আমার খুশি হওয়া উচিত, কিন্তু খুশি হওয়া গেল না। মনে হলো কবি নিশ্চয়ই অসুস্থ। সুস্থ ইকবাল হাসান এ ধরনের লেখা অবশ্যই লিখবেন না।
তিনি পরে টেলিফোন করে জানতে চাইলেন আমি তার লেখা পড়েছি কি না।
আমি বললাম, পড়েছি। উল্টাগীত গাইছেন কেন?
কবি বললেন, আগে যখন আপনার ইন্টার নিয়েছি তখন আমি অপরিপক্ক ছিলাম।
আমি বললাম, এখন কি পেকেছেন?
কবি হতাশাগ্রস্ত গলায় বললেন, হুমায়ূন ভাই, আমি এ দেশের একমাত্র কবি যে আপনার নুহাশপল্লী নিয়ে কবিতা লিখেছে। আর কেউ কিন্তু লিখে নি। আপনি কেন এরকম করে আমার সঙ্গে কথা বলছেন।
আমি তাঁকে ধন্যবাদ দিলাম। তাঁর লেখা কবিতাটি পত্রস্থ করা হলো।
.
নুহাশপল্লী
নিঃশ্বাস ফেলবে কোথায়? নেবে শ্বাস?
শরীরকে দেবে অক্সিজেন? এখন বাতাসে
শুধু কার্বডাইঅক্সাইড শুষে নেবে তেমন বৃক্ষ কোথায়?
যেদিকে তাকাবে তুমি শুধু দূষিত বাতাস। বড় হয়ে
দেখবে, পৃথিবী সুন্দর কতো’–মধ্যবয়সে এসে দেখি,
এসব আশ্বাসবাণী শুধু শূন্যে ঝরে পড়ে। হাওয়া নেই
শহরে ও গ্রামে। সবকিছু গিলে খাচ্ছে বিষাক্ত আকাশ।
যদিও স্বপ্ন দ্যাখায় প্রভাতের বোদ আর রাতের নক্ষত্র
তবু ভাবি : মেঘে মেঘে বেলা তো অনেক হলো, আর কবে
আমাদের গ্রামগুলো নুহাশপল্লীর মতো স্বয়ংম্ভর হবে?
[আকাশপরী, ইকবাল হাসান, পৃষ্ঠা-১৫, দি রয়েল পাবলিশার্স, ঢাকা]
.
পাদটিকা
Insects sting, not for malice, but because they want to live. It is the same with critics; they desire our blood, not our pain.
Friedrich Nietzsche
পোকারা আমাদের উপর রাগ করে কামড়ায় না। তারা বেঁচে থাকতে চায় বলেই কামড়ায়। সমালোচকদের বেলাতেও কথাটা সত্য। তারা আমাদের রক্ত চায়, আমাদের কষ্ট চায় না।
ফ্রেডারিখ নীটশে
ক্ষুদে গানরাজ
স্যার, আপনি কি গান গাইতে জানেন?
না।
গান বোঝেন?
না।
রাগ বিষয়ে জ্ঞান আছে?
না।
মীড়, গমক, মূৰ্ছনা–এইসব কী?
জানি না কী।
তাহলে ক্ষুদে গানরাজের প্রথম বিচারক হলেন কী জন্যে?
এই প্রশ্নের একটাই উত্তর, ‘ভুল হয়ে গেছে। মানুষ হিসেবে ভুল করার অধিকার আমার আছে।’
মহাবিজ্ঞানী আইনস্টাইন একবার শিশুদের কবিতা আবৃত্তির বিচারক হয়েছিলেন। ঔপন্যাসিক চার্লস ডিকেন্স কুস্তি প্রযোগিতার বিচারক হয়েছিলেন।
ক্ষুদে গানরাজের আরেকজন বিচারকের নাম মেহের আফরোজ শাওন। সে আমার পরিচিত। সে গান জানে, গান বোঝে, রাগ জানে, মীড় গমক-মূর্ছনা জানে। এরকম একজন বিচারক পাশে থাকলে নির্ভয়ে থাকা যায়। তার আবার আমার প্রতি উচ্চ ধারণা। সে মনে করে আমার কান অত্যন্ত পরিষ্কার। গান ভালো হচ্ছে নাকি হচ্ছে না–এটা আমি অতিদ্রুত ধরতে পারি।
শাওন অন্য স্ত্রীদের চেয়ে আলাদা না। স্ত্রীরা নির্গুণ স্বামীর ভেতরও গুণ আবিষ্কার করে ফেলে।
বিচারকের দায়িত্ব পালন শুরু হলো। আমি কঠিন ভাইবা পরীক্ষা নিচ্ছি এরকম মুখ করে বসে থাকি। শাওন চাপা গলায় বলে, ভুরু কুঁচকে আছ কেন? বাচ্চাদের দিকে রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে আছ কেন? ওরা ভয় পাচ্ছে। আমার নিজেরই তোমার দিকে তাকাতে ভয় লাগছে, ওর ভয় পাবে না কেন!
আমি চাপা গলায় বললাম, ওরা আমাকে মোটেই ভয় পাচ্ছে না। তোমাকে ভয় পাচ্ছে। তুমি গানে ভুল ধরছ, আমি ধরছি না।
তুমি একজন বিচারক। ওরা ভুল করলে তুমি ধরবে না!
আমি বললাম, ভুল ধরার যে ছাকনি আমার কানে আছে সেটা নষ্ট হয়ে গেছে। আমি ভুল ধরতে পারছি না। যা শুনছি তা-ই মনে হচ্ছে শুদ্ধ।
পাঠকরা বলুন, যে বাচ্চাটি ক্লাস ওয়ানে উঠে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে তাল লয়-সুর ঠিক রেখে গান করছে আমি তার কী ভুল ধরব? ভুল ধরায় আমার কোনো আনন্দ নেই, আমার গান শোনাতেই আনন্দ।
মৃত্তিকা নামের যে মেয়েটি ক্ষুদে গানরাজের প্রধান সমন্বয়কারী তাকে আমি ছোটবেলা থেকে চিনি, আমার শহীদুল্লাহ হলের বাসায় সে তার বাবার হাত ধরে প্রায়ই আসত। এসেই দৌড়ে টয়লেটে ঢুকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ত বাথটাবে। তখন তাকে হাতি দিয়ে টেনে তোলাও ছিল অসম্ভব। এই মেয়েটি ছিল ক্ষুদে দস্যি। তানিশা নামের আরেকটি মেয়ে যে উপস্থাপনার কঠিন এবং বিরক্তিকর কাজটি হাসিমুখে করে তাকেও অতি শৈশব থেকে চিনি। সে আরেক দস্যি। তার প্রধান কাজ ছিল, বাইরে থেকে বাথরুমের ফুটো দিয়ে তাকিয়ে থাকা এবং কিছুক্ষণ পর পর বলা–দেখে ফেলেছি, দেখে ফেলেছি।
আসলে ক্ষুদে গানরাজে ঢুকে আমি ক্ষুদেদের জগতে ঢুকে পড়েছি। এতগুলি গানের পাখি আর দুজন একসময়কার ক্ষুদে দস্যিকে নিয়ে আমার যাত্রা। Alice in wonderland এর আশ্চর্য জগতে আমার বিচরণ।
জীবন শুকায়ে গেলে করুণাধারায় আশ্রয় নিতে হয়। রবীন্দ্রনাথ এই পরামর্শ দিয়েছেন। আমার জীবন শুকিয়ে যায় নি। সেই সম্ভাবনা একেবারেই নেই, তারপরেও আমি সুরের করুণাধারায় অবগাহন করতে পারছি এ আমার পরম সৌভাগ্য।
একটাই কষ্টকর ব্যাপার–বাচ্চারা যখন বাদ পড়ে যায়। কী অবাক দৃষ্টিতেই না তারা তাকায়। তাদের চোখের দৃষ্টি বলে দেয়-আমি এত সুন্দর করে গাইলাম আর তোমরা আমাকে বাদ দিয়ে দিলে! বড়দের জগতের নিষ্ঠুরতার পরিচয়ে তাদের ক্ষুদ্র ভুবন হয়ে যায় এলোমেলো। বাদ পড়ে যাওয়া ছেলেমেয়েদের প্রতি কিছু বাবা-মা অত্যন্ত হৃদয়হীন আচরণ করেন। একটি মেয়ে দর্শকদের ভোটের কারণে বাদ পড়ল। সে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। এর মধ্যে মঞ্চে উপস্থিত হলেন মেয়েটির মা। শুরু করলেন মার। কী আশ্চর্য কাণ্ড। তাঁর মেয়ে ক্ষুদে গানরাজ হবে এই স্বপ্নে মহিলার মস্তিষ্কবিকৃতি ঘটেছে। তিনি তা জানেন না।