উত্তর : মহাদেব শিব তাঁর হাতের অনামিকা দিয়ে চারমাথা ব্রহ্মার একটা মাথা ঘাড় থেকে ফেলে দিয়েছিলেন।
এই কাজের পরপর মহাদেব অনুতাপে দগ্ধ হলেন। যে আঙুল দিয়ে তিনি এই কাজটি করেছেন সেই আঙুলকে তিনি অভিশাপ দিলেন। বললেন, আজ থেকে তুই নাম গ্রহণের যোগ্যতা হারালি। আজ থেকে তুই অনামিকা।
[উৎস : বাংলা শব্দের উৎস অভিধান। ফরহাদ খান।]
পড়াশোনা
বাংলা শব্দের মজার দ্বৈততা বিষয়ে আগেও লিখেছি। এখন আরেকবার–পড়ার সঙ্গে শোনা। যেন শোনাও পড়ারই অংশ।
আমরা যেভাবে পডি সেভাবে কি শুনি? সবাই চায় অন্যকে শোনাতে। নিজে শুনতে চায় না। সবচেয়ে বড় উদাহরণ আমি নিজে। বৃদ্ধ বোকা সংঘের আসরে অন্য কেউ কথা বললেই বিরক্তি লাগে। শুধু আমি মনের আনন্দে বকবক করে যাই। তখন আমার বিরক্তি লাগে না। ক্লাসে বক্তৃতা দেওয়ার আনন্দ পাই।
একটা বয়স পার হলে মানুষ ‘কথা বলা রোগ’-এ আক্রান্ত হয়। এই বয়সটা একেকজনের জন্যে একেক রকম। সাধারণভাবে ধরা হয় ষাট। কারণ এই বয়সেই মানুষের কর্মহীন সময়ের শুরু। ষাট থেকে সত্তর এই দশ বছর সব মানুষের জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ নাকি এই দশ বছর অর্থপূর্ণ কথা বলে। তারপর থেকেই কথা থেকে সারবস্তু চলে যায়। বাহাত্তরে পা দিলে তো সর্বনাশ।
প্রাচীন ভারতে বিদ্যাদানের কাজটা গুরুরা করতেন এই দশ বছর। পুরো বিদ্যাদানের প্রক্রিয়া ছিল কথানির্ভর। গুরু কথা বলতেন শিষ্য শুনত। বিদ্যাদান প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে দীর্ঘসময় লাগত। একসময় গুরু বলতেন, আমার বিদ্যা যা ছিল সব শেখানো হয়েছে। এখন যাও স্নান করে এসো। শিষ্য স্নান করে ফিরতেন। এই স্নান থেকেই এসেছে ‘স্নাতক’ শব্দ। শিষ্য গ্র্যাজুয়েট হয়েছে।
পাঠক আবার ভেবে বসবেন না যে শিষ্য দীর্ঘ পাঠগ্রহণ প্রক্রিয়া চলাকালে স্নান করে নি। অবশ্যই স্নান করেছে, তবে শেষদিনের স্নান হলো স্নাতক হওয়ার স্নান।
আমাদের শিক্ষাগ্রহণ প্রক্রিয়া এখনো শোনানির্ভর। বিজ্ঞানের প্রাকটিক্যাল ক্লাস ছাড়া ছাত্রদের শুধু শুনে যেতে হয়।
ধর্মপ্রচারকরাও শিষ্যদের সঙ্গে কথা বলতেন। শিষ্যরা গভীর আবেগে ধর্মগুরুর কথা শুনত।
নবিজীকে (দঃ) আল্লাহর বাণী শোনানো হলো কথায়–’পড়ো! তোমার প্রভুর নামে…’
তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? শোনাটা পড়ার চেয়ে জরুরি? আগে শোনা তারপর পড়া। অর্থাৎ পড়াশোনা না, শোনাপড়া।
আমার আত্মীয়স্বজনরা মাঝে মাঝে বেশ আয়োজন করে আমার কথা শুনতে আসেন। তাদের ধারণা আমার কাছ থেকে শোনা কথাগুলি নাকি ‘অতি উত্তম’। তাদেরকে কথা শোনানো কঠিন কর্মের মধ্যে পড়ে, কারণ তারা মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই আসেন যে ‘অতি উত্তম’ কথা শুনবেন। মানসিক প্রস্তুতি থাকা মানেই আশাভঙ্গের সম্ভাবনা। তারা আবার ফরমাশ করেন–হুমায়ূণ, ঐ ফকিরের গল্পটা আরেকবার বলো। ফকিরের গল্প মনে নেই, তারাই মনে করিয়ে দেন।
লেখকরা গুছিয়ে কথা বলবেন–এটা নিপাতনে সিদ্ধের মধ্যে পড়ে না। বেশির ভাগ লেখক কথা বলতেই পছন্দ করেন না। এই শ্রেণীর লেখকরা আবার কথা শুনতেও পছন্দ করেন না। আমার অতি প্রিয় লেখক এডগার এলেন পো কারও সঙ্গেই কথা বলতেন না। কেউ কথা বলতে এলেও মহা বিরক্ত হতেন।
উল্টোদিকে আছেন চার্লস ডিকেন্স। শুধুমাত্র তার মুখের গল্প শোনার জন্যে টিকিট কেটে মানুষ হল ভর্তি করে ফেলত।
বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর গ্রান্ডমাস্টার আইজাক অ্যাসিমভকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় গেস্ট লেকচার দেওয়ার জন্যে নিয়ে যেত। তিনি বক্তৃতার জন্যে প্রচুর টাকা নিতেন। এক ঘণ্টা কথা বলতেন, এই এক ঘণ্টা দর্শক মুগ্ধ হয়ে থাকত।
আচ্ছা আমি কি গল্প সুন্দর করে বলতে পারি? মনে হয় পারি। কেন বিনয়ের ধারেকাছে না গিয়ে পারি বলে ফেললাম সেটা ব্যাখ্যা করি। আমি লক্ষ করেছি, গল্প যখন শুরু করি সবাই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকে। অনেকেই অতি বিনয়ের সঙ্গে বলে, আমি একবার আপনার আজ্ঞায় এসেছিলাম। আরেকদিন কি আসতে পারি? দূরে এক কোনায় বসে থাকব।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণমূলক রচনা পড়তে গিয়ে দেখি তিনি লিখেছেন–
‘হুমায়ূন আহমেদ আড্ডায় বসে যেসব চমৎকার গল্প করেন সেগুলি রেকর্ড করে রাখা উচিত।…’
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এই লেখা পড়েই মনে হয় অন্যদিন পত্রিকার সম্পাদক মাজহার উৎসাহিত হলো (সে অতি দ্রুত উৎসাহী হওয়ার মতো ক্ষমতা রাখে। একদিন আড্ডায় গল্প করছি, হঠাৎ দেখি আমার বাঁ-পাশে কালো মতো ছোট্ট একটা কী। সেখান থেকে জোনাকিপোকার মতো থেমে থেমে আলো আসছে। আমি বললাম, এটা কী?
মাজহার বলল, স্যার ভয়েস রেকর্ডার।
ভয়েস রেকর্ডার কেন?
এখন থেকে ঠিক করেছি আমাদের আড্ডার পুরো সময়টা রেকর্ড করা থাকবে।
আমি ঠান্ডা গলায় বললাম, এই বস্তু নিয়ে যাও এবং তুমি নিজেও আগামী সাত দিন আড্ডায় আসবে না। আমি এমন কোনো বাণী দেই না যা রেকর্ড করে রাখতে হবে।
শুরু করেছিলাম পড়াশোনা নিয়ে। চলে এসেছি আড্ডার গল্পে এবং নিজেকে বিরাট কথক হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা চালাচ্ছি। পাঠক, সরি। তবে ফাউনটেনপেন যেহেতু আত্মজৈবনিক লেখা, নিজের কথা বলা যেতে পারে। যদিও নিজের প্রশংসা নিজেই করার মতো তুচ্ছ কিছু হতে পারে না। অন্যের নিন্দা করা যত দোষ নিজের প্রশংসা করা তারচেয়েও দোষ। কেউ যখন নিজের প্রশংসা নিজেই শুরু করেন তখন আমার গা চিড়বিড় করতে থাকে। সেখানে আমি কী করে বলছি, আমি ভালো কথক? থুকু ফিরিয়ে নিলাম।