এই তোর অবস্থা কিরে? ঝুড়ি এর মধ্যেই নামিয়ে ফেলেছিস? ঝুড়ি নামানোর মতো অবস্থা তো হয় নি। ঘটনা কী? মালী তোকে ঠিকঠাক যত্ন করছে?
গাছের সঙ্গে তুই তুই করে কেন কথা বলি? জানি না।
গাছের কথা কিছুক্ষণ বন্ধ থাকুক। আবার এই প্রসঙ্গে ফিরে আসব, এখন বিজ্ঞান-কথা। একটা কুকুর দিয়ে শুরু করা যাক। সে ভরপেট খেয়ে উঠানে শুয়ে আছে। এই মুহূর্তে খাদ্যের সন্ধানে সে যাবে না। এর অর্থ এই না সে তার চারপাশের জগৎ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। শামুক তা-ই করত। খাওয়া শেষ হলেই খোলসের ভেতর ঢুকে খোলসের মুখ বন্ধ করে দিত। কুকুর তা করছে না। সে বিশ্রাম নিতে নিতেই এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। হঠাৎ কান খাড়া করে দূরের কোনো শব্দ শুনছে। সে তথ্য সংগ্রহ করছে। এই তথ্যের কিছুটা সে তার মস্তিস্কে জমা করে রাখবে। অনেকটাই ফেলে দেবে। যে প্রাণী যত উন্নত তার তথ্য সংগ্রহ এবং তথ্য জমা রাখার পদ্ধতিও তত উন্নত। সৌরজগতের সবচেয়ে উন্নত প্রাণী মানুষের তথ্য সংগ্রহের ক্ষমতা বিস্ময়কর। একজন মানুষ এক জীবনে পনেরো ট্রিলিয়ন তথ্য সংগ্রহ করে। এই তথ্য সংগ্রহের প্রায় সবটাই হলো কৌতূহলের কারণে।
পেনডোরার বাক্সের ঘটনা তো সবার জানা। গল্পটা এরকম–পেনডোরাকে একটা বাক্স দিয়ে বলা হলো, খবরদার এই বাক্স তুমি খুলবে না। কৌতূহলের কারণে পেনডোরা সেই বাক্স খুলল, বাক্স থেকে বের হলো, দুঃখ-কষ্ট, জরা, দুর্ভিক্ষ ভয়ঙ্কর সব জিনিস। সেই থেকেই এইসব পৃথিবীতে আছে। পেনডোরা কৌতূহলী না হলে আজ আমরা সুখে থাকতাম। পেনডোরার গল্পের সঙ্গে আদম হাওয়ার গল্পের মিল আছে। কৌতূহলের কারণেই হাওয়া গন্ধম ফল খেলেন, নিজের স্বামীকে খাইয়ে পৃথিবীতে নির্বাসিত হলেন। পৃথিবীর গ্লানি, দুঃখ-কষ্ট, জরা-মৃত্যু তাদেরকে স্পর্শ করল।
মানুষ তথ্য সগ্রহ করে, তথ্যগুলি সাজায়, তাদের ভেতর মিল-অমিল বের করে। মিল-অমিলের পেছনে কী তা বের করার চেষ্টা করে। এটাই বিজ্ঞান।
উদাহরণ দেই—
তথ্য
লোহা পানিতে ডুবে যায়, কাঠ ভাসে, তুলা ভাসে, পাখির পালক ভাসে, পিতল ডুবে যায়, পাথর ডুবে যায়…।
তথ্যের বিচার
লোহা, পিতল, পাথর পানিতে ডুবে যায়।
কাঠ, তুলা, পাখির পালক ভাসে।
বিজ্ঞান
পানির চেয়ে ভারী বস্তু ডুবে যাবে, পানির চেয়ে হালকা বস্তু ভেসে থাকবে।
জ্ঞান কিন্তু এইখানেই থেমে থাকবে না। আরও এগুবে। নতুন তথ্য যুক্ত। হবে। যেমন–
নতুন তথ্য
লোহা পানিতে ডুবে যায়, কিন্তু লোহার তৈরি নৌকা ভাসে। কেন? পিতল নদীতে ডুবে যায়, কিন্তু পিতলের কলসি পানিতে ভাসে। কেন?
এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্যে মানবজাতিকে অপেক্ষা করতে হলো। একদিন আর্কিমিডিস স্নানঘরের চৌবাচ্চায় নগ্ন হয়ে স্নান করতে নামলেন। নেমেই উত্তর পেয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, Eureka! কথিত আছে তিনি নগ্ন অবস্থায় রাজপথে নেমে গলা ফাটিয়ে চেঁচাতে লাগলেন, Eureka! Eureka! পেয়ে গেছি! পেয়ে গেছি!
লেখক হিসেবে আমাকে মাঝে মধ্যে একটি প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। যেমন, আপনার কি মৃত্যুভীতি আছে?
উত্তরে আমি বলি, আমার মৃত্যুভীতি নেই, তবে মৃত্যুর বিষয়ে প্রবল বিদ্বেষ আছে। আমি মোটামুটি এক হাজার বছর বেঁচে তারপর মরতে চাই।
কেন?
কচ্ছপের মতো তুচ্ছ একটি প্রাণী তিন শ’, সাড়ে তিন শ’ বছর বাঁচে আর মানুষের মতো এত ক্ষমতাধর প্রাণী সত্তর-আশি বছরেই শেষ। এর কোনো অর্থ আছে?
এক হাজার বছর বাঁচতে চান কেন? বিজ্ঞানের মহান আবিষ্কারগুলি দেখে মরতে চাই। পেনডোরার বাক্স থেকে যেসব ভয়ঙ্কর জিনিস বের হয়েছিল বিজ্ঞান সব কটাকে আবার বাক্সে ঢোকাবে। সেই বাক্স বিজ্ঞান ধ্বংস করে দেবে। এই দৃশ্য দেখার আমার শখ।
বিজ্ঞান কিছু প্রশ্নের উত্তর দেবে। যেমন, আমরা কে? পৃথিবীতে কেন জন্ম নিয়েছি। আমরা কী উদ্দেশ্যে এসেছি?
সৃষ্টির মূল রহস্য বিজ্ঞানই ভেদ করবে। আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণ বিজ্ঞান করবে। ফিলসফি না।
.
বিজ্ঞানের ছাত্র বলেই হয়তো বিজ্ঞানের প্রতি আমার আস্থা এবং ভরসা সীমাহীন। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান ক্রমেই জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে। তার যাত্রা Abstract-এর দিকে। কোয়ান্টাম থিওরি, স্ট্রিং থিওরি সবকিছু আমার মতো সাধারণ মানুষের বোধের বাইরে চলে যাচ্ছে। বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা চলে যাচ্ছে ফিলসফির দিকে। সুফিরা যেমন বলেন, সবই মায়া; বিজ্ঞানও বলা শুরু করেছে, সবই মায়া।
কবি রিল্কে (Rainer Maria Rilke) তাঁর The Tenth Elegy-তে বলেছেন–
… how alien, alas are the streets
of the city of grief.
এখানে grief এর বদলে science লিখে দিলে খুব যুক্তিযুক্ত মনে হবে–
… how alien, alas are the streets
of the city of science.
আমি এক পর্যায়ে গাছপালার কাছে ফিরে আসব বলেছিলাম, এখন ফিরলাম।
গাছপালা খাদ্যের সন্ধানে যেতে পারে না। তাকে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে। থাকতে হয়। সূর্যের আলো তার গায়ে পড়ে। এখান থেকেই সে খাবার তৈরি করে। সে খাদ্যচিন্তা থেকে মুক্ত। মুক্ত বলেই সে তার চিন্তা অন্যদিকে নিতে পারে। তার অনুভূতি আছে। তার সেই অনুভূতির নিয়ন্ত্রকও থাকতে হবে। নিয়ন্ত্রণটা কোথায়?
আমার ভাবতে ভালো লাগে বৃক্ষরাজি অনেক রহস্যই জানে। তার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার কারণে এইসব রহস্য মানুষকে জানাতে পারছে না। মানুষও তার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে গাছের কাছ থেকে কিছু জানতে পারছে না। একদিন সীমাবদ্ধতা দূর হবে। বৃক্ষরাজি কথা বলা শুরু করবে। কী অদ্ভুত কাণ্ডই না তখন ঘটবে!