উপগ্রহের টেলিফোন এসেছে। কণ্ঠ উত্তেজিত। উত্তেজনার ভেতর চাপা আনন্দ।
হুমায়ূন ভাই! আপনাকে তো শুইয়ে ফেলেছে।
কে শুইয়েছেন?
বদরুদ্দিন উমর।
কোথায় শোয়ালেন?
সমকাল পত্রিকার সেকেন্ড এডিটরিয়েলে। উনি বলেছেন আপনার লেখায় শিক্ষামূলক কিছু নাই।
এটা তো উনি ঠিকই বলেছেন। আমি তো পাঠ্যবই লিখি না। আমার বই শিক্ষামূলক হবে কেন? জীবনে একটাই পাঠ্যবই লিখেছিলাম–কোয়ান্টাম রসায়ন। সম্ভবত উনার চোখ এড়িয়ে গেছে।
না হুমায়ূন ভাই, আপনি জিনিসটা হালকা দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। একটা বাদানুবাদ হওয়া উচিত। আপনি একটা কাউন্টার লেখা দিন। এটা আমার রিকোয়েস্ট।
আমি টেলিফোনের লাইন কেটে দিলাম। রাতের আড্ডায় (Old Fools Club) আমার সমকাল-এর পাতায় শুয়ে পড়ার ঘটনা বললাম। বন্ধুরা আনন্দ পেল। আমার যে-কোনো পতন আমার বন্ধুদের কাছে আনন্দময়। .
এখন শিক্ষা-বিষয়ে বলি। অতি বিচিত্র কারণে বাংলাদেশের মানুষ সব কিছুতেই শিক্ষা খোঁজে। গল্প-উপন্যাসে শিক্ষা, নাটকে-সিনেমায় শিক্ষা। একসময় ঈদে প্রচারিত হাসির নাটকের শুরুতেই আমি লিখে দিতাম- “এই নাটকে শিক্ষামূলক কিছু নেই।”
সাধারণ মানুষ এবং অসাধারণ সমালোকরাই শুধু যে শিক্ষা খোঁজেন তা না, দেশের প্রধানরাও শিক্ষা নিয়ে আগ্রহী। তারাও একে অন্যকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যে নানান ব্যতিক্রমী কর্মকাণ্ড হাতে নেন।
শিক্ষা নিয়ে এত উদ্বেগের পরেও জাতি হিসেবে আমরা ক্রমেই মূর্খ হচ্ছি কেন কে বলবে!
আচ্ছা শিক্ষা আপাতত থাকুক। মহান কালজয়ীরা বর্তমানের কুসাহিত্য নিয়ে চিন্তায় অস্থির হতে থাকুন, আমি ফিরে যাই বইমেলায়। আপনারা কি জানেন, মেলায় প্রকাশিত চমৎকার সব প্রচ্ছদের বইগুলির বেশিরভাগ লেখক প্রবাসী? তারা বৎসরে একবার ডলার পাউন্ড পকেটে নিয়ে দেশে আসেন। প্রকাশকদের সঙ্গে চুক্তি হয়। খরচ তাদের। প্রকাশকরা শুধু বই ছেপে দেবেন। প্রবাসী লেখকদের বইয়ের মোড়ক উন্মোচন খুব ঘটা করে হয়। আমাদের দেশের মন্ত্রীদের হাতে কাজকর্ম নেই বলেই হয়তো মোড়ক উন্মোচন নামক অনুষ্ঠানে তাঁদের ডাকলেই পাওয়া যায়।
দু’বছর আগের কথা। এক প্রবাসী কবির বই বের হয়েছে, তিনি চাচ্ছেন আমি বইটির মোড়ক উন্মোচন করি। আমি বললাম, না। আমি একদিনের জন্যে মেলায় যাই। সেই দিনটা মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে নষ্ট করব না।
ভদ্রলোক এবং তার স্ত্রী অত্যন্ত মন খারাপ করলেন। তাদের মন খারাপ দেখে আমার নিজের মন খারাপ হয়ে গেল। আমি তখন বিকল্প প্রস্তাব দিলাম। আমি বললাম, আপনারা নুহাশপল্লীতে চলে আসুন। নুহাশপল্লীর দিঘিতে আমার একটা নৌকা আছে। আপনি নৌকায় বসে নিজের কবিতা আবৃত্তি করবেন। আমরা দিঘির ঘাটে বসে থাকব। পুরো অনুষ্ঠান ভিডিও করে আপনাকে একটা কপি দেব। সেই ভিডিও আপনি বন্ধুবান্ধবদের দেখাবেন। এরজন্যে আপনাকে একটি পয়সাও খরচ করতে হবে না। নুহাশ চলচ্চিত্র ভিডিও করে দেবে।
ভদ্রলোক আনন্দে অভিভূত হলেন।
যথাসময়ে অনুষ্ঠান হলো। তিনি নৌকায় দাঁড়িয়ে কবিতা আবৃত্তি করছেন। আমাদের ব্যবস্থা দেখে তার চোখে একটু পর পর পানি আসছে। তিনি চোখ মুছছেন। তার স্ত্রীও আমার পাশে বসেই কবিতা শুনছিলেন। তিনি এক পর্যায়ে জলভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে যা বললেন তার সরল বাংলা হলো, তাদের দুজনের জীবনে অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা আজকের অভিজ্ঞতা। তারা সারা জীবন এই সুখস্মৃতি অন্তরে লালন করবেন। তাঁর স্বামীর একটা কবিতার বইও যদি কেউ না কেনে তাতেও কিছুই আর যায় আসে না।
এই প্রবাসী কবির কথা থাকুক, অন্য আরেকজনের গল্প করি। তিনি কানাডা প্রবাসী কবি। তার নাম ইকবাল হাসান। প্রতি বছরই বইমেলায় তার কবিতার বই প্রকাশিত হয়। এই কবি আমাকে একবার ভালো বিপদে ফেলেছিলেন। বিপদের গল্পটি বলা যেতে পারে।
আমি গিয়েছি নিউইয়র্কে। বিশ্বজিৎ সাহা বইমেলার আয়োজন করেছেন। আমি বইমেলার অতিথি। মেলা উপলক্ষে কানাডা থেকে কবি ইকবাল হাসান এসেছেন। তিনি আমাকে ধরে বসলেন, একটা ইন্টারভ্যু তাঁকে দিতেই হবে। আমার নিশ্চয়ই তখন শনির দশা চলছিল, কাজেই রাজি হয়ে গেলাম। ইন্টারভ্যুপর্ব শুরু হওয়া মাত্র বুঝলাম–ঘটনা অন্য। ইকবাল হাসানের প্রশ্নের নমুনা শুনলে পাঠকও বলবেন, ঘটনা অন্য। প্রশ্নের নমুনা–
‘অনেকেই এখন বলছেন আপনি উপন্যাস হিসেবে যা লেখেন তা আসলে অপন্যাস। আপনি কী বলেন?
‘আপনার হালকা লেখাগুলি কি বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে লেখা হয়?’
‘জীবনের গভীর বোধ আপনার লেখায় অনুপস্থিত কেন?’
‘একই গল্প আপনি একটু এদিক ওদিক করে লেখেন। আপনার এই সীমাবদ্ধতার কারণ কী?’
‘আপনার বানানো নাটক-সিনেমা, আপনার বইগুলির মতোই হালকা এবং অগভীর। এর কারণ কী?’
আমি হাসিমুখে সব প্রশ্নের উত্তর দিলাম। তিনি যে উত্তর শুনতে চাইছেন তা-ই বললাম। বললাম, আমার লেখা সস্তা। টাকার জন্যে লেখি–এইসব।
এবারের বইমেলায় (২০১০) ইকবাল হাসান এসেছেন। সমকাল পত্রিকায় কলাম লিখছেন। হঠাৎ সেখানে আমাকে নিয়ে এক লেখা। কী লেখা থাকবে জানি। ভদ্রভাবে গালাগালি। কবিরা সুন্দর কাব্যময় গদ্যে গালাগালি করতে পারেন। ইকবাল হাসানের লেখা পড়ে চমকালাম। ইকবাল হাসান উল্টাগীত ধরেছেন। রচনা পাঠ করে মনে হলো- হুমায়ূন আহমেদ একজন মহান লেখক। যারা তার নিন্দামন্দ করেন তারাও সুযোগ পেলেই গোপনে তার বই পড়েন। ইত্যাদি।