শুরুতে আমার নাম ছিল শামসুর রহমান। তিনি আমার নাম বদলে হুমায়ূন আহমেদ রেখেছেন, কিন্তু এই তথ্য প্রভিডেন্ট ফান্ডের কাগজপত্রে দিতে ভুলে গেছেন।

যাকে এত কথা বলা হলো তিনি মুখ গম্ভীর করে বললেন, আপনি প্রমাণ করুন। যে শুরুতে আপনার নাম ছিল শামসুর রহমান।

আমি অতি দ্রুত তা প্রমাণ করলাম। ভদ্রলোকের হাতে একশ টাকা ধরিয়ে দিলাম। জীবনে প্রথম কাউকে ঘুষ দেওয়া।

আমাদের নবিজী (দঃ) সন্তানের নামকরণ বিষয়ে উপদেশ দিয়ে গেছেন। তিনি বলেছেন, তোমরা সন্তানদের জন্যে সুন্দর সুন্দর নাম রাখবে। যেমন, আসিয়া নামটা রাখবে না। আসিয়া নামের অর্থ দুঃখিনী। দুঃখিনী নাম কেন রাখবে।

আমার বড় চাচির নাম আসিয়া। দুঃখে দুঃখে তাঁর জীবন কেটেছে। শেষজীবনে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।

আমরা বাংলাদেশী মুসলমানরা ছেলেমেয়েদের ইসলামী নাম রাখতে আগ্রহী। আল্লাহর নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাম। যেমন, আব্দুল কাদের (আল্লাহর দাস)। গোলাম রসুল (রসুলের গোলাম)।

আল্লাহর নামের সঙ্গে মিলিয়ে কখনো কোনো মেয়ের নাম কেন রাখা হয় না। আল্লাহপাক তো নারী-পুরুষের ঊর্ধ্বে, তারপরেও তাঁর নাম পুরুষবাচক কেন ভাবা হয়? এই বিষয়ে জ্ঞানীরা কেউ কি আমার প্রশ্নের জবাব দেবেন?

বাংলাদেশের শিক্ষিত এবং ২১ ফেব্রুয়ারির ভাবে উজ্জীবিতরা সন্তানদের জন্যে বাংলা নাম খোঁজেন, তবে ডাকনাম। ভালো নাম অবশ্যই ইসলামী।

বাংলা নাম নিয়ে আমি আছি বিপদে। অনেকেরই ভুল ধারণা আছে যে, লেখকরা সুন্দর সুন্দর নাম জানেন। আমি কিন্তু জানি না। তাতে রক্ষা নেই, পরিচিতজনদের নাম দেওয়ার জন্যে আমাকে প্রস্তুত থাকতে হয়। সিলেটের নাট্যকর্মী আরজুর ছেলে হয়েছে। নামের জন্যে দিনে চার-পাঁচবার টেলিফোন। আকিকা আটকে আছে।

আমি বললাম, নাম রাখো মানব।

আরজু বিস্মিত হয়ে বলল, স্যার সে তো মানবই, অন্য কিছু তো না। তাহলে মানব কেন রাখব?

আমি বললাম, সেটাও একটা কথা। এক মাস সময় দাও নাম ভাবতে থাকি।

না স্যার, খাসি কেনা হয়ে গেছে। আজই নাম রাখা হবে। মানবই রাখা হবে।

হবিগঞ্জের আরেক অভিনেতার নাম সোহেল। তার প্রথম ছেলে হয়েছে। নামের জন্যে অস্থির। নাম আমাকেই রাখতে হবে। আমি বললাম, যেহেতু প্রথম সন্তান নাম রাখো প্রথম।

সোহেল বলল, নাম খুবই পছন্দ হয়েছে স্যার। অদ্ভুত।

এক বছর না ঘুরতেই আবারও তার এক ছেলে। তার নাম রাখলাম দ্বিতীয় এবং সোহেলকে বললাম, তৃতীয় ছেলেমেয়ে যাই হয় আমার কাছে নাম চাইবে না। সরাসরি নাম রাখবে তৃতীয়। পরেরজন চতুর্থ, তারপরের জন পঞ্চম… এইভাবে চলবে। ঠিক আছে?

জি স্যার ঠিক আছে।

সম্প্রতি ছেলের নামের জন্যে আমার কাছে এসেছে অভিনেতা মিজান। আমি বললাম, নাম রাখো ‘লুব্ধক’।

মিজান মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, লুব্ধক জিনিসটা কী স্যার?

আমি বললাম, আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র। ইংরেজিতে বলে Sirius.

মিজান-পুত্র এখন আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

কেউ যখন আর্কিটেক্টকে দিয়ে বাড়ি বানায় তখন বেশ আয়োজন করে বলে তার কী কী প্রয়োজন। যেমন, মাস্টার বেডরুমের সঙ্গে বারান্দা থাকতে হবে। ফ্যামিলি স্পেসে বই রাখার লাইব্রেরি হবে। সার্ভেন্ট টয়লেট আলাদা হবে। ইত্যাদি।

আমার কাছে যারা নাম চাইতে আসে, তারাও বেশ আয়োজন করেই তাদের দাবিগুলি তোলে। যেমন, এক মা তার ছেলের নামের জন্যে এসেছে—

স্যার! ছেলের নামের প্রথম অক্ষর হবে আ। কারণ আমার নামের প্রথম অক্ষর ‘আ’, আতিয়া। শেষ অক্ষর হবে ‘ল’। কারণ ছেলের বাবার নামের প্রথম অক্ষর ‘ল’, লতিফ। নামের অর্থ যদি নদী, আকাশ বা মেঘ হয় তাহলে খুব ভালো হয়। তারচেয়েও বড় কথা–নামটা হতে হবে আনকমন।

আমি বললাম, ছেলের নাম রাখো আড়িয়াল খাঁ। নদীর নামে নাম। আড়িয়াল খাঁ নামে আমাদের একটা নদী আছে, জানো নিশ্চয়ই?

ছেলের মা গম্ভীর মুখে বলল, আড়িয়াল খাঁ নাম রাখব?

হা। তোমার সব ইচ্ছা এই নামে পূরণ হচ্ছে। নদীর নামে নাম, আনকমন নাম, শুরু হয়েছে তোমার নামের আদ্যক্ষর ‘আ’ দিয়ে, শেষ হচ্ছে তোমার স্বামীর নামের আদ্যক্ষর দিয়ে।

আমার স্বামীর বংশ খাঁ বংশ না।

তাতে কী? তোমার ছেলে খাঁ বংশের পত্তন করবে। তার থেকেই শুরু হবে খাঁ বংশ।

স্যার, আপনাকে আমার ছেলের নাম রাখতে হবে না। ধন্যবাদ।

তোমাকেও ধন্যবাদ।

শুধু যে ছেলেমেয়েদের নাম তা-না, আমাকে অনেক স্থাপনার নামও রাখতে হয়েছে। কাকলী প্রকাশনীর মালিক সেলিম সাহেব উত্তরায় বিশাল চারতলা বাড়ি তুললেন। আমাকে নাম রাখতে হলো। নাম রাখলাম ‘বৃষ্টি বিলাস’।

সেলিম সাহেব বাড়ির সামনে শ্বেতপাথরের ফলকে লিখলেন–এই বাড়ির নাম রেখেছেন…।

সময় প্রকাশনীর ফরিদ ময়মনসিংহে বাড়ি করবে। বাড়ির নাম আমি ছাড়া কে রাখবে? নাম দিলাম ‘ছায়াবীথি’।

নামকরণ চলছেই। এই নামকরণের একটা ভালো দিক হচ্ছে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে নামের পরিবর্তন হবে না।

পাদটিকা

ওল্ড ফুলস ক্লাবের সান্ধ্যসভায় কলকাতার এক ভাষাতত্ত্ববিদ উপস্থিত হলেন। আমরা সবাই চেষ্টা করতে লাগলাম জ্ঞানী টাইপ কথা বলার। তেমন কোনো জ্ঞানী কথা খুঁজে না পেয়ে আমি বললাম, আচ্ছা ভাই, আম নামটা কীভাবে এল? আমের বদলে জাম নাম আমরা কেন রাখলাম না।

ভদ্রলোক বললেন, আমের নাম যদি জাম রাখা হতো তাহলে আপনি বলতেন, জাম রাখা হলো কেন? কেন আম রাখা হলো না?

আমি বললাম অত্যন্ত সত্যি কথা। বাংলা ভাষাভাষী বিশাল ভূখণ্ডে সবাই একসঙ্গে আম’কে আম ডাকা শুরু করল কেন? মিটিং করে কি ঠিক করা হয়েছিল এই ফলটার নাম হবে আম? আমি যতদূর জানি অতি প্রাচীনকালে মানব সমাজ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। এক দলের সঙ্গে আরেক দলের যোগাযোগই ছিল না। অথচ সবাই একটা ফলের নাম রাখল আম। এক হাজার মাইল লম্বা নদী ব্রহ্মপুত্র। সবাই তাকে ব্রহ্মপুত্রই ডাকছে। কে রেখেছিল আদি নাম?

ভাষাতত্ত্ববিদ হকচকিয়ে গেলেন। আবোল-তাবোল কথা বলা শুরু করলেন। তাঁর জন্যে ওই দিনের আসর ছিল শিক্ষাসফর।

কুইজ

আমাদের পাঁচ আঙুলের একটির নাম অনামিকা (রিং ফিঙ্গার) অর্থাৎ নামহীন। এই আঙুলটির নাম নেই কেন?

উত্তর : মহাদেব শিব তাঁর হাতের অনামিকা দিয়ে চারমাথা ব্রহ্মার একটা মাথা ঘাড় থেকে ফেলে দিয়েছিলেন।

এই কাজের পরপর মহাদেব অনুতাপে দগ্ধ হলেন। যে আঙুল দিয়ে তিনি এই কাজটি করেছেন সেই আঙুলকে তিনি অভিশাপ দিলেন। বললেন, আজ থেকে তুই নাম গ্রহণের যোগ্যতা হারালি। আজ থেকে তুই অনামিকা।

[উৎস : বাংলা শব্দের উৎস অভিধান। ফরহাদ খান।]

পড়াশোনা

বাংলা শব্দের মজার দ্বৈততা বিষয়ে আগেও লিখেছি। এখন আরেকবার–পড়ার সঙ্গে শোনা। যেন শোনাও পড়ারই অংশ।

আমরা যেভাবে পডি সেভাবে কি শুনি? সবাই চায় অন্যকে শোনাতে। নিজে শুনতে চায় না। সবচেয়ে বড় উদাহরণ আমি নিজে। বৃদ্ধ বোকা সংঘের আসরে অন্য কেউ কথা বললেই বিরক্তি লাগে। শুধু আমি মনের আনন্দে বকবক করে যাই। তখন আমার বিরক্তি লাগে না। ক্লাসে বক্তৃতা দেওয়ার আনন্দ পাই।

একটা বয়স পার হলে মানুষ ‘কথা বলা রোগ’-এ আক্রান্ত হয়। এই বয়সটা একেকজনের জন্যে একেক রকম। সাধারণভাবে ধরা হয় ষাট। কারণ এই বয়সেই মানুষের কর্মহীন সময়ের শুরু। ষাট থেকে সত্তর এই দশ বছর সব মানুষের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ নাকি এই দশ বছর অর্থপূর্ণ কথা বলে। তারপর থেকেই কথা থেকে সারবস্তু চলে যায়। বাহাত্তরে পা দিলে তো সর্বনাশ।

প্রাচীন ভারতে বিদ্যাদানের কাজটা গুরুরা করতেন এই দশ বছর। পুরো বিদ্যাদানের প্রক্রিয়া ছিল কথানির্ভর। গুরু কথা বলতেন শিষ্য শুনত। বিদ্যাদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দীর্ঘসময় লাগত। একসময় গুরু বলতেন, আমার বিদ্যা যা ছিল সব শেখানো হয়েছে। এখন যাও স্নান করে এসো। শিষ্য স্নান করে ফিরতেন। এই স্নান থেকেই এসেছে ‘স্নাতক’ শব্দ। শিষ্য গ্র্যাজুয়েট হয়েছে।

পাঠক আবার ভেবে বসবেন না যে শিষ্য দীর্ঘ পাঠগ্রহণ প্রক্রিয়া চলাকালে স্নান করে নি। অবশ্যই স্নান করেছে, তবে শেষদিনের স্নান হলো স্নাতক হওয়ার স্নান।

আমাদের শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়া এখনো শোনানির্ভর। বিজ্ঞানের প্রাকটিক্যাল ক্লাস ছাড়া ছাত্রদের শুধু শুনে যেতে হয়।

ধর্মপ্রচারকরাও শিষ্যদের সঙ্গে কথা বলতেন। শিষ্যরা গভীর আবেগে ধর্মগুরুর কথা শুনত।

নবিজীকে (দঃ) আল্লাহর বাণী শোনানো হলো কথায়–’পড়ো! তোমার প্রভুর নামে…’

তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? শোনাটা পড়ার চেয়ে জরুরি? আগে শোনা তারপর পড়া। অর্থাৎ পড়াশোনা না, শোনাপড়া।

আমার আত্মীয়স্বজনরা মাঝে মাঝে বেশ আয়োজন করে আমার কথা শুনতে আসেন। তাদের ধারণা আমার কাছ থেকে শোনা কথাগুলি নাকি ‘অতি উত্তম’। তাদেরকে কথা শোনানো কঠিন কর্মের মধ্যে পড়ে, কারণ তারা মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই আসেন যে ‘অতি উত্তম’ কথা শুনবেন। মানসিক প্রস্তুতি থাকা মানেই আশাভঙ্গের সম্ভাবনা। তারা আবার ফরমাশ করেন–হুমায়ূণ, ঐ ফকিরের গল্পটা আরেকবার বলো। ফকিরের গল্প মনে নেই, তারাই মনে করিয়ে দেন।

লেখকরা গুছিয়ে কথা বলবেন–এটা নিপাতনে সিদ্ধের মধ্যে পড়ে না। বেশির ভাগ লেখক কথা বলতেই পছন্দ করেন না। এই শ্রেণীর লেখকরা আবার কথা শুনতেও পছন্দ করেন না। আমার অতি প্রিয় লেখক এডগার এলেন পো কারও সঙ্গেই কথা বলতেন না। কেউ কথা বলতে এলেও মহা বিরক্ত হতেন।

উল্টোদিকে আছেন চার্লস ডিকেন্স। শুধুমাত্র তার মুখের গল্প শোনার জন্যে টিকিট কেটে মানুষ হল ভর্তি করে ফেলত।

বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর গ্রান্ডমাস্টার আইজাক অ্যাসিমভকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় গেস্ট লেকচার দেওয়ার জন্যে নিয়ে যেত। তিনি বক্তৃতার জন্যে প্রচুর টাকা নিতেন। এক ঘণ্টা কথা বলতেন, এই এক ঘণ্টা দর্শক মুগ্ধ হয়ে থাকত।

আচ্ছা আমি কি গল্প সুন্দর করে বলতে পারি? মনে হয় পারি। কেন বিনয়ের ধারেকাছে না গিয়ে পারি বলে ফেললাম সেটা ব্যাখ্যা করি। আমি লক্ষ করেছি, গল্প যখন শুরু করি সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। অনেকেই অতি বিনয়ের সঙ্গে বলে, আমি একবার আপনার আজ্ঞায় এসেছিলাম। আরেকদিন কি আসতে পারি? দূরে এক কোনায় বসে থাকব।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণমূলক রচনা পড়তে গিয়ে দেখি তিনি লিখেছেন–

‘হুমায়ূন আহমেদ আড্ডায় বসে যেসব চমৎকার গল্প করেন সেগুলি রেকর্ড করে রাখা উচিত।…’

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই লেখা পড়েই মনে হয় অন্যদিন পত্রিকার সম্পাদক মাজহার উৎসাহিত হলো (সে অতি দ্রুত উৎসাহী হওয়ার মতো ক্ষমতা রাখে। একদিন আড্ডায় গল্প করছি, হঠাৎ দেখি আমার বাঁ-পাশে কালো মতো ছোট্ট একটা কী। সেখান থেকে জোনাকিপোকার মতো থেমে থেমে আলো আসছে। আমি বললাম, এটা কী?

মাজহার বলল, স্যার ভয়েস রেকর্ডার।

ভয়েস রেকর্ডার কেন?

এখন থেকে ঠিক করেছি আমাদের আড্ডার পুরো সময়টা রেকর্ড করা থাকবে।

আমি ঠান্ডা গলায় বললাম, এই বস্তু নিয়ে যাও এবং তুমি নিজেও আগামী সাত দিন আড্ডায় আসবে না। আমি এমন কোনো বাণী দেই না যা রেকর্ড করে রাখতে হবে।

শুরু করেছিলাম পড়াশোনা নিয়ে। চলে এসেছি আড্ডার গল্পে এবং নিজেকে বিরাট কথক হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা চালাচ্ছি। পাঠক, সরি। তবে ফাউনটেনপেন যেহেতু আত্মজৈবনিক লেখা, নিজের কথা বলা যেতে পারে। যদিও নিজের প্রশংসা নিজেই করার মতো তুচ্ছ কিছু হতে পারে না। অন্যের নিন্দা করা যত দোষ নিজের প্রশংসা করা তারচেয়েও দোষ। কেউ যখন নিজের প্রশংসা নিজেই শুরু করেন তখন আমার গা চিড়বিড় করতে থাকে। সেখানে আমি কী করে বলছি, আমি ভালো কথক? থুকু ফিরিয়ে নিলাম।

নিজের প্রশংসা নিজে করার সবচেয়ে খারাপ উদাহরণ ইমদাদুল হক মিলন। গত বইমেলা বিষয়ে তার একটা লেখা কালের কণ্ঠের সাহিত্যপাতায় ছাপা হয়েছে। সে লিখেছে…

তখন আমার একটা বই বাংলা একাডেমী বেস্ট সেলার ঘোষণা করেছে। পাঠক-পাঠিকা বইটির জন্যে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। প্রকাশক চাহিদামতো বই যোগান দিতে পারছে না। বইটির জন্যে বইমেলার অনেক জায়গায় কাটাকাটি মারামারি হচ্ছে…

কালের কণ্ঠের সাহিত্যপাতা মিলন দেখে। আমার ‘ফাউনটেনপেন’ তার হাত দিয়েই যাবে। আজকের লেখাটা পড়ে তার মুখের ভাব কী রকম হবে কল্পনা করেই মজা পাচ্ছি। হা হা হা। মিলন, সরি। তুমি তোমার কোনো একটি লেখায় আমাকে তুলোধোনা করে দিয়ো। আমি কিছু বলব না।

.

যখন লেখালেখি করি না, আড্ডা দিতে বসি না, তখন কী করে সময় কাটাই? এই প্রশ্ন কিছুদিন আগে টেলিফোনে এক সাংবাদিক করলেন। আমি বললাম, তখন আমি একটা কাচি নিয়ে বসি। কাঁচি দিয়ে কেটে সময় কাটাই।

সাংবাদিক আমার কথায় আহত হয়ে টেলিফোন রেখে দিলেন। তাঁর জানার জন্যে এবং পাঠকদের জানার জন্যে বলি–তখন আমি সিনেমা দেখি এবং পড়ি। আমার কাছে মোটা একটা বই আছে। বইয়ের নাম ‘One thousand one film that you must see before you die. ‘এক হাজার একটি ছবি যা মৃত্যুর আগে তোমাকে দেখতেই হবে। বই দেখে দেখে ভিডিওর দোকান থেকে ফিল্ম আনি। ছবি দেখার পর বই থেকে নামটা কেটে দেই। বইয়ে নাম নেই এমন ছবিও দেখা হয়। যেমন, সম্প্রতি দেখেছি Avater, Time traveller’s wife. ‘এভেটার’ ছবি। দেখে আনন্দ পেয়েছি।

বলতে ভুলে গেছি, আমি নিজে এক হাজার একটি বইয়ের তালিকা প্রস্তুত করছি। যে বইগুলি মৃত্যুর আগে অবশ্যই পড়া উচিত। একটা বই পড়তে তিন দিন লাগলে ১০০১টি বই পড়তে লাগবে মাত্র দশ বছর।

লেখকদের নানান দোষ থাকে, তার প্রায় সবগুলিই আমার মধ্যে আছে। তবে একটা গুণও আছে। আমিও লেখকদের মতো প্রচুর বই পড়ি। একসময় গল্প উপন্যাস পড়তাম। এখন জানি না কেন, গল্প-উপন্যাস পড়তে ভালো লাগে না।

বই সবচেয়ে বেশি পড়ি যখন দেশের বাইরে যাই। বিদেশ যাত্রার প্রস্তুতি হিসেবে আমার দু’টা স্যুটকেস গোছানো হয়। একটায় থাকে কাপড়চোপড়! এটা শাওন গোছায়। আরেকটায় থাকে ‘Reading Material’, বাংলায় ‘পাঠবস্তু। এই স্যুটকেস আমি গোছই। দুমাস আগে মিশরের পিরামিড দেখার ব্যবস্থা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত যাওয়া বাতিল হয়েছে। ‘Reading Material’-এর স্যুটকেস গোছানোই আছে।

সেখানে কী কী বই নেওয়া হয়েছে তার তালিকা দিচ্ছি–

১. একটা রাশিয়ান সায়েন্স ফিকশান। আগরতলা বইমেলা থেকে একগাদা সায়েন্স ফিকশান কিনেছিলাম। একটাও পড়া হয় নি। যখনই বাইরে যাই একটা রাশিয়ান সায়েন্স ফিকশনের বই নিয়ে যাই। কেন জানি কখনো পড়া হয় না।

Ambassador Without Credentials
Sergei Snegov (Raduga Publishers)

২. The Travels of Marcoplo

এই বইটি আমি আগে একবার পড়েছি। আবারও সঙ্গে নিচ্ছি, কারণ মার্কোপোলোর গাঁজাখুরি ভ্রমণকাহিনী পড়তে ভালো লাগে।

সচেতন পাঠক নিশ্চয় ভুরু কুঁচকাচ্ছেন। মার্কোপোলোর ভ্রমণকাহিনীকে আমি গাঁজাখুরি বলছি। কারণ ব্যাখ্যা করি। তিনি ভারতবর্ষে (বর্ণনা শুনে মনে হয় বাংলাদেশ) একদল মানুষ দেখেছেন যাদের মুখ কুকুরের মতো। এরা কুকুরের মতোই ডাকে।

মার্কোপোলো বাংলাদেশেই আরেকদল মানুষ দেখেছেন যারা প্রকাশ্যে যৌনসঙ্গম করে। এতে কোনো লজ্জা বোধ করে না।

তিনি চীন ভ্রমণের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন, কিন্তু গ্রেট চায়নীজ ওয়াল তাঁর চোখে পড়ে নি।

৩. The End of Time

এটি বিজ্ঞানের বই। সময় কী তা ব্যাখ্যা করা। সহজপাঠ্য।

8. The Demon Hanunted World

Carl Sagan

কার্ল সেগান আমার অতি পছন্দের লেখকদের একজন। তার লেখা Cosmos বইটির আমি একসঙ্গে দুটি কপি কিনেছিলাম যাতে একটি হারিয়ে গেলে অন্যটি থাকে। হায় খোদা, দুটাই হারিয়েছে!

৫. বাংলা একাডেমীর প্রকাশনা বাবরনামা। এই বইটিও আগে ইংরেজিতে পড়া। আবারও পড়ছি, কারণ একটা ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার বাসনা আছে। সম্রাট হুমায়ূনকে নিয়ে উপন্যাস। নাম দেব ‘বাদশাহ নামদার’। হুমায়ূন প্রসঙ্গে যেখানে যা পাচ্ছি পড়ে ফেলছি। বাবরনামাকে world classic বলা হয়। আমি পড়তে গিয়ে ধাক্কার মতো খেয়েছি। পাতায় পাতায় তার মদ খাওয়ার বর্ণনা। ভোরবেলায় একবার, আসর এবং মাগরেবের নামাজের সময় একবার। এশার নামাজের পর আরেকবার। যখন মদ খাচ্ছেন না তখন ভাং-এর নেশা করছেন।

মানুষ হত্যার নির্বিকার বর্ণনা আছে। যেমন, আমি কয়েকজনকে শূলে চড়ালাম। বাকিদের নাক কেটে দিলাম। তারা কাটা নাক নিয়ে আমার তাঁবুর চারপাশে ঘুরতে লাগল। এরকমই নির্দেশ।

আরেক জায়গায় আছে, আমি দুর্গ দখল করলাম। দুর্গের নারী এবং শিশুদের বাদ দিয়ে সমস্ত পুরুষকে হত্যার নির্দেশ দিলাম।

এই বাবুর মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা। এবং তাঁর কালের একজন বড় কবি। কিছুই হিসাব মিলাতে পারি না। তার একটা কবিতা (তুর্কি ভাষায়)–

“গোলাপ কুঁড়ির মতো আমার হৃদয়
তার দলের উপর রক্তের ছাপ,
লক্ষ বসন্ত ও আমার সে হৃদয়ের ফুল
কুঁড়ি ফুটাতে পারে না।”

কী আশ্চর্য! একের পর এক বইয়ের নাম লিখে যাচ্ছি কেন? আমি স্যুটকেসে কী সব বই ভরেছি তা পাঠকদের জানানোর প্রয়োজন কি আছে?

কোনোই প্রয়োজন নেই। কী ধরনের বই আমি পড়তে পছন্দ করি, কেন করি–তা জানানো অর্থহীন। পাঠাভ্যাসের রুচি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়।

এখন অন্য প্রসঙ্গ। আমি নানা ধর্মগ্রন্থ ঘেvছ একটা বিষয় জানার জন্যে বেহেশত বা স্বর্গে কি কোনো লাইব্রেরি থাকবে? সুখাদ্যের বর্ণনা আছে, অপূর্ব দালানের কথা আছে, উৎকৃষ্ট মদ্যের কথা আছে, রূপবতী তরুণীর কথা আছে, বহুমূল্য পোপাশাকের কথা আছে, সঙ্গীতের কথা আছে। লাইব্রেরির কথা নেই।

লাইব্রেরি হচ্ছে মানুষের চিন্তা এবং জ্ঞানের ফসল। বেহেশতে হয়তো মানুষের চিন্তা এবং জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। সেখানকার চিন্তা অন্য, জ্ঞান অন্য। বিশুদ্ধ চিন্তা, বিশুদ্ধ জ্ঞান।

অবশ্যপাঠ্য বইয়ের প্রথম তালিকা। প্রিয় লেখক বিভূতিভূষণকে দিয়ে শুরু।

লেখক : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়

লেখা–১. পথের পাঁচালি ২. দৃষ্টি-প্রদীপ ৩. আরণ্যক ৪. ইছামতি ৫. দেবযান

.

পাদটিকা

Books are delightful society. If you go into a room filled with books, even without taking them down from their shelves, they seem to speak to you, to welcome you.

-William F Gladstone

বন্দুক-মানব

গানম্যানের বাংলা করলাম ‘বন্দুক-মানব’। ঘন বাংলা হয় নি, পাতলা বাংলা হয়েছে। ‘গানম্যানে’ যে কঠিন ভাব আছে, ‘বন্দুক-মানবে’ তা নেই। এখানে মানব শব্দটাই প্রাধান্য পেয়েছে। বন্দুক হয়েছে গৌণ। বাংলা ভাষার এ এক মজার খেলা।

অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যেমন, মন্ত্রী-মিনিস্টার, দেশের প্রধান, রাজনৈতিক নেতাদের সরকার গানম্যান দেয়। গানম্যানরা শাদা পোশাকে থাকে। তাদের পকেটে থাকে আধুনিক মারণাস্ত্র।

বিজ্ঞাপনে দেখি লাইফবয় সাবান জীবাণু থেকে সুরক্ষা দেয়। গানম্যানরাও গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের সুরক্ষা দেন।

এক সকালের কথা। থাকি ‘দখিন হাওয়া’র ফ্ল্যাটে। সম্পূর্ণ ‘একা’। একজন বাবুর্চি ছিল, সে রাত একটা-দুটায় আমি ডিনার খাই দেখে কাউকে কিছু না-বলে (এবং তার পাওনা বেতন না নিয়ে চলে গেছে। আমি হাতমুখ ধুয়ে এককাপ চা বানিয়ে পত্রিকা নিয়ে বসেছি, তখন ঘরে সুশ্রী চেহারার এক যুবক ঢুকল। তার গায়ের শার্ট দামি, প্যান্ট দামি, জুতাজোড়াও চকচক করছে। তার গা থেকে সেন্টের গন্ধ আসছে।

আমি বললাম, কী ব্যাপার?

যুবক বলল, স্যার আমি গানম্যান।

গানম্যান খুব ভালো কথা। আমার কাছে কী?

স্যার, আমি আপনার গানম্যান।

পানি খেতে গিয়ে লোকে বিষম খায়, আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বিষম খেলাম। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বললাম, কোথাও কোনো ভুল হয়েছে। আমার কোনো গানম্যান নেই। থাকার কথাও না।

কোনো ভুল হয় নাই স্যার। এই যে আমার পরিচয়পত্র। পুলিশ। হেডকোয়ার্টার থেকে আপনাকে একটা চিঠিও দেওয়া হয়েছে। এই যে চিঠি।

চিঠি পড়ে দেখি ঘটনা সত্যি। সরকার আমার জন্যে গানম্যানের ব্যবস্থা করেছে। গানম্যান সার্বক্ষণিকভাবে আমার সঙ্গে থাকবে। আমাকে সুরক্ষা দেবে।

আমি বললাম, হলি কাউ!

গানম্যান বলল, কী বললেন বুঝতে পারলাম না।

আমি বললাম, বুঝতে হবে না। ঘরে সিগারেট নেই বলে সিগারেট খেতে পারছি না। তুমি এক প্যাকেট সিগারেট কিনে আনতে পারবে?

অবশ্যই পারব স্যার।

গানম্যান সিগারেট কিনতে গেল, আমি পরিস্থিতি নিয়ে ভাবতে বসলাম।

গানম্যান নিয়ে ঘোরার মধ্যে আত্মশ্লাঘার বিষয় আছে। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা এবং অন্যের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করা। এই পরিস্থিতিতে আমি কী করব বুঝতে পারছি না। গানম্যানের আনা সিগারেট টেনেও মাথা পরিষ্কার হলো না। আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আমি একজন লেখক মানুষ। লেখক ঘুরবে ঝোলা নিয়ে, ঝোলাতে থাকবে কাগজ-কলম। লেখক কখনো গানম্যান নিয়ে ঘুরবে না। আপনি গানম্যান উঠিয়ে নিন।

কয়েকদিন থাকক। তারপর আপনার কথামতো উঠিয়ে নিব।

কয়েকদিন শুনে রাজি হলাম, সেই কয়েকদিন তিন বছর পর্যন্ত গড়াল। যাই হোক, প্রথম দিনের কথা বলি। দুপুর তিনটার দিকে গানম্যান বলল, স্যার দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা কী?

খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নাই। পাশের ফ্ল্যাট থেকে খাবার আসে। আজ মনে হয় ভুলে গেছে। মাঝে মাঝে তারা খাবার পাঠাতে ভুলে যায়।

আমরা দুপুরে খাব না?

তেহারির দোকান থেকে দু’প্যাকেট তেহারি নিয়ে আসো।

আপনার কি গাড়ি আছে?

গাড়ি আছে। ড্রাইভার নাই। রিকশা করে চলে যাও।

গানম্যান চিন্তিত ভঙ্গিতে তেহারি আনতে বের হলো।

সন্ধ্যার কথা। বন্ধুবান্ধব আসবে। ওল্ড ফুলস ক্লাবের আড্ডা বসবে। আমার বসার ঘরের দরজা সবসময় খোলা থাকে। হিমু তার ঘরের দরজা খোলা রাখে, আমি হিমুর বাবা। আমারও ঘরের দরজা খোলা রাখা উচিত।

আজ দরজা বন্ধ। দরজার পাশে চেয়ার নিয়ে গানম্যান বসে আছে। তার চোখমুখ কঠিন।

দরজার বেল বাজল। গানম্যান দরজা খুলে বলল, হাত উপরে তুলুন, বডি চেক। ভয় পাবেন না। রুটিন চেক। হুমায়ূন স্যারের সিকিউরিটির বিষয়।

আমার কাছে এসেছে ছেলেবেলার বন্ধু ডাক্তার করিম (অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান)। সে হাত তুলল। বডি চেক করা হলো। গানম্যান বলল, আপনার ব্যাগে কী? ব্যাগ খুলুন, ব্যাগে কী আছে দেখব।

করিম ভয়ে ভয়ে বলল, আপনি কে?

আমি হুমায়ূন স্যারের গানম্যান। এখন বলুন, আপনি কে, কোত্থেকে এসেছেন, কেন এসেছেন?

করিম বলল, আমি পাঁচতলায় এসেছিলাম আলমগীর রহমানের কাছে। ভুলে ছয়তলায় চলে এসেছি। হমায়ূন আহমেদকে আমি সেভাবে চিনি না।

একটা চৈনিক প্রবাদ আছে–”হাঁচি, কাশি এবং প্রেম কারও কাছ থেকে লুকানো যায় না।“ আমি এই তিনটির সঙ্গে আরেকটি যুক্ত করেছি- “হাঁচি, কাশি, প্রেম এবং গানম্যান কারও কাছ থেকে লুকানো যায় না।“ কিছুদিনের মধ্যে সবাই জেনে গেল আমার সঙ্গে একজন দুর্ধর্ষ গানম্যান আছে। বন্ধুবান্ধবদের বাসায় আসা আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেল।

দশ দিনের মাথায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এল। আমি গানম্যানকে বললাম, আমার দরজা সবসময় খোলা থাকবে, কাউকে চেক করা যাবে না। অতিথিদের নাম-ঠিকানা লেখা যাবে না। আমি যখন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেব তখন সামনে দিয়ে হাঁটাহাঁটি করা যাবে না।

গানম্যান নতুন রুটিনে দ্রুত অভ্যস্ত হয়ে গেল। সে আমার পাশে একটা ঘরে ঘুমায়, সকালে ঘুম থেকে উঠে নাশতা খেয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে দুপুরের খাবার খেয়ে আবার ঘুম। ঘুম ভাঙার পর সে আমার লেখা গল্প-উপন্যাসের বই হাতে নিয়ে চোখমুখ শক্ত করে বই পড়ে। যেন পরীক্ষার পড়া মুখস্থ করছে। সাহিত্য নিয়ে মাঝে মধ্যে কিছু আলোচনাও হয়। যেমন, স্যারের এই বইটা তেমন ভালো হয় নাই। এন্ডিং-এ ঝামেলা আছে।

আমাদের দুজনের জীবনচর্যায় মিল পাওয়া গেল। সে তার ঘরে একা থাকে, আমিও আমার ঘরে একা থাকি। সে সারা দিন ঘুমায়, আমি সারা দিন লিখি। সন্ধ্যার পর থেকে সে বই পড়ে, আমিও বই পড়ি। গভীর রাত পর্যন্ত সে হিন্দি সিরিয়াল দেখে। গভীর রাত পর্যন্ত আমিও ভিসিআরে সিনেমা দেখি।

গানম্যানের নিঃসঙ্গতা কাটল, আমার একজন বাবুর্চি জোগাড় হলো। গানম্যান বাজার করে আনে, দু’জনে মিলে কোটাবাছা করে। রান্না চাপায়। একদিন মজার এক দৃশ্য দেখলাম, রান্নাঘরে গানম্যান লেপটা দিয়ে বসে কচুর লতি বাছছে। পাশেই লোডেড পিস্তল।

কোরবানির ঈদে সে ছুটি নিয়ে দেশে গেল না। আমাকে একা ফেলে যাবে না। ঈদের দিন আমাকে কে দেখবে? আমি.কোরবানি দেব না শুনে সে মুষড়ে পড়ল। আমি বললাম, মাংস কাটা, রান্না করা, এইসব কে করবে? ঘরে কেউ নাই। বাবুর্চি ছুটি নিয়ে চলে গেছে।

স্যার আমি তো আছি। টাকা দিন, খাসি কিনে নিয়ে আসি। আরেকটা কথা, আপনার অনুমতি ছাড়াই পাশের বাসার মাজহার স্যারের গরুতে একটা নাম দিয়ে দিয়েছি।

তাকে নিয়ে ঈদের নামাজ পড়তে গিয়ে আরেক যন্ত্রণা। সিজদায় গিয়েছি, টুপ করে শব্দ হলো। তাকিয়ে দেখি পকেট থেকে গানম্যানের পিস্তল জায়নামাজে পড়ে গেছে। মুসুল্লীরা তাকিয়ে আছেন আতংকিত চোখে।

গানম্যানদের প্রতিমাসেই গাজীপুরে পিস্তল শুটিং-এর পরীক্ষা হয়। একবার পরীক্ষা দিয়ে আমার গানম্যান খুব মন খারাপ করে ফিরল।

আমি বললাম, কী হয়েছে?

সে বলল, পরীক্ষা খারাপ হয়েছে। হাতের টিপ নষ্ট হয়ে গেছে।

কচুর লতি বাছলে হাতের টিপ তো নষ্ট হবেই।

তারপরেও স্যার অসুবিধা নাই। আপনার উপর কোনো হামলা হলে পঁচিশ গজের ভিতর যে আসবে তারেই শুট করে ফেলে দিব। একটা হামলা হোক, দেখেন স্যার কী করি?

গানম্যান হামলার আশায় দিন কাটাতে লাগল। সন্ত্রাসী হামলা হলো না, তবে অন্য ধরনের হামলায় জীবনসংশয় হলো। এই হামলার নাম হার্টঅ্যাটাক। ল্যাবএইড হাসপাতালে ভর্তি হলাম। আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে, গানম্যান সঙ্গে যাবে। ডাক্তার বললেন, অসম্ভব! আপনি যেতে পারবেন না।

গানম্যান বলল, অবশ্যই আমাকে যেতে হবে। ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে যদি স্যারের উপর হামলা হয় কে সামলাবে? আপনারা সামলাবেন? জবাবদিহি তো আপনাদের করতে হবে না। আমাকে করতে হবে।

আমাকে সিডেটিভ দেওয়া হয়েছিল। গানম্যান এবং ডাক্তারদের তর্কবিতর্ক শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল অনেক রাতে। চোখ মেলে দেখি, আমি পর্দাঘেরা ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে আছি। আমার পাশে গানম্যান দাঁড়িয়ে। তার চোখ মমতায় আর্দ্র। সে বলল, স্যার আমি আছি। কোনোরকম দুশ্চিন্তা করবেন না। কেউ এসে হামলা করুক দেখেন কী করি?

তার মমতাভেজা কণ্ঠ বলে দিল সে গানম্যান না, বন্দুক-মানব।

.

পাদটিকা

জমিকে লালাউ গুল জিনহে খেয়াল নেহি।
ও লোগ চান্দসিতারো কি বাৎ করতে হ্যাঁয়।

খয়াল কানপুরী

পৃথিবীর বুকের ফুলফল লতাগুল্মে যার চোখ নেই, সে-ই শুধু আকাশের চন্দ্র এবং নক্ষত্রের গল্প করে।

বৃষ্টি নেশা ভরা সন্ধ্যাবেলা

রবীন্দ্রনাথের লেখা এই লাইনটি আমার অতি অতি প্রিয়। কবি ধরতে পেরেছেন ততেও নেশা ধরিয়ে দেয়। মানুষ কোন ছাড়।

বৃষ্টি আমাকে নেশাগ্রস্ত করে। ভালোভাবেই করে। ব্যাপারটা শুরু হয়েছে আমার শৈশবে। তখন সিলেটে থাকি। সিলেটের বিখ্যাত বৃষ্টি। একবার শুরু হলে সাতদিন আটদিন থাকে। ইচ্ছা করে ভিজে চুপচুপা হয়ে স্কুলে যাই। স্যার আমাকে দেখে আঁৎকে উঠে বলেন, এ-কী অবস্থা! নিউমোনিয়া বাধাবি তো। যা বাড়ি যা। ভেজা কাপড়ে স্কুল করতে হবে না। গাধা কোথাকার! বাসায় ফিরে বই খাতা রেখে আবার বৃষ্টিতে নেমে যাওয়া। কাঁচা আমের সন্ধানে আমগাছের নিচে নিচে ঘুরে বেড়ানো। তখনকার অভিভাবকরা সন্তানদের নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। সন্তানরা তাদের কাছে হাঁস-মুরগির মতো। সন্ধ্যা হলে হাঁস-মুরগির মতো তারা ঘরে ফিরলেই চলবে।

আমাদের সময় ‘রেইনি ডে’ বলে একটা ব্যাপার ছিল। জটিল বৃষ্টি হলে স্কুল ছুটি। হেডস্যার ভাব করতেন ছুটি দিতে গিয়ে তিনি মহা বিরক্ত। কিন্তু তার মুখেও থাকত চাপা আনন্দ। বৃষ্টি তার আনন্দ সবার মধ্যেই ছড়িয়ে দেয়।

আজকালকার ইংরেজি স্কুলের শহুরে ছেলেমেয়েরা এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত। তারা গাড়ি করে স্কুলে আসে গাড়ি করে চলে যায়। ঝড়-বৃষ্টি তাদের স্পর্শ করে না।

যে কথা বলছিলাম, বৃষ্টির ব্যাপারে আমি নেশাগ্রস্ত। বৃষ্টি হলে আমি জলধারায় নিজেকে সমর্পণ করব–এটা নিপাতনে সিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নুহাশপল্লী এবং নুহাশ চলচ্চিত্রের স্টাফরা বিষয়টায় খুবই আনন্দ পায়। অতিথিদের সঙ্গে তাদের আলাপ-আলোচনা–

‘বৃষ্টি নামছে আর স্যার ঘরে বসা, এই জিনিস হবে না। তখন স্যাররে যদি তালাবন্ধ করে রাখেন স্যার তালা ভেঙে বের হয়ে যাবে। যতক্ষণ বৃষ্টি থাকবে ততক্ষণ স্যার বৃষ্টিতে ব্যাঙের মতো লাফালাফি করবে।‘

সমস্যা হয়েছে ইদানীং বৃষ্টিতে নামতে ইচ্ছা করে না। নিশ্চয়ই বয়স ফ্যাক্টর। তারপরেও বাধ্য হয়ে নামি। না নামলে আমার স্টাফদের ইজ্জত থাকে না।

গত বর্ষায় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। আমি আমার ঘরে বসে আছি। রিডার্স ডাইজেস্টের একটা পুরনো সংখ্যায় চোখ বুলাচ্ছি, দরজা খুলে নুহাশপল্লীর ম্যানেজার বুলবুল ঢুকল। উত্তেজিত গলায় বলল, স্যার মনে হয় খেয়াল করেন নাই। বিরাট বৃষ্টি। ভিজবেন না?

আমি বই বন্ধ করতে করতে বললাম, আসছি।

পুকুরে নৌকা রেডি করেছি যদি নৌকায় বসে বৃষ্টি দেখতে চান।

পুকুরপাড়ের দিকে যাব, তোমরা দলবেঁধে পিছে পিছে আসবে না। আমি বৃষ্টিতে ভিজছি এটা হা করে দেখার কিছু নাই।

অবশ্যই নাই। আমরা দীঘির দিকে যাব না।

বৃষ্টিতে নেমেই যৌবনকালের মাহাত্ম বুঝলাম। তখন বৃষ্টির আনন্দে অভিভূত হতাম এখন থরথর করে শীতে কাঁপছি। দাঁত কিড়মিড় করা শুরু করেছে। যাচ্ছি পুকুরপাড়ের দিকে। পরিকল্পনা হলো, শ্বেতপাথরের ঘাটে বসে বৃষ্টি দেখব। ঘাটে বসে আছি। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকানোর কিছুক্ষণ পর বজ্রপাতের শব্দ। ঐ যে আলোর গতি এবং শব্দের গতির পার্থক্য, নাটক সিনেমায় অবশ্যি বিদ্যুতের ঝলক এবং বজ্রপাতের শব্দ একসঙ্গে দেখানো হয়। বিদ্যুৎচমকের পর পর বজ্রপাতের শব্দের জন্যে অপেক্ষা করার অদ্ভুত টেনশানও উপভোগ করার মতো ব্যাপার। শব্দটা বড় হবে, না ছোট হবে? অল্পক্ষণ হবে নাকি অনেকক্ষণ?

বজ্রপাতের অপেক্ষা করছি হঠাৎ আমার ভেতরের সিক্সথ সেন্স আমাকে সতর্ক করল। আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘাটে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার ছয় থেকে সাত হাত দূরে একটা সুপারি গাছের উপর বজ্রপাত হলো। গাছ সঙ্গে সঙ্গে পুড়ে কয়লা।

আমি প্রথম এত কাছে বজ্রপাত দেখলাম। বজ্রপাতের আলো দূর থেকে নীল দেখা যায়। খুব কাছ থেকে এই আলো কিন্তু গাঢ় কমলা।

বজ্রপাতে মৃত্যু না হওয়ায় একটি কারণে যথেষ্ট সন্তোষ লাভ করলাম– আমাকে আল্লাহ সরাসরি শাস্তি দিয়েছেন এটা এখন কেউ বলবে না। প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, অতি অতি দুষ্টদের আল্লাহপাক বজ্রপাতের মাধ্যমে সরাসরি শাস্তি দেন।

উদাহরণ সিরাজউদ্দৌলার হত্যাকারী মিরন। তার ঘটনা এরকম– সিরাজউদ্দৌলার আপন খালা ঘসেটি বেগম বজরায় করে বুড়িগঙ্গা নদী পার হচ্ছেন। ব্যবস্থা করে দিয়েছে মিরন। ঘসেটি বেগম হঠাৎ দেখলেন, মাঝনদীতে বজরা আসামাত্র নৌকার মাঝিমাল্লারা বজরা ফেলে ঝাঁপিয়ে বুড়িগঙ্গায় পড়ল এবং প্রাণপণে সাঁতরাতে লাগল তীরের দিকে। বজরার নিচ ফুটো করা হয়েছে। বজরা পানিতে ডুবতে শুরু করেছে। ঘসেটি বেগম মিরনের ষড়যন্ত্র বুঝতে পারলেন। তিনি বজরার ছাদে উঠে চিৎকার করে বললেন, মিরন! তুই মারা যাবি বজ্রাঘাতে।

ইতিহাস বলে বজ্রপাতের কারণেই মিরনের মৃত্যু হয়েছে। আমার কথা হচ্ছে, আল্লাহপাক কি সরাসরি শাস্তি দেন? যদি দিতেন তাহলে পৃথিবীর চেহারা অন্যরকম হতো। অতি দুষ্টলোকদের আমি কখনোই শাস্তি পেতে দেখি নি। তারা পরম সুখে জীবন পার করে। এক পর্যায়ে মাদ্রাসা মসজিদ বানায় বলে পরকালেও হয়তো তারা পরম সুখে বাস করবে।

আল্লাহপাক সম্বন্ধে আমাদের কিছু ভ্রান্ত ধারণা আছে। যেমন বলা হয় নর নারীর বিবাহের ব্যাপারটা তিনি দেখেন। Bible-এ এই কথা আছে–Marriges are made in heaven.

আমার এক বন্ধু চার-পাঁচটা বিয়ে করেছেন (সঠিক সংখ্যা রহস্যাবৃত) এবং ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ কোনো স্ত্রী তাকে সুখ দিতে পারে নি। বর্তমানে সুখের জন্যে তিনি স্ত্রীর বিকল্পের সন্ধানে ব্যস্ত। এখন তিনি যদি বলেন, বিয়ে-শাদি তো আল্লাহর হাতে। উনি যা ঠিক করেছেন আমার ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে–তাহলে কি চলবে?

ইসলামের দুটি ধারা। এক ধারা বলছে Free will-এর কথা, অর্থাৎ মানুষকে বিবেচনাশক্তি দিয়ে পাঠানো হয়েছে। আরেক দল ফ্রি উইল অস্বীকার করেন। তারা বলেন, সবই পূর্বনির্ধারিত। এই ক্ষেত্রে তারা সূরা বনি ইসরাইলের একটি আয়াত উল্লেখ করেন

“আমি তোমাদের ভাগ্য তোমাদের গলায় হারের মতো ঝুলাইয়া দিয়াছি। ইহা আমার পক্ষে সম্ভব।”

বলা হয়ে থাকে পাঁচটা জিনিস আল্লাহপাক সরাসরি নিজের কনট্রোলে রেখেছেন। যেমন–

১. হায়াত ২. মৃত্যু ৩. ধনদৌলত ৪. রিজিক ৫. বিবাহ

ধর্ম বিষয়ে আমার সীমিত পড়াশোনায় যা জানি তা হচ্ছে, পাঁচটা বিষয়ের জ্ঞান আল্লাহর হাতে

১. কেয়ামত কখন হবে। ২. কোথায় কখন বৃষ্টি হবে। ৩. মায়ের গর্ভে কী আছে (ছেলে, মেয়ে তাদের ভাগ্য ইত্যাদি) ৪. মানুষ আগামীকাল কী উপার্জন করবে। ৫. তার মৃত্যু কোথায় কীভাবে ঘটবে।

(সূত্র : সূরা লোকমান আয়াত ৩৪।)

আমি কোনো ভুল করেছি এরকম মনে হয় না, তারপরেও এই বিষয়ে জ্ঞানী। আলেমদের বক্তব্য আমি আগ্রহের সঙ্গে শুনব।

.

পাদটিকা

আমার তিন বছর বয়েসী পুত্র নিষাদকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা! আল্লাহ কোথায় থাকেন?

সে যথেষ্ট জোর দিয়ে বলল, আকাশে থাকেন।

তার সঙ্গে আমাদের দেশের ক্রিকেট প্লেয়ারদের চিন্তাতেও মিল দেখলাম। ক্রিকেট প্লেয়াররা কোনোক্রমে একটা হাফ সেঞ্চুরি করলেই আকাশের দিকে তাকিয়ে তাদের কৃতজ্ঞতা নিবেদন করেন। তারাও জানেন আল্লাহ আকাশে থাকেন।

শিশুপুত্র নিষাদ আল্লাহর অবস্থান বলেই ক্ষান্ত হলো না। সে বলল, আল্লাহর কাছে দুটা বড় এসি আসে। একটা এসি দিয়ে তিনি গরম বাতাস দেন, তখন আমাদের গরম লাগে। আরেকটা এসি দিয়ে তিনি ঠান্ডা বাতাস দেন, তখন আমাদের ঠান্ডা লাগে।

কুইজ-১

কোন মোগল সম্রাট টাকশাল থেকে স্বর্ণমুদ্রা ছেড়েছিলেন, সেখানে লেখা—’আমি আল্লাহ’। কিন্তু সেই সময়কার মাওলানারা তার জোরালো প্রতিবাদ করতে পারেন নি।

উত্তর : সম্রাট আকবর। তিনি স্বর্ণমুদ্রায় লিখলেন, আল্লাহু আকবর। এর একটি অর্থ আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ। অন্য অর্থ আকবর আল্লাহু। সম্রাট আকবর তখন নতুন ধর্মমত প্রচার শুরু করেছেন–দিন-ই-এলাহি। মোল্লারা যখন তাকে স্বর্ণমুদ্রায় লেখা নিয়ে প্রশ্ন করল তখন তিনি হাসতে হাসতে বললেন, যে অর্থ গ্রহণ করলে আপনারা খুশি হন সেই অর্থ গ্রহণ করুন। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ-–এই অর্থ নিন।

কুইজ-২

প্রতি সেকেন্ডে পৃথিবীপৃষ্ঠে কতবার বজ্রপাত হয়?

উত্তর : দুইশত বার।

বেঁচে আছি

কেউ যদি জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন আছেন?’–তার উত্তরে ‘ভালো আছি’ বলাটাই ভদ্রতা। খারাপ থাকলেও বলতে হয় ভালো আছি।

বৃদ্ধদের জন্যে এই নিয়ম খাটে না। এক বৃদ্ধ যখন অন্য বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করেন, কেমন আছেন?’–তার উত্তরে ভালো আছি’ না বলে যেসঝ অসুখ বিসুখে তিনি ভুগছেন তার বিশদ বর্ণনা দেওয়াটাই ভদ্রতা। যেমন, কিছুই হজম হচ্ছে না। গ্যাসের যন্ত্রণা। রাতে ঘুম হয় না বললেই হয়। মাথার তালু, পায়ের পাতা গরম হয়ে থাকে। মনে হয় ভাপ বের হচ্ছে।

আমাকে কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন, ‘কেমন আছেন?’–আমি বলি ‘বেঁচে আছি’। বেঁচে থাকা আমার কাছে বিস্ময়কর একটা ঘটনা বলেই ‘বেঁচে আছি’ বলি। আমার বেঁচে থাকা কোনোক্ৰমে টিকে থাকা না। আনন্দময় অবস্থায় থাকা।

যে-কোনো অবস্থায় যে-কোনো পরিস্থিতিতে আমি আনন্দে থাকতে পারি। এইদিকে হিমু চরিত্রের সঙ্গে আমার কিছুটা মিল আছে।

আমার চরম দুঃসময়ে আনন্দে থাকার কয়েকটা ঘটনা বলি।

(ক)

১৯৭১ সন। মহসিন হল থেকে আমাদের কয়েকজনকে মিলিটারি ধরে নিয়ে গেছে। ভোরবেলা মেরে ফেলা হবে এমন কথা শোনা যাচ্ছে। রাত দশটার দিকে মিলিটারিদের একজন এসে আমার হাতে বিশাল আকৃতির একটা সাগর কলা। ধরিয়ে দিল। আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, কলাটা খাও। মনে হচ্ছে তোমাকে মেরে ফেলা হবে। তবে তোমার জন্যে সান্ত্বনার একটি বিষয় আছে। শুনতে চাও?

চাই।

তুমি যদি অপরাধী হয়ে থাকো তাহলে মৃত্যু তোমার প্রাপ্য শাস্তি। আর যদি অপরাধী না হও তাহলে সরাসরি বেহেশতে চলে যাবে। হুরপরীদের সঙ্গে থাকবে।

আমি তার যুক্তি শুনে শব্দ করে হেসে ফেললাম। মৃত্যুভয়জনিত টেনশন একপাশে রেখে সহবন্দিদের সঙ্গে গল্পগুজব শুরু করলাম।

পরদিন কীভাবে বেঁচেছি সেই গল্প অনেক জায়গায় করেছি বলে উহ্য রাখলাম।

(খ)

মালিবাগ রেলক্রসিং। ট্রেন আসছে। রেলক্রসিং-এ ঘণ্টা বাজছে। গেটের লৌহদণ্ড উপর থেকে ধীরে ধীরে নামছে। গাড়ির যাত্রীরা চাচ্ছে এই ফাঁকে পার হয়ে যেতে। হুড়মুড় করে গাড়ি ক্রসিং পার হচ্ছে। আমার ড্রাইভারও গাড়ি রেললাইনের উপর তুলল। তখনই ঘটল সাড়ে সর্বনাশ। গাড়ি জ্যামে আটকে গেল। আমাদের সামনে অসংখ্য গাড়ি, পেছনে গাড়ি, আমরা রেললাইনে। ট্রেন ঘণ্টা বাজিয়ে আসছে।

আমার সঙ্গে আছেন অভিনেতা মোজাম্মেল সাহেব। ( অয়োময়ের হানিফ, খুকখুক করে কেঁশে যিনি সবার হৃদয় হরণ করেছিলেন।) হানিফ সাহেব আতঙ্কে অস্থির হয়ে গেলেন। একবার দরজা ধরে টানেন, একবার লাফিয়ে সামনের দিকে আসেন, পরক্ষণেই এক লাফে পেছনে যান। আমি বললাম, হানিফ সাহেব! অস্থির হবেন না। তিনি চিৎকার করে উঠলেন, অবস্থা বুঝতেছেন না? এক্ষুনি মারা যাব। আমি তার উত্তরে হাসতে হাসতে বললাম, ঐ দেখুন ট্রেনের ইঞ্জিন। রেলগাড়ি ঝমাঝম, পা পিছলে আলুর দম।

প্রবল আতঙ্কের সময় শরীরে এনডলিন নামের একটি এনজাইম আসে। এই এনজাইম ভয় কাটিয়ে দেয়। এই এনজাইম বাইরে থেকেও শরীরে দেওয়া যায়।

আমি তখন সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে ওটি-তে নেওয়া হবে। ওপেন হার্ট সার্জারি। ডাক্তার বললেন, ভয় পাচ্ছেন?

আমি বললাম, পাচ্ছি।

ডাক্তার বললেন, একটা ইনজেকশন দিচ্ছি, ভয় কেটে যাবে।

আমি বললাম, এনড্রলিন জাতীয় কিছু?

ডাক্তার বললেন, হ্যাঁ।

ইনজেকশন দেওয়া হলো। আমার ভয় কেটে গেল। ভয় কাটানোর এই ওষুধ টেবলেট আকারে পাওয়া গেলে ভালো হতো। ভয় পাচ্ছি, চট করে একটা টেবলেট গিলে ফেলা।

ভয়কে আমি মোটামুটি জয় করেছি এটি বলা যেতে পারে। অপমান’ জয় করতে পারি নি। আনন্দে বেঁচে থাকার জন্যে অপমান জয় করা অতি জরুরি। লেখকজীবনে আমাকে নানান ধরনের অপমানের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। এখনো যাচ্ছি। চামড়া গণ্ডারের কাছাকাছি করে ফেলেছি। এখন লেখালেখি নিয়ে অপমান গায়ে লাগে না। তবে পুত্রকন্যাদের অপমান গায়ে লাগে। তখন বেঁচে থাকা খুব আনন্দময় মনে হয় না।

একটা ঘটনা বলা যেতে পারে।

আমার মেজো মেয়ে শীলা আহমেদ। ইকনমিক্সে খুব ভালো রেজাল্ট করে পাস করেছে। তাকে অভিনন্দন জানিয়ে একগুচ্ছ ফুল এবং এক প্যাকেট মিষ্টি পাঠালাম। সে থাকে ভাইবোনদের নিয়ে তার মা’র সঙ্গে। আমার সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। দ্বিতীয় বিয়ে করায় বাবার প্রতি তাদের কঠিন রাগ।

ফুল পাঠানোর এক ঘণ্টার মধ্যে ফুল এবং মিষ্টির প্যাকেট ফেরত এল। সঙ্গে শীলার কঠিন এক নোট–

বাবা,

ফুল-মিষ্টি ফেরত পাঠালাম। একটা মিষ্টি ভুলে খেয়ে ফেলেছি। সরি।

ইতি

শীলা

ভুলে একটা মিষ্টি খেয়ে ফেলার মধ্যে যে কৌতুক আছে তা-ই আমাকে অপমান থেকে রক্ষা করল। আমি অনেকক্ষণ হো হো করে হাসলাম।

আধুনিক মানুষ যেসব কাল্পনিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হন তার একটির নাম ভালো না-লাগা রোগ। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির কিছুই ভালো লাগে না। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে, বৃষ্টি ভালো লাগে না। আকাশ ভেঙে জোছনা নেমেছে, জোছনা ভালো লাগে না। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গ ভালো লাগে না।

আমার সবই ভালো লাগে। উদাহারণ দেই।

৮ জুলাই বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড ক্রিকেট খেলা। আমার জুলাইয়ের এক তারিখ থেকে ভালো লাগতে শুরু করে। এই তো আর কয়েকটা মাত্র দিন, তারপর আরাম করে ক্রিকেট খেলা দেখব। এক সপ্তাহ আগে থেকেই আনন্দ শুরু।

ভিডিওর দোকান থেকে পছন্দের ভিডিও কিনে আনা হয়েছে। আলাদা সাজানো আছে। কোনো একসময়ে ছবি দেখা হবে, এই চিন্তাই আনন্দের।

পড়ার জন্যে প্রচুর বই আছে। যে-কোনো একটা হাতে নিলেই জগৎ-সংসার ভুলে যাওয়া। ছোটবেলার কথা মনে আছে, ভালো কোনো বই হাতে এসেছে (তখনকার ভালো বই মানে ডিটেকটিভ বই, কিরীটি রায়, দস্যু মোহন…) বইটা গোগ্রাসে পড়ার কথা, পড়ছি না। পড়লেই শেষ হয়ে যাবে। এক পাতা দু’পাতা করে পড়া। শিশুর হাতের সন্দেশের মতো। সে সন্দেশ হাতে নিয়ে ঘুরছে। মাঝে মাঝে শুকে দেখছে। খাচ্ছে না। খেলেই তো শেষ হয়ে যাবে।

আনন্দময় বেঁচে থাকার অন্যতম প্রধান শর্ত ভালো সঙ্গিনী। প্রাচীনকালে স্ত্রীদের তিন ভাগে ভাগ করা হতো

১. ঘর জ্বালানি, পাড়া জ্বালানি

(এরা ঘর জ্বালায়, পাড়াপ্রতিবেশিকে জ্বালায়)

২. ঘর জ্বালানি, পাড়া ভালানি। ৩. ঘর ভালানি, পাড়া ভালানি।

(আদর্শ স্ত্রী)

এই সময়ে, ফ্ল্যাট বাসের যুগে, পাড়া বলে কিছু নেই। সবই ঘরকেন্দ্রিক। আমি এই সময়ের স্ত্রীদের কয়েকটা ভাগ করেছি।

১. সন্দেহ নারী

এরা স্বামীর মোবাইল চেক করবে। স্বামী বাইরে থেকে ফিরলে শার্ট খুঁকে দেখবে, শার্টে কোনো অপরিচিত গন্ধ আছে কি না। কিংবা লম্বা চুল লেগে আছে কি না। গাড়ির ড্রাইভার তাদের প্রধান স্পাই। স্যার কোথায় কোথায় গেল, কার সঙ্গে কথা বলল, সব ম্যাডামের কাছে রিপোর্ট করা হবে। ম্যাডাম দরাজ হাতে বখশিশ দেবেন।

২. না নারী

এরা স্বামীর প্রতিটি কথাতেই ‘না’ বলবেন। স্বামী যদি বলেন, আজ ইলিশ। মাছ রান্না করো। স্ত্রী বলবে, না ইলিশ না। ছোট মাছ খাও। স্বামী যদি অবসরে একটা ছবি দেখার জন্যে স্ত্রীর হাতে দিয়ে বলেন, এসো এই ছবিটা দেখি। স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে বলবেন, এটা না অন্য একটা দেখব।

৩. মার্কেট নারী।

এরা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আট ঘন্টাই মার্কেটে মার্কেটে ঘোরেন এবং দুনিয়ার আবর্জনা কিনে ঘর ভর্তি করেন।

৪. নারী চিৎকারক

এরা থাকেন চিঙ্কারের উপর। এদের ধারণা কাজের মেয়েদের কাছ থেকে কাজ আদায় করতে হলে সারাক্ষণই চিৎকার করতে হবে। একসময় এরা স্বাভাবিক কথা বলতেও ভুলে যান। স্বামী-সন্তান সবার সঙ্গেই চিৎকার করতে থাকেন।

৫. নারী দ্রৌপদী (শৌখিন)

এদের বেশির ভাগ সময় কাটে রান্নাঘরে। বই দেখে অদ্ভুত অদ্ভুত রান্না করতে এরা ভলোবাসেন। সেইসব অখাদ্য স্বামীকে গিলতে হয় এবং বিস্মিত হওয়ার মতো ভঙ্গি করে বলতে হয়, অদ্ভুত হয়েছে। রেসিপি কোথায় পেয়েছ? তাদের রান্না করা অদ্ভুত খাদ্যের নমুনা, আনারস করলার প্যান ফ্রাই।

এতক্ষণ রসিকতা করলাম। স্ত্রীরা সংসার নামক অতি জটিল নৌকার একমাত্র মাঝি। যে নৌকা চলছে ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রপাতের ভেতর দিয়ে। তাদের সব ভুল সব ক্রটি স্বামীদের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা করতে হবে।

সংসারের সবচেয়ে সুন্দর সংজ্ঞা দিয়েছেন আমেরিকান কবি রবার্ট ফ্রস্ট। তিনি, ‘Home is a place where, if you want to go there, They have to take you in’.

এমন ‘Home’ কয়জনের ভাগ্যে আছে! রবার্ট ফ্রস্টের ভাগ্যে তো ছিল না।

পাদটিকা

আমার আনন্দময় বেঁচে থাকায় গায়িকা এবং অভিনেত্রী শাওনের বড় ভূমিকা আছে। তার ভূমিকা বলার প্রয়োজন বোধ করছি

১. সে কখনোই কোনো কিছু নিয়ে আমাকে বিরক্ত করে। একদিন সে বলল, একজন লেখক যখন লিখেন না, চুপচাপ বসে থাকেন তখনো তিনি মনে মনে লিখছেন। এই সত্যটা জানি বলেই বিরক্ত করি না।

২. ঢাকা শহরে শাওনের প্রচুর আত্মীয়স্বজন। তাদের অনুষ্ঠান লেগেই আছে, আজ অমুকের বিয়ে তমুকের খত্না। তারা টেলিফোন করে। শাওন বলে, ও গর্তজীবি মানুষ। কোথাও যেতে পছন্দ করে না। কাজেই ও যাবে না। তাকে একা ঘরে ফেলে আমিও যাব না।

৩. আমি যে ফ্ল্যাটে বাস করি সেখানে কোনো বারান্দা ছিল না। বৃষ্টি দেখতে পারতাম না। আকাশ দেখতে পারতাম না। আমি যাতে বৃষ্টি দেখতে পারি তার জন্যে পুরো ফ্ল্যাট সে ভেঙেছে। এখন বৃষ্টি দেখার জন্যে আমার অপূর্ব একটা জায়গা হয়েছে। আমি বেশির ভাগ সময় সেখানে বসে থাকি এবং তারাশংকরের নায়কের মতো বলি–”জীবন এত ছোট কেন?”

লেখার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। সুন্দর একটা কবিতা দিয়ে শেষ করতে চাচ্ছি। এই মুহূর্তে বিশেষ কোনো কবিতা মনে পড়ছে না। কবিতাটি এমন হওয়া উচিত যেখানে বেঁচে থাকার আনন্দ প্রকাশিত হয়। সব আনন্দের সঙ্গেই দুঃখ মেশানো থাকে। সেই দুঃখও যেন থাকে। একটা পাওয়া গেছে–

Where shall I go
To escape from folly?
For now there is love i know.
Or else this melancholly.
Heigh, heigho.

স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন

দুঃস্বপ্ন নিয়ে লেখা সাইকোলজির একটা বই পড়ছিলাম, Nightmare You Hate. মানুষ কী কী দুঃস্বপ্ন দেখে, কেন দেখে–তা-ই বিতং করে লেখা। আমি আমার দুঃস্বপ্নগুলি বইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চাচ্ছিলাম। বই পড়ে জানলাম, মানুষ সবচেয়ে বেশি যে দুঃস্বপ্ন দেখে তা হচ্ছে উঁচু জায়গা থেকে পতন। এই পতনের শেষ নেই। একসময় সে আতঙ্কে জেগে ওঠে।

এই বিশেষ দুঃস্বপ্ন আমি যৌবনকালে দেখতাম। এখন আর দেখি না। বইয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে–এই দুঃস্বপ্ন অসহায়ত্বের প্রতীক। কেউ যদি অসহায় বোধ করে তখনই এই দুঃস্বপ্ন দেখে। হয়তো যৌবনে আমি অসহায় বোধ করতাম।

দ্বিতীয় দুঃস্বপ্ন যা মানুষ প্রায়ই দেখে তা হচ্ছে, জনসমাবেশে নিজেকে নগ্ন অবস্থায় আবিষ্কার করা। নিজের সম্মান নিয়ে যারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, তারাই নাকি এই দুঃস্বপ্ন দেখেন। আমি নিজে কয়েকবার নগ্ন অবস্থায় নিজেকে বিশিষ্টজনদের সঙ্গে দেখেছি। স্বপ্নে পুরো ব্যাপারটা স্বাভাবিক মনে হয়েছে।

আজকাল কেন জানি স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন কোনোটাই দেখি না। গভীর রাতে ঘুমাতে যাই। এমনিতেই আমার ঘুম ভালো হয়, তারপরেও ডাক্তারের পরামর্শে ডিজোপেন নামের একটা ঘুমের ওষুধ খাই। সাইকিয়াট্রিস্ট এবং লেখিকা আনোয়ারা সৈয়দ হক আমি ডিজোপেন খাই শুনে আঁতকে উঠে বলেছিলেন, এটা তো পাগলের ওষুধ। আপনি পাগলের ওষুধ খাচ্ছেন কেন?

আমি বিনয়ের সঙ্গে বলেছি, আমি তো পাগলই!

কড়া ঘুমের ওষুধ মাথা থেকে স্বপ্ন তাড়িয়ে দেয়। যারা ঘুমের ওষুধ খায় তাদের স্বপ্ন দেখার কথা না, তারপরেও কয়েকদিন আগে স্বপ্নে দেখলাম, আমি ক্লাস নিচ্ছি। একদল ছাত্র গম্ভীরমুখে বসে আছে। আমি তাদেরকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের Particle in a box problem পড়াচ্ছি। হঠাৎ লক্ষ করলাম আমার প্যান্টের ফ্লাই ভোলা। প্রবল আতঙ্কে ঘুম ভেঙে গেল। বিছানায় বসে আছি আর ভাবছি, এই স্বপ্নটা কেন দেখলাম? বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা মিস করছি বলে দেখছি? ক্লাসে পড়াচ্ছি ঠিক আছে, প্যান্টের ফ্লাই খোলা কেন? এর অর্থ কী?

সাইকিয়াট্রিস্টরা স্বপ্নের ব্যাখ্যা নিয়ে চিন্তা করতে থাকুন, এই ফাঁকে আমি বলে ফেলি যে অধ্যাপনার বিষয়টা আমি মিস করি। ‘মিস’ করার ভালো বাংলা পাচ্ছি না বলে ইংরেজি শব্দটাই লিখলাম। বাংলায় মিস করা হলো অভাববোধ, দুঃখবোধ। কোনোটাই মূল ইংরেজি শব্দের সঙ্গে যাচ্ছে না।

অধ্যাপনার সময়টা ছিল আমার অর্থকষ্টের কাল। টেলিভিশন কেনার সামর্থ্য ছিল না বলে বাসায় টেলিভিশন ছিল না। হাতের কাছের সমুদ্রে পা ভেজানোর সামর্থ্যও ছিল না। তারপরেও দুঃখে-কষ্টে সময়টা ভালো কেটেছে। কেমিস্ট্রির দুরূহ বিষয় ছাত্রদের কাছে পরিষ্কার করতে পারছি এই আনন্দ তুলনাহীন।

বহিরাগত পরীক্ষক হয়ে তখন বরিশাল-পটুয়াখালি যেতাম। যাওয়া-আসার TA, DAটা সংসারের কাজে আসত। ঢাকা থেকে লঞ্চ ছাড়ত সন্ধ্যাবেলায়। লঞ্চের ডেকে একা বসে থাকার আনন্দও ছিল সীমাহীন। আজকাল একা থাকতে পারি না। সবসময় আশপাশে মানুষজন লাগে। মানসিক এই পরিবর্তন কেন হচ্ছে কে জানে!

আমি বহিরাগত একজামিনার হিসেবে সবচেয়ে বেশি গিয়েছি বরিশাল বি এম কলেজে। আমার থাকার ব্যবস্থা হতো কেমিস্ট্রির ল্যাবরেটরির একটা ঘরে। ঘরভর্তি মাকড়সা। মেঝেতে তেলাপোকা। ল্যাবরেটরি গাছপালার মাঝখানে। সন্ধ্যার পর পরিবেশ ভুতুড়ে হয়ে যেত। অধ্যাপক নিজের বাড়ি থেকে ভদ্রতা করে খাবার আনতেন তা-না। বহিরাগত পরীক্ষকের ‘সেবার জন্যে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা হতো।

রাত নটার পর রসায়নের কোনো এক অধ্যাপকের বাসা থেকে খাবার আসত। রাত নটাতেই মনে হতো নিশুতি রাত। মশারি খাঁটিয়ে মশারির ভেতর বসে থাকতাম। ঘুম আসত না। মাকড়সা-তেলাপোকা ছাড়াও অন্য একটি ভয় আমাকে আচ্ছন্ন করত। সেটা হলো ভূতের ভয়। এতে একটা লাভ অবশ্যি হয়েছে, আমি বেশকিছু ভূতের গল্প লিখেছি।

বিএম কলেজে দিন যাপনের একটা গল্প বলা যেতে পারে। এক সন্ধ্যায় মধ্যবয়স্ক এক মহিলা বিশাল বাহারি কাজ করা পিতলের টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে উপস্থিত হলেন। তাঁর সাজগোজ দেখার মতো। হাতভর্তি সোনার গয়না। (সেই সময় নকল গয়নার চল শুরু হয় নি।) গলায় চন্দ্রহার। ভদ্রমহিলা অতি পরিচিতজনের গলায় বললেন, হুমায়ূন ভাই, ভালো আছেন?

আমি বললাম, জি। আপনাকে চিনতে পারলাম না।

ভদ্রমহিলা তার নাম বললেন। তিনি যে আমার কিছু বই পড়েছেন সে তথ্য জানালেন। টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি পোলাও, কোর্মা, ঝালমাংস এবং ইলিশ মাছ ভাজা এনেছেন তাও শুনলাম।

একজন নতুন প্রায় অখ্যাত লেখকের জন্যে বিপুল আয়োজন আমাকে বিস্মিত করল। ভদ্রমহিলা জানালেন, তিনিও একজন লেখিকা। একটা উপন্যাস সম্প্রতি লিখে শেষ করেছেন। উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। আমাকে পাণ্ডুলিপি পড়তে হবে।

আমি বললাম, আপনি পাণ্ডুলিপি রেখে যান। আমি আগ্রহ নিয়ে পড়ব।

ভদ্রমহিলা বললেন, পাণ্ডুলিপি রেখে গেলে আপনি পড়বেন না। তারচেয়েও বড় কথা, আমি আমার পাণ্ডুলিপি কখনো হাতছাড়া করি না। বলা তো যায় না, কোত্থেকে কী হয়। আমি নিজে আপনাকে পড়ে শোনাব।

কত পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি?

চার শ’ পৃষ্ঠার।

চার শ’ পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি পড়তে আপনার কতক্ষণ লাগবে?

আট ঘণ্টা লাগবে। আমি একজনকে পড়ে শুনিয়েছিলাম। আট ঘণ্টা পঁচিশ মিনিট লেগেছে।

সারা রাত আপনি আমাকে পাণ্ডুলিপি পড়ে শোনাবেন?

আমি খবর নিয়েছি আপনি আরও চারদিন আছেন। আমি রোজ সন্ধ্যায় এসে দু’ঘণ্টা পড়ব। সময় নষ্ট না করে শুরু করে দেই।

আমি তখন পুরোপুরি হতাশ। এই মহিলার হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনো পথ দেখছি না। প্রতি সন্ধ্যায় কালজয়ী কোনো লেখাও আমি লেখকের মুখ থেকে শুনব না।

ভদ্রমহিলা বললেন, হুমায়ূন ভাই, এটা একটা প্রেমের করুণ উপন্যাস। নৌকাতে নায়ক-নায়িকার প্রেম হয়। নৌকা ঝড়ের মধ্যে পড়ে। নায়িকা সাঁতার জানে না। তাকে বাঁচাতে গিয়ে নায়কেরও সলিল সমাধি হয়। দু’জনকে উদ্ধারের পর দেখা যায়, দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে মরে পড়ে আছে। পড়া শুরু করি?

আমি হতাশ গলায় বললাম, করুন।

ভদ্রমহিলা পাঠ শুরু করলেন। তাঁর উপন্যাসের প্রথম বাক্য’নৌকার মাঝি বদর বদর বলে নৌকা ছেড়ে দিল।

আমি বললাম, থামুন। আমি ভাটি অঞ্চলের দিকের মানুষ। জীবনে অসংখ্যবার নৌকায় চড়েছি। কখনো শুনি নি কোনো মাঝি বদর বদর বলে নৌকা ছাড়ৈ। আপনি শুনেছেন?

না।

তাহলে কেন লিখেছেন, মাঝি বদর বদর করে নৌকা ছেড়ে দিল? আপনার পর্যবেক্ষণে ভুল আছে। আপনি আশপাশে কী হয় দেখেন না। আপনার লেখা কিছু হবে বলে আমি মনে করি না। আমি আপনার লেখা শুনব না।

পুরোটা না শুনলে কীভাবে বুঝবেন?

হাঁড়ির ভাত সিদ্ধ হয়েছে কি না জানার জন্যে একটা ভাত টেপাই যথেষ্ট। প্রতিটি ভাত টিপতে হয় না। আপনার ভাত সিদ্ধ হয় নাই।

আপনার নিজের ভাত সিদ্ধ হয়েছে? নিজেকে আপনি কী মনে করেন?

ভদ্রমহিলা যথেষ্ট চেঁচামেচি করে টিফিন ক্যারিয়ার ফেরত নিয়ে চলে গেলেন। আমার মাংস-পোলাও খাওয়া হলো না।

এধরনের সমস্যা আমার এখনো মাঝে মাঝে হয়। তার একটা গল্প বলি। এক তরুণী কবি আমাকে কবিতার বই দিতে এসেছেন। বইটা তাঁকে নিজ হাতে আমাকে দিতে হবে কারণ কবি বইটা আমাকে উৎসর্গ করেছেন। এটি তার প্রকাশিত দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ।

আমি তাকে বাসায় আসতে বললাম। চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়েসী এক তরুণী। বিষাদগ্রস্ত চেহারা। খুবই অস্থিরমতি। স্থির হয়ে তাকাচ্ছেও না।

আমাকে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার জন্যে তাকে ধন্যবাদ দিলাম। সে বলল, স্যার আমি আপনার কিছু সময় নেব। সবগুলি কবিতা আমি নিজে আপনাকে পড়ে শোনাব। আপনি না বললে শুনব না।

বলেই সে অপেক্ষা করল না। বই খুলে কবিতা আবৃত্তি শুরু করল। চটি বই। কবিতা পড়ে শেষ করতে আধঘণ্টার মতো লাগল। আমি বললাম, ভালো হয়েছে।

কবি হতাশ গলায় বলল, ভালো হয়েছে বলে শেষ করলে হবে না। আপনার অনুভূতি পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে হবে। কেন ভালো হয়েছে সেটা বলবেন। প্রতিষ্ঠিত কবিদের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা করবেন।

আমি বললাম, তাহলে বলব ভালো হয় নি।

কেন?

তুমি ছন্দ বলে যে একটা ব্যাপার আছে তা-ই জানো না।

আমি লিখি আমার নিজস্ব ছন্দে। ছন্দের পুরনো ধারণায় আমি বিশ্বাসী না।

কবিতার নানান ছন্দ আছে–এই বিষয়টা কি তুমি জানো?

হুঁ।

দু’একটা ছন্দের নাম বলতে পারবে?

এখন মনে পড়ছে না। শুধু অমিত্রাক্ষর ছন্দের নাম মনে আসছে। মাইকেল মধুসূদনের আবিষ্কার।

পয়ার ছন্দ জানো?

না।

আমি বললাম, “চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন
ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে
কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে
কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।’ এইটি কোন ছন্দে লেখা বলতে পারবে?

না।

আমি বললাম, ছন্দের নাম ‘ললিত’! ললিতের অনেক ভাগ আছে। যেমন, ভঙ্গ ললিত, মিশ্র ললিত, ললিত ত্রিপদী, ললিত চতুষ্পদি, ভঙ্গ ললিত চতুম্পদি।

আপনি কি প্রমাণ করতে চাইছেন যে আপনি ছন্দ বিশেষজ্ঞ?

আমি কিছুই প্রমাণ করতে চাইছি না। একবার আমার ছবির জন্যে গান লেখার প্রয়োজন পড়ল। তখনি ছন্দ বিষয়ে পড়াশোনা করেছি। তোমার প্রতি আমার উপদেশ হলো, ছন্দ বিষয়টা পুরোপুরি জেনে তারপর কবিতা লিখবে।

বরিশালের মহিলা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে চলে গিয়েছিল, এই কবি তার বই ফেরত নিয়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে অপমানসূচক একটি বাক্য বলে গেল। সেই বাক্যটি বলতে ইচ্ছা করছে না। অভিমানী কবি যা ইচ্ছা বলতে পারেন।

.

পাদটিকা

There are, in actual fact man who talk like books. Happily however, there are also books that talk like men.

—Theodor Haecker.

কিছু মানুষ আছে যারা বইয়ের মতো কথা বলে। আনন্দের বিষয় হচ্ছে, কিছু বই আছে মানুষের মতো কথা বলে।

–থিওডর হেকার।

কুইজ

এভারেস্ট বিজয়ী বাংলাদেশী তরুণ মুসা ইব্রাহিমের বাবার নাম কী?

উত্তর : জনাব মোঃ আনসার আলী।

(মুসা ইব্রাহিম! অভিনন্দন, বাপকা ব্যাটা!)

হাসপাতাল

ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালের একটি কেবিন।

কবি শামসুর রাহমান শুয়ে আছেন। তার নাকে অক্সিজেনের নল। গায়ে হাসপাতালের পোশাক নেই। লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে শুয়ে আছেন। গেঞ্জি গলা পর্যন্ত ওঠানো বলে কবির বুক যে হাপরের মতো ওঠানামা করছে তা দেখা যাচ্ছে। কবি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন। তাঁর দৃষ্টিতে প্রাণের স্পর্শ নেই।

হাসপাতালের ঐ কেবিনে আমার সঙ্গে আছেন সৈয়দ শামসুল হক এবং দৈনিক বাংলার সহ-সম্পাদক সালেহ চৌধুরী। আরও কেউ কেউ হয়তো ছিলেন, তাদের নাম মনে করতে পারছি না। আমরা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে কবির রোগযন্ত্রণা দেখছি, হঠাৎ সৈয়দ শামসুল হক নৈঃশব্দ ভঙ্গ করলেন। তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, কবি, আপনাকে বাঁচতেই হবে। আমি আমার আয়ু থেকে খানিকটা আপনাকে দিলাম।

ঘোষণায় নাটকীয়তা ছিল, আবেগ ছিল, যুক্তি ছিল না। একজন তার আয়ুর খানিকটা অন্যকে দিতে পারেন না। বাংলাদেশের সব মানুষ এক মিনিট করে আয়ু কবিকে দান করলে কবি বেঁচে থাকতেন তিনশ’ বছর।

তবে মোঘল সম্রাট বাবর তাঁর পুত্র হুমায়ূনকে নিজের আয়ু দান করেছিলেন। ঘটনাটা এ রকম–হুমায়ূণ মৃত্যুশয্যায়। চিকিৎসকদের সব চিকিৎসা ব্যর্থ। এইসময় সুফি দরবেশ মীর আবুল কাশেম সম্রাটকে বললেন, আপনি আপনার জীবনের একটি অতি প্রিয় জিনিসের বিনিময়ে পুত্রের জীবন ভিক্ষা চাইতে পারেন। এটা হবে শেষ চেষ্টা।

সম্রাট বাবর বললেন, আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস হলো নিজ জীবন। এর বিনিময়ে আমি পুত্রের জীবন ভিক্ষা চাইব।

মীর আবুল কাশেম আঁতকে উঠে বললেন, কী সর্বনাশ! নিজের জীবন না, আপনি বরং বহুমূল্যবান কোহিনূর হীরা দান করে দিন।

সম্রাট বললেন, আমার পুত্রের জীবন কি সামান্য হীরকখণ্ডের তুল্যমূল্য? আমি আমার জীবনের বিনিময়ে পুত্রের জীবন ভিক্ষা চাইব।

সম্রাট তিনবার পুত্রের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে প্রার্থনা করলেন। তিনবার বললেন, পুত্র, তোমার সমস্ত ব্যাধি আমি নিজ দেহে তুলে নিলাম। পরম করুণাময় আমার প্রার্থনা কবুল করো।

হুমায়ূন অবচেতন অবস্থা থেকে চেতন অবস্থায় এসে পানি খাইতে চাইলেন আর বাবর হলেন অসুস্থ।

আমার নিজের জীবনেও এরকম একটি ঘটনা আছে। আমার ছেলে রাশেদ হুমায়ূনের বয়স দুই দিন তাকে ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছে। সে মারা যাচ্ছে। আমি হাসপাতাল থেকে শহীদুল্লাহ হলের বাসায় ফিরে এলাম। অজু করে জায়নামাজে দাঁড়ালাম। আমি ঠিক করলাম, সম্রাট বাবরের মতো নিজের জীবনের বিনিময়ে পুত্রের প্রাণ ভিক্ষা চাইব। জায়নামাজে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হলো এই প্রার্থনা কবুল হবে।

শেষ মুহূর্তে প্রবল ভীতি আমাকে আচ্ছন্ন করল। আমি জীবনের বিনিময়ে জীবনের প্রার্থনা করতে পারি নি। আমি আমার মৃত শিশুপুত্রের কাছে লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী।

নুহাশপল্লীর ঔষধি উদ্যানে একটি স্মৃতিফলক আছে– রাশেদ হুমায়ূন ঔষধি উদ্যান। তার নিচে লেখা–”আমার ছোট্ট বাবাকে মনে করছি।”

আমার শিশুপুত্র তিন দিনের আয়ু নিয়ে অদ্ভুত সুন্দর পৃথিবীতে এসেছিল। সে এই সৌন্দর্যের কিছুই দেখে নি। আমি প্রায়ই নিজেকে এর জন্যে দায়ী করি।

থাকুক পুরনো কথা, হাসপাতালের অন্য গল্প করি।

গল্প-১

স্থান : হৃদরোগ ইনস্টিটিউট। শেরেবাংলা নগর।

আমার বড় ধরনের হার্টঅ্যাটাক হয়েছে। ভর্তি হয়েছি হাসপাতালে। নানান যন্ত্রপাতি এবং মনিটর শরীরে লাগানো। আমার বড় ছেলে নুহাশ আমাকে দেখতে এসেছে। নুহাশের বয়স পাঁচ। সে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মনিটরের দিকে। মনিটরে ঢেউয়ের মতো রেখা দেখা যাচ্ছে।

নুহাশ বলল, বাবা এখানে কী হচ্ছে আমি জানি।

কী হচ্ছে?

এই যে ঢেউয়ের মতো রেখাগুলি দেখছ, একসময় রেখা সমান হয়ে স্ট্রেইট লাইন হবে। তখন তুমি মারা যাবে।

আমি বললাম, ও!

নুহাশ গভীর আগ্রহ নিয়ে মনিটর দেখছে। কখন স্ট্রেইট লাইন হবে কখন তার বাবা মারা যাবে এই প্রতীক্ষা।

গল্প-২

স্থান : বেলিভিউ হাসপাতাল। নিউইয়র্ক।

আমার এনজিওগ্রাম করা হবে। পায়ের ধমনী কেটে একটা সুই ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। সেই সুঁই চলে যাবে হৃৎপিণ্ডে। আমাকে বলা হয়েছে, এই পদ্ধতিতে প্রতি এক হাজারে একজন মারা যায়। আমি কাগজপত্রে সই করে জানিয়েছি মৃত্যু হলে দায়দায়িত্ব হাসপাতালের না, আমার।

অপারেশন হবে ভোর নটায়। আগের রাতে আমার কাছে হাসপাতালের একজন কাউন্সিলর এলেন। তিনি বললেন, তুমি কি মুসলিম?

হ্যাঁ।

কাল ভোরে তোমার অপারেশন। তুমি কি চাও তোমার জন্যে তোমার ধর্মমতে প্রার্থনা করা হোক?

তার মানে কী?

এই হাসপতালে রোগীদের জন্যে প্রার্থনার ব্যবস্থা আছে। প্রার্থনার জন্যে আলাদা ফি আছে। তুমি ফি’র ডলার জমা দিলেই প্রার্থনা ব্যবস্থা হবে।

হাসপাতাল হলো চিকিৎসার জায়গা। প্রার্থনার জায়গা এটা জানতাম না।

কাউন্সিলর বললেন, সমীক্ষায় দেখা গেছে যাদের জন্যে প্রার্থনা করা হয় তাদের আরোগ্যের হার বেশি। এইজন্যেই প্রার্থনা বিভাগ খোলা হয়েছে।

আমি প্রার্থনা করাব না। অর্থের বিনিময়ে প্রার্থনায় আমার বিশ্বাস নেই।

তোমার অপারেশনটি জটিল। তুমি যদি চাও আমি ডিসকাউন্টে প্রার্থনার জন্যে সুপারিশ করতে পারি। একজন মুসলমান আলেম প্রার্থনা করবেন?

ডিসকাউন্টের প্রার্থনাতেও আমার বিশ্বাস নেই।

তুমি কি নাস্তিক?

আমি নাস্তিক না বলেই ডিসকাউন্টের প্রার্থনায় বিশ্বাসী না।

ভোর ন’টায় এনজিওগ্রাম শুরু হলো। ডাক্তার একজন অল্পবয়েসী তরুণী। আমেরিকান না, ভারতীয় তরুণী। সে কিছু একটা গণ্ডগোল করল। ধমনী ফেটে রক্ত ছিটকে বের হয়ে আমার সামনের মনিটরে পড়ল। ডাক্তারের চোখেমুখেও পড়ল। আমি ইংরেজিতে জানতে চাইলাম, কোনো সমস্যা কি হয়েছে?

তরুণী বলল, Stay calm, অর্থাৎ শান্ত থাকো।

আমাকে শান্ত থাকতে বলে সে যথেষ্টই অশান্ত হয়ে পড়ল। একটা পর্যায়ে তাকে সাহায্য করার জন্যে অন্য ডাক্তার চেয়ে পাঠাল। আমি মনে মনে বললাম, ডিসকাউন্টের প্রার্থনা নেওয়াই মনে হয় উচিত ছিল।

গল্প-৩

স্থান : মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতাল। সিঙ্গাপুর। মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চতুর্থবারের মতো আমার এনজিওগ্রাম করা হয়েছে। রাতটা হাসপাতালের কেবিনে কাটাতে হবে। পরদিন ছুটি। খরচ কমানোর জন্যে সিঙ্গেল কেবিন না নিয়ে ডাবল কেবিন নিয়েছি। আমার পাশে আরেকজন অতি বৃদ্ধ চায়নিজ রোগী। দু’জনের মাঝখানে পর্দা আছে। পর্দার ফাঁক দিয়ে আমি বৃদ্ধ রোগীকে দেখতে পাচ্ছি।

রোগীর অবস্থা শোচনীয়। তার মুখে বেলুনের মতো কী যেন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সঙ্গে বেলুন ফুলছে এবং সংকুচিত হচ্ছে। অনেকটা ব্যাঙের গলার ফুলকার মতো। রোগী ঘড়ঘড় শব্দ করছে। ভয়ঙ্কর রকম আহত জন্তু হয়তোবা এরকম শব্দ করে।

রোগীকে দেখার জন্যে একের পর এক তার আত্মীয়স্বজন আসছে। কিছুক্ষণ কেঁদে স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। অনেককে দেখলাম রোগীর বালিশের নিচে টাকা গুঁজে দিচ্ছে। দর্শনার্থীরা কেউ কেউ বাচ্চা নিয়ে আসছে। বাবা-মা বাচ্চাদের। উঁচু করে রোগীকে দেখাচ্ছে। অনেকটা শেষ দেখার মতো। কুমিরের বাচ্চার মতো দেখানো শেষ হওয়ামাত্র বাচ্চাগুলিকে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে আমার দিকে। এরা শুরু করে কিচিরমিচির। কেউ কেউ চেষ্টা করে আমার বিছানায় উঠতে।

একসময় মধ্যবয়স্ক এক মহিলা এসে বিনয়ে নিচু হয়ে আমাকে জানাল, তার দাদা মারা যাচ্ছেন বলে সবাই দেখতে আসছে। আমাকে যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে বলে তাদের লজ্জার সীমা নেই। আমি যেন ক্ষমা করে দেই।

রাত দশটায় নার্স আমার জন্যে ওষুধ নিয়ে এল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ঐ বৃদ্ধের কী হয়েছে?

নার্স বলল, বার্ধক্য ব্যাধি।

অবস্থা কি খারাপ?

যথেষ্টই খারাপ। ঘটনা রাতেই ঘটবে।

আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, কেউ রাতে মারা গেলে তার ডেডবডি কি তোমরা সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যাও, না পরে নাও?

অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা হয়।

আমি বললাম, আমি মৃত মানুষ পাশে নিয়ে কখনো শুয়ে থাকি নি। আমাকে কি অন্য একটা কেবিনে দেওয়া যাবে?

নার্স বলল, অবশ্যই যাবে। তুমি ওষুধ খাও, আমি ব্যবস্থা করছি।

আমি ওষুধ খেলাম। নিশ্চয়ই কড়া কোনো ঘুমের ওষুধ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাঙল ভোরবেলা। আমি আমার নিজের কেবিনেই আছি। পর্দার ওপাশে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কোনো শব্দও নেই। সুনসান নীরবতা। ঘটনা নিশ্চয়ই ঘটে গেছে।

আমি অতি কষ্টে বিছানা থেকে নামলাম। উঁকি দিলাম পাশের বিছানায়। বৃদ্ধ হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে আছে। বৃদ্ধের মুখ হাসিহাসি। সে চামচ দিয়ে স্যুপ খাচ্ছে। আমাকে দেখে বলল, গুড মর্নিং।

আমি বললাম, গুড মর্নিং।

বৃদ্ধ হাত ইশারা করে আমাকে কাছে ডাকল। বিড়বিড় করে চায়নিজ ভাষায় কী, যেন বলল। আমি কাছে এগিয়ে গেলাম। বৃদ্ধ বালিশের নিচে হাত দিয়ে একশ’ সিঙ্গাপুর ডলারের একটা নোট আমার দিকে বাড়িয়ে বলল, টেক টেক টেক। মনে হয় জীবন ফিরে পেয়ে সে মহা আনন্দিত। এই আনন্দের খানিকটা ভাগ আমাকে দিতে চায়। (পাঠকদের কী ধারণা–আমি কি বৃদ্ধের উপহার নিয়েছি, নাকি নেই নি? কুইজ।)

.

পাদটিকা-১

এইবার ইউরোপের অতি উন্নত একটি দেশের অদ্ভুত চিকিত্সার গল্প। দেশটির নাম সুইডেন। সেই দেশে বাঙালি এক মহিলা দাঁতের সমস্যা নিয়ে গেছেন। দাঁতের ডাক্তার পরীক্ষা করে আঁতকে উঠে বললেন, দাঁতের গোড়ায় ভয়ঙ্কর এক জীবাণু পাওয়া গেছে। এই জীবাণু হার্টে চলে যাওয়া মানে হার্ট ফেইলিউর। তিনি ব্যবস্থা দিলেন রোগীর সব দাঁত জরুরি ব্যবস্থায় তুলে ফেলতে হবে। মহিলা শুরু করলেন কান্না। মহিলার মেয়ে একজন ডাক্তার। সে মাকে বলল, মা, তোমার চিকিৎসা হচ্ছে সুইডেনে, এত ভালো চিকিৎসা কোথাও হবে না। দাঁত ফেলতে বলছে ফেলে দাও।

বেচারির সব সুস্থ দাঁত টেনে তুলে ফেলে দেওয়া হলো। তাকে ভর্তি করা হলো ভয়ঙ্কর জীবাণুর চিকিৎসা যে হাসপাতালে হয় সেখানে। ডাক্তররা ভয়ঙ্কর জীবাণুর সন্ধানে লেগে গেলেন। একসময় ঘোষণা করলেন, এই জীবাণুর কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায় নি। ভুল হয়েছে। ভুলের কারণেই সব দাঁত ফেলা হয়েছে। তারা দুঃখিত।

ভদ্রমহিলা হচ্ছেন নির্বাসিত লেখিকা তসলিমা নাসরিনের মা। তসলিমা নাসরিন মা’কে চিকিৎসা করাতে সুইডেনে নিয়ে গিয়েছিলেন।

পাদটিকা-২

আমি কখনোই মনে করি না মানুষ এমন কোনো অপরাধ করতে পারে যার শাস্তি তার কাছ থেকে দেশ কেড়ে নেওয়া। মানুষ মানুষকে ত্যাগ করে। দেশ কখনো তার সন্তানকে ত্যাগ করে না। যারা তসলিমা নাসরিনের রচনা পছন্দ করে না তারা পড়বেন না। তসলিমা নাসরিন যদি বিভ্রান্ত হয়ে থাকেন, তিনি থাকবেন তার বিভ্রান্তি নিয়ে, আমরা কেন তাকে দেশছাড়া করব? কেন বাংলাদেশের একটা মেয়ে ভবঘুরের মতো এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরবে? ভয়ঙ্কর সব যুদ্ধাপরাধী তো ঠিকই বাংলাদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা তো তাদেরকে দেশান্তরী করি নি।

Exit mobile version