বেগম সাহেবের কথাগুলি শুনতে খারাপ লাগলেও কিছু করার নেই। তার অন্তর ভালো। তিন ঈদেই তার ছেলেমেয়ের জন্য টাকা দিয়েছে। গত ঈদে বেতনের বাইরেও পাঁচশ টাকা দিলেন। একটা গায়ের চাদর দিলেন। তার বেতন ছিল দেড়শ। তাকে কিছু বলতে হয় নি, বেগম সাহেব নিজেই বেতন বাড়িয়ে করেছেন দুশ। তা ছাড়া লোকজন এ বাড়িতে বেড়াতে এলে যাবার সময় হাতে পঞ্চাশ, একশ টাকা সব সময়ই দেয়। প্রতিটি পাই পয়সা সফুরার কাজে লাগে। বেতনের বাইরের টাকাটা সে জমা করে রাখে। দেশে যাবার সময় সঙ্গে নিয়ে যাবে। ছেলেমেয়েদের জন্যে এটা-সেটা নিজের হাতে কিনে নিয়ে যাবে। তার এত কষ্টের টাকা।
বকুলের বাবা এসেছে সফুরাকে নিয়ে যেতে। বাবু সেজে এসেছে। হাতে ঘড়ি। চোখে কালো চশমা। গম্ভীর মুখে বারান্দায় বসে আছে। সফুরা বেগম সাহেবের কাছে বিদায় নিল। কদমবুসি করল এবং কেঁদে ফেলল। তিন বৎসর ছিল। মায়া পড়ে গেছে। যেতেও কষ্ট হচ্ছে। বেগম সাহেব বললেন, তোমার কাজে-কর্মে আমি খুব খুশি হয়েছি। আমার বাচ্চারাও তোমাকে পছন্দ করে। বেশিদিন থেকো না, চলে এসো। আজ থেকে তোমার বেতন আমি তিনশ করে দিলাম। ফিরে এসে এই বেতনেই কাজ করবে।
আপনের অনেক দয়া আম্মা।
বেগম সাহেব বেতন ছাড়াও–যাওয়া-আসার গাড়িভাড়া বাবদ দুশ টাকা দিলেন। একটা প্রায়-নতুন শাড়ি দিলেন। একজোড়া পুরানো স্যান্ডেল দিলেন। উদাস গলায় বললেন, তোমার সাহেবের একটা কোট আছে। এখন আর পরে না। নিয়ে যাও—কাউকে দিয়ে দিয়ে।
বকুলের বাবা সেই কোট সঙ্গে-সঙ্গে গায়ে দিয়ে বলল, ভালো ফিট করছে বউ। মাপ মতো হইছে। চল এখন গাবতলি বাসস্টেশন গিয়া বাস ধরি।
সফুরা বিস্মিত হয়ে বলল, পুলাপানের জন্যে সদাই করমু না? এতদিন পরে দেশে যাইতেছি।
কী সদাই করবা? চল গিয়া দেখি–জামা জুতা। রিকশা লও।
বকুলের বাবা সিগারেট ধরিয়ে বাবু সাহেবের মতো টানতে-টানতে খালি রিকশা দেখতে লাগল। সফুরা বলল, আপনেরে চিননের আর উপায় নাই। বাবু সায়েবের মতো লাগতাছে। চউক্ষে চশমা দিছেন কত দাম চশমার?
শস্তায় কিনছি। রইদের মইধ্যে চউক্ষে দিলে খুব আরাম হয়।
আপনে অখন একজোড়া জুতা কিনেন।
বকুলের বাবা উদাস গলায় বলল, চল যাই। শস্তায় পাইলে একজোড়া কিনব।
রিকশায় উঠে বকুলের বাবা ক্ষীণ স্বরে বলল, একটা বিষয় হইছে, বুঝলা সফুরা। তোমারে আগে না বললে বাড়িতে গিয়া হই চই করবা। হই চই করনের কিছু না।
সফুরা আতঙ্কিত গলায় বলল, কী বিষয়?
বকুলের বাবা নিচু গলায় বলল, তুমি ঢাকায় চইল্যা আসলা, বাড়ি হইল খালি। ঘরের শতেক কাজকর্ম। সংসার ভাইস্যা যাওনের উপক্রম। গেরামের দশজনে তখন বলল ….
আপনে কী বিবাহ করছেন?
উপায়ান্তর না দেইখ্যা গত বাইস্যা মাসে …
আমারে তো কিছু খবর দেন নাই।
বকুলের বাবা চুপ করে গেল। সফুরার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। সে শাড়ির আঁচলে চোখ মুছল। লোকটা বাইস্যা মাসে বিয়ে করেছে। ঈদের পরপর। বেগম সাহেব জাকাতের টাকা থেকে যে পাঁচশ টাকা বাড়তি দিয়েছেন সেই টাকাটা খরচ করেছে বিয়েতে। জাকাতের টাকাটাই তার কাল হয়েছে।
রাগ করলা নাকি সফুরা? ভালো মতো বিবেচনা কর। মেয়েমানুষ ছাড়া সংসার চলে? তুমি পইরা আছ ঢাকা শহরে।
নয়া বউ-এর নাম কী?
সুলতানা।
দেখতে কেমুন?
আছে মোটামুটি।
গায়ের রং কেমন? ধলা।
আবার সফুরার চোখে পানি এসে গেল। চিৎকার করে তার কাদতে ইচ্ছা করছে। ইচ্ছা করলেও তা সম্ভব না। তা ছাড়া কী হবে চিৎকার করে কাঁদলে? কিছুই হবে না।
ঘুরে-ঘুরে অনেক কিছু কিনল সফুরা। ছেলেমেয়েদের জন্যে জামা-জুতা, স্নাে-আলতা। একটা মশারি। চিনি, পোলাউয়ের চাল, এক ডজন কমলা। সবার জন্যেই কিছু-না-কিছু কেনা হয়েছে, শুধু নতুন বউয়ের জন্যে কেনা হয় নি। বেচারি মন খারাপ করবে। তার তো কোনো দোষ নাই। তাকে বিয়ে করেছে বলেই সে এই সংসারে এসেছে।
সফুরা নয় বউ-এর জন্যে একটা লালপেড়ে শাড়ি এবং কাচের চুড়ি কিনল।
বকুলের বাবা বলল, লাল ফিতা কিনো তো বউ। ফিতার কথা বলছিল।
সফুরা লাল ফিতাও কিনল।
দুপুরের দিকে তারা গাবতলি বাসস্টেশন থেকে বাসে উঠল। বকুলের বাবা মিষ্টি পান কিনেছে। সে বসেছে জানালার পাশে। জানালার পাশে ছাড়া সে বসতে পারে না। তার মাথা ধরে যায়। বাস ছাড়ার মুহূর্তে সে ঘড়িতে সময় দেখে গম্ভীর গলায় বলল, রাইত আটটা বাজব। শীতের দিন বইল্যা রক্ষা। আরামে যাইবা। গরমের সময় হইলে খুব কষ্ট হইত। এইটা খিয়াল রাখবা বউ, শীতকাল ছাড়া দেশে আসবা না। বেড়াইবার সময় হইল তোমার শীতকাল।
সফুরা জবাব দিল না। শীতকালের পড়ন্ত রোদে সে বেড়াতে যাচ্ছে। পাশে স্বামী। কতদিন পর দেখবে ছেলেমেয়েদের। আনন্দে তারা চিৎকার করে কাদবে। সারারাত হয়তো ঘুমাবে না। নয়া বউ লালপেড়ে শাড়ি পরে তাকে এসে কদমবুসি করবে। সে নয়া বউকে বলবে— আমার অনেক কষ্টের এই সংসার। তুমি এরে দেখেশুনে রাখ। বলতে বলতে. সে হয়তো কেঁদে ফেলবে। আজকাল অকারণেই তার চোখে জল আসে। কত আনন্দ করে সে বাড়ি যাচ্ছে। এখন কাদার কোনো কারণ নেই। অথচ কী কাণ্ড! সে কেঁদেই যাচ্ছে। অনেককাল আগে বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি যাবার সময়ও সে এইভাবেই কাঁদছিল।
একজন ক্রীতদাস
কথা ছিল পারুল নটার মধ্যে আসবে।
কিন্তু এল না। বারোটা পর্যন্ত দাঁড়িয়ে রইলাম একা একা। চোখে জল আসবার মতো কষ্ট হতে লাগল আমার। মেয়েগুলি বড খেয়ালি হয়।