আমরা বাংলাদেশী মুসলমানরা ছেলেমেয়েদের ইসলামী নাম রাখতে আগ্রহী। আল্লাহর নামের সঙ্গে মিলিয়ে নাম। যেমন, আব্দুল কাদের (আল্লাহর দাস)। গোলাম রসুল (রসুলের গোলাম)।
আল্লাহর নামের সঙ্গে মিলিয়ে কখনো কোনো মেয়ের নাম কেন রাখা হয় না। আল্লাহপাক তো নারী-পুরুষের ঊর্ধ্বে, তারপরেও তাঁর নাম পুরুষবাচক কেন ভাবা হয়? এই বিষয়ে জ্ঞানীরা কেউ কি আমার প্রশ্নের জবাব দেবেন?
বাংলাদেশের শিক্ষিত এবং ২১ ফেব্রুয়ারির ভাবে উজ্জীবিতরা সন্তানদের জন্যে বাংলা নাম খোঁজেন, তবে ডাকনাম। ভালো নাম অবশ্যই ইসলামী।
বাংলা নাম নিয়ে আমি আছি বিপদে। অনেকেরই ভুল ধারণা আছে যে, লেখকরা সুন্দর সুন্দর নাম জানেন। আমি কিন্তু জানি না। তাতে রক্ষা নেই, পরিচিতজনদের নাম দেওয়ার জন্যে আমাকে প্রস্তুত থাকতে হয়। সিলেটের নাট্যকর্মী আরজুর ছেলে হয়েছে। নামের জন্যে দিনে চার-পাঁচবার টেলিফোন। আকিকা আটকে আছে।
আমি বললাম, নাম রাখো মানব।
আরজু বিস্মিত হয়ে বলল, স্যার সে তো মানবই, অন্য কিছু তো না। তাহলে মানব কেন রাখব?
আমি বললাম, সেটাও একটা কথা। এক মাস সময় দাও নাম ভাবতে থাকি।
না স্যার, খাসি কেনা হয়ে গেছে। আজই নাম রাখা হবে। মানবই রাখা হবে।
হবিগঞ্জের আরেক অভিনেতার নাম সোহেল। তার প্রথম ছেলে হয়েছে। নামের জন্যে অস্থির। নাম আমাকেই রাখতে হবে। আমি বললাম, যেহেতু প্রথম সন্তান নাম রাখো প্রথম।
সোহেল বলল, নাম খুবই পছন্দ হয়েছে স্যার। অদ্ভুত।
এক বছর না ঘুরতেই আবারও তার এক ছেলে। তার নাম রাখলাম দ্বিতীয় এবং সোহেলকে বললাম, তৃতীয় ছেলেমেয়ে যাই হয় আমার কাছে নাম চাইবে না। সরাসরি নাম রাখবে তৃতীয়। পরেরজন চতুর্থ, তারপরের জন পঞ্চম… এইভাবে চলবে। ঠিক আছে?
জি স্যার ঠিক আছে।
সম্প্রতি ছেলের নামের জন্যে আমার কাছে এসেছে অভিনেতা মিজান। আমি বললাম, নাম রাখো ‘লুব্ধক’।
মিজান মুখ কাঁচুমাচু করে বলল, লুব্ধক জিনিসটা কী স্যার?
আমি বললাম, আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র। ইংরেজিতে বলে Sirius.
মিজান-পুত্র এখন আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
কেউ যখন আর্কিটেক্টকে দিয়ে বাড়ি বানায় তখন বেশ আয়োজন করে বলে তার কী কী প্রয়োজন। যেমন, মাস্টার বেডরুমের সঙ্গে বারান্দা থাকতে হবে। ফ্যামিলি স্পেসে বই রাখার লাইব্রেরি হবে। সার্ভেন্ট টয়লেট আলাদা হবে। ইত্যাদি।
আমার কাছে যারা নাম চাইতে আসে, তারাও বেশ আয়োজন করেই তাদের দাবিগুলি তোলে। যেমন, এক মা তার ছেলের নামের জন্যে এসেছে—
স্যার! ছেলের নামের প্রথম অক্ষর হবে আ। কারণ আমার নামের প্রথম অক্ষর ‘আ’, আতিয়া। শেষ অক্ষর হবে ‘ল’। কারণ ছেলের বাবার নামের প্রথম অক্ষর ‘ল’, লতিফ। নামের অর্থ যদি নদী, আকাশ বা মেঘ হয় তাহলে খুব ভালো হয়। তারচেয়েও বড় কথা–নামটা হতে হবে আনকমন।
আমি বললাম, ছেলের নাম রাখো আড়িয়াল খাঁ। নদীর নামে নাম। আড়িয়াল খাঁ নামে আমাদের একটা নদী আছে, জানো নিশ্চয়ই?
ছেলের মা গম্ভীর মুখে বলল, আড়িয়াল খাঁ নাম রাখব?
হা। তোমার সব ইচ্ছা এই নামে পূরণ হচ্ছে। নদীর নামে নাম, আনকমন নাম, শুরু হয়েছে তোমার নামের আদ্যক্ষর ‘আ’ দিয়ে, শেষ হচ্ছে তোমার স্বামীর নামের আদ্যক্ষর দিয়ে।
আমার স্বামীর বংশ খাঁ বংশ না।
তাতে কী? তোমার ছেলে খাঁ বংশের পত্তন করবে। তার থেকেই শুরু হবে খাঁ বংশ।
স্যার, আপনাকে আমার ছেলের নাম রাখতে হবে না। ধন্যবাদ।
তোমাকেও ধন্যবাদ।
শুধু যে ছেলেমেয়েদের নাম তা-না, আমাকে অনেক স্থাপনার নামও রাখতে হয়েছে। কাকলী প্রকাশনীর মালিক সেলিম সাহেব উত্তরায় বিশাল চারতলা বাড়ি তুললেন। আমাকে নাম রাখতে হলো। নাম রাখলাম ‘বৃষ্টি বিলাস’।
সেলিম সাহেব বাড়ির সামনে শ্বেতপাথরের ফলকে লিখলেন–এই বাড়ির নাম রেখেছেন…।
সময় প্রকাশনীর ফরিদ ময়মনসিংহে বাড়ি করবে। বাড়ির নাম আমি ছাড়া কে রাখবে? নাম দিলাম ‘ছায়াবীথি’।
নামকরণ চলছেই। এই নামকরণের একটা ভালো দিক হচ্ছে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে নামের পরিবর্তন হবে না।
পাদটিকা
ওল্ড ফুলস ক্লাবের সান্ধ্যসভায় কলকাতার এক ভাষাতত্ত্ববিদ উপস্থিত হলেন। আমরা সবাই চেষ্টা করতে লাগলাম জ্ঞানী টাইপ কথা বলার। তেমন কোনো জ্ঞানী কথা খুঁজে না পেয়ে আমি বললাম, আচ্ছা ভাই, আম নামটা কীভাবে এল? আমের বদলে জাম নাম আমরা কেন রাখলাম না।
ভদ্রলোক বললেন, আমের নাম যদি জাম রাখা হতো তাহলে আপনি বলতেন, জাম রাখা হলো কেন? কেন আম রাখা হলো না?
আমি বললাম অত্যন্ত সত্যি কথা। বাংলা ভাষাভাষী বিশাল ভূখণ্ডে সবাই একসঙ্গে আম’কে আম ডাকা শুরু করল কেন? মিটিং করে কি ঠিক করা হয়েছিল এই ফলটার নাম হবে আম? আমি যতদূর জানি অতি প্রাচীনকালে মানব সমাজ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। এক দলের সঙ্গে আরেক দলের যোগাযোগই ছিল না। অথচ সবাই একটা ফলের নাম রাখল আম। এক হাজার মাইল লম্বা নদী ব্রহ্মপুত্র। সবাই তাকে ব্রহ্মপুত্রই ডাকছে। কে রেখেছিল আদি নাম?
ভাষাতত্ত্ববিদ হকচকিয়ে গেলেন। আবোল-তাবোল কথা বলা শুরু করলেন। তাঁর জন্যে ওই দিনের আসর ছিল শিক্ষাসফর।
কুইজ
আমাদের পাঁচ আঙুলের একটির নাম অনামিকা (রিং ফিঙ্গার) অর্থাৎ নামহীন। এই আঙুলটির নাম নেই কেন?