পরীক্ষা নিতে একবার গেলাম পটুয়াখালি সরকারি কলেজে। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম শিক্ষক হয়েছি। গা থেকে ছাত্রের গন্ধ যায় নি। সিনিয়র শিক্ষকরা এত দূরে পরীক্ষা নিতে আসতে চান না বলেই আমাকে পাঠানো।
কলেজ কম্পাউন্ডের একটা ঘরে আমার থাকার জায়গা। আমার জন্যে আলাদা বাবুর্চি। এই বাবুর্চি মনে হয় লবণ ছাড়া রান্নার কোর্স নিয়েছে। কোনো খাবারেই লবণ হয় না। তবে সে লবণের অভাব পুষিয়ে দিত ভূতের গল্প করে। তাদের বাড়িতে একটি পোষা ভূত আছে। এই ভূতকে যদি বলা হয় চাপকল টিপে পানি বের করতে, সে বাধ্য ছেলের মতো চাপকল টিপে পানি বের করে। ঘর ঝাঁট দেয়। চাপকল উঠানামা করে। কল চাপতে কাউকে দেখা যায় না। বাবুর্চি বলল, স্যার কষ্ট করে যদি আমার বাড়িতে পায়ের ধুলা দেন তাহলে আপনাকে ভূতের খেলা দেখায়ে দিতাম। যেতে হবে রাতে।
রাতেই গেলাম। ভূতের চাপকলে পানি তোলা। উঠান ঝাঁট দেওয়া কিছুই দেখলাম না। বাবুর্চি বলল, আপনি অপরিচিত তো আপনারে দেখে শরম পাইছে। সামনে আসতেছে না।
বাবুর্চি তার বাড়িতে খাবার আয়োজন করে রেখেছিল। প্রতিটি আইটেমের লবণ ঠিক ছিল। খেতেও হয়েছিল অসাধারণ। তার বাড়িতে খাওয়া তপসে মাছের স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে।
ধানমণ্ডির ফ্ল্যাটে কেউ কেউ সরাসরি আমাকে ভূত বা জ্বিন দেখাতে আসেন। একজন এসেছিলেন কক্সবাজার কিংবা দোহাজারি থেকে। তিনি নিজে একজন কবি এবং ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। তিনি বললেন, স্যার আমি জ্বিন দেখাতে পারব না। চর্মচক্ষে তাদের দেখা যায় না। যারা বলে জ্বিন দেখাবে তারা মিথ্যা কথা বলে। তবে আমি জিনের মাধ্যমে খাবার এনে খাওয়াব। আপনি কী খেতে চান বলুন।
আমি বললাম, মুরগির রোস্ট।
জ্বিন জাতি ঝাল জাতীয় খাবার আনে না। মিষ্টি জাতীয় কোনো নাম বলুন।
আমি বললাম, বগুড়ার মিষ্টি দই।
শুকনা খাবারের নাম বলতে হবে। ভেজা খাবার এরা আনে না।
লাড্ডু খেতে পারি। লাড্ডু কি আনতে পারবে?
অবশ্যই পারবে। বাতি নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করতে বলুন। জ্বিনরা আলোতে আসে না।
বাতি নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করা হলো। লাড্ডুর জন্যে অপেক্ষা করতে করতে আধঘণ্টা পার হলো। লাড্ডু পাওয়া গেল না। ভদ্রলোক বললেন, জ্বিন আসতে চাচ্ছে না।
গায়ক এস আই টুটুল একবার কুষ্টিয়া থেকে দুজন জ্বিনসাধক নিয়ে এল। এরা নাকি সুপার জেনুইন। মুহূর্তের মধ্যে জ্বিন হাজির করবে। জ্বিন আমাদের প্রশ্নের উত্তর দেবে। জ্বিন এল না। প্রশ্নের উত্তর অনেক পরের ব্যাপার। দুই জ্বিনসাধক টুটুলকে বলল, স্যারের সঙ্গে এক কঠিন জ্বিন থাকে। এই জ্বিনকে দেখে ভয় পেয়ে তাদের জ্বিন আসে নাই। আমাকে বাদ দিয়ে আসর বসালেই নাকি জ্বিন আসবে। আমি তাতেই রাজি হয়েছি। টুটুল ইউরোপ-আমেরিকা করে বেড়াচ্ছে বলে আসর বসানোর সময় বের করতে পারছে না।
ছোটবেলায় যেসব ভূতের গল্প শুনতাম এখন আর শুনি না। আমার মার আপন চাচির মুখে শুনেছি, জন্মের পর পর জ্বিন বা ভূত তাকে নিয়ে উঁচু তালগাছের মাথায় রেখে দিয়েছিল। সারা গ্রামের মানুষ মশাল-লণ্ঠন জ্বেলে তালগাছ ঘিরেছে। গাছে মই লাগিয়ে শিশুকে নামিয়ে এনেছে। আমার মা বললেন, ঘটনা সত্য। তিনি ছোটবেলা থেকেই শুনছেন।
মাতৃহারা বানর মানবসন্তান চুরি করে গাছে নিয়ে যায়। এমন কিছু কি ঘটেছে?
গ্রামাঞ্চলে জ্বিন বা ভূত তাড়ানোর ওঝাদের একসময় ভালো প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল। এই শ্রেণী এখন মনে হয় উঠে গেছে। গতবার গ্রামে গিয়ে ওঝার সন্ধান করলাম। ওঝাদের কাছ থেকে কিছু মন্ত্র লিখে নেব। গল্প-উপন্যাস লেখায় কাজে দেবে। জ্বিন-ভূতের একজন ওঝাকে পাওয়া গেল। সে তার পুরনো পেশা ছেড়ে দিয়ে রুয়াইল বাজারে পানে খাওয়ার ঝিনুকের চুন বিক্রি করে। তাকে খবর দিয়ে আনা হলো। সে দুঃখের সঙ্গে বলল, পল্লী বিদ্যুতের কারণে জ্বিন-ভূত নাই বললেই হয়। সেই কারণেই সে ওঝগিরি ছেড়ে দিয়েছে। জ্বিন -ভূত তাড়াবার কিছু মন্ত্র তার কাছ থেকে আদায় করার চেষ্টা করলাম। সে মন্ত্র জানাতে রাজি হলো না। সম্ভবত তার। কাছে কোনো মন্ত্র নেই।
আমার শৈশবের কিছু অংশ কেটেছে নানার বাড়ি নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে। সেখানে ভূতের আছর হওয়া এবং ওঝা দিয়ে ভূত তাড়ানো দেখেছি। বেশির ভাগ সময় আছর হতো যুবতী মেয়েদের উপর। ওঝা এসে মন্ত্র-তন্ত্র পাঠ করার পর আছর হওয়া কন্যা যে কাজটি প্রথম করত তা হলো টেনেটুনে শাড়ি খুলে ফেলা। ঘটনা। দেখে বয়স্করা নিশ্চয় মজা পেতেন। আমার কাছে দৃশ্যটা ছিল ভীতিকর। ওঝার সঙ্গে কথোপকথন হতো। মেয়েটিই বিকৃত গলায় কথা বলত।
ওঝা : তুই কে?
মেয়ে : আমি অমুক (একটা নাম বলত। পুরুষের নাম।)
ওঝা : একে ধরেছিস কেন?
মেয়ে : সে সিনান করে আমার গায়ের উপর দিয়ে হেঁটে গেছে। এইজন্যে ধরেছি।
ওঝা তখন মন্ত্র শুরু করতেন। মন্ত্রের সবটাই অশ্লীলতম বাক্যে ভর্তি।
মন্ত্র পাঠ এবং সরিষার দানা ছুঁড়ে মারার পর ভূত চলে যেত। মেয়েটা তখন পরনের খুলে ফেলা শাড়ি দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে কুকুরের মতো চারপায়ে দ্রুত ঘরের দিকে যেত। বেশির ভাগ সময় দরজার চৌকাঠে বাড়ি খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেত।
পুরো বিষয়টা অবদমিত যৌন কামনার প্রকাশ ছাড়া আর কিছুই না। গায়ের কাপড় খুলে ফেলা, আগ্রহ নিয়ে ওঝার অশ্লীল কথাবার্তা শোনার অন্য কারণ নেই। গায়ের কাপড় খুলে ফেলার বিষয়টি এত নিয়মিত ঘটত যে ময়মনসিংহের গ্রাম্য বাগধারায় বিষয়টি উঠে এসেছে। উদাহরণ–”জ্বর হয়ে বৌ নেংটা হইল, সেই থেকে বৌয়ের অভ্যাস হইল।” এই বাগধারার অর্থ একবার প্রবল জ্বরের ঘোরে নতুন বৌ গায়ের কাপড় খুলে ফেলে দিল। কেউ তাকে কিছু না বলায় সে লাই পেয়ে গেছে। এখন অকারণেই সে গায়ের কাপড় খোলে।