বরিশালের মহিলা টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে চলে গিয়েছিল, এই কবি তার বই ফেরত নিয়ে চলে গেল। যাওয়ার আগে অপমানসূচক একটি বাক্য বলে গেল। সেই বাক্যটি বলতে ইচ্ছা করছে না। অভিমানী কবি যা ইচ্ছা বলতে পারেন।
.
পাদটিকা
There are, in actual fact man who talk like books. Happily however, there are also books that talk like men.
—Theodor Haecker.
কিছু মানুষ আছে যারা বইয়ের মতো কথা বলে। আনন্দের বিষয় হচ্ছে, কিছু বই আছে মানুষের মতো কথা বলে।
–থিওডর হেকার।
কুইজ
এভারেস্ট বিজয়ী বাংলাদেশী তরুণ মুসা ইব্রাহিমের বাবার নাম কী?
উত্তর : জনাব মোঃ আনসার আলী।
(মুসা ইব্রাহিম! অভিনন্দন, বাপকা ব্যাটা!)
হাসপাতাল
ঢাকার বক্ষব্যাধি হাসপাতালের একটি কেবিন।
কবি শামসুর রাহমান শুয়ে আছেন। তার নাকে অক্সিজেনের নল। গায়ে হাসপাতালের পোশাক নেই। লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে শুয়ে আছেন। গেঞ্জি গলা পর্যন্ত ওঠানো বলে কবির বুক যে হাপরের মতো ওঠানামা করছে তা দেখা যাচ্ছে। কবি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছেন। তাঁর দৃষ্টিতে প্রাণের স্পর্শ নেই।
হাসপাতালের ঐ কেবিনে আমার সঙ্গে আছেন সৈয়দ শামসুল হক এবং দৈনিক বাংলার সহ-সম্পাদক সালেহ চৌধুরী। আরও কেউ কেউ হয়তো ছিলেন, তাদের নাম মনে করতে পারছি না। আমরা নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে কবির রোগযন্ত্রণা দেখছি, হঠাৎ সৈয়দ শামসুল হক নৈঃশব্দ ভঙ্গ করলেন। তিনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, কবি, আপনাকে বাঁচতেই হবে। আমি আমার আয়ু থেকে খানিকটা আপনাকে দিলাম।
ঘোষণায় নাটকীয়তা ছিল, আবেগ ছিল, যুক্তি ছিল না। একজন তার আয়ুর খানিকটা অন্যকে দিতে পারেন না। বাংলাদেশের সব মানুষ এক মিনিট করে আয়ু কবিকে দান করলে কবি বেঁচে থাকতেন তিনশ’ বছর।
তবে মোঘল সম্রাট বাবর তাঁর পুত্র হুমায়ূনকে নিজের আয়ু দান করেছিলেন। ঘটনাটা এ রকম–হুমায়ূণ মৃত্যুশয্যায়। চিকিৎসকদের সব চিকিৎসা ব্যর্থ। এইসময় সুফি দরবেশ মীর আবুল কাশেম সম্রাটকে বললেন, আপনি আপনার জীবনের একটি অতি প্রিয় জিনিসের বিনিময়ে পুত্রের জীবন ভিক্ষা চাইতে পারেন। এটা হবে শেষ চেষ্টা।
সম্রাট বাবর বললেন, আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস হলো নিজ জীবন। এর বিনিময়ে আমি পুত্রের জীবন ভিক্ষা চাইব।
মীর আবুল কাশেম আঁতকে উঠে বললেন, কী সর্বনাশ! নিজের জীবন না, আপনি বরং বহুমূল্যবান কোহিনূর হীরা দান করে দিন।
সম্রাট বললেন, আমার পুত্রের জীবন কি সামান্য হীরকখণ্ডের তুল্যমূল্য? আমি আমার জীবনের বিনিময়ে পুত্রের জীবন ভিক্ষা চাইব।
সম্রাট তিনবার পুত্রের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে প্রার্থনা করলেন। তিনবার বললেন, পুত্র, তোমার সমস্ত ব্যাধি আমি নিজ দেহে তুলে নিলাম। পরম করুণাময় আমার প্রার্থনা কবুল করো।
হুমায়ূন অবচেতন অবস্থা থেকে চেতন অবস্থায় এসে পানি খাইতে চাইলেন আর বাবর হলেন অসুস্থ।
আমার নিজের জীবনেও এরকম একটি ঘটনা আছে। আমার ছেলে রাশেদ হুমায়ূনের বয়স দুই দিন তাকে ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছে। সে মারা যাচ্ছে। আমি হাসপাতাল থেকে শহীদুল্লাহ হলের বাসায় ফিরে এলাম। অজু করে জায়নামাজে দাঁড়ালাম। আমি ঠিক করলাম, সম্রাট বাবরের মতো নিজের জীবনের বিনিময়ে পুত্রের প্রাণ ভিক্ষা চাইব। জায়নামাজে দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হলো এই প্রার্থনা কবুল হবে।
শেষ মুহূর্তে প্রবল ভীতি আমাকে আচ্ছন্ন করল। আমি জীবনের বিনিময়ে জীবনের প্রার্থনা করতে পারি নি। আমি আমার মৃত শিশুপুত্রের কাছে লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী।
নুহাশপল্লীর ঔষধি উদ্যানে একটি স্মৃতিফলক আছে– রাশেদ হুমায়ূন ঔষধি উদ্যান। তার নিচে লেখা–”আমার ছোট্ট বাবাকে মনে করছি।”
আমার শিশুপুত্র তিন দিনের আয়ু নিয়ে অদ্ভুত সুন্দর পৃথিবীতে এসেছিল। সে এই সৌন্দর্যের কিছুই দেখে নি। আমি প্রায়ই নিজেকে এর জন্যে দায়ী করি।
থাকুক পুরনো কথা, হাসপাতালের অন্য গল্প করি।
গল্প-১
স্থান : হৃদরোগ ইনস্টিটিউট। শেরেবাংলা নগর।
আমার বড় ধরনের হার্টঅ্যাটাক হয়েছে। ভর্তি হয়েছি হাসপাতালে। নানান যন্ত্রপাতি এবং মনিটর শরীরে লাগানো। আমার বড় ছেলে নুহাশ আমাকে দেখতে এসেছে। নুহাশের বয়স পাঁচ। সে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মনিটরের দিকে। মনিটরে ঢেউয়ের মতো রেখা দেখা যাচ্ছে।
নুহাশ বলল, বাবা এখানে কী হচ্ছে আমি জানি।
কী হচ্ছে?
এই যে ঢেউয়ের মতো রেখাগুলি দেখছ, একসময় রেখা সমান হয়ে স্ট্রেইট লাইন হবে। তখন তুমি মারা যাবে।
আমি বললাম, ও!
নুহাশ গভীর আগ্রহ নিয়ে মনিটর দেখছে। কখন স্ট্রেইট লাইন হবে কখন তার বাবা মারা যাবে এই প্রতীক্ষা।
গল্প-২
স্থান : বেলিভিউ হাসপাতাল। নিউইয়র্ক।
আমার এনজিওগ্রাম করা হবে। পায়ের ধমনী কেটে একটা সুই ঢুকিয়ে দেওয়া হবে। সেই সুঁই চলে যাবে হৃৎপিণ্ডে। আমাকে বলা হয়েছে, এই পদ্ধতিতে প্রতি এক হাজারে একজন মারা যায়। আমি কাগজপত্রে সই করে জানিয়েছি মৃত্যু হলে দায়দায়িত্ব হাসপাতালের না, আমার।
অপারেশন হবে ভোর নটায়। আগের রাতে আমার কাছে হাসপাতালের একজন কাউন্সিলর এলেন। তিনি বললেন, তুমি কি মুসলিম?
হ্যাঁ।
কাল ভোরে তোমার অপারেশন। তুমি কি চাও তোমার জন্যে তোমার ধর্মমতে প্রার্থনা করা হোক?