গায়ে গা লাগিয়ে মানুষ হাঁটছে। বই হাতে নিয়ে দেখার সুযোগ নেই। বাচ্চারা ভিড়ে অস্থির হয়ে কাঁদছে। কেউ কেউ হারিয়ে যাচ্ছে। বখাটে ছেলেরা থাকছে যদি সুযোগ বুঝে কোনো তরুণীর গায়ে হাত রাখা যায়। তসলিমা নাসরিন দেশে নেই। তরুণী লাঞ্ছিত হলেও লেখার কেউ নেই। লাঞ্ছিত হলেও ঐতিহ্য তো বজায় থাকবে।
টিভিতে বইমেলা দেখে আমি মাঝে মাঝেই আতঙ্কে অস্থির হয়েছি। যদি আগুন লাগে, যেখানে আগুন লেগেছে সেখানে কি দমকলের গাড়ি পৌঁছতে পারবে? ছোটাছুটি শুরু হলে বাচ্চারা কোথায় যাবে? কলকাতার অতি প্রশস্ত বইমেলাও একবার আগুনে পুড়ে ছাই হয়েছিল। সে-সময় আমি কলকাতার বইমেলায়। কী ভয়ঙ্কর অবস্থা হয়েছিল আমার জানা আছে।
ঐতিহ্য-প্রেমিকদের বলছি, ঐতিহ্যও বদলায়। একসময় আমাদের পূর্বপুরুষরা ধুতি পরতেন। ধুতি পরার ঐতিহ্য থেকে আমরা সরে এসেছি।
আগের লেখকরা ঝর্ণা কলমে লিখতেন। এখন অনেকেই কম্পিউটারে লেখেন। ঝর্ণা কলম নামক ঐতিহ্যের মৃত্যু।
বাংলা একাডেমীর পাশেই বিশাল মাঠ পড়ে আছে। সেই মাঠ কারও চোখে পড়ছে না। আমরা আটকে আছি খুপড়িতে। বাংলা একডেমীর কর্তারা কেন মেলা পরিচালনা করছেন তাও বুঝতে পারছি না। মেলা পরিচালনা করবেন প্রকাশকরা। নীতি তারা নির্ধারণ করবেন।
বইমেলায় হেঁটে বেড়ানো, নতুন প্রকাশিত বই হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখার আনন্দ থেকে বাংলা একাডেমী পাঠককে বঞ্চিত করছে। মেলা তাদের হাতের মুঠোয় রেখে দিয়েই কাজটা করছে।
প্রসঙ্গক্রমে অতীতের এক বইমেলার ঘটনা বলি। আমি একটা স্টলে বসেছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাংলা একডেমীর ডিজি আমার কাছে চলে এলেন। তাঁর নাম, আচ্ছা থাক, নাম বললাম না। ডিজি’র চোখমুখ শক্ত। তিনি বললেন, আপনি মেলায় থাকতে পারবেন না।
আমি অবাক হয়ে বললাম, কেন পারব না?
তিনি বললেন, আপনার কারণে মেলায় বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। দুর্ঘটনা ঘটবে। আপনাকে এক্ষুনি উঠে যেতে হবে।
আমি বললাম, ব্যবস্থা করে দিন যাতে বিশৃঙ্খলা না হয়। লেখক হিসেবে আমার অধিকার আছে মেলায় আসার। বইমেলা শুধু পাঠক-প্রকাশকের মেলা না। লেখকদেরও মেলা।
আপনার সঙ্গে তর্কে যাব না। আপনাকে মেলা ছেড়ে চলে যেতে হবে।
আমি বেশ মন খারাপ করে বাসায় চলে এলাম। তারপর অবশ্য ঘটনা অনেকদূর গেল। অনেক প্রকাশক ঘোষণা করলেন তারা মেলা করবেন না। সংসদে পর্যন্ত বিষয়টি উঠল। বাংলা একাডেমীর ডিজি আমার ধানমণ্ডির বাসায় উপস্থিত হয়ে বলতে শুরু করলেন আমার লেখা তার কত পছন্দ। ইত্যাদি।
আমি মেলায় যাওয়া এরপর থেকে বন্ধই করে দিলাম। এক দিন কিংবা দুদিন শুধু যাই। আমার অবস্থা চিলের মতো। চিল আকাশে ওড়ে, তার মন পড়ে থাকে মাটিতে। আমি আমার ঘরের বারান্দায় বসে থাকি, আমার মন পড়ে থাকে বইমেলায়।
আমি যে ফ্ল্যাটে থাকি তার পাশের ফ্ল্যাটেই থাকেন মাজহারুল ইসলাম, ‘অন্যপ্রকাশ’-এর মালিক। তিনি হুমায়ূন আহমেদ টাইপ বাজারি লেখকদের বই ছেপে কুখ্যাতি অর্জন করেছেন। তার স্টলের সামনে নাকি ভিড় লেগে থাকে। অপরিপক্ক তরুণ-তরুণীরা মাছির মতো ভিড় করে বাজারি লেখকদের বই কিনতে চায়।
ভালো কথা, বাজারি লেখক–বিষয়টা আরও পরিষ্কার করা দরকার। বাজারি লেখক মানে তুচ্ছ লেখক। তেল-সাবান-পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ বিক্রেতা টাইপ লেখক। এদের বই বাজারে পাওয়া যায় বলেও বাজারি। যাদের বই বাজারে পাওয়া যায় না, তাঁদের বাড়িতে কার্টুনভর্তি থাকে, তারা মহান লেখক, মুক্তবুদ্ধি লেখক, কমিটেড লেখক, সত্যসন্ধানী লেখক। তাঁদের বেশিরভাগের ধারণা তারা কালজয় করে ফেলেছেন। এঁরা বাজারি লেখকদের কঠিন আক্রমণ করতে ভালোবাসেন। তাদের আক্রমণে শালীনতা থাকে। তারা সরাসরি কখনো আমার নাম নেন না। তবে বুদ্ধিমান পাঠকরা বুঝে ফেলেন কাকে ধরা হচ্ছে। তাদের আক্রমণের নমুনা, অন্যপ্রকাশের সামনে জনৈক বাজারি লেখকের বইয়ের জন্যে তরুণ-তরুণীর সমাবেশ দেখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে হয়। এরা সৎ সাহিত্য থেকে বঞ্চিত। কষ্টকল্পিত উদ্ভট চরিত্রের গালগল্পে বিভ্রান্ত। বাজারি লেখক এবং তার প্রকাশকের অর্থ জোগান দেওয়া ছাড়া এই তরুণ-তরুণীরা আর কিছুই করছে।
কালজয়ী এইসব মহান লেখকের সঙ্গে মাঝে মাঝে আমার দেখা হয়ে যায়। বেশিরভাগ দেখা হয় দেশের বাইরের বইমেলায়। আমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে তারা কিছুটা বিচলিত বোধ করেন। কেন করেন তা আমার কাছে স্পষ্ট না। এমন একজনের সঙ্গে কথোপকথনের নমুনা–
কালজয়ী : কেমন আছেন?
আমি : জি ভালো।
কালজয়ী : ইদানীং কিছু কি লিখছেন?
আমি : একটা সস্তা প্রেমের উপন্যাস লেখার চেষ্টা করছি। যতটা সস্তা হওয়া দরকার ততটা সস্তা হচ্ছে না বলে অস্বস্তিতে আছি। আপনার দোয়া চাই যেন আরেকটা সস্তা লেখা লিখতে পারি।
কালজয়ী : (গম্ভীর)
আমি : আপনি কি মহান কোনো লেখায় হাত দিয়েছেন?
কালজয়ী : আপনার রসবোধ ভালো। আচ্ছা পরে কথা হবে।
.
কালজয়ীরা আবার স্তুতি পছন্দ করেন। তাঁরা নিজেদের গ্রহ মনে করেন বলেই উপগ্রহ নিয়ে ঘোরাফেরা করতে পছন্দ করেন। গ্রহদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ কখনোই থাকে না, কিন্তু উপগ্রহের সঙ্গে থাকে। উপগ্রহরা উপযাজক হয়েই টেলিফোন করেন। তাদের টেলিফোন পেলে আতঙ্ক বোধ করি। কেন আতঙ্ক বোধ করি তা ব্যাখ্যা করছি–