ডলারে দাম বলব ন বাংলাদেশী টাকায় বলব?
ডলারেই বলুন।
দশ হাজার ডলার।
বলেন কী?
জুবায়ের খান চোখ কপালে তুলে ফেলল। কুদ্দুস বলল, আপনার জন্যে দশ পারসেন্ট কমিশন আছে। দশ হাজার ডলারে আপনি পাবেন এক হাজার।
আমার কমিশনের কোনো দরকার নাই। পাঁচশ টাকা। এই জিনিসের দাম দশ হাজার ডলার এমন কথা আমার পক্ষে স্যারকে বলা সম্ভব না। তাও মূর্তি যদি কষ্টিপাথরের হত একটা কথা হত।
কুদ্দুস বলল, তাহলে আর কি উঠি। বলতে বলতে সে তোয়ালে দিয়ে মূর্তি জড়িয়ে ফেলল। আর তখন জাপানি সাহেব ঘরে ঢুকলেন। জুবায়ের হরবড় করে কী যেন বলল। জাপানি ভাষা। বাঙালি ছেলের মুখে জাপানি ভাষা শুনতে অদ্ভুত লাগে। উত্তরে জাপানিও কিছুক্ষণ কিচকিচ করল। জুবায়ের কুদ্দুসের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার মূর্তি দেখতে চাচ্ছে।
কুদ্দুস উদাস গলায় বলল, দেখে কী হবে?
জুবায়ের বলল, দেখে কিছুই হবে না। স্যার যদি এক হাজার ডলারেও এই মূর্তি কিনতে চায় আমি নিষেধ করব। তবু দেখতে চাচ্ছে দেখান।
কুদ্দুস টাওয়েল সরাল। সাহেব কাছে এগিয়ে এলেন। আরো কিছুক্ষণ কিচকিচ করলেন।
জুবায়ের বলল, স্যার বলছেন মূর্তি দেখতে খারাপ না, তবে ঠোট ভাঙা। এই দেখেন নিচের ঠোটের একটা অংশ ভাঙা।
কুদ্দুস দেখল। আসলেই ভাঙা। পুরানো আমলের এইসব জিনিসের মূল্য ভাঙা থাকলেই বাড়ে। তারপরেও খুঁতভো বটেই। কেনার সময় আরো দেখে শুনে কেনা উচিত ছিল। তবে ঠোট ভাঙার কারণে মূর্তিটা দেখতে খারাপ লাগছে না। কুদ্দুস এই মূর্তি আগে ভালোমতো দেখেনি। এই প্রথম দেখছে। যতই দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। পাথরের মূর্তি বলে মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে জীবন্তু কোনো মেয়ে। যে-কোনো কারণে লজ্জা পেয়েছে বলে চোখের দৃষ্টি হঠাৎ নত হয়েছে। গাল হয়েছে ঈষৎ লাল। খুবই আনমনা মেয়ে।
জুবায়ের বলল, স্যার দাম জানতে চাচ্ছেন।
দামতো বলেছি।
সেতো কথার কথা। এখন ঠিক দাম বলেন। ক্যাশ পেমেন্ট হবে। জাপানিরা অল্প কথার মানুষ। এক হাজার ডলার অনেক বেশি হয়ে যায়। তারপরেও অপিনি কষ্ট করে এসেছেন স্যারকে এক হাজার ডলার বলে দেখি। রাজি হবে বলে মনে হচ্ছে না।
কুদ্দুস মূর্তি তীর ব্যাগে ভরে ফেলল। ব্যাগ কাঁধে নিতে নিতে বললবলেছি বলেছি। আপনার স্যার যেমন এক কথার মানুষ। আমিও সে রকম এক কথার মানুষ।
আপনি কি ফিক্সড প্রাইস শপ খুলেছেন না-কি?
জ্বি ফিক্সড প্রাইস।
সাহেব আবারো কিচকিচ করা শুরু করেছে। তার কিচকিচানির মধ্যে একধরনের উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে। একবার মনে হল জাপানি ভাষায় জুবায়েরকে ধমকও দিলেন। তারপর কুদ্দুসের দিকে তাকিয়ে ইংরেজিতে বললেন সিট ডাউন।
কুদ্দুস বসল। মনে হচ্ছে বাণিজ্য হবে। পুরানো আমলের জিনিস একবার কারো মনে ধরে গেলে বিপদ আছে। একবার মনে ধরা মানে বড়শিতে গেঁথে যাওয়া! সেই বড়শি থেকে বের হওয়া অতি কঠিন। সাহেব কি বড়শিতে গেঁথেছে? মনে হয় গেঁথেছে?
মৃর্তিটা বিক্রি করা কুদ্দুসের জন্যে অতি জরুরি। গত এক বছরে সে কিছুই বিক্রি করতে পারেনি। হাসমত একটা বিষ্ণুমূর্তি এনে দেবে বলে সত্তর হাজার টাকা নিয়ে গিয়েছিল। হাসমতের কোনো খোঁজ নেই। লোকমুখে শুনেছে সে মূর্তি ঠিকই জোগাড় করেছে, বিক্রি করেছে অন্য জায়গায়। কুদ্দুসের বিরাট সংসার। চার ছেলেমেয়ে স্ত্রী। তার দুই শালাও তার সঙ্গে বাস করে। দেশে টাকা পাঠাতে হয়। এক বোন সম্প্রতি বিধবা হয়েছে। তাকেও টাকা পয়সা দিতে হয়। শুধু টাকা দিয়ে মনে হয় পার পাওয়া যাবে না। এই বোনও তার সংসার নিয়ে কুদ্দুসের বাসায় উঠবে। আজ মূর্তিটা বিক্রি করতে পারলে হত।
জুবায়ের বলল, স্যার বলছেন মুর্তিটা বের করতে।
কুদ্দুস মূর্তি বের করল। আগে মনে হচ্ছিল মূর্তির মেয়েটা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করেছে। এখন মনে হচ্ছে তা-না। মেয়েটা রাগ করে চোখ নামিয়ে নিয়েছে। খুবই তুচ্ছ কোনো কারণে রাগ করেছে। কিছু কিছু মেয়ে আছে রেগে গেলে চোখে পানি এসে যায়, এই মেয়ে সেই জাতের। এখনি হয়ত কেঁদে ফেলবে।
জুবায়ের বলল, আপনার দাম শুনে স্যার প্রায় ভিরমি খেয়েছেন। যাই হোক স্যার একটা দাম বলেছেন। এর বেশি একটা পয়সাও দেবেন না। ক্যাশ ডিলিং হবে। আপনি মূর্তি রেখে যাবেন, ডলার পকেটে ভরবেন। স্যার বলছেন সর্বমোট চার হাজার ডলার।
কুদ্দুস অতি দ্রুত চিন্তা করছে। চার হাজার ডলার খারাপ না। ভালো। বেশ ভালো। ডলারে একান্ন টাকা করে পাওয়া যাচ্ছে। চার হাজার গুনন একান্ন-কত হয়? দুই লাখ চার হাজার। এই মূর্তির পেছনে তার খরচ হয়েছে খুবই সামান্য এগারো হাজার টাকা। লাভ এক লাখ তিরানব্বই। খারাপ না, ভালো।
জুবায়ের বলল, চুপ করে আছেন কেন? কিছু বলেন।
কী বলব?
স্যার একটা প্রাইস বলেছেন। হ্যাঁ-না, কিছু বলেন।
কুদ্দুস মূর্তির দিকে একঝলক তাকাল। ধ্বক করে বুকে ধাক্কার মতো লাগল। মূর্তি মেয়েটা মনে হয় কথাবার্তা শুনছে। তাকে নিয়ে দরদাম করা হচ্ছে মেয়েটা যে চোখ নিচু করে আছে এই লজ্জাতেই নিচু করে আছে।
জাপানি কিচকিচ করে ইঁদুরের মতো কীসব যেন জুবায়েরকে বলছে। হাত নাড়ছে। হাত নেড়ে কথা বলার অভ্যাস হল বাঙালির অভ্যাস। মাঝে মাঝে বিদেশীদের মধ্যেও এই অভ্যাস দেখা যায়।
আলফ্রেড গোমেজ সাহেব।
জি।
স্যারের সঙ্গে লাস্ট কথা হয়েছে। উনি আজ রাতের ফ্লাইটে চলে যাচ্ছেন। সিঙ্গাপুর এয়ার লাইনস। উনি সময় নষ্ট করতে চান না। আরো পাঁচশ ডলার ধরে দিয়েছেন। আশা করি এর পরে আর কোনো আপত্তি থাকার কথা না।