বিএম কলেজে দিন যাপনের একটা গল্প বলা যেতে পারে। এক সন্ধ্যায় মধ্যবয়স্ক এক মহিলা বিশাল বাহারি কাজ করা পিতলের টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে উপস্থিত হলেন। তাঁর সাজগোজ দেখার মতো। হাতভর্তি সোনার গয়না। (সেই সময় নকল গয়নার চল শুরু হয় নি।) গলায় চন্দ্রহার। ভদ্রমহিলা অতি পরিচিতজনের গলায় বললেন, হুমায়ূন ভাই, ভালো আছেন?
আমি বললাম, জি। আপনাকে চিনতে পারলাম না।
ভদ্রমহিলা তার নাম বললেন। তিনি যে আমার কিছু বই পড়েছেন সে তথ্য জানালেন। টিফিন ক্যারিয়ার ভর্তি পোলাও, কোর্মা, ঝালমাংস এবং ইলিশ মাছ ভাজা এনেছেন তাও শুনলাম।
একজন নতুন প্রায় অখ্যাত লেখকের জন্যে বিপুল আয়োজন আমাকে বিস্মিত করল। ভদ্রমহিলা জানালেন, তিনিও একজন লেখিকা। একটা উপন্যাস সম্প্রতি লিখে শেষ করেছেন। উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। আমাকে পাণ্ডুলিপি পড়তে হবে।
আমি বললাম, আপনি পাণ্ডুলিপি রেখে যান। আমি আগ্রহ নিয়ে পড়ব।
ভদ্রমহিলা বললেন, পাণ্ডুলিপি রেখে গেলে আপনি পড়বেন না। তারচেয়েও বড় কথা, আমি আমার পাণ্ডুলিপি কখনো হাতছাড়া করি না। বলা তো যায় না, কোত্থেকে কী হয়। আমি নিজে আপনাকে পড়ে শোনাব।
কত পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি?
চার শ’ পৃষ্ঠার।
চার শ’ পৃষ্ঠার পাণ্ডুলিপি পড়তে আপনার কতক্ষণ লাগবে?
আট ঘণ্টা লাগবে। আমি একজনকে পড়ে শুনিয়েছিলাম। আট ঘণ্টা পঁচিশ মিনিট লেগেছে।
সারা রাত আপনি আমাকে পাণ্ডুলিপি পড়ে শোনাবেন?
আমি খবর নিয়েছি আপনি আরও চারদিন আছেন। আমি রোজ সন্ধ্যায় এসে দু’ঘণ্টা পড়ব। সময় নষ্ট না করে শুরু করে দেই।
আমি তখন পুরোপুরি হতাশ। এই মহিলার হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনো পথ দেখছি না। প্রতি সন্ধ্যায় কালজয়ী কোনো লেখাও আমি লেখকের মুখ থেকে শুনব না।
ভদ্রমহিলা বললেন, হুমায়ূন ভাই, এটা একটা প্রেমের করুণ উপন্যাস। নৌকাতে নায়ক-নায়িকার প্রেম হয়। নৌকা ঝড়ের মধ্যে পড়ে। নায়িকা সাঁতার জানে না। তাকে বাঁচাতে গিয়ে নায়কেরও সলিল সমাধি হয়। দু’জনকে উদ্ধারের পর দেখা যায়, দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে মরে পড়ে আছে। পড়া শুরু করি?
আমি হতাশ গলায় বললাম, করুন।
ভদ্রমহিলা পাঠ শুরু করলেন। তাঁর উপন্যাসের প্রথম বাক্য’নৌকার মাঝি বদর বদর বলে নৌকা ছেড়ে দিল।
আমি বললাম, থামুন। আমি ভাটি অঞ্চলের দিকের মানুষ। জীবনে অসংখ্যবার নৌকায় চড়েছি। কখনো শুনি নি কোনো মাঝি বদর বদর বলে নৌকা ছাড়ৈ। আপনি শুনেছেন?
না।
তাহলে কেন লিখেছেন, মাঝি বদর বদর করে নৌকা ছেড়ে দিল? আপনার পর্যবেক্ষণে ভুল আছে। আপনি আশপাশে কী হয় দেখেন না। আপনার লেখা কিছু হবে বলে আমি মনে করি না। আমি আপনার লেখা শুনব না।
পুরোটা না শুনলে কীভাবে বুঝবেন?
হাঁড়ির ভাত সিদ্ধ হয়েছে কি না জানার জন্যে একটা ভাত টেপাই যথেষ্ট। প্রতিটি ভাত টিপতে হয় না। আপনার ভাত সিদ্ধ হয় নাই।
আপনার নিজের ভাত সিদ্ধ হয়েছে? নিজেকে আপনি কী মনে করেন?
ভদ্রমহিলা যথেষ্ট চেঁচামেচি করে টিফিন ক্যারিয়ার ফেরত নিয়ে চলে গেলেন। আমার মাংস-পোলাও খাওয়া হলো না।
এধরনের সমস্যা আমার এখনো মাঝে মাঝে হয়। তার একটা গল্প বলি। এক তরুণী কবি আমাকে কবিতার বই দিতে এসেছেন। বইটা তাঁকে নিজ হাতে আমাকে দিতে হবে কারণ কবি বইটা আমাকে উৎসর্গ করেছেন। এটি তার প্রকাশিত দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ।
আমি তাকে বাসায় আসতে বললাম। চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়েসী এক তরুণী। বিষাদগ্রস্ত চেহারা। খুবই অস্থিরমতি। স্থির হয়ে তাকাচ্ছেও না।
আমাকে তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার জন্যে তাকে ধন্যবাদ দিলাম। সে বলল, স্যার আমি আপনার কিছু সময় নেব। সবগুলি কবিতা আমি নিজে আপনাকে পড়ে শোনাব। আপনি না বললে শুনব না।
বলেই সে অপেক্ষা করল না। বই খুলে কবিতা আবৃত্তি শুরু করল। চটি বই। কবিতা পড়ে শেষ করতে আধঘণ্টার মতো লাগল। আমি বললাম, ভালো হয়েছে।
কবি হতাশ গলায় বলল, ভালো হয়েছে বলে শেষ করলে হবে না। আপনার অনুভূতি পুরোপুরি ব্যাখ্যা করতে হবে। কেন ভালো হয়েছে সেটা বলবেন। প্রতিষ্ঠিত কবিদের সঙ্গে তুলনামূলক আলোচনা করবেন।
আমি বললাম, তাহলে বলব ভালো হয় নি।
কেন?
তুমি ছন্দ বলে যে একটা ব্যাপার আছে তা-ই জানো না।
আমি লিখি আমার নিজস্ব ছন্দে। ছন্দের পুরনো ধারণায় আমি বিশ্বাসী না।
কবিতার নানান ছন্দ আছে–এই বিষয়টা কি তুমি জানো?
হুঁ।
দু’একটা ছন্দের নাম বলতে পারবে?
এখন মনে পড়ছে না। শুধু অমিত্রাক্ষর ছন্দের নাম মনে আসছে। মাইকেল মধুসূদনের আবিষ্কার।
পয়ার ছন্দ জানো?
না।
আমি বললাম, “চিরসুখী জন ভ্রমে কি কখন
ব্যথিত বেদন বুঝিতে পারে
কী যাতনা বিষে বুঝিবে সে কিসে
কভু আশীবিষে দংশেনি যারে।’ এইটি কোন ছন্দে লেখা বলতে পারবে?
না।
আমি বললাম, ছন্দের নাম ‘ললিত’! ললিতের অনেক ভাগ আছে। যেমন, ভঙ্গ ললিত, মিশ্র ললিত, ললিত ত্রিপদী, ললিত চতুষ্পদি, ভঙ্গ ললিত চতুম্পদি।
আপনি কি প্রমাণ করতে চাইছেন যে আপনি ছন্দ বিশেষজ্ঞ?
আমি কিছুই প্রমাণ করতে চাইছি না। একবার আমার ছবির জন্যে গান লেখার প্রয়োজন পড়ল। তখনি ছন্দ বিষয়ে পড়াশোনা করেছি। তোমার প্রতি আমার উপদেশ হলো, ছন্দ বিষয়টা পুরোপুরি জেনে তারপর কবিতা লিখবে।