সবই খুব সুন্দর সুখের কল্পনা। তবু এক-এক রাতে কষ্টে চোখে জল আসে। সারারাত জেগে বসে থাকি। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ভাবি, আমার এই জীবনটা আমি কি কিছুতেই বদলাতে পারি না?
বন্ধুবান্ধব সবাইকে অবাক করে এক সন্ধ্যায় জগন্নাথ কলেজের নাইট সেকশনের এম এ. ক্লাসে ভর্তি হয়ে যাই। ধার-টার করে আমার ঘরের জন্যে নতুন পর্দা, বিছানার নতুন চাদর, নেটের মশারি কিনে ফেলি। অনেক ঘোরাঘুরি করে একটা ফুলদানি কিনি। একশ টাকা লেগে যায় ফুলদানিতে। তা লাগুক, তবু তো একটা সুন্দর জিনিস। একগুচ্ছ রজনীগন্ধা যখন এখানে রাখব তখন হয়তো এই ঘরের চেহারা পাল্টে যাবে। আমার এক আর্টিস্ট বন্ধুর কাছ থেকে একদিন প্রায় জোর করে জলরঙা একটা ছবিও নিয়ে আসি। নোনাধরা দেয়ালে সেই ছবি মানায় না। নিজেই চুন এনে দেয়ালে চুনকাম করি।
চুন দেয়ালে আটকায় না, ঝরে-ঝরে পড়ে। তবু আমার ঘর দেখে বন্ধুরা চোখ কপালে তুলে।
করছিস কী তুই? ইন্দ্রপুরী বানিয়ে ফেলেছিস দেখি। আবার দেখি খুশবুও আসছে। বিছানায় আতর ঢেলে দিয়েছিস নাকি? মাই গড! মেয়েমানুষ ছাড়া এই ঘর মানায় না। এক কাজ কর একশ টাকা দিয়ে একটা মেয়েমানুষ এক রাতের জন্য নিয়ে আয়। ফুর্তি কর। আমরা পর্দার ফাঁক দিয়ে দেখি।
রাগে আমার মাথায় রক্ত উঠে যায়। কিছু বলি না। কী হবে বলে। আমার বন্ধুরা গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা দেয়। সিগারেটের টুকরা দিয়ে মেঝে প্রায় ঢেকে ফেলে। একজন আমার নতুন কেনা বিছানায় চায়ের কাপ উল্টে দিয়ে বলে, যা শালা, চাঁদে কলঙ্ক লেগে গেল।
আমি কিছু বলি না। দাঁতে–দাঁত চেপে থাকি। আর মনে-মনে ভাবি— এই মূর্খদের সঙ্গে কী করে এতদিন কাটিয়েছি। কী করে এদের সহ্য করেছি?
ইরফান বলল, প্রেম করেছিস কিনা বল। তোর হাবভাব যেন কেমন রঙ্গিলা।
আমি জবাব দেই না। ইরফান পান-খাওয়া লাল দাত বের করে হাসতে-হাসতে বলে, জিনিস কেমন বল। টিপেটুপে দেখেছিস তো?
সবাই হো হো করে হাসে। কোন্ অন্ধকার নরকে এরা পড়ে আছে? এদের কী কোনোদিন মুক্তি ঘটবে না? আমার ইচ্ছা করে এশাকে একদিন ওদের সামনে উপস্থিত করি। সেটা নিশ্চয়ই খুব অসম্ভব নয়। বললেই সে আসবে। তবে আমার বলতে সাহস করে না।
প্রথম যেদিন তাকে তুমি বললাম কী প্রচণ্ড ভয়ে-ভয়েই না বললাম। সে গোলাপগাছের ডাল ছেটে দিচ্ছিল। আমি পাশে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ কী হল, নিজের অজান্তেই বলে ফেললাম— কাঁচিটা আমার হাতে দাও, আমি হেঁটে দি। বলেই মনে হল—এ কী করলাম আমি? আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। অমাির মনে হল সে এবার চোখে চোখে তাকিয়ে শীতল গলায় বলবে, আমাকে তুমি করে বলবেন না। এত ঘনিষ্ঠতা তো আপনার সঙ্গে আমার নেই।
এশা সে-রকম কিছুই বলল না। কাঁচি আমার হাতে দিয়ে বলল, তিন ইঞ্চি করে কাটবেন। এর বেশি না। আর আপনি কি চা খাবেন?
হ্যাঁ খাব।
চা নিয়ে আসছি। শুনুন, এরকম কচকচ করে কাটবেন না, ওরা বাধা পায়। গাছেরও জীবন আছে। জগদীশ চন্দ্র বসুর কথা।
এশা ঘরে ঢুকে গেল। চৈত্র মাসের বিকেলে আমি গোলাপ হাঁটতে লাগলাম। আমার ত্রিশ বছর জীবনের সেটা ছিল শ্রেষ্ঠতম দিন। বিকালটাই যেন কেমন অন্যরকম হয়ে গেল। শেষ বিকেলের রোদকে মনে হল লক্ষ-লক্ষ গোলাপ, বাতাস কী মধুর। এশার বাবা যখন বাইরে এসে বললেন— তারপর রঞ্জু দেশের খবর কী বল? নতুন কী গুজব শুনলে?—কী যে ভালো লাগল সেই কথাগুলি! মনে হল। এরকম সুন্দর কথা এর আগে আমাকে কেউ বলে নি।
গোলাপের ডাল ছাঁটছ মনে হচ্ছে। জি চাচা।
এর একটা ফিলসফিক আসপেকট আছে। সেটা লক্ষ্য করেছ? ফুল ফোটাবার জন্যে গাছকে কষ্ট দিতে হচ্ছে। হা-হা-হা।
তাঁর সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমিও হাসলাম। এশা চায়ের ট্রে নিয়ে ঢুকতে-চুকতে বলল, এত হাসাহাসি হচ্ছে কেন? আমি যোগ দিতে পারি?
ওদের বাড়ি থেকে ফিরলাম সন্ধ্যার পর। এশা গেট পর্যন্ত এল। হাসিমুখে বলল, আবার আসবেন।
এই কথাটি কি পৃথিবীর মধুরতম কথার একটি নয়? আমি আবার আসতে পারি এ বাড়িতে। যতবার ইচ্ছা আসতে পারি। আমাকে কোনো অজুহাত তৈরি করতে হবে না। তবুও ছোটখাটো কিছু অজুহাত আমি তৈরি করেই রাখি। যেমন একবার আমার একটা হ্যান্ডব্যাগ ফেলে এলাম যাতে পরদিন গিয়ে বলতে পারি, জরুরি কিছু কাগজপত্র ছিল। যাক পাওয়া গেল। সবচে বেশি যা করি তা হচ্ছেগল্পের বই নিয়ে আসি। তারপর সেই বই ফেরত দিতে যাই।
গল্পের বই আমি পড়ি না। ভালো লাগে না। কোনোকালেও ভালো লাগে নি। তবু রাতে শুয়ে-শুয়ে বইয়ের ঘ্রাণ নেই, পাতা ওল্টাই। এশার স্পর্শ এই বইগুলির পাতায়-পাতায় লেগে আছে ভাবতেই আমার রোমাঞ্চ বোধ হয়। গা শিরশির করে। গভীর আনন্দে চোখ ভিজে উঠে। বই ওল্টাতে-ওল্টাতে একরাতে অদ্ভুত এক কাণ্ড হল। টুক করে বইয়ের ভেতর থেকে কী যেন পড়ল। তাকিয়ে দেখি ছোট একটা নীল রঙের বোতাম। যেন একটা নীল অপরাজিতা। নাকের কাছে নিয়ে দেখি সত্যি গন্ধ আসছে। আমি গভীর মমতায় বোতামটা বালিশের নিচে রেখে দিলাম। সারারাত ঘুম হল না। কেবলি মনে হল একদিন-না-একদিন এশা আসবে এ বাড়িতে। আমি তাকে বলব, তুমি যে ফুলটি আমাকে দিয়েছিলে সেটা এখনো ভালো আছে। কী সুন্দর গন্ধ। সে অবাক হয়ে বলবে, আমি আবার ফুল দিলাম কবে?
এর মধ্যে ভুলে গেলে? একটা নীল ফুল দিয়েছিলে না?
বলেন কী! নীল ফুল আমি কোথায় পাব?
আমি বালিশ সরিয়ে বোতামটা বের করে আনব। এশা বিস্মিত হয়ে বলবে— এটা বুঝি আপনার নীল ফুল? আমি বলব, বিশ্বাস না হলে গন্ধ শুঁকে দেখ।