ডাক্তার বললেন, হ্যাঁ।
ইনজেকশন দেওয়া হলো। আমার ভয় কেটে গেল। ভয় কাটানোর এই ওষুধ টেবলেট আকারে পাওয়া গেলে ভালো হতো। ভয় পাচ্ছি, চট করে একটা টেবলেট গিলে ফেলা।
ভয়কে আমি মোটামুটি জয় করেছি এটি বলা যেতে পারে। অপমান’ জয় করতে পারি নি। আনন্দে বেঁচে থাকার জন্যে অপমান জয় করা অতি জরুরি। লেখকজীবনে আমাকে নানান ধরনের অপমানের ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে। এখনো যাচ্ছি। চামড়া গণ্ডারের কাছাকাছি করে ফেলেছি। এখন লেখালেখি নিয়ে অপমান গায়ে লাগে না। তবে পুত্রকন্যাদের অপমান গায়ে লাগে। তখন বেঁচে থাকা খুব আনন্দময় মনে হয় না।
একটা ঘটনা বলা যেতে পারে।
আমার মেজো মেয়ে শীলা আহমেদ। ইকনমিক্সে খুব ভালো রেজাল্ট করে পাস করেছে। তাকে অভিনন্দন জানিয়ে একগুচ্ছ ফুল এবং এক প্যাকেট মিষ্টি পাঠালাম। সে থাকে ভাইবোনদের নিয়ে তার মা’র সঙ্গে। আমার সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ নেই। দ্বিতীয় বিয়ে করায় বাবার প্রতি তাদের কঠিন রাগ।
ফুল পাঠানোর এক ঘণ্টার মধ্যে ফুল এবং মিষ্টির প্যাকেট ফেরত এল। সঙ্গে শীলার কঠিন এক নোট–
বাবা,
ফুল-মিষ্টি ফেরত পাঠালাম। একটা মিষ্টি ভুলে খেয়ে ফেলেছি। সরি।
ইতি
শীলা
ভুলে একটা মিষ্টি খেয়ে ফেলার মধ্যে যে কৌতুক আছে তা-ই আমাকে অপমান থেকে রক্ষা করল। আমি অনেকক্ষণ হো হো করে হাসলাম।
আধুনিক মানুষ যেসব কাল্পনিক ব্যাধিতে আক্রান্ত হন তার একটির নাম ভালো না-লাগা রোগ। এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির কিছুই ভালো লাগে না। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে, বৃষ্টি ভালো লাগে না। আকাশ ভেঙে জোছনা নেমেছে, জোছনা ভালো লাগে না। বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গ ভালো লাগে না।
আমার সবই ভালো লাগে। উদাহারণ দেই।
৮ জুলাই বাংলাদেশ-ইংল্যান্ড ক্রিকেট খেলা। আমার জুলাইয়ের এক তারিখ থেকে ভালো লাগতে শুরু করে। এই তো আর কয়েকটা মাত্র দিন, তারপর আরাম করে ক্রিকেট খেলা দেখব। এক সপ্তাহ আগে থেকেই আনন্দ শুরু।
ভিডিওর দোকান থেকে পছন্দের ভিডিও কিনে আনা হয়েছে। আলাদা সাজানো আছে। কোনো একসময়ে ছবি দেখা হবে, এই চিন্তাই আনন্দের।
পড়ার জন্যে প্রচুর বই আছে। যে-কোনো একটা হাতে নিলেই জগৎ-সংসার ভুলে যাওয়া। ছোটবেলার কথা মনে আছে, ভালো কোনো বই হাতে এসেছে (তখনকার ভালো বই মানে ডিটেকটিভ বই, কিরীটি রায়, দস্যু মোহন…) বইটা গোগ্রাসে পড়ার কথা, পড়ছি না। পড়লেই শেষ হয়ে যাবে। এক পাতা দু’পাতা করে পড়া। শিশুর হাতের সন্দেশের মতো। সে সন্দেশ হাতে নিয়ে ঘুরছে। মাঝে মাঝে শুকে দেখছে। খাচ্ছে না। খেলেই তো শেষ হয়ে যাবে।
আনন্দময় বেঁচে থাকার অন্যতম প্রধান শর্ত ভালো সঙ্গিনী। প্রাচীনকালে স্ত্রীদের তিন ভাগে ভাগ করা হতো
১. ঘর জ্বালানি, পাড়া জ্বালানি
(এরা ঘর জ্বালায়, পাড়াপ্রতিবেশিকে জ্বালায়)
২. ঘর জ্বালানি, পাড়া ভালানি। ৩. ঘর ভালানি, পাড়া ভালানি।
(আদর্শ স্ত্রী)
এই সময়ে, ফ্ল্যাট বাসের যুগে, পাড়া বলে কিছু নেই। সবই ঘরকেন্দ্রিক। আমি এই সময়ের স্ত্রীদের কয়েকটা ভাগ করেছি।
১. সন্দেহ নারী
এরা স্বামীর মোবাইল চেক করবে। স্বামী বাইরে থেকে ফিরলে শার্ট খুঁকে দেখবে, শার্টে কোনো অপরিচিত গন্ধ আছে কি না। কিংবা লম্বা চুল লেগে আছে কি না। গাড়ির ড্রাইভার তাদের প্রধান স্পাই। স্যার কোথায় কোথায় গেল, কার সঙ্গে কথা বলল, সব ম্যাডামের কাছে রিপোর্ট করা হবে। ম্যাডাম দরাজ হাতে বখশিশ দেবেন।
২. না নারী
এরা স্বামীর প্রতিটি কথাতেই ‘না’ বলবেন। স্বামী যদি বলেন, আজ ইলিশ। মাছ রান্না করো। স্ত্রী বলবে, না ইলিশ না। ছোট মাছ খাও। স্বামী যদি অবসরে একটা ছবি দেখার জন্যে স্ত্রীর হাতে দিয়ে বলেন, এসো এই ছবিটা দেখি। স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে বলবেন, এটা না অন্য একটা দেখব।
৩. মার্কেট নারী।
এরা চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আট ঘন্টাই মার্কেটে মার্কেটে ঘোরেন এবং দুনিয়ার আবর্জনা কিনে ঘর ভর্তি করেন।
৪. নারী চিৎকারক
এরা থাকেন চিঙ্কারের উপর। এদের ধারণা কাজের মেয়েদের কাছ থেকে কাজ আদায় করতে হলে সারাক্ষণই চিৎকার করতে হবে। একসময় এরা স্বাভাবিক কথা বলতেও ভুলে যান। স্বামী-সন্তান সবার সঙ্গেই চিৎকার করতে থাকেন।
৫. নারী দ্রৌপদী (শৌখিন)
এদের বেশির ভাগ সময় কাটে রান্নাঘরে। বই দেখে অদ্ভুত অদ্ভুত রান্না করতে এরা ভলোবাসেন। সেইসব অখাদ্য স্বামীকে গিলতে হয় এবং বিস্মিত হওয়ার মতো ভঙ্গি করে বলতে হয়, অদ্ভুত হয়েছে। রেসিপি কোথায় পেয়েছ? তাদের রান্না করা অদ্ভুত খাদ্যের নমুনা, আনারস করলার প্যান ফ্রাই।
এতক্ষণ রসিকতা করলাম। স্ত্রীরা সংসার নামক অতি জটিল নৌকার একমাত্র মাঝি। যে নৌকা চলছে ঝড়-বৃষ্টি-বজ্রপাতের ভেতর দিয়ে। তাদের সব ভুল সব ক্রটি স্বামীদের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমা করতে হবে।
সংসারের সবচেয়ে সুন্দর সংজ্ঞা দিয়েছেন আমেরিকান কবি রবার্ট ফ্রস্ট। তিনি, ‘Home is a place where, if you want to go there, They have to take you in’.
এমন ‘Home’ কয়জনের ভাগ্যে আছে! রবার্ট ফ্রস্টের ভাগ্যে তো ছিল না।
পাদটিকা
আমার আনন্দময় বেঁচে থাকায় গায়িকা এবং অভিনেত্রী শাওনের বড় ভূমিকা আছে। তার ভূমিকা বলার প্রয়োজন বোধ করছি