আব্দুল কুদ্দুস অর্থাৎ আলফ্রেড গোমেজ সাহেবের পেশা পাথরের মূর্তি বেচাকেনা। যেখানে বৎসরে একটা মূর্তি বেচতে পারলেই হয় সেখানে সে চারপাঁচটার মতো মূর্তি বিক্রি করে ফেলে। আগে তার প্রধান খদ্দের ছিল আমেরিকান সাহেবরা এখন জাপানিরা। জাপানিদের সঙ্গে ব্যবসা করার অনেক যন্ত্রণা। তারা মূর্তির ছবি দেখে সন্তুষ্ট না। তাদেরকে জিনিস দেখাতে হয়। সেই জিনিস তারা যে দেখেই সন্তুষ্ট হয় তা না, নানানভাবে হাতাপিতা করে। শিরিষ কাগজের মতো সবুজ রঙের কাগজে মূর্তি ঘসাঘসি করে। তারপর সেই কাগজ বড় সাইজের ক্যালকুলেটরের মতো যন্ত্রে ফেলে দেয়। যন্ত্রের ভেতর থেকে কটকট কটকট করে শব্দ হবে। কী সব লেখা বের হবে। তারপর এমনভাবে মাথা নাড়তে থাকবে যেন আব্দুল কুদ্দুস নকল মাল গছিয়ে দিতে এসেছে। মাছি তাড়াবার মতো ভঙ্গি করে বলকেনো নো নো। নো ডিল। ইউ গো।
কাস্টমারদের এইসব অভিনয় কুদ্দুস খুব ভালো বোঝে। সে সঙ্গে সঙ্গে তার জিনিসপত্র গুটিয়ে ফেলে। কাপড়ের ব্যাগে মাল সামলে ব্যাগ হাতে উঠে দাঁড়ায়। হাসি মুখে বলে ওকে বাই। বলেই দাঁড়ায় না। দরজার দিকে হাঁটা দেয়। জাপানি খদ্দের তখন ব্যস্ত ভঙ্গিতে কুদ্দুসের চেয়েও খারাপ ইংরেজিতে বলে-এটা ছাড়া তোমার কাছে আর কী আছে? কুদ্দুস বলে, আরো আছে তবে তোমাদের সঙ্গে কোনো বিজনেস আমি করব না। তোমরা আসল নকল বোঝ না।
অন্য মালামাল কী আছে দেখি।
না আপনাদের কিছু দেখাব না।
এই বলে কুদ্দুস অপেক্ষা করে না, লম্বা পা ফেলে বের হয়ে আসে। গরজ তার, গরজ সাহেবদের। ঠিকই তাকে খুঁজে বের করবে। গলি তস্য গলি পার হয়ে উপস্থিত হবে শাহ সুরী রোডে। এটা কুদ্দুসের অপছন্দ। সাহেব সুবোরা তার বাড়িতে আসা-যাওয়া করলে লোকজনের চোখ পড়বেই। চোখ কপালে তুলে ভাববে-বিষয়টা কী? এই বাড়িতে এত সাহেবের আনাগোনা কেন?
মূর্তি বেচাকেনার ব্যবসাটা কুদ্দুসের পছন্দ। রিস্ক আছে তবে বড় রিস্ক না। বাংলাদেশের মানুষ মূর্তি নিয়ে মাথা ঘামায় না। পত্রপত্রিকায় মাঝে মধ্যে ভিতরের পাতায় সংবাদ ছাপা হয় তা দেশের অমূল্য সম্পদ পাচার খুবই ফালতু। এই জাতীয় খবরে কেউ মাথা ঘামায় না। যে দেশের মানুষই পাচার হয়ে যাচ্ছে, সে দেশে মূর্তি পাচার কোনো ব্যাপারই না। মূর্তির দাম নিশ্চয়ই মানুষের চেয়ে বেশি না।
আব্দুল কুদ্দুস পর্যটনের হোটেলের একটা কামরায় চুপচাপ বসে আছে। মেঝেতে চেয়ারের পাশে ক্যাম্বিসের সবুজ রঙের পেট মোটা ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর প্রথমে টাওয়েল তারপর খবরের কাগজ এবং পলিথিন দিয়ে মোড়া জিনিস। কুদ্দুসের মুখোমুখি বসে আছে চশমাপরা বাঙালি এক ভদ্রলোক। ব্যবসায়িক লেনদেন সে করবে এটা বোঝা যাচ্ছে। আব্দুল কুদ্দুস সামান্য শংকিত-এই বাঙালি বাবু কমিশন কত খাবে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ইশারা ইঙ্গিতে যদি লোকটাকে বলা যেত যে কমিশন দেয়া হবে তাহলে মোটামুটি নিশ্চিন্ত থাকা যেত। টেন পারসেন্ট কমিশন। যত বেশি দামে বিক্রি হবে তত কমিশন। এইসব ক্ষেত্রে দালালরা দাম বাড়াতে সাহায্য করে। চশমাপরা লোকটাকে হাতে রাখতে পারলে ভালো হত। তেমন সুযোগ এখনো হয় নি। মূল খদ্দের টয়লেটে ঢুকেছে এখনো বের হচ্ছে না। একটু পরপর বাথরুম থেকে ফ্ল্যাশ টানার শব্দ আসছে। সাহেবের বাংলাদেশী খাবার খেয়ে পেট নেমে গেছে কি-না কে জানে? ওরস্যালাইন চলছে? চশমা পরা এসিসটেন্ট ওরস্যালাইন এনে দিচ্ছে না কেন?
ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে বললেন, আমার নাম জুবায়ের খান। যে হাতটা বাড়িয়েছেন সেই হাতেই জ্বলন্ত সিগারেট। হাল্ডসেক করতে গেলে সিগারেটের ছ্যাকা খাওয়ার সম্ভাবনা। কুদ্দুস বিরস মুখে জুবায়ের খানের আঙুলগুলি শুধু স্পর্শ করল।
কুদ্দুস গম্ভীর গলায় বলল, আমার নাম আলফ্রেড গোমেজ।
আপনি খ্রিস্টান?
জ্বি।
মূর্তি কেনাবেচার ব্যবসা কতদিন ধরে করছেন?
কুদ্দুসের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। মুখ বাঁকিয়ে কী বিশ্রী ভঙ্গিতেই না প্রশ্নটা করেছে। যেন কুদ্দুস বাংলাদেশের সবচে বড় চোর। দেশের অমূল্য সম্পদ পার করে দেশকে শেষ করে দিচ্ছে। আর সে মহা সাধু। কুদ্দস মনে মনে বলল—তুই যতদিন ধরে দালালি করছিস আমার ব্যবসা ততদিনের।
স্যাম্পল এনেছেন?
কুদ্দুস হ্যাঁ না কিছুই বলল না। সে লক্ষ করল হঠাৎ তার রাগ উঠে গেছে।
স্যাম্পল কী এনেছেন আমাকে দেখান।
কুদ্দুস বলল, যে কিনবে সে দেখুক। আপনি দেখে কী করবেন?
আগে আমি দেখব। আমি দেখে যদি ইয়েস বলি তবেই স্যার দেখবেন। মৃর্তির কোয়ালিটি তার প্রাইস এইসবে আমার সামান্য অভিজ্ঞতা আছে।
কুদ্দুস নিতান্ত অনিচ্ছায় তার ক্যাম্বিসের ব্যাগ খুলল। মোটা টাওয়ালে জড়ানো মূর্তি বের করল। ভদ্রলোক ঝুঁকে এলেন। শুকনো গলায় বললেন—কী মূর্তি?
কুদ্দুস বলল, কি মূর্তি তা জানি না। আমি আপনার মতো এক্সপার্ট না। মেয়ে মানুষের মূর্তি এইটা বলতে পারি। হিন্দুদের কোনো দেবী টেবি হবে। এদের তো কয়েক লক্ষ দেবী। কয়েক লক্ষ দেবীর একজন।
উহুঁ, কোনো দেবী মূর্তি না। অপ্সরাদের মূর্তি হতে পারে। রম্ভা, মেনকা। স্যার ইন্টারেস্টেড হবেন বলে মনে হয় না।
কেন ইন্টারেস্টেড হবে না, মূর্তি খারাপ?
বেশিদিন আগের মূর্তি না। কাট দেখেই বোঝা যাচ্ছে বয়স পাঁচশ বছরের বেশি না। পাথরের গ্রেইন বড় বড়। দাম কত চান?