বর্তমানে সে মস্তিষ্কের ক্যান্সারে আক্রান্ত। তার চিকিৎসা চলছে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসার বিপুল ব্যয়ভার তার পরিবার আর নিতে পারছে না।
আমি তার হয়ে আপনার কোমল মানবিক সত্তার কাছে আবেদন করছি। আপনার মঙ্গলময় হাত কি এই শক্তিমান অসহায় অভিনেতার দিকে প্রসারিত করা যায়?
বিনীত হুমায়ূন আহমেদ
.
পাদটিকা
How many loved your moments of glad grace
And loved your beauty with love false or true,
But one man loved the pilgrim soul in you,
And loved the sorrows of your changing face.
W.B. Yeats
ছাইঞ্চ মিয়া
স্যার, আমার নাম ‘ছাইঞ্চ’ মিয়া।
কী নাম বলেছ?
ছাইঞ্চ মিয়া।
গ্রামের মানুষদের মধ্যে অদ্ভুত অদ্ভুত নাম রাখার প্রবণতা আছে। তবে সেসব নাম সহজ হয়। উচ্চারণে অসুবিধা হয় না। ছাইঞ্চ যথেষ্ট জটিল। আমি বললাম, এই নামের অর্থ কী?
লেহা-পড়া। এই নামের অর্থ লেহা-পড়া।
আমি বললাম; সায়েন্স থেকে ছাইন্স? বিজ্ঞান?
জায়গামতো ধরছেন স্যার। এইটাই আমার নাম।
ঘটনা যা জানলাম তা হলো ছাইন্স মিয়ার আসল নাম ছাত্তার। সে আট ন’ বছর বয়সে নীলগঞ্জ স্কুলের বিজ্ঞানের শিক্ষক আজিজ মাস্টারের বাড়িতে কাজের ছেলে হিসেবে যোগ দেয়! আজিজ মাস্টার ছাত্তারের নানান বিষয়ে আগ্রহ এবং কৌতূহল দেখে তাকে আদর করে ডাকতেন সায়েন্স। সেখান থেকে ছাইঞ্চ মিয়া।
এখন তার বয়স পঁয়ত্রিশ। বেঁটেখাটো মানুষ। শক্ত সবল। গাত্রবর্ণ ঘোর কৃষ্ণ। গ্রামের মানুষদের সহজে টাক পড়ে না। এর মাথায় চুলের বংশও নেই। ছাইঞ্চ মিয়া কাজকর্ম কিছু করে না। স্কুলঘরের বারান্দায় ঘুমায়। ছাত্রদের হোস্টেলে রান্নাবান্নার বিনিময়ে খাবার পায়। মাছ মারায় তার বিশেষ পারদর্শিতা আছে। কৈ জাল দিয়ে কৈ মাছ ধরার ব্যাপারে সে একজন বিশেষজ্ঞ। সে নাকি কিছুদিন পরপর মাছ মারার নতুন নতুন কৌশল আবিষ্কার করে।
ছাইঞ্চ মিয়া হাত কচলাতে কচলাতে বলল, আপনার কাছে একটা প্রশ্ন নিয়া আসছি স্যার। অনেকরে জিজ্ঞাস করেছি কেউ বলতে পারে নাই। আজিজ স্যারে বাইচা থাকলে উনি পারতেন। উনার মতো জ্ঞানী মানুষ খোদার আলমে নাই বললেই চলে।
আমি বললাম, অনেকেই যখন পারে নাই তখন আমারও না পারার কথা। প্রশ্নটা কী?
জগতের সব ফল গোল। বেদানা, আপেল, বড়ই, আঙুর, আম, কাঁঠাল, ডাব, শরিফা। কিন্তু কলা ফলটা লম্বা। এর কারণ কী?
আমি একটু থতমত খেলাম। কী উত্তর দেব বুঝতে পারছি না। ছাইঞ্চ মিয়া বলল, বুঝতাছি আপনে পারতেছেন না। আমি নিজে নিজে একটা উত্তর বাইর করেছি। স্যার বলব?
বলো।
আল্লাপাক গোল পছন্দ করেন এইজন্যে সব ফল গোল। কলা আল্লাপাক পছন্দ করে না বিধায় কলা লম্বা। কলা খাওয়া এই কারণে ঠিক না। আমি সব ফল খাই, কলা খাই না।
আমি কিছু বললাম না। ছাইঞ্চ মিয়া বলল, যে ফল যত গোল সেটা তত ‘উবগার’, আমি হিসাবে এইটা পাই। স্যার ঠিক আছে?
প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আমি বললাম, তুমি লেখাপড়া কতটুকু জানো?
বাংলা লেখতে পড়তে পারি। নয় ঘর পর্যন্ত নামতা জানি। আজিজ স্যার শিখায়েছেন। ৯ একে ৯, ৯ দুকুনে ১৮, তিন নং ২৭…
ছাইঞ্চ মিয়া নয়ের ঘরের নামতা শেষ করে উঠে দাঁড়াল। মাছ মারতে যাবে। তার কাছে শুনলাম সে কৈ মাছ ধরার একটা পদ্ধতি বের করেছে। এ পদ্ধতিতে শুধু ডিমওয়ালা কৈ মাছ ধরা পড়ে, ডিম ছাড়া কৈ কখনো না।
.
বিজ্ঞানের শুরুটা কোথায়?
জ্ঞানীরা বলেন, শুরু হলো কৌতূহলে। মানুষ কৌতূহলী হওয়ার কারণেই বিজ্ঞান। গাছের অনুভূতি আছে, কৌতূহল নেই বলেই বিজ্ঞানে গাছের অবদান নেই।
আমি জ্ঞানী না বলেই হয়তো জ্ঞানীদের কথা নিতে পারছি না। আমার মতে, বিজ্ঞানের শুরু খাদ্য অনুসন্ধানে। খাদ্য কোথায় পাওয়া যাবে, কীভাবে পাওয়া যাবে–এই ব্যাকুলতা থেকেই বিজ্ঞান। আর গাছের কৌতূহল নেই তাই আমরা ধরে নেব কেন? আমার মনে হয়, গাছ তার নিজের মতো করেই কৌতূহলী। আমরা তার কৌতূহল ধরতে পারছি না।
নুহাশপল্লীতে আমার দিন কাটে গাছপালার সঙ্গে। তাদের জগৎ বোঝার সাধ্যও আমার নেই। সেই চেষ্টাও বড় ধরনের বোকামি ছাড়া কিছু না। তারপরেও গাছপালার বনে হাঁটতে হাঁটতে ভাবি-গাছদের কি চিন্তা করার ক্ষমতা আছে? তারা কি ভাবতে পারে? কল্পনা করতে পারে?
বিশাল বৃক্ষকে ‘বনসাই’ বানানোর প্রবণতা আজকাল দেখতে পাচ্ছি। টবে বটগাছ, ঝুড়ি নেমে গেছে–এইসব। বনসাই বৃক্ষ যতবার দেখি ততবারই মন খারাপ হয়। একটা বিশাল বৃক্ষকে পঙ্গু বানিয়ে রাখার মানে কী? গত বৃক্ষমেলা থেকে অনেক দাম দিয়ে আমি দুটা বনসাই গাছ কিনলাম। একটা বট আরেকটা তেঁতুল। এই দুই বামুন বৃক্ষকে নুহাশপল্লীতে নিয়ে এসে বললাম, আজ তোদেরকে বনসাই অবস্থা থেকে মুক্তি দেব। তোরা সাধারণ বৃক্ষের মতো বড় হবি। এবং অবশ্যই বলবি–একজন মানুষ আমাদের কষ্ট বুঝতে পেরে মুক্তির ব্যবস্থা করেছেন। তোরা বলবি–মানুষের জয় হোক।
বনসাই গাছ দুটি পুতে দিলাম। এক বছরের আগেই তারা স্বাস্থ্যে, সৌন্দর্যে, প্রাণে ঝলমল করে উঠল। তারা এখন আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধা নিয়ে বড় হচ্ছে। আমার নানাবিধ পাগলামির একটি হচ্ছে, এই দুটি গাছের সঙ্গে কথা বলা। কথা বলার নমুনা (বটগাছের সঙ্গে)–