- বইয়ের নামঃ ফাউন্টেনপেন
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই, আত্মজীবনী, জীবনী
অপেক্ষা
মানবজীবন হলো অপেক্ষার জীবন। ছোটখাটো অপেক্ষা দিয়ে জীবনের শুরু–মা কি আমাকে চকলেট কিনে দেবে? বাবা কি আজ ঘোড়া ঘোড়া খেলবে? বাবা ঘোড়া হবে, আমি তার পিঠে উঠে হেট হেট করব।
জীবনের শেষে অপেক্ষার ধরন সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। তখন অপেক্ষা মৃত্যুর। এই মৃত্যুকে মহিমান্বিত করার অনেক চেষ্টা করা হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘মরণরে উঁহু মম শ্যাম সমান।‘ মহাপুরুষদের কাছে মৃত্যুর অপেক্ষা হয়তোবা আনন্দময়।
আমি সাধারণ অভাজন হওয়ার কারণে মৃত্যুচিন্তা মাথায় এলে অস্থির হয়ে যাই। আমি চলে যাব, তারপরেও আকাশ ভেঙে জোছনা নামবে, ‘সবাই যাবে বনে’। আষাঢ় মাসে আকাশ অন্ধকার করে মেঘ জমবে। তরুণীরা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গাইবে, ‘এসো করো স্নান নবধারা জলে’। সেই অপূর্ব নবধারা জল দেখার জন্যে আমি থাকব না, এর কোনো মানে হয়?
প্রসঙ্গ আপাতত থাকুক। নানাবিধ অপেক্ষার গল্প করা যাক।
আধুনিক নগরজীবনে নতুন কিছু অপেক্ষা’র সৃষ্টি হয়েছে যা আগে ছিল না। যেমন, গাড়িতে বসে, গরমে সিদ্ধ হতে হতে যানজট খোলার অপেক্ষা। এই অপেক্ষা অর্থবহ করার অনেক চেষ্টা আমি করেছি, যেমন গাড়ির সিটপকেটে সহজে হজম হয় এমন বই। অ্যাসিমভের Book of Facts. উন্মাদ পত্রিকার সম্পাদক আহসান হাবীবের কিছু রসিকতার বই। রিপ্লের একটা বই যেখানে উদ্ভট উদ্ভট কাহিনী। এর বাইরে আছে মোবাইল ফোনে সাপের খেলা।
জ্যামে আটকা পড়লে কোনো কিছুই ভালো লাগে না। বইয়ের পাতা খুলতেই পারি না। মোবাইল ফোনের সাপ নিয়ে তখন খেলতে বসি। সাপকে আপেল, চেরি ফল খাইয়ে লম্বা করাই হলো খেলার নিয়ম। কিছুক্ষণ সাপকে খাওয়ানোর পরে মনে হয় এখন কী করা যায়? অন্যদের কথা জানি না, জ্যামে আটকা পড়লে অবধারিতভাবে আমার ছোট বাথরুম পায়। তখন গভীর শঙ্কা নিয়ে ভাবি, আগামী তিন ঘণ্টায় যদি জ্যাম না ছোটে তাহলে কী কেলেংকারি হবে কে জানে!
যানজটে সবাই অসুখী হন তা-না। ভিক্ষুক এবং ফেরিওয়ালারা দন্ত বিকশিত করে হাসেন। ভিক্ষুকের হাত থেকে বাঁচার কূটকৌশল একজন আমাকে শিখিয়েছেন। ভিক্ষুক যখন ভিক্ষা চাইবে তখন তাদের দিকে তাকানো যাবে না। ভাব করতে হবে ভিক্ষুকরা অদৃশ্য মানব। এদেরকে দেখা যাচ্ছে না। ‘মাফ করেন’–বাক্যটাও ওদের দিকে তাকিয়ে বলা যাবে না। চোখে চোখ পড়লেই নাকি ধরা খেতে হয়।
জলজ্যান্ত মানুষকে অদৃশ্য মানব ভাবা কঠিন কর্ম। আমি ভিক্ষুকদের দিকে তাকাই। যথেষ্ট বিনয়ের সঙ্গে বলি, মাফ করেন। মাফ চাইতে গিয়ে আমার জীবনে একটা ঘটনা ঘটেছে। জনৈক ভিক্ষুক বলেছে, স্যার সকাল থাইকা আমি খালি মাফই করতেছি। আর কত মাফ করব?
এমন বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ ভিক্ষুকের কাছ থেকে আশা করা যায় না। আমি মানিব্যাগ খুলে ১০০ টাকার একটা নোট বের করলাম।
কয়েকদিন আগে পত্রিকায় একজন ভিক্ষুকের ছবি ছাপা হয়েছে। সে নাকি ভিক্ষা করে কোটিপতি হয়েছে। সে তার সন্তানদের সমাজে আদর্শ ভিক্ষুক হিসেবে দেখতে চায় এবং তাদের সাফল্য কামনা করে।
ইদানীং পত্রিকায় কোটিপতিদের নিয়ে ফিচার হচ্ছে। কেউ কাঁচামরিচের ক্ষেত করে কোটিপতি, কেউ ঝিংগা চাষ করে কোটিপতি। কোটিপতিদের ছবিও ছাপা হয়। ছবিতে তাদের অত্যন্ত বিমর্ষ দেখায়। কোটিপতি হয়ে তারা এমন বিমর্ষ কেন কে জানে! পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে এক এক ধরনের খবরের জোয়ার আসে। একটা সময় গেছে গাই গরুর। সবাই গাই গরু পাচ্ছে। তাদের ছবি ছাপা হচ্ছে। বেশিরভাগ সময়েই চিন্তিত কৃশকায় এক তরুণী গরুর দড়ি ধরে ভীত চোখে গরুর দিকে তাকিয়ে থাকে। এখন জোয়ার চলছে কোটিপতির। সম্প্রতি পড়লাম শামুক বিক্রি করে কোটিপতি।
অপেক্ষা বিষয়ে বলতে গিয়ে অন্য বিষয়ে চলে এসেছি। মূল বিষয়ে আসা যাক। অপেক্ষার শ্রেণীভেদ–
কসাইয়ের অপেক্ষা
কসাই অপেক্ষা করে একদিন তার ছেলে এমন নামি কসাই হবে, যে, একটা আস্ত গরু এক ঘণ্টায় নামিয়ে ফেলবে।
ছাত্রলীগের অপেক্ষা
পড়াশোনা, ভালো রেজাল্ট–এইসব নিয়ে এরা মাথা ঘামায় না। তাদের অপেক্ষা টেন্ডার নিয়ে। তারা বাকি জীবন ছাত্রলীগের সেবা করে যেতে চায়। সময় হলে বয়স্কভাতার জন্যে আবেদনের ইচ্ছাও তারা পোষণ করেন। বর্ষাকালে কই মাছ উজায়। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসা মানে ছাত্রলীগের বর্ষাকাল। তারা একসঙ্গে উজায়া যায়।
তাদেরকে থামানোর নানান চেষ্টার কথা শুনছি। কোনোটিই মনে হয় কাজ করছে না।
লিচু খাওয়া নিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপ মারামারি করেছে। দশজন আহত। এই খবর কিছুক্ষণ আগে পড়েছি। লিচুর পরপরই আমের সিজন আসছে। ভয়ে আছি, তখন না জানি কী হয়।
আমি তখন শহীদুল্লাহ হলের হাউস টিউটর। শহীদুল্লাহ হল ছাত্রলীগের এক কর্মী কী একটা কাজে যেন এসেছে। আমি তাকে বললাম, এই তোমরা তো আওয়ামী লীগের লেজ।
সেই ছেলে চোখ কপালে তুলে বলল, স্যার, এটা কী বলেন? আওয়ামী লীগ আমাদের লেজ।
সাম্প্রতিক ঘটনা দেখে ঐ ছাত্রের কথাই ঠিক বলে মনে
ডাক্তারদের অপেক্ষা
তাদের অপেক্ষা রোগের জন্যে। তাদের কোনো জাতীয় সঙ্গীত থাকলে তার প্রথম পঙক্তি হতো–”আয় রোগ আয়, উড়াল দিয়ে আয়।”