আমাদের সময় ‘রেইনি ডে’ বলে একটা ব্যাপার ছিল। জটিল বৃষ্টি হলে স্কুল ছুটি। হেডস্যার ভাব করতেন ছুটি দিতে গিয়ে তিনি মহা বিরক্ত। কিন্তু তার মুখেও থাকত চাপা আনন্দ। বৃষ্টি তার আনন্দ সবার মধ্যেই ছড়িয়ে দেয়।
আজকালকার ইংরেজি স্কুলের শহুরে ছেলেমেয়েরা এই আনন্দ থেকে বঞ্চিত। তারা গাড়ি করে স্কুলে আসে গাড়ি করে চলে যায়। ঝড়-বৃষ্টি তাদের স্পর্শ করে না।
যে কথা বলছিলাম, বৃষ্টির ব্যাপারে আমি নেশাগ্রস্ত। বৃষ্টি হলে আমি জলধারায় নিজেকে সমর্পণ করব–এটা নিপাতনে সিদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নুহাশপল্লী এবং নুহাশ চলচ্চিত্রের স্টাফরা বিষয়টায় খুবই আনন্দ পায়। অতিথিদের সঙ্গে তাদের আলাপ-আলোচনা–
‘বৃষ্টি নামছে আর স্যার ঘরে বসা, এই জিনিস হবে না। তখন স্যাররে যদি তালাবন্ধ করে রাখেন স্যার তালা ভেঙে বের হয়ে যাবে। যতক্ষণ বৃষ্টি থাকবে ততক্ষণ স্যার বৃষ্টিতে ব্যাঙের মতো লাফালাফি করবে।‘
সমস্যা হয়েছে ইদানীং বৃষ্টিতে নামতে ইচ্ছা করে না। নিশ্চয়ই বয়স ফ্যাক্টর। তারপরেও বাধ্য হয়ে নামি। না নামলে আমার স্টাফদের ইজ্জত থাকে না।
গত বর্ষায় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। আমি আমার ঘরে বসে আছি। রিডার্স ডাইজেস্টের একটা পুরনো সংখ্যায় চোখ বুলাচ্ছি, দরজা খুলে নুহাশপল্লীর ম্যানেজার বুলবুল ঢুকল। উত্তেজিত গলায় বলল, স্যার মনে হয় খেয়াল করেন নাই। বিরাট বৃষ্টি। ভিজবেন না?
আমি বই বন্ধ করতে করতে বললাম, আসছি।
পুকুরে নৌকা রেডি করেছি যদি নৌকায় বসে বৃষ্টি দেখতে চান।
পুকুরপাড়ের দিকে যাব, তোমরা দলবেঁধে পিছে পিছে আসবে না। আমি বৃষ্টিতে ভিজছি এটা হা করে দেখার কিছু নাই।
অবশ্যই নাই। আমরা দীঘির দিকে যাব না।
বৃষ্টিতে নেমেই যৌবনকালের মাহাত্ম বুঝলাম। তখন বৃষ্টির আনন্দে অভিভূত হতাম এখন থরথর করে শীতে কাঁপছি। দাঁত কিড়মিড় করা শুরু করেছে। যাচ্ছি পুকুরপাড়ের দিকে। পরিকল্পনা হলো, শ্বেতপাথরের ঘাটে বসে বৃষ্টি দেখব। ঘাটে বসে আছি। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বিদ্যুৎ চমকানোর কিছুক্ষণ পর বজ্রপাতের শব্দ। ঐ যে আলোর গতি এবং শব্দের গতির পার্থক্য, নাটক সিনেমায় অবশ্যি বিদ্যুতের ঝলক এবং বজ্রপাতের শব্দ একসঙ্গে দেখানো হয়। বিদ্যুৎচমকের পর পর বজ্রপাতের শব্দের জন্যে অপেক্ষা করার অদ্ভুত টেনশানও উপভোগ করার মতো ব্যাপার। শব্দটা বড় হবে, না ছোট হবে? অল্পক্ষণ হবে নাকি অনেকক্ষণ?
বজ্রপাতের অপেক্ষা করছি হঠাৎ আমার ভেতরের সিক্সথ সেন্স আমাকে সতর্ক করল। আমি সঙ্গে সঙ্গে ঘাটে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার ছয় থেকে সাত হাত দূরে একটা সুপারি গাছের উপর বজ্রপাত হলো। গাছ সঙ্গে সঙ্গে পুড়ে কয়লা।
আমি প্রথম এত কাছে বজ্রপাত দেখলাম। বজ্রপাতের আলো দূর থেকে নীল দেখা যায়। খুব কাছ থেকে এই আলো কিন্তু গাঢ় কমলা।
বজ্রপাতে মৃত্যু না হওয়ায় একটি কারণে যথেষ্ট সন্তোষ লাভ করলাম– আমাকে আল্লাহ সরাসরি শাস্তি দিয়েছেন এটা এখন কেউ বলবে না। প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, অতি অতি দুষ্টদের আল্লাহপাক বজ্রপাতের মাধ্যমে সরাসরি শাস্তি দেন।
উদাহরণ সিরাজউদ্দৌলার হত্যাকারী মিরন। তার ঘটনা এরকম– সিরাজউদ্দৌলার আপন খালা ঘসেটি বেগম বজরায় করে বুড়িগঙ্গা নদী পার হচ্ছেন। ব্যবস্থা করে দিয়েছে মিরন। ঘসেটি বেগম হঠাৎ দেখলেন, মাঝনদীতে বজরা আসামাত্র নৌকার মাঝিমাল্লারা বজরা ফেলে ঝাঁপিয়ে বুড়িগঙ্গায় পড়ল এবং প্রাণপণে সাঁতরাতে লাগল তীরের দিকে। বজরার নিচ ফুটো করা হয়েছে। বজরা পানিতে ডুবতে শুরু করেছে। ঘসেটি বেগম মিরনের ষড়যন্ত্র বুঝতে পারলেন। তিনি বজরার ছাদে উঠে চিৎকার করে বললেন, মিরন! তুই মারা যাবি বজ্রাঘাতে।
ইতিহাস বলে বজ্রপাতের কারণেই মিরনের মৃত্যু হয়েছে। আমার কথা হচ্ছে, আল্লাহপাক কি সরাসরি শাস্তি দেন? যদি দিতেন তাহলে পৃথিবীর চেহারা অন্যরকম হতো। অতি দুষ্টলোকদের আমি কখনোই শাস্তি পেতে দেখি নি। তারা পরম সুখে জীবন পার করে। এক পর্যায়ে মাদ্রাসা মসজিদ বানায় বলে পরকালেও হয়তো তারা পরম সুখে বাস করবে।
আল্লাহপাক সম্বন্ধে আমাদের কিছু ভ্রান্ত ধারণা আছে। যেমন বলা হয় নর নারীর বিবাহের ব্যাপারটা তিনি দেখেন। Bible-এ এই কথা আছে–Marriges are made in heaven.
আমার এক বন্ধু চার-পাঁচটা বিয়ে করেছেন (সঠিক সংখ্যা রহস্যাবৃত) এবং ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ কোনো স্ত্রী তাকে সুখ দিতে পারে নি। বর্তমানে সুখের জন্যে তিনি স্ত্রীর বিকল্পের সন্ধানে ব্যস্ত। এখন তিনি যদি বলেন, বিয়ে-শাদি তো আল্লাহর হাতে। উনি যা ঠিক করেছেন আমার ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে–তাহলে কি চলবে?
ইসলামের দুটি ধারা। এক ধারা বলছে Free will-এর কথা, অর্থাৎ মানুষকে বিবেচনাশক্তি দিয়ে পাঠানো হয়েছে। আরেক দল ফ্রি উইল অস্বীকার করেন। তারা বলেন, সবই পূর্বনির্ধারিত। এই ক্ষেত্রে তারা সূরা বনি ইসরাইলের একটি আয়াত উল্লেখ করেন
“আমি তোমাদের ভাগ্য তোমাদের গলায় হারের মতো ঝুলাইয়া দিয়াছি। ইহা আমার পক্ষে সম্ভব।”
বলা হয়ে থাকে পাঁচটা জিনিস আল্লাহপাক সরাসরি নিজের কনট্রোলে রেখেছেন। যেমন–
১. হায়াত ২. মৃত্যু ৩. ধনদৌলত ৪. রিজিক ৫. বিবাহ