১. সে কখনোই কোনো কিছু নিয়ে আমাকে বিরক্ত করে। একদিন সে বলল, একজন লেখক যখন লিখেন না, চুপচাপ বসে থাকেন তখনো তিনি মনে মনে লিখছেন। এই সত্যটা জানি বলেই বিরক্ত করি না।
২. ঢাকা শহরে শাওনের প্রচুর আত্মীয়স্বজন। তাদের অনুষ্ঠান লেগেই আছে, আজ অমুকের বিয়ে তমুকের খত্না। তারা টেলিফোন করে। শাওন বলে, ও গর্তজীবি মানুষ। কোথাও যেতে পছন্দ করে না। কাজেই ও যাবে না। তাকে একা ঘরে ফেলে আমিও যাব না।
৩. আমি যে ফ্ল্যাটে বাস করি সেখানে কোনো বারান্দা ছিল না। বৃষ্টি দেখতে পারতাম না। আকাশ দেখতে পারতাম না। আমি যাতে বৃষ্টি দেখতে পারি তার জন্যে পুরো ফ্ল্যাট সে ভেঙেছে। এখন বৃষ্টি দেখার জন্যে আমার অপূর্ব একটা জায়গা হয়েছে। আমি বেশির ভাগ সময় সেখানে বসে থাকি এবং তারাশংকরের নায়কের মতো বলি–”জীবন এত ছোট কেন?”
লেখার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। সুন্দর একটা কবিতা দিয়ে শেষ করতে চাচ্ছি। এই মুহূর্তে বিশেষ কোনো কবিতা মনে পড়ছে না। কবিতাটি এমন হওয়া উচিত যেখানে বেঁচে থাকার আনন্দ প্রকাশিত হয়। সব আনন্দের সঙ্গেই দুঃখ মেশানো থাকে। সেই দুঃখও যেন থাকে। একটা পাওয়া গেছে–
Where shall I go
To escape from folly?
For now there is love i know.
Or else this melancholly.
Heigh, heigho.
স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্ন
দুঃস্বপ্ন নিয়ে লেখা সাইকোলজির একটা বই পড়ছিলাম, Nightmare You Hate. মানুষ কী কী দুঃস্বপ্ন দেখে, কেন দেখে–তা-ই বিতং করে লেখা। আমি আমার দুঃস্বপ্নগুলি বইয়ের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে চাচ্ছিলাম। বই পড়ে জানলাম, মানুষ সবচেয়ে বেশি যে দুঃস্বপ্ন দেখে তা হচ্ছে উঁচু জায়গা থেকে পতন। এই পতনের শেষ নেই। একসময় সে আতঙ্কে জেগে ওঠে।
এই বিশেষ দুঃস্বপ্ন আমি যৌবনকালে দেখতাম। এখন আর দেখি না। বইয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে–এই দুঃস্বপ্ন অসহায়ত্বের প্রতীক। কেউ যদি অসহায় বোধ করে তখনই এই দুঃস্বপ্ন দেখে। হয়তো যৌবনে আমি অসহায় বোধ করতাম।
দ্বিতীয় দুঃস্বপ্ন যা মানুষ প্রায়ই দেখে তা হচ্ছে, জনসমাবেশে নিজেকে নগ্ন অবস্থায় আবিষ্কার করা। নিজের সম্মান নিয়ে যারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, তারাই নাকি এই দুঃস্বপ্ন দেখেন। আমি নিজে কয়েকবার নগ্ন অবস্থায় নিজেকে বিশিষ্টজনদের সঙ্গে দেখেছি। স্বপ্নে পুরো ব্যাপারটা স্বাভাবিক মনে হয়েছে।
আজকাল কেন জানি স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন কোনোটাই দেখি না। গভীর রাতে ঘুমাতে যাই। এমনিতেই আমার ঘুম ভালো হয়, তারপরেও ডাক্তারের পরামর্শে ডিজোপেন নামের একটা ঘুমের ওষুধ খাই। সাইকিয়াট্রিস্ট এবং লেখিকা আনোয়ারা সৈয়দ হক আমি ডিজোপেন খাই শুনে আঁতকে উঠে বলেছিলেন, এটা তো পাগলের ওষুধ। আপনি পাগলের ওষুধ খাচ্ছেন কেন?
আমি বিনয়ের সঙ্গে বলেছি, আমি তো পাগলই!
কড়া ঘুমের ওষুধ মাথা থেকে স্বপ্ন তাড়িয়ে দেয়। যারা ঘুমের ওষুধ খায় তাদের স্বপ্ন দেখার কথা না, তারপরেও কয়েকদিন আগে স্বপ্নে দেখলাম, আমি ক্লাস নিচ্ছি। একদল ছাত্র গম্ভীরমুখে বসে আছে। আমি তাদেরকে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের Particle in a box problem পড়াচ্ছি। হঠাৎ লক্ষ করলাম আমার প্যান্টের ফ্লাই ভোলা। প্রবল আতঙ্কে ঘুম ভেঙে গেল। বিছানায় বসে আছি আর ভাবছি, এই স্বপ্নটা কেন দেখলাম? বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনা মিস করছি বলে দেখছি? ক্লাসে পড়াচ্ছি ঠিক আছে, প্যান্টের ফ্লাই খোলা কেন? এর অর্থ কী?
সাইকিয়াট্রিস্টরা স্বপ্নের ব্যাখ্যা নিয়ে চিন্তা করতে থাকুন, এই ফাঁকে আমি বলে ফেলি যে অধ্যাপনার বিষয়টা আমি মিস করি। ‘মিস’ করার ভালো বাংলা পাচ্ছি না বলে ইংরেজি শব্দটাই লিখলাম। বাংলায় মিস করা হলো অভাববোধ, দুঃখবোধ। কোনোটাই মূল ইংরেজি শব্দের সঙ্গে যাচ্ছে না।
অধ্যাপনার সময়টা ছিল আমার অর্থকষ্টের কাল। টেলিভিশন কেনার সামর্থ্য ছিল না বলে বাসায় টেলিভিশন ছিল না। হাতের কাছের সমুদ্রে পা ভেজানোর সামর্থ্যও ছিল না। তারপরেও দুঃখে-কষ্টে সময়টা ভালো কেটেছে। কেমিস্ট্রির দুরূহ বিষয় ছাত্রদের কাছে পরিষ্কার করতে পারছি এই আনন্দ তুলনাহীন।
বহিরাগত পরীক্ষক হয়ে তখন বরিশাল-পটুয়াখালি যেতাম। যাওয়া-আসার TA, DAটা সংসারের কাজে আসত। ঢাকা থেকে লঞ্চ ছাড়ত সন্ধ্যাবেলায়। লঞ্চের ডেকে একা বসে থাকার আনন্দও ছিল সীমাহীন। আজকাল একা থাকতে পারি না। সবসময় আশপাশে মানুষজন লাগে। মানসিক এই পরিবর্তন কেন হচ্ছে কে জানে!
আমি বহিরাগত একজামিনার হিসেবে সবচেয়ে বেশি গিয়েছি বরিশাল বি এম কলেজে। আমার থাকার ব্যবস্থা হতো কেমিস্ট্রির ল্যাবরেটরির একটা ঘরে। ঘরভর্তি মাকড়সা। মেঝেতে তেলাপোকা। ল্যাবরেটরি গাছপালার মাঝখানে। সন্ধ্যার পর পরিবেশ ভুতুড়ে হয়ে যেত। অধ্যাপক নিজের বাড়ি থেকে ভদ্রতা করে খাবার আনতেন তা-না। বহিরাগত পরীক্ষকের ‘সেবার জন্যে ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে চাঁদা তোলা হতো।
রাত নটার পর রসায়নের কোনো এক অধ্যাপকের বাসা থেকে খাবার আসত। রাত নটাতেই মনে হতো নিশুতি রাত। মশারি খাঁটিয়ে মশারির ভেতর বসে থাকতাম। ঘুম আসত না। মাকড়সা-তেলাপোকা ছাড়াও অন্য একটি ভয় আমাকে আচ্ছন্ন করত। সেটা হলো ভূতের ভয়। এতে একটা লাভ অবশ্যি হয়েছে, আমি বেশকিছু ভূতের গল্প লিখেছি।