কী আশ্চর্য! একের পর এক বইয়ের নাম লিখে যাচ্ছি কেন? আমি স্যুটকেসে কী সব বই ভরেছি তা পাঠকদের জানানোর প্রয়োজন কি আছে?
কোনোই প্রয়োজন নেই। কী ধরনের বই আমি পড়তে পছন্দ করি, কেন করি–তা জানানো অর্থহীন। পাঠাভ্যাসের রুচি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়।
এখন অন্য প্রসঙ্গ। আমি নানা ধর্মগ্রন্থ ঘেvছ একটা বিষয় জানার জন্যে বেহেশত বা স্বর্গে কি কোনো লাইব্রেরি থাকবে? সুখাদ্যের বর্ণনা আছে, অপূর্ব দালানের কথা আছে, উৎকৃষ্ট মদ্যের কথা আছে, রূপবতী তরুণীর কথা আছে, বহুমূল্য পোপাশাকের কথা আছে, সঙ্গীতের কথা আছে। লাইব্রেরির কথা নেই।
লাইব্রেরি হচ্ছে মানুষের চিন্তা এবং জ্ঞানের ফসল। বেহেশতে হয়তো মানুষের চিন্তা এবং জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। সেখানকার চিন্তা অন্য, জ্ঞান অন্য। বিশুদ্ধ চিন্তা, বিশুদ্ধ জ্ঞান।
অবশ্যপাঠ্য বইয়ের প্রথম তালিকা। প্রিয় লেখক বিভূতিভূষণকে দিয়ে শুরু।
লেখক : বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
লেখা–১. পথের পাঁচালি ২. দৃষ্টি-প্রদীপ ৩. আরণ্যক ৪. ইছামতি ৫. দেবযান
.
পাদটিকা
Books are delightful society. If you go into a room filled with books, even without taking them down from their shelves, they seem to speak to you, to welcome you.
-William F Gladstone
বন্দুক-মানব
গানম্যানের বাংলা করলাম ‘বন্দুক-মানব’। ঘন বাংলা হয় নি, পাতলা বাংলা হয়েছে। ‘গানম্যানে’ যে কঠিন ভাব আছে, ‘বন্দুক-মানবে’ তা নেই। এখানে মানব শব্দটাই প্রাধান্য পেয়েছে। বন্দুক হয়েছে গৌণ। বাংলা ভাষার এ এক মজার খেলা।
অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি যেমন, মন্ত্রী-মিনিস্টার, দেশের প্রধান, রাজনৈতিক নেতাদের সরকার গানম্যান দেয়। গানম্যানরা শাদা পোশাকে থাকে। তাদের পকেটে থাকে আধুনিক মারণাস্ত্র।
বিজ্ঞাপনে দেখি লাইফবয় সাবান জীবাণু থেকে সুরক্ষা দেয়। গানম্যানরাও গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের সুরক্ষা দেন।
এক সকালের কথা। থাকি ‘দখিন হাওয়া’র ফ্ল্যাটে। সম্পূর্ণ ‘একা’। একজন বাবুর্চি ছিল, সে রাত একটা-দুটায় আমি ডিনার খাই দেখে কাউকে কিছু না-বলে (এবং তার পাওনা বেতন না নিয়ে চলে গেছে। আমি হাতমুখ ধুয়ে এককাপ চা বানিয়ে পত্রিকা নিয়ে বসেছি, তখন ঘরে সুশ্রী চেহারার এক যুবক ঢুকল। তার গায়ের শার্ট দামি, প্যান্ট দামি, জুতাজোড়াও চকচক করছে। তার গা থেকে সেন্টের গন্ধ আসছে।
আমি বললাম, কী ব্যাপার?
যুবক বলল, স্যার আমি গানম্যান।
গানম্যান খুব ভালো কথা। আমার কাছে কী?
স্যার, আমি আপনার গানম্যান।
পানি খেতে গিয়ে লোকে বিষম খায়, আমি চায়ে চুমুক দিয়ে বিষম খেলাম। চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে বললাম, কোথাও কোনো ভুল হয়েছে। আমার কোনো গানম্যান নেই। থাকার কথাও না।
কোনো ভুল হয় নাই স্যার। এই যে আমার পরিচয়পত্র। পুলিশ। হেডকোয়ার্টার থেকে আপনাকে একটা চিঠিও দেওয়া হয়েছে। এই যে চিঠি।
চিঠি পড়ে দেখি ঘটনা সত্যি। সরকার আমার জন্যে গানম্যানের ব্যবস্থা করেছে। গানম্যান সার্বক্ষণিকভাবে আমার সঙ্গে থাকবে। আমাকে সুরক্ষা দেবে।
আমি বললাম, হলি কাউ!
গানম্যান বলল, কী বললেন বুঝতে পারলাম না।
আমি বললাম, বুঝতে হবে না। ঘরে সিগারেট নেই বলে সিগারেট খেতে পারছি না। তুমি এক প্যাকেট সিগারেট কিনে আনতে পারবে?
অবশ্যই পারব স্যার।
গানম্যান সিগারেট কিনতে গেল, আমি পরিস্থিতি নিয়ে ভাবতে বসলাম।
গানম্যান নিয়ে ঘোরার মধ্যে আত্মশ্লাঘার বিষয় আছে। নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবা এবং অন্যের কাছে গুরুত্বপূর্ণ করা। এই পরিস্থিতিতে আমি কী করব বুঝতে পারছি না। গানম্যানের আনা সিগারেট টেনেও মাথা পরিষ্কার হলো না। আমি পুলিশ হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আমি একজন লেখক মানুষ। লেখক ঘুরবে ঝোলা নিয়ে, ঝোলাতে থাকবে কাগজ-কলম। লেখক কখনো গানম্যান নিয়ে ঘুরবে না। আপনি গানম্যান উঠিয়ে নিন।
কয়েকদিন থাকক। তারপর আপনার কথামতো উঠিয়ে নিব।
কয়েকদিন শুনে রাজি হলাম, সেই কয়েকদিন তিন বছর পর্যন্ত গড়াল। যাই হোক, প্রথম দিনের কথা বলি। দুপুর তিনটার দিকে গানম্যান বলল, স্যার দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা কী?
খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নাই। পাশের ফ্ল্যাট থেকে খাবার আসে। আজ মনে হয় ভুলে গেছে। মাঝে মাঝে তারা খাবার পাঠাতে ভুলে যায়।
আমরা দুপুরে খাব না?
তেহারির দোকান থেকে দু’প্যাকেট তেহারি নিয়ে আসো।
আপনার কি গাড়ি আছে?
গাড়ি আছে। ড্রাইভার নাই। রিকশা করে চলে যাও।
গানম্যান চিন্তিত ভঙ্গিতে তেহারি আনতে বের হলো।
সন্ধ্যার কথা। বন্ধুবান্ধব আসবে। ওল্ড ফুলস ক্লাবের আড্ডা বসবে। আমার বসার ঘরের দরজা সবসময় খোলা থাকে। হিমু তার ঘরের দরজা খোলা রাখে, আমি হিমুর বাবা। আমারও ঘরের দরজা খোলা রাখা উচিত।
আজ দরজা বন্ধ। দরজার পাশে চেয়ার নিয়ে গানম্যান বসে আছে। তার চোখমুখ কঠিন।
দরজার বেল বাজল। গানম্যান দরজা খুলে বলল, হাত উপরে তুলুন, বডি চেক। ভয় পাবেন না। রুটিন চেক। হুমায়ূন স্যারের সিকিউরিটির বিষয়।
আমার কাছে এসেছে ছেলেবেলার বন্ধু ডাক্তার করিম (অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান)। সে হাত তুলল। বডি চেক করা হলো। গানম্যান বলল, আপনার ব্যাগে কী? ব্যাগ খুলুন, ব্যাগে কী আছে দেখব।